#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয় পর্বঃ১+২+৩

0
1078

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয় পর্বঃ১+২+৩
#Lamyea_Chowdhury

শ্রাবণ মাস, চারিদিকে মেঘের ঘনঘটা।
রাস্তার দুপাশের সারি সারি গাছ পিছনে ফেলে, আর আকাশের এক চিলতে মেঘকে সঙ্গে নিয়ে শায়েরী হেঁটে চলেছে। তার দুহাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ আর কাঁধে ভ্যানিটি ব ব্যাগে থাকা মোবাইলটা অবিরামভাবে ভাইব্রেট হচ্ছে। বোধহয় মৌন ফোন করেছে। শায়েরী কল রিসিভ করল না। এখন যতদ্রুত সম্ভব বাসায় যেতে হবে। এই গলিটা পেরুতে পারলেই হয়, সামন গলিতেই শায়েরী থাকে। মুখ তুলে আকাশ পানে চাইল সে। কি সুন্দর শশোঁ করে বয়ে চলেছে! এই যে এখনও বৃষ্টি করেনি কিন্তু আকাশ কেমন গুমরো হয়ে আ, বেশ লাগছে শায়েরীর। বৃষ্টি থেকেও তার বেশি পছন্দ বৃষ্টি হওয়ার আগ মুহূর্তটা। এই পরিবেশটা হচ্ছে ষোড়সী বালিকার মন কেমন করা, অষ্টাদশী তরুণীর প্রেমিকের প্রতি অভিমান কিংবা চতুর্বিংশতি যুবতীর বহু ক্লান্তিমাখা মুখখানি। কান্না চেপে রাখার মাঝে একটা আর্ট আছে। মেঘও এখন কান্না চেপে আকাশের সাথে মিশে আছে। যখনই কেঁদে ফেলবে টুপ করে পৃথিবী ভিজে একাকার হয়ে যাবে। শায়েরী দ্রুত পা চালাল। কিন্তু লাভ হলো না। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে শায়েরীকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। শায়েরী বাসায় ফিরল কাকভেজা হয়ে। আদুরী দরজা খুলতেই শায়েরী ঝট করে বাসার ভেতর চলে এলো। আদুরী দুহাতে নিজের গাল চেপে বলল,
“একিরে তুই এমন ভিজলি কি করে?”
শায়েরী চোখে মুখে বিরক্তি মিশিয়ে বলল,
” মৌন কোথায়? ওকে বল চট করে চুলোয় জগা খিচুড়ি বসাতে।”
আদুরী শায়েরীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ দুটো নিয়ে নামিয়ে রাখল। তারপর শায়েরীর কাঁধ চেপে ধরল দুহাতে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
” শায়েরী সত্যি করে বলতো তুই এভাবে কাঁপছিস কেনো? তোর ঠোঁট নীল হয়ে আছে কেনো? আমায় ছুঁয়ে বল।”
আদুরী কথা বলতে বলতে শায়েরীর এক হাত নিজের মাথায় রাখলো। তারপর বলল,
” তোর জানের জিগার দোস্তর দিব্যি কেটে বল দেখি। কোন যুবকের সর্বনাশ করে এসেছিস?”
শায়েরী চোখ লাল করে বলল,
“অসভ্য একটা! ভালো হয়ে যা বুঝলি, ভালো হয়ে যা। ভালো হতে এমবি লাগে না।”
আদুরী দমে যায়নি। বলল,
“বল না কার ওয়াইফাই হ্যাক করে এমন থরথর কাঁপছিস?”
শায়েরী এবার বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল,
” তৈমুরের! ”
আদুরী এবার কাঁপতে লাগল। রাগে কান দিয়ে যেন ধুঁয়া বেরুচ্ছে তার। রক্তচোষার মতন শায়েরীর দিকে চেয়ে আছে সে,এই বুঝি শায়েরীকে উপরে পাঠিয়ে দিবে। শায়েরী হামি তুলতে তুলতে নিজের রুমের দিকে চলে গেল আর আদুরী তখনও দাঁড়িয়ে অনবরত রাগে কাঁপছে।
.
শায়েরী রুমে এসে ফ্রেশ হলো তারপর মাথায় টাউয়াল পেঁচিয়ে ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নক্ষত্র ভাইয়ের আসার কথা আজকে। কি যেন আসবে কিনা। মানুষটা যে এমন কেনো শায়েরী খুঁজে পায় না। এত অগোছালো আর এত খেচর শ্রেণীর ছেলে শায়েরী তার এত বছরের জীবনে দুটো দেখেনি। নক্ষত্র ভাইয়ের বেশ কিছু ইজম আছে। শায়েরী এই ইজমগুলোকে বলে খেচরিজম অফ নক্ষত্র ভাই। খেচরিজমের বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। এই ইজমের একটা বড়সড় উদাহরণ হলো মশারি। নক্ষত্র ভাই কখনোই নিজের রুমের বিছানার মশারি খুলেন না,সবসময় এটা টানানো থাকে। এমনি চারিদিক দিয়ে গুঁজানোও থাকে শুধু খানিক অংশ থাকে আধ গেঁাজানো অবস্হায় যেটা দিয়ে নক্ষত্র ভাই আসা যাওয়া করেন। এই খেচরিজম এর বিশাল বড় যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, যেহেতু মশারি আবার রাতে টানাতেই হয় তাই সকালে খুলার দরকারটা কোথায়? কাঁথা কম্বলও ভাঁজ করার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি। এগুলা বারংবার ব্যবহার করতে হয়, গুছিয়ে কি লাভ হয় তাহলে? শুধু