#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
#১৮তম পরিচ্ছেদ
____________________________
-তুমি মানে আপনি এখানে?
পিছন ফিরে চারুকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলো তাহের। আবায়া হিজাবে ঢাকা চারুকে আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করে,
-এত পরিবর্তন?
চারু কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। তাহের আসবে এটা তার কল্পনায়ও ছিল না। চারু এখানে সেটা জানলো কি করে! নিজের জায়গাতেই আড়ষ্ট হয়ে যায় ও। কোনো রকমে গলার ভিতর থেকে কষ্ট করে দুটো শব্দ বের করলো,
-কেন এসেছেন?
-তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে! প্লিজ চারুমনি আমি ভুল করেছি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
‘চারুমণি’ নাম শুনে সহসা কেঁপে উঠল চারু। বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে এই নামে ডাকতো তাহের। তারপর তো সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। তবুও চারুর মনের গহিনে তাহের নামে একটা দাগ আছে।
জীবনের প্রথম পুরুষ! প্রথম স্বামী, আর ভাবতে পারে না চারু। তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠে।
-মানে?
-প্লিজ চারু…
-চলে যান, এখনি চলে যান এখান থেকে।
তাহের জানতো চারু আজ যাবে না। চারুকে আজ নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেনি সে। শুধু পরিস্থিতি বুঝতে এসেছিল মাত্র।
চারুর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছে চারুর মনে এখনো তার জন্য সফট কর্ণার আছে, সুতরাং সুযোগ একটা নেওয়াই যায়।
-আমি আবার আসব…!
এটা বলে মন খারাপের ভাব করে বেরিয়ে যায় তাহের। চারুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিসিয়ে বলে যায় “ভালবাসি এখনো”
চমকে ওঠে চারু। সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হেসে তাহের বেরিয়ে যায় স্কুলের ওয়েটিং রুম থেকে।
সেদিন আর বাকি ক্লাস গুলো নেওয়া হয় না।
আজ তারানা এসেছিল স্কুলে।
চারুর চোখ মুখ দেখে কিছু পরিবর্তন দেখে প্রশ্ন করে,
-কি হয়েছে?
তারানাকে কোনো রকমে তাহেরের কথা বলে আর দাঁড়ায় না। তনুকে নিয়ে পা বাড়ার বাসার উদ্দেশ্য।
তারানা চারুকে কিছু বলার সুযোগ পায় না। ঠিক করে বিকালে মিফা আর মেহরীনকে সাথে নিয়ে যাবে চারুর বাসায়।
এই টানাপোড়েনের একটা বিহিত হওয়া দরকার। একা একটা মেয়ে! আর কত! এই কয়েক মাসের সম্পর্কেই বড্ড ভালবেসে ফেলেছে মেয়েটাকে। একটু রাগী হলেও মনটা খুব সরল।
আল্লাহ কেন যেন এসব সরল মানুষ গুলোর উপরেই পরীক্ষা নিতে থাকেন! আল্লাহর ইচ্ছা।
পুরো রাস্তা নিজেকে পাগলের মতো লাগছে চারুর। তাহের কি পেয়েছে! কখনো কাছে টানবে কখনো ছুঁড়ে ফেলে দিবে!
এসব ভাবতে ভাবতেই আবার তাহেরের প্রতি মন কিছুটা আর্দ্র হয়ে ওঠে, কেন তা চারু নিজেই জানে না।
প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ঘুমন্ত তনুকে চুমু খাচ্ছে একটু পরপর। বুকের ভিতর কান্না উথাল-পাতাল করছে। প্রায় দুই বছর হতে চলল তনুর।
মাঝে মাঝে আধো বোলে মা ডেকে ওঠে।
কি যে শান্তি পায় চারু তখন।
তনুর আসল জন্মদিন আসলে কবে? চারু তনুকে খুঁজে পাওয়ার তিনদিন আগে? চারুর তাই মনে হয়।
তাহের কেন এলো!
ওর বউ আবার গেছে! আমি কেন ফিরে যাবো!
তাহলে কি তাহের নিজের ভুল বুঝেছে! আমি যাবো? নাকি না? নাহ যাবো না।
নিজের মনে এভাবে অসংখ্যবার একই প্রশ্ন-উত্তর আনাগোনা করে চারুর। বাসার গেইটে ঢুকতেই বাড়িওয়ালা ভাবিকে বাগানে দেখতে পায় ও। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মৃদুস্বরে সালাম দেয়। উত্তর নিয়ে তিনি বলেন,
-তোমার বোন এসেছে কিছুক্ষণ আগে, আমার ঘরে আছে।
-জ্বি ভাবি।
‘হঠাৎ নিধি কেন? তাহের কি কিছু বলে পাঠিয়েছে!’ চারু কোনো কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে রুমের লক খুলে তনুকে শুইয়ে নিধিকে নিয়ে আসার জন্য বাড়িওয়ালার ঘরের দিকে এগোয় চারু।
-তনু কই?
