#Journey episode 40

0
167

#Journey episode 40

#৪০

সেলিম ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে টানা দুসপ্তাহে ওষুধের কড়া ডোজে ওর মায়ের মাথা উলট পালট হয়ে গেছে কিনা,কারণ তা নাহলে এমন উদ্ভট কথা তো বলার কথা না।সেলিমের চাহনী দেখে জেসমিন অন্যদিকে তাকায়।

“আমি জানি তুই বিশ্বাস করছিস না,করার কথাও না।তবে এটা সত্যি যে তোর পাপার সাথে যদি আমার দেখা না হতো,তাহলে আজ তোকে এই জীবন পেতে হতো না,তাকেও মরে যেতে হতো না।সব…সব আমারই দোষ,আমার এই পৃথিবীতে আসাটাই ভুল হয়েছে!”

জেসমিন ডুকরে কেঁদে উঠে।সেলিম ওর মাকে জড়িয়ে ধরে।

“মা,শান্ত হও প্লিজ।এমনিতেই তোমার শ্বাসকষ্ট,তার উপর এখন যদি এসব কথা বলো…”
“বা…বা…বাবা…আমাকে মাফ করে দিস প্লিজ!”
“কিন্তু তুমি করেছ কি তা বলবে তো!”

জেসমিন ধীরে ধীরে ওর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলতে শুরু করে।কেমন ছিল ওর বাংলাদেশের জীবন,কেমন ছিল ওর পরিবার,কেমন দুর্ভাগ্য ছিল ওর জীবনের প্রতিটা মোড়,ওর মায়ের ছেড়ে যাওয়া,ইটালীতে আগমন,জাফারের সাথে পরিচয়,রাইফের সাথে বিয়ে,এক্সিডেন্ট,আর তারপর থেকে নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।সেলিম ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না,আবার অবিশ্বাসও করতে পারে না।

“তারপর?”
“তারপর এতগুলো বছর কেটে গেছে।যদিও এর মাঝে কোন ঝামেলা হয়নি,তবে মাঝে মাঝে মনে হয়,বুঝি জীবন আর স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে না”
“কিন্তু মা,তুমি তো বললে না এর পেছনে কারণ কি?কেন দাদী বা ঐ পরিবার তোমাদের পিছনে লাগল?”
“এর কারণ জানতে চাস?এদিকে আয়”

জেসমিন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ ওদের কথা শুনছে কিনা।কন্ঠস্বর নিচু করে বলে,
“এর পেছনে আছে চার বিলিয়ন টাকার কিছু আফ্রিকান হীরে যা তোর নানু আমার জন্য ব্যাংকের ভল্টে রেখে গিয়েছিল!!”

সেলিম চমকে ওঠে।ও ঠিক শুনছে তো? চার বিলিয়ন টাকা!!!
“তোর বাবাও বিশ্বাস করতে চায়নি,তবে আমাদের এমন খুনোখুনির হিসেব মেলাতে গেলে এটা বিশ্বাস করতেই হবে।এই হীরের খবর গোপন থাকে নি,একারণেই যত ঝামেলা”
“কিন্তু সেগুলো এখন কোথায়?!”
“আছে,কিছু বিক্রি করেছে তোর মামা ব্ল্যাক মার্কেটে,আর কিছু…”
“আর কিছু কি?”

জেসমিন রহস্য ভরা হাসি দেয়।
“সেটা সময় হলেই জানবি…বাবা,আমার ভেতরটা কেমন যেন করছে।জিহান আর জাফরিনকে ডেকে আন,আমি বোধহয়…”
জেসমিন কথা শেষ করতে পারে না,অক্সিজেন এর নল থাকা সত্ত্বেও ওর শ্বাস টান উঠে যায়।সেলিম দৌড়ে ডক্টর নার্সকে ডেকে আনে আর জিহানের নাম্বারে ডায়াল করে,এর মাঝেই জেসমিন ওর হাত চেপে ধরে।ছেলেকে কাছে এনে বলে,
“জি…জিহান আর জাফ…জাফরিনকে কিছু জানাস না…ওরা ছোট…ওরা…”
সেলিম মাকে ইশারা দেয় কিছু জানাবে না।জেসমিন আবার হাত ধরে টানে।
“আমাকে মাফ করিস…”

ওর চোখের কোণা চিকচিক করছে।তবে সেই চোখ থেকে অশ্রু ঝরার আগেই সেলিম তা মুছে কপালে চুমু খায়।

ভাইয়ের কল পেয়ে কিছুক্ষণের মাঝে দু ভাই বোনই ছুটে আসে হসপিটালে।মায়ের পাশে তিনজনই বসে থাকে।নতুন করে কিছু মেডিসিন দেয়ার পর জেসমিনের অবস্থা কিছুটা শীথিল হয়।জেসমিন জিহান আর জাফরিনের খবর নিতে থাকে।এদিকে সেলিম উশখুশ করছে ওর মাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার জন্য,যা তার মনের মাঝে খচখচ করছে।কিন্তু ওদের সামনে থাকার কারণে বলতেও পারছে না।মা যে বলল,ওদের জীবন কিছুটা অস্বাভাবিক,সত্যিই তো,অস্বাভাবিক লাগছে।কিন্তু এর কারণ কি?