শুধু সময় আর শ্রম অপচয় করা। আসলে সমাজের সিস্টেমেই গন্ডগোল। সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে, সমাজের সিস্টেমকে বদলাতে হবে আর সেটার শুরুও তিনিই করেছেন। একদিন আসবে যেদিন বাংলার ঘরে ঘরে মশারি সারা রাতদিন টানানো থাকবে,সেদিন সত্যি সত্যি নক্ষত্র ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে। খেচরিজম অফ নক্ষত্র ভাই নিয়ে ভাবতে বসলে তা আর শেষ হবার নয়। তাই শায়েরী ভাবাভাবি বাদ দিয়ে নক্ষত্রের নাম্বর ডায়াল করল। ফোনটা বেজেই চলেছে কিন্তু নক্ষত্রের রিসিভের কোনো নাম গন্ধ নেই। খানিক সময় আরো কয়েকবার চেষ্টা করল শায়েরী কিন্তু লাভ হলো না।নক্ষত্র ফোন রিসিভ করল না। শায়েরী মোবাইলটা বেতের চেয়ারে রেখে বারান্দার গ্রিল দুহাতে চেপে আকাশের দিকে তাকালো। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এখন আকাশে আবার মেঘ জমেছে। ধূসর কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। নাকে মৌনর জগা খিচুড়ির সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। কিছু চরণ মনে পড়ছে শায়েরীর। রুদ্র গোস্বামীর লেখা চারটে লাইন, ভীষণরকম প্রিয় তাঁর। বিড়বিড় করে সে লাইনগুলো বলতে লাগল,
“তুমি ভাবছ মেঘ করেছে
বৃষ্টি পড়বে অনেকক্ষণ,
আসলে তো মেঘ করেনি
মন খারাপের বিজ্ঞাপন!”
মৌন ভেতর থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
” শায়েরী! কিরে খেতে আয় তাড়াতাড়ি, তোর জগাখিচুড়ি ডান। ”
শায়েরী চুল থেকে টাওয়াল খুলতে খুলতে ডাইনিং রুমে এল। মৌন বলল,
“আদুরী কোথায়? ক্ষেপে আছে নাকি?”
শায়েরী চোখের ইশারায় মৌনকে চুপ থাকার কথা বলল। তারপর আদুরীকে বেডরুম থেকে এক প্রকার জোর করেই ডেকে নিয়ে এল। আদুরী আসতে চাইল না। কিন্তু শায়েরী যেন নাছোড়বান্দা। আদুরীর মান ভাঙাতে শায়েরী তৈমুরকে ফোন করল। তারপর বলল,
” তৈমুর ভাইয়া! আপনার প্রেমিকা তো ভীষন অভিমানী! ”
তৈমুর হেসে বলল,
“কেনো মেমসাহেব আবার কি করল?”
“ঐ একটু মজা করেছিলাম আপনাকে নিয়ে এতেই রেগে টালমাটাল।”
“আই সি!”
“না ভাইয়া আপনি দেখেননি। ভিডিও কল দিয়ে দেখুন রেগে আদুরী একদম লাল টমেটো হয়ে আছে।”
শায়েরী কথাটা শেষ করতে না করতেই আদুরী খপ করে মোবাইল নিজের হাতে নিয়ে নিল। তারপর আহ্লাদী সুরে বলল,
“তৈমুর ওর কথায় কান দিও না তো। আমি এখন আর একদমি রেগে নেই।”
তৈমুর হয়ত ওপাশ থেকে কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু শায়েরী যখন বুঝতে পারল আদুরীর রাগ উবে গেছে সে মোবাইল নিয়ে নিল ওর কাছ থেকে। তারপর সুইচড অফ করে এক প্রকার অবহেলায় মোবাইলটাকে ছুঁড়ে ফেলল সাইড টেবিলে। একইসাথে আদুরীকে টেনে এনে ডাইনিং এর চেয়ারে বসিয়ে নিজেও বসে খেতে শুরু করল। খাওয়ার মাঝেই শায়েরী আর মৌনর চোখাচোখি হলো। ইশারায় কি বলল কে জানে! তবে মৌন মনের অজান্তেই সামান্য শব্দ করেই বলল,
“কোনো দোকানে এই মেয়ের বিকাশ হয়নি। ”
আদুরীর কানে কথাটা গেল। সে সহাস্যে গদগদ হয়ে বলল,
“তৈমুরের পার্সোনাল নাম্বারে বিকাশ হলেই হয়।”
শায়েরী আর মৌন একইসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
.
তাসলিমা মাথায় তিনটা বরফের কিউব দিয়ে বসে আছেন। তিনি বড়ই বিরক্ত! তাসলিমা তাঁর মেয়ে প্রহরকে নিয়ে আছেন ভীষণ ঝামেলায়। এই মেয়েকে তিনি ভয় পান। তবে তিনি তা স্বীকার করতে চান না। এমন নয় যে এই স্বীকারোক্তি বাইরের কোনো মানুষের কাছে। তারপরো তিনি মনে মনেই মেয়ের প্রতি নিজের দুর্বলতা নিয়ে মহাবিরক্ত। তাসলিমা সুলতানা যাঁর এক কথায় অফিস কাঁপে, শুধু যে অফিস তা নয় মাঝে মাঝে তাসলিমার মনে হয় অফিসের স্টাফ আর এম্প্লইরা তাকে দেখলেই যমের কথা মনে করে। আর সেই তাসলিমায় নাকি এই পুচকি একটা মেয়েকে এত ভয় পান! তিনি বিড়বিড় করে অবিশ্বাস্য শব্দটা তিনবার উচ্চারণ করলেন তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুলেন ছেলের রুমের দিকে। রুমের দরজায় নক করতেই নক্ষত্র বলল,
“কাম ইন”