চারুকে দেখেই প্রশ্ন করে নিধি। জবাব না দিয়ে সালাম দেয় চারু। সর্তকতার সাথে বোনের সালামের সুন্দর করে উত্তর দেয় নিধি। এ মূহুর্তে সালাম নিয়ে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছে নেই ওর।
-তনুকে আগে ঘরে রেখে তোর কাছে এলাম।
-ও আচ্ছা, চল।
হাতের ব্যাগ টা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিধি। নিধির হাতে ব্যাগ দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকায় চারু,
-যাবি কোথাও?
-না তোর বাসায় থাকব ক’দিন! কেন, কোনো সমস্যা আছে তোর?
-উফ নিধি এত কথা বলিস না তো, চল।
মুচকি হাসে নিধি।
ঘরে ঢুকেই চারু বলে,
-যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমিও ওযু করব নামায পড়তে হবে। তুইও নামায পড়বি।
বোনের দিকে একবার কপট বিরক্তিভরে তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায় নিধি।
চারু নামায শেষে কিচেনে যায়, যে খাবার আছে তা চারু রাতেও খেতো। সেটা দিয়ে এখন দুজনের হয়ে যাবে। শুধু তনুর জন্য খিচুড়ি রান্না করতে হবে, তবে সেটা এখনই না যা আছে তাতে তনু উঠলে খেতে পারবে, রাতের রান্নার সাথে করলেই হবে। আপাতত রান্নার ঝামেলা নেই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চারু।
কিন্তু যত যাই করছে তাতেই তাহেরের কথা মনে পড়ছে। মন থেকে কোনোভাবেই সরাতে পারছে না। একদমই ভাল লাগছে না চারুর।
-কি রে চুপ হয়ে আছিস কেন? রান্না করতে হবে?
নিধির ডাকে পিছনে তাকায় চারু।
-না আছে, চল খেয়ে নিই।
চিন্তাটাকে কোনোভাবেই দূরে সরিয়ে রাখতে পারছে না চারু। নিধি বিষয়টা লক্ষ্য করছে শুরু থেকেই। খাওয়ার পর চারুকে প্রশ্ন করে,
-ওই আপু কি হয়েছে বল তো?
-না রে কিছু না, ক্লান্ত লাগছে। শোন ঘুমাবো একটু তনু উঠলে হটপটে রাখা ওর জন্য খিচুড়ি রান্না আছে, খাইয়ে দিতে পারবি না?
-পারবো না কেন। দিবো।
-আচ্ছা আমাকে আসরের আগে আর ডাকিস না। ঘুমালাম একটু।
-হু
চারু চোখ বন্ধ করলে নিধিও চারুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায়।
আসরের সময় চারুর নামায শেষে বসে আছে এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে।
মিফা মেহরীনকে নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে তারানা বলে,
-তাহের আসলো আর তুই ওমনি চুপসে গেলি!
তারানা জানতো না নিধি আছে সেটা। চারু ইশারা করার আগেই নিধি সামনে এসে বলে,
-কি রে আপু! তাহের ভাই এসেছিল!
অবাক চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে থাকে নিধি। তারানা কিছুটা থতমত খেয়ে যায় নিধিকে দেখে। নিধির প্রশ্নকে উপেক্ষা করে,
-তারানা আর নিধি তোমরা পরিচিত হও, দুজনকেই দুজনের কথা অনেকবার বলেছি।
নিধি আর তারানা কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চারু মিফাকে একবার কোলে নেয়, পাশে আরেকটা মেয়েকে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়,
-তোমার নাম কি মামণি?
-মেহরীন মাহমুদ
মেহরীনের মায়াভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে চারু। নিধির সাথে তাহের আসার ব্যাপারে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চারুকে খেয়াল করে তারানা বলে,
-ও মেহরীন, আমার ভাইয়ের মেয়ে।
চারুও এমনটাই ধারণা করেছিল। মিফা আর মেহরীনকে নিয়ে অনেকগুলো ক্যাটবেরী ধরিয়ে দেয়। নিজে চকলেট পছন্দ করায় চারুর কাছে চকলেট সবসময়ই থাকে। দুজনের কেউই শুরুতে নিতে চাইছিল না, অনেক বলার পরে রাজি হয়। খুশিতে চারুকে জড়িয়ে ধরে দুজনেই। চারুর কাছে ওদের এই ভদ্রতাটুকু খুব ভাল লাগে।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ওদের সাথে। তারপর ওদেরকে তনুর কাছে বসিয়ে নিধি আর তারানার পাশে এসে বসে চারু।
-ভাইয়া কাল তোর সাথে দেখা করবে।
আচমকাই বলে তারানা।
-মা…মানে?
নিধি বলে ওঠে,
-কিসের মানে! তুমি যাবে, আমি শুনেছি সব।
-কিন্তু…!
চারু একেবারে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে।
-কোনো কিন্তু নয়!
জোর দিয়ে বলে নিধি।
-আচ্ছা যাবে চারু।
চারুর দিকে মুচকি হেসে এবারে ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পালটে ফেলে তারানা।
(চলবে)