মাঝরাতের দিকে জাফরিন ঘুমিয়ে পড়ে আর জিহান বাহিরে যায়।ওর নাকি দম আটকে আসছে,স্মোক করতেই হবে।সেলিম এই সুযোগে মায়ের মাথায় হাত বুলায়।জেস্মিন চোখ খুলে ছেলেকে দেখে স্মিত হাসে।

“মা,তুমি তো সবই বললে,এবার আমি কিছু বলি।তুমি কেন নিজেকে এত দোষী ভাব?পাপা চলে যাবার কথা ছিল,তাই চলে গেছে।আর আমি অনেক ভাগ্যবান যে তোমাদের মত মা বাবা পেয়েছি।পাপা বেঁচে থাকলে আমাকে মায়ের আদর দিতে পারত না যা তুমি দিয়েছ।আমার এরকম দুইটা ভাই বোন থাকত না।যে জীবন আমি তোমাদের সাথে পেয়েছি,আমি কৃতজ্ঞ।পাপা চলে গেছে,কিন্তু সঠিক মানুষের কাছে আমাকে রেখে গেছে।আমি যা পেয়েছি,তা খুব কম মানুষই পায়।

আর এখন যদি এর পেছনের কথা বলি,তোমার তো দোষ নেই!তোমার মা তোমাকে যা দিয়েছে তা তুমি রক্ষা করেছ।তবে একটা কথা আমারো মনে হচ্ছে,আমাদের জীবনটা সত্যিই অস্বাভাবিক।এই দেখ, পাপা চলে গেল,তাঈ আবার ভুল করে মেরে দিল।বছর দুই আগে বাবাও চলে গেল,তাও আবার সামান্য মাথায় ব্যথা থেকেই।পড়ে গেল,মাথায় ব্যথা পেল,কোত্থেকে মাথার রগ ছিড়ে ইন্টারনাল ব্লিডিং এ মারা গেল!

আর এদিকে তুমি!বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে কোন না কোন অসুখ বাঁধিয়েই আছো।কেন যেন মনে হচ্ছে,এসব ঐ আফ্রিকান জিনিসগুলোর অভিশাপ! আমি চাই এগুলো ছুড়ে ফেলে দাও,মামাকে বল…”
“চুপ! প্রাণহীন কোন কিছুই আমাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে না বা অভিশপ্ত হয় না!এসব বিশ্বাস করে কক্ষণো ঈমানকে হালকা করবি না!”
“কিন্তু মা…”
“কোন কিন্তু না! এই জিনিসগুলো আসলে…কিছু তো গরীবদের কাজে লাগিয়েছি…আর বা…বাকিটা…বাকিটা…”

সেলিম উৎসুক দৃষ্টিতে জেসমিনের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে।জে্সমিন বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে।তারপর আবার সেলিমের হাত দুহাতে চেপে ধরে মুখ খুলে,
“বাকিটা তোর।আমি…আমি তোকে এতীম করেছি,তাই আমি তোর জন্যে রেখেছি।আমার…আমার জিহান আর জাফ…জাফরিনের জন্যে অনেক রেখেছি…কি…কিন্তু ওগুলো তোর…শুধু তোর…তুই দেখিস,আমি এগুলো…”

কথা শেষ হয় না,আর আগেই জেসমিন শ্বাস নিতে পারে না।মনে হচ্ছে বুকের উপর কি যেন চেপেে বসেছে।গলার ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে।সেলিম ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ে।এদিকে জাফরিনের ঘুম ভেঙে গেছে,জিহানও ফিরে এসেছে।মায়ের এই অবস্থা দেখে ওরা কান্না শুরু করে।ডক্টর এসে সব দেখে আবার কিছু মেডিসিন বাড়িয়ে দেয়,তারপর গম্ভীর মুখে সেলিমকে কাছে ডাকে।

“রোগীর অবস্থা শুধুই খারাপ হচ্ছে।উনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম,এন্টিবায়োটিকগুলো এক এক করে ফেইল হচ্ছে।সরি সেলিম,তোমার মাকে এভাবে কতদিন বাঁচানো যাবে জানি না”

সেলিমের চোখ ছলছল করছে।ডক্টর কি বলে গেল?ও ওদেরকে কি বল্বে?মাথা কিছুতেই কাজ করছে না।এই মুহূর্তে মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও ঐ হীরে গুলো কে বড় অভিশপ্ত মনে হচ্ছে।কাঁদতেও পারছে না,কাউকে বলতেও পারছে না বুকের ভেতর কি হচ্ছে।চুপ করে তাকিয়ে দেখছে,মা ঘুমুচ্ছে।কিন্তু কত সেকেন্ড আর আছে বাকি হাতে?

দুইদিনের মাঝে জেসমিনের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়।জিহান আর জাফরিন প্রতিদিন মায়ের কাছে এসে পড়ে থাকে।জিহান মেডিকেলের ছাত্র হওয়ায় এরকম অনেক দেখেছে,কিন্তু তার কেউ ওর মা ছিল না।তাই সেও আবেগ আটকাতে পারে না।আর সেলিম ওর মাকে প্রতিদিন শ্বাস টান উঠলেই সূরা ইয়াসিন পড়ে শুনায়,অন্তত তার কষ্ট যেন কিছু কমে।

আর এভাবেই দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে চলা ইহকাল আর পরকালের টানাটানিতে পরকালের ডাকই টিকে যায়।জেসমিন ওর তিন সন্তানকে একেবারে এতীম করে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

সেলিম ওর মৃত মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বিরবির করে,
“মা,যাই হোক,আমি আমার ভাই বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবই করব,তুমি ভেব না।তুমি,বাবা,পাপা, you all will be proud of me from heaven!”

চলবে….

লেখনীতে #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here