তাসলিমা দরজার নব ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। নক্ষত্র তখন মনযোগ দিয়ে কি যেন একটা করছে। তাসলিমা লক্ষ করলেন নক্ষত্র কানের উপর পেন্সিল গুঁজে রেখেছে। কাঠমিস্ত্রীরা যেমন কানের উপর পেন্সিল গুঁজে রাখে ঠিক সে ভঙ্গিতেই সে পেন্সিলটা গুঁজে রেখেছে। দৃশ্যটা দেখেই তাসলিমার মেজাজ বিগড়ে গেল। মুখে ঝামটা মেরে বললেন,
“লেখাপড়া শিখলে কি আর হবে যেই চামার সেই চামারই রয়ে গেছিস। তোকে আর কি বলব তোদের গুষ্ঠিটাই চামারের গুষ্ঠি। সারাজীবন আমাকে জ্বালিয়ে মেরেও শান্তি হয়নি। এখন শেষ বয়সেও জ্বালাতে ছাড়ে না। ”
নক্ষত্র ভীষণরকমের বিরক্ত কেননা কালকে তার এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট। এখন সে সেটাই করছিল কিন্তু মা যেভাবে চিৎকার চেঁচামেঁচি শুরু করল তাতে তার কনসান্ট্রেশন বারবার ব্রেক হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। তারপর মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রহরকে তো কিছু বলতে পারো না আমাকে নিয়ে তোমার যত ঝামেলা। প্রহরের ঝাল আমার উপরে মিটাতে আসবে না একদম।”
প্রহরের কথা মনে পড়তেই তাসলিমা কিছুটা মিইয়ে গেলেন। তারপর গলার স্বর যতটা কোমল করা যায় করলেন। বললেন,
“প্রহরটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে বাবা। শায়েরীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার বায়না ধরে বসে আছে। এখন কি করি বলতো।”
নক্ষত্র চোখে মুখে বিরক্তি মিশিয়ে বলল,
“ড্রাইভারকে বলো গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসুক।”
তাসলিমা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“প্রহর বলছে সে তার ভাইয়ের সাথে বাইকে করে যাবে। খোলা হাওয়া খেতে খেতে বাইকে তোর পিছে বসে যাওয়ার মজাটাই নাকি আলাদা।”
নক্ষত্র নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসল। মনোযোগ দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করতে লাগল আবার। তাসলিমা বললেন,
“কিরে রেডি হ।”
“না মা আমার সময় নেই, কাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট। এখন যেতে পারব না, প্লিজ বিরক্ত করো না তো।”
তাসলিমা বাজখাই গলায় ছেলেকে ধমকে বললেন,
“আমি বলেছি যেতে মানে যেতে হবে, আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস আদৌ কারোই নেই।”
নক্ষত্র মনে মনে বলল,
“কে বলেছে মা কারোর সাহস নেই তোমার মুখের উপর কথা বলার? আমার রুম থেকে বেরিয়ে সোজা করিডর ধরে ডানদিকের প্রথম রুমটায় উঁকি দাও। সেখানে চশমা পড়া ফর্সা গোলগাল মুখের একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার নাম প্রহর। তাকে দেখলেই তুমি চুপসে যাও। ”
মনে মনে এতগুলো কথা বললেও নক্ষত্রের সাহস নেই মায়ের সামনে তার মনে মনে ভেবে রাখা একটি শব্দও বলার। বিরক্ত মুখে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে গায়ে একটা হালকা মেরুন রঙের কুঁচকে থাকা শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল রুম থেকে। নক্ষত্রকে বাইকে বসিয়ে পাক্কা ত্রিশ মিনিট পর প্রহর হেলেদুলে বাসা থেকে বের হলো। তারপর ধীর গতিতে হেঁটে এসে নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে বাইকে বসল। নক্ষত্র এখন প্রহরের উপর ভীষণভাবে ক্ষীপ্ত তাই কোনো কথা বলল না সে। বাইক স্টার্ট দিয়ে ডানদিকের রাস্তায় যেতেই প্রহর বলল,
“দাভাই! শায়েরী আপি এখন আর হলে থাকে না। বান্ধবীদের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।”
নক্ষত্র থমথমে গলায় বলল,
“আমি জানি কিন্তু এদিক দিয়ে শর্টকাট রাস্তা, তাড়াতাড়ি হবে তাই যাচ্ছি। তাছাড়া তোর মতন আমি তো আর অবসর বসে থাকিনা, আমার বহু কাজ আছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আবার।”
প্রহর ভেঙচি কাটল শব্দ করে। নক্ষত্র খানিক বাদে বলল,
“আমি এর আগে যাইনি সেখানে তাই কত নাম্বার ফ্লোরে থাকে জানি না। তুই জানিস? না জানলে শায়েরীকে ফোন করে জেনে নে।”
প্রহর বলল,
“আমি জানি তো। টুয়েলভথ ফ্লোর, ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়।

পর্বঃ২
ড্রয়িংরুমে কমবয়সী বেশ সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে। চোখে চশমা, গোলগাল ফর্সা মুখ। গালে ছোট্ট একটা তিল আছে মেয়েটার। হাসলে গালের দুইপাশে টোল পড়ে। মৌনের কাছে মেয়েটাকে ভারি মিষ্টি লাগল। মৌন মিষ্টি করে হাসল তাকে দেখে। শায়েরীকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল মেয়েটা। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে হেলেদুলে কথা বলছে দু’জন। মৌনকে হাসতে দেখে প্রহরও তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘তুমি বুঝি শায়েরী আপির ফ্রেন্ড?’

– আজ থেকে তোমারো ফ্রেন্ড তবে তুমি চাইলে আরকি।

প্রহর ঘর কাঁপিয়ে হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশ্যাক করল মৌনের সাথে। আবার তিনজন মেতে উঠল খোশগল্পে। মৌন জানতে পারল প্রহর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। পড়াশুনা করছে হলিক্রসে। সম্পর্কে শায়েরীর মামাতো বোন। কথাটা শুনেই মৌন তড়িৎ শায়েরীর দিকে তাকাল। শায়েরী সামান্য হাসল, মৌন ভারি অবাক হলো। তার জানা মতে, শায়েরীর একজনই মামা আছেন, সামজিদ হোসেন। আর সামজিদ হোসেনের স্ত্রী মানে শায়েরীর মামীর নামটা মৌনের ঠিক মনে পড়ছে না। তবে মৌন এটুকু ঠিক জানে যে শায়েরীর মামী শায়েরীকে একদমই পছন্দ করেন না। ননদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনো কালেই তার ভালো ছিল না। এজন্য ননদের মেয়েকেও যারপরনাই অপছন্দ করেন। অথচ তার মেয়ের সাথেই শায়েরীর এমন গলায় গলায় ভাব! মৌন কথাগুলো অগোছালোভাবে ভাবছিল। কারওর গলা খাঁকাড়িতে মৌনের ভাবনায় ছেদ পড়ল।

কেউ একজন বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেজাজি কণ্ঠে প্রহরকে বকাঝকা করছে। প্রহর ঠিক দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তাই দরজার ওপাশের মানুষটাকে মৌন ঠিকঠাকভাবে দেখতে পারছে না। শায়েরীও প্রহরের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু মানুষটা যেন শায়েরীর কথায় আরও বেশি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। কৌতূহলী হয়ে মৌন দরজার কাছে দাঁড়াল। বেশ লম্বা শ্যামবর্ণের একটা ছেলে। পড়নে কুঁচকানো শার্ট, প্যান্টটাও কুঁচকে আছে। পায়ে বোধহয় বাসার স্যান্ডেল।

– নক্ষত্র ভাই! তুমি এমন করো কেন? প্রহর যেহেতু আজকে থাকবে বলছে থাকুক না। এখানে ওর কোনো অসুবিধা হবে না, আমি বলছি তো, ট্রাস্ট মি!

নক্ষত্র দুহাত নেড়ে না করার ভঙ্গি করে বলল, ‘দেখো শায়েরী আমি তোমার মতন আজাইরা বসে থাকি না। আমার বহু কাজ আছে। এই মেয়েকে এখানে রেখে গেলে আবার আমাকে এসেই নিয়ে যেতে হবে। আমি বারবার এখানে আসতে পারব না।’

শায়েরী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নক্ষত্র বাধা দিয়ে বলল, ‘আর একটা কথাও না আজু! প্রহরকে বলো ভালোয় ভালোয় আমার সাথে চলে আসতে নয়তো মায়ের কাছে তুমিই বকা শুনবে।’

কথা শেষে নক্ষত্র হামি তুলতে তুলতে লিফ্টের দিকে হেঁটে চলল। প্রহর চোখমুখ খিঁচে বলল, ‘আপি আমি এখন আসছি, তবে দাভাইকে যদি আমি এই এলাকায় চার চক্কর না দেওয়াই না আমার নামও প্রহর সামজিদ না।’

বলেই প্রহর পা বাড়াল ফ্ল্যাটের বাইরে। কিছুদূর যেয়েই আবার ফিরে তাকাল। শায়েরী আর মৌন তখনো ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রহর মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করল। তারপর কিছুটা জোরেশোরেই বলল, ‘তোমরা ভাদ্র মাসের কুকুর দেখেছ? ঐ যে তেষ্টায় জিহ্বা বের করে রাখে? ঠিক ভাদ্র মাসের কুকুরের মতন দাভাইকে এই এলাকায় ঘুরাব। তোমাদের ফ্ল্যাটের দিকে তৃষিত চোখে তাকিয়ে থাকবে দেখো।’

তারপর অনেকটা দৌড়েই চলে গেল লিফটের দিকে। লিফটের দরজা খোলা পেয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ল সে। প্রহর চলে যেতেই মৌন বললো, ‘তোর নক্ষত্র ভাই এত ভাব ধরে কেন? আর তুই বা এমন মিনমিন করিস কেন উনার সামনে?’

শায়েরী বলল, ‘ভিতরে চল তো।’

– বেশি বড় লোকের ছেলে তাই এত্ত ভাব না?

শায়েরী হেসে বলল, ‘হতে পারে, তার ওপর বুয়েটের ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। ভাবতো একটু থাকবেই! সবচেয়ে বড় কথা আমাকে সহ্য করতে পারেন না।’

কিছুটা অবাক হয়ে মৌন বলল, ‘মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে নাকি? তোর মামীও তোকে অপছন্দ করে। সমস্যা কি ওদের মা ছেলের?’

– মাকে ভীষণরকমের ভয় পান তিনি তবে আমাকে কেন যে এত অপছন্দ তা আমি জানি না, ভেবেও পাই না। তোর কথাটা সত্য হলেও হতে পারে।

শায়েরী বহুকষ্টে দীর্ঘশ্বাসটা লুকালো। তারপর আবারও বলল, ‘এই যে বললি না মিনমিন করে থাকি আসলে আমার কিন্তু এখন অনেক রাগ হচ্ছে কিন্তু চুপ করে আছি কেন জানিস?’

মৌন দু’পাশে শুধু মাথা নেড়ে জবাব দিল। শায়েরী দরজা লক করতে করতে বলল, ‘প্রহরই শায়েস্তা করে ফেলবে উনাকে আমার আর রাগ দেখিয়ে লাভ কি? হা হা হা!’

তখন রাত কয়টা বাজে জানা নেই শায়েরীর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রুম ছেড়ে লাগোয়া বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে পা তুলে বসে রইল। আকাশে আজ চাঁদ নেই, অমানিশা চলছে বোধহয়। পাশের বারান্দায় হাসনাহেনা আছে হয়তো। কি মিষ্টি সুবাস যে ছড়াচ্ছে! শায়েরীর হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা পাশে কেউ একজন বসে যদি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো! চোখ সরাতে বললেও যদি খানিক বেহায়া হতো!

ভাবতেই হাসি পেল তার, খানিক লজ্জাও হলো। তবে ভাবতে গেলে আসলেই খুব ভালো লাগে! শায়েরীর হঠাৎ গান শুনতে ইচ্ছে হলো। একবার ভাবল মোবাইল তো পাশেই আছে কিন্তু সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বেডরুমে গেল মৌনকে ঘুম থেকে উঠাতে। মৌনের কণ্ঠে গান শুনবে সে। রুমে যেয়ে দেখল আদুরী পড়ছে। শায়েরী মনে মনে বলল, ‘ভাগ্যিস মেডিকেল সাইন্সের স্টুডেন্ট হতে হয়নি, নয়তো সারাজীবন এই অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হতো। সারাদিন পড়া আর পড়া। আদুরীর মতন প্রাইভেট মেডিকেল হলে তো কথাই নেই। ফেইল করলেই সর্বনাশ!’

এই ফ্ল্যাটে মাস্টারবেডসহ আরও দু’টো বেডরুম আছে। তারপরও তিন বান্ধবী এক রুমেই থাকে। গল্প করতে করতে ঘুমোয়। মৌন কাঁথা দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে আছে। শায়েরী যেয়ে পাশে বসল ওর। তারপর চেহারা থেকে কাঁথা সরাতে নিতেই মৌন শায়েরীর হাত সরিয়ে দিল। শায়েরী হেসে বলল, ‘উঠ তো! গান শুনাবি এখন।’

মৌন কিছু বলল না। শায়েরী তাই জোর করে মৌনর ওপর থেকে কাঁথাটা টেনে নিলে। মৌন নিঃশব্দে কাঁদছিল। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। চোখের কোল থেকে অনবরত পানি ঝড়েই যাচ্ছে। শায়েরী তাড়াতাড়ি করে তাকে বিছানা থেকে টেনে উঠিয়ে ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘কী হয়ছে তোর? কাঁদছিস কেন? অ্যাঁই মৌন। বলবি তো!’

ততক্ষণে আদুরীও টেবিল ছেড়ে উঠে এসে ওদের দুজনের পাশে বসল। তারপর দু’জন মিলে মৌনকে একাধারে জেরা করা শুরু করল। মৌন কান্না করেই চলেছে। শায়েরী শায়েরী মৌনকে খানিক সময় দিল নিজেকে সামলে নেওয়ার। কিছুক্ষণ না যেতে আবার জিজ্ঞাসা করতেই মৌন বলতে শুরু করল, ‘আমার চাচা তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, চাচীও তাই চাচ্ছেন কিন্তু আমি তো তা চাই না। এখন আমি কী করব না করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

আদুরী বলল, ‘কী আর করবি, বলবি তুই রাজি না! নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি আর বিয়ে করবি নাকি?’

– আরে না তুই বুঝতে পারছিস না। আমার বাবা মা আমার ছেলেবেলাতেই মারা গেছে। তারপর থেকে চাচা চাচীর কাছেই মানুষ হয়েছি। এই যে এত ভালো পড়াশুনা করছি, এত ভালো আছি সবই চাচ্চু আর চাচীর জন্য। ওরা আমার জন্য কি তা বোঝাতে পারব না।

শায়েরী বলল, ‘তা ঠিক আছে। তোর কাছ থেকে সবসময় শুনে এসেছি তোর চাচা চাচীই তোর বাবা মা। আর নিজের বাবা- মাকে নিজের মনের কথা বলবি না তো আর কাকে বলবি?’

মৌন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘ওদের মুখের ওপর কথা বলার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। আর ওদের ছেলেকে না করার কোনো যুক্তিসংগত কারণও তো দেখাতে পারব না ওদের। না আমার অন্য কারও সাথে রিলেশন আছে, না উনি কোনোদিক থেকে কম বা খারাপ। এস্টাবলিশ ডাক্তার উনি, ব্যবহারও অমায়িক। আর চাচ্চু আর চাচীর কথা কি আর বলব? নিজেদের মেয়ে নেই কিন্তু আমাকেই মেয়ে ভাবেন। অলওয়েজ ওরা নিজের ছেলের আগে আমাকে প্রায়োরিটি দিয়েছেন। খুব বেশি ধনী কিন্তু না তবে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের হয়েও আমাকে প্রিন্সেসের মতন বড় করেছে। নিজেদের ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছে আমাকেও ঢাবিতে পড়াচ্ছে। জানিস ভাইয়া যখন মেডিকেলের কোচিং করেছিল তখন চাচ্চু বলেছিল সরকারিতে না হলে প্রাইভেটে পড়াবেন না। অথচ আমাকে বলেছিল প্রাইভেটে হলেও পড়াবেন আমিই ইন্টারেস্টেড ছিলাম না। আমাকে এত্ত আদর করেন ওরা। এখন ওদের মুখের ওপর কি করে বলি আমি যে ওদের ছেলেকে বিয়ে করতে পারব না?’

শায়েরী অবাক হয়ে বলল, ‘তুই বিয়েটা করতে চাচ্ছিস না কেন, ইজ দেয়ার এনি রিজন?’

– আমি জাস্ট উনাকে অন্য চোখে দেখেনি কখনো, এজ আ কাজিনই দেখেছি। সোউলমেট টাইপ মনে হয় না উনাকে।

আদুরী বলল, ‘তাহলে তোর চাচার ছেলেকে বল তুই উনাকে বিয়ে করতে পারবি না আর উনি যেন উনার মা- বাবাকে বুঝিয়ে বলেন। ছেলে না করলে তো আর কিছুই হবার নয়, তাইনা?’

– আমি এটাও পারব না কেননা কি বলব না বলব সেটাই বুঝে পাই না। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি বাট বলা হয়ে উঠেনি।

কিছুটা বিরক্ত নিয়ে এবার আদুরী বলল, ‘তাহলে মর তুই! এটা পারবি না ওটা পারবি না, পারবিটা কী?’

শায়েরী আদুরীকে ধমকে বলল, ‘থাম তো!’

তারপর মৌনকে বলল, ‘তোর কাজিন ঢাকাতেই থাকে নাকি তোর চাচ্চুদের সাথে সিলেটে থাকে?’

– ঢাকায় থাকে।

– তাহলে ঠিকানাটা দে আমি আর আদুরী যেয়ে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি কেমন?

মৌন দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, ‘তোরা যাবি?’

আদুরী বলল, ‘না যেয়ে আর উপায় কি?’

মৌন বললো, ‘ড্রেসিংটেবিলের ওপরে আমার পার্সটা আছে নিয়ে আয়।’

আদুরী উঠে যেয়ে পার্সটা নিয়ে এলো। মৌন পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে শায়েরীর হাতে দিয়ে বলল, ‘এটায় এড্রেস আছে।’

শায়েরী কার্ড হাতে নিয়ে পড়ল,

ডা. সায়াহ্ন শাহরিয়ার

এম বি বি এস (SBMC), এম এস (orthopedics -1st part)

রোগী দেখার সময়:

বিকাল ৪টা- রাত ৮টা

সিরিয়ালের জন্য নাম্বার : ০১———

সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে মোবাইল করবেন।

চেম্বার:……………

পর্ব:৩

– রোগীর নাম??

আদুরী পাশ থেকে বলল, ‘নাফিসা শায়েরী।’

ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা বললো, ‘ডাক্তার সাহেব নিজেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই আপনাদের কাল আসতে হবে।’

আদুরী বললো, ‘দেখুন ইটস্ আর্জেন্ট! বেশিক্ষণ লাগবে না।’

– বললাম তো হবে না। স্যার রেস্ট নিচ্ছেন।

শায়েরী কটমটিয়ে আদুরীর দিকে তাকালো। মনে মনে বললো, বলদীর কি দরকার ছিল মিথ্যে বলার? সব বিষয়ে ন্যাকা ন্যাকা। তারপর সামনে বসা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমরা উনার রিলেটিভ। বেশি সময় লাগবে না। আপনি এক কাজ করুন উনাকে কল করে বলুন মৌনের ফ্রেন্ডস এসেছে।’

– ওহ্ আপনারা মৌন ম্যাম এর ফ্রেন্ড? তাহলে যেতে পারুন।

শায়েরী হেসে বলল, ‘অন্যরা তাহলে কি দোষ করল?’

– নাহ্ তা করবে কেনো? তবে আপনাদের যেতে না দিলে পরে স্যারই রাগ করবেন।

– ধন্যবাদ ভাইয়া।

আদুরীই প্রথম চেম্বারের ভিতর এলো, শায়েরী এলো পিছন পিছন। চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা ছেলে চোখ বুজে আছে, ঘুমিয়ে পড়েছে কি? ছেলেটা অস্বাভাবিক রকমের ফর্সা। আদুরী বিড়বিড় করে বললো, ‘স্কিনের সমস্যা নাকি, শ্বেতরোগ আছে নাকি? এজন্যই বুঝি মা-বাবা হুটহাট করে বিয়ে করাতে চাচ্ছে।’

শায়েরী চেয়ার টেনে বসে ঠাণ্ডা গলায় বললো, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। আপনার শরীর কি বেশি খারাপ? তাহলে নাহয় কাল আসছি।’

ছেলেটা মাথা থেকে হুডিটা সরিয়ে আধশোয়া থেকে উঠে বসে চোখ মেললো। সাথে সাথে আদুরী বললো, ‘ওহ্ মাই গড! আমি তো শেষ।’

শায়েরী অবাক হয়ে সামনে বসে থাকা নীল চোখের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। মাথায় হুডি থাকায় ডিপ ব্রুনেট চুলগুলো এতক্ষণ আড়াল হয়ে ছিল। ছেলেটার হাতে ব্যান্ডেজ করা। আদুরীর কথাটা ছেলেটা শুনেছে হয়তো! ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর টেবিলের উপর দুই হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে একদম আদুরীর মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘ওহে মার্জারী! তোমার রূপের ছটা দেখিয়া অনেক মার্জার কবি হইয়া পড়ে আর তুমি কিনা এই আমিতে শেষ?’

আদুরী কিছুটা নড়েচড়ে বসল। শায়েরী মনে মনে বলল, ‘তোমার নীল চোখের সাগরে আমিও যে কবি হতে চাই।’

কথাটা বলে নিজের মনেই শায়েরী প্রবোধ গুনলো। নিজেকেই নিজে বলল, শায়েরী আর যাই হোক তুই কখনো কোনো ছেলেকে দেখে পাগল হতে পারিস না, কখনো না! শায়েরী এসির মধ্যে বসেও দরদর করে ঘামছে, সত্যি সত্যি এবার মনে হচ্ছে ওর অসুখ হয়েছে। অসুখটা কোথায় বুকের মাঝে নাকি চোখের দৃষ্টিতে? সে উঠে দাঁড়াল, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না, এক মুহূর্তও না। একটা ঘোরের মাঝেই সে হেঁটে চলে এলো। মাথা ঝিমঝিম করছে ওর, সমস্ত পৃথিবীটা যেন হঠাৎ থমকে গেছে, আর শায়েরীর হার্টবিট ম্যারাথন গতিতে দৌড়চ্ছে।

শায়েরীর পিছন পিছন আদুরীও কিছু না বলেই চলে এসেছে। সিএনজিতে উঠে বসে বললো, ‘মুণ্ডুর হাসপাতাল আমার আর মুণ্ডুর ডাক্তার! শালার এমন ডাক্তার দেখলে ভালো মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় সুস্থ হতে আর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অ্যাঁই শায়েরী ব্রেক আপ তৈমুরের সাথে! আমার মাথা ঘুরছে, চোখ জ্বলছে। আমি বোধহয় মরেই যাব।’

আদুরীর কোনো কথা শায়েরীর কানে ঢুকছে না। শায়েরী গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আদুরী তৈমুরকে ফোন করে বললো, ‘হ্যালো তৈমুর আম স্যরি, রিয়ালি স্যরি। আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ এনাদার ম্যান, আ ম্যান অফ ব্লু আইস! ইটস টাইম ফর দা ব্রেকআপ সং।’

তৈমুরের চোখের যেন পলক পড়ছে না, কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছে না সে। সব কথা গলায় এসে আটকে রইল। আদুরী কিছু শোনার জন্য অপেক্ষাও করল না। কথা শেষ করেই সে খট করে মোবাইল রেখে দিলো।

সায়াহ্ন লাঞ্চব্রেকে বাইরে গিয়েছিল লাঞ্চ করতে। হসপিটালের উল্টোপাশেই একটা রেস্টুরেন্ট। আসার সময় দেখল একজন মানুষ কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে রাস্তা ক্রস করছে। শুধু যে গান শুনছে তাই নয় সাথে হাত পা বিভিন্ন এঙ্গেলে নেড়ে চলেছে। মুন ওয়াক করে রাস্তা পার হচ্ছে, চোখও বন্ধ করে রেখেছে। যদিও বা রাস্তাটা সবসময় বেশ ফাঁকাই থাকে তাও বিশ্বাসের নিঃশ্বাস নেই। কখন কি হয় বলা যায়! সায়াহ্ন বিড়বিড় করে বলল, ‘রিডিকিউলাস!’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখল একটা বাস ছেলেটার দিকেই ছুটে আসছে। সায়াহ্ন তড়িৎ দৌড়ে গেল। মানুষটাকে টেনে সরিয়ে আনলো। পাশেই ল্যাম্পপোস্ট ছিল। সায়াহ্ন সেই ল্যাম্পপোস্টের সাথে আঘাত পেল। ছেলেটাকে সরিয়ে আনতে যেয়ে নিজের মাথা এখন ফুলে অবস্থা খারাপ। প্রচণ্ড ব্যথায় সে রোগী দেখাই অফ করে বসে আছে। ওয়াশরুমে যেয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিতেই মাথাটা ঘুরে উঠল তার। কোনোরকমে ওয়াশরুম থেকে বাইরে বের হলো। সায়াহ্নকে দেখে ছেলেটা আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাই ডুড! তুমি ঠিক আছো তো?’

তার চোখে একই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা আর অনুশোচনা। সায়াহ্ন ওকে নিজের চেয়ারে বসতে দেখে ভারি অবাক হলো। পরক্ষণেই নিজের মনকে বুঝালো যে ছেলে চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুঁজে মুন ওয়াক করতে করতে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে ওর দ্বারা সবই সম্ভব। সায়াহ্ন সামনের চেয়ারটায় ধীরে সুস্থে বসে বললো, ‘আপনার কি চান্দের দেশে যাওয়ার এতই শখ নাকি ভাই?’

সলজ্জিত গলায় সায়াহ্নের সামনে বসে থাকা ছেলেটা বলল, ‘আমি দুরুক! দুরুক খান। তুমি আমার জন্য যা করেছ সবসময় মনে থাকবে আমার। এই দুরুক আজ থেকে তোমার জন্য সব করতে পারবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো সময়ে তোমার যাই হেল্প লাগুক না কেনো আমাকে তুমি পাশে পাবে। অনেক ধন্যবাদ আজকে তুমি না থাকলে মুন ওয়াক করতে করতে চান্দের দেশেই চলে যেতে হতো।’

সায়াহ্ন হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি সায়াহ্ন! আপনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি, হালকা আঘাত, বেশি না। ভাগ্যিস ল্যাম্পপোস্টে দুজনেই ধাক্কা খেলাম। বাস ধাক্কা দিলে এতক্ষণে মুন ওয়াক করতে করতে চাঁদের দেশে। হা হা হা।’

– হেই ম্যান তুমি আপনি আপনি করবে না, তুমি করে বলবে। আমার মনে হয় তুমি আমার চেয়ে বয়সেও বড় হবে।

– ২৮ শুরু হলো।

– দেখলে তো আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়।

সায়াহ্ন হেসে বলল, ‘তুমি খুব সুন্দর বাংলা পারো। তোমার মা বাঙালি নাকি বাবা?’

– দুজনেই।

সায়াহ্ন খানিক ভরকে গেল। দুরুকের ডিপ ব্রুনেট চুল আর নীল চোখ দেখে তারপর ভাবলো হয়তো ফ্যামিলির অন্য কেউ ফরেনার। কিন্তু আগ বাড়িয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না।

মৌন বেশ বিরক্ত। আদুরী আর শায়েরী দুজনের একজনও সায়াহ্নকে কিছুই বলে আসেনি। তার উপর দু’জন কিসব আবোল তাবোল বলছে। সায়াহ্ন ভাইয়ার চোখের মণি নীল কি করে হলো আর চুলের রঙইবা কালো থেকে পাল্টে গেল কি করে? মৌন এ ঘর ও ঘর পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। তার মেজাজ বিগড়ে গেছে শায়েরী আর আদুরীর অবস্থা দেখে। আদুরী সায়াহ্নকে দেখে তৈমুরের সাথে ব্রেক আপ করে ফেলার সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলো! আর শায়েরী সেখান থেকে আসার পর এখনও অব্ধি একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ বই নিয়ে বসে গেছে। শায়েরী তো পরীক্ষার দিন সকাল ছাড়া বই ছুঁবেই না, আর এখন বইয়ে বুঁদ হয়ে আছে। এক্সাম তো সেদিন মাত্র শেষ হলো! মৌন এবার না পেরেই শায়েরীর সামনে থেকে বইটা সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। শায়েরী হকচকিয়ে গেল যদিও সে পড়ছিল না শুধুমাত্র বইয়ের পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে ছিল।

– কি হলো কিছু বলিস না কেনো?

শায়েরী বললো, ‘কি বলব?’

মৌন চিৎকার করে বললো, ‘কি বলব মানে? তোরা সেখানে কেনো গিয়েছিলি মনে নেই?’

আদুরী বললো, ‘তোর কাজিনকে দেখে আমরা সব ভুলে গেছি, শায়েরীর কথা জানি না তবে আমি পুরোপুরি শেষ। আচ্ছা আমাকে কি বিড়ালের মতন লাগে? আমার চেহারা তো কিছুটা লম্বাটে তাহলে আমাকে মার্জারী বলল কেন?’

মৌন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুই বলতে চাচ্ছিস উনি তোকে মার্জারী বলেছেন?’

আদুরী কপালের সামনে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে বলল, ‘রূপের ছটার কথাও বলেছেন। ’

– সিরিয়াসলি?

শায়েরী এবার মুখ খুললো, ‘তুই কি পাগল মৌন? তুই উনাকে রিজেক্ট করছিস?’

আদুরী শায়েরীর কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল, ‘ইশ্ আমাকে তোর চাচা- চাচী আমাকে দেখল না কেন? পুরাই ডিজনি থেকে উঠে আসা প্রিন্স চার্মিং। কি সুন্দর নীল চোখ। তারপর চুল গুলো উফ! সোনালী আর বাদামীর মিশেলে ডিপ ব্রুনেট রঙের। ফেয়ারেস্ট ওয়ান! এই শায়েরী লম্বা পাঁচ ফুট দশ কিংবা এগারো হবে না?’

মৌন নিজের চুল টেনে বলল, ‘হেমায়েতপুর পাঠাতে হবে তোদের। নীল চোখ? কি যা তা বলছিস।’

শায়েরী বলল, ‘হয় তো তোর ভাই লেন্স লাগিয়েছে, আর চুলও কালার করেছে।’

– হাইটও কি চেঞ্জ করে ফেলবে নাকি? বেশি হলে পাঁচ ফুট সাত হবে আর তোরা কিসব বলছিস।

শায়েরী কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মৌন শায়েরীর বইটা দিয়েই শায়েরীকে দু’তিনবার মারল। তা দেখে আদুরী বলল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে মারিস না। তুই যে কারাটে পারিস জানি তো! আমাদের উপর এই বিদ্যা ফলাতে হবে না।’

মৌন আদুরীর দিকে এগিয়ে যেতেই আদুরী দৌড়ে পালালো, আর মৌন বললো, ‘তোদের কারো কথা বলতে হবে না, আমি নিজেই বলব।’

(চলবে…)
.
একশত ভাগ গ্যারান্টি দিলাম আপনাকে শারীরিক মানসিক সহ ম
বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন ভালবাসার গল্প, জোকস, প্রেমের কাহিনী পেতে এখনি পেজটি লাইক দিয়ে একটিভ থাকুন, আর পড়তে থাকুন মন ছুয়ে যাওয়া অসাধারণ কাহি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here