আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১৭

0
265

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
#১৭তম পরিচ্ছেদ
_____________________________
-আসসালামু আলাইকুম
-ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?
-আন্টি, আপনি আমাকে চিনবেন না আমি চারুর ফ্রেন্ড তারানা, বাংলাদেশ থেকে।
বাংলাদেশ থেকে আননোন নম্বরে ফোন আসায় রেণু একটু অবাকই হয়েছিল। আত্মীয়দের কেউ হবে ভেবে রিসিভ করে ও। তারানা নামের মেয়েটার সুস্পষ্ট ভঙ্গিতে সালাম শুনে বেশ চমকিত হয় রেণু। এখনকার মানুষ তো সালাম দেওয়া ভুলেই গিয়েছে।
যদিও বা কেউ দেয় সেটা দ্রুত বলতে গিয়ে কি যে উচ্চারণ করে তা নিজেই জানেনা। সেটাতে আর যাই হোক শান্তি ঠিকমতো বর্ষিত হতে পারে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়!
-ও আচ্ছা। হ্যাঁ তারানা বলো,
-আন্টি আমি আসলে চারুর বিষয়ে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
তারানার কথা শুনে ভয় পায় রেণু।
-মানে কি হয়েছে আমার চারুর!
-আরে… না… না… আন্টি কোনো বিপদ না! আসলে বিষয়টা হলো, বলতেও সংকোচ লাগছে। আমার বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। আছি আমরা দুই ভাইবোন, তাই আমাকেই বলতে হচ্ছে ভাইয়ার অভিভাবক হিসেবে।
-কি কথা?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে রেণু।
-আন্টি আমি আমার ভাইয়ার সাথে চারুর বিয়ের ব্যাপারে বলতে চাচ্ছিলাম… আসলে আন্টি…
তারানা চারুর সাথে বলা কথাগুলোই আরো একটু গুছিয়ে বলে রেণুর সাথে। সব শুনে রেণু বলে,
-আচ্ছা তারানা, আমি তো দেশের বাইরে জানোই। আমার আরো বছরখানেক পরে যাওয়ার কথা কিন্তু আমি দুই মাসের মধ্যেই আসার ব্যবস্থা করছি কোনোভাবে। এই চারুকে নিয়ে আমার সবসময়ই ভয়। ওর একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে আমার শান্তি নেই।
শোন, আমি ত্বাসিনের বাবা মানে তোমার আঙ্কেলের সাথে একটু কথা বলি। তুমি অপেক্ষা করো আমি তোমাকে নিজেই জানাবো। আর চারুর বাবার সাথে কথা বলব। কেমন?
রেণুর আশ্বাসমূলক কথাতে তারানা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যদিও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে না।
-ঠিক আছে আন্টি।
-হ্যাঁ তারানা, যেহেতু ব্যক্তিগত জীবনে দুজনেই একবার করে ধাক্কা খেয়েছে, তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
-জ্বি আন্টি আমিও সেজন্যই সময় দিচ্ছি চারু আর আমার ভাইয়াকে। ওদের বলেছি আর ওরা দুজনেই জানে তাদের কাউকে দরকার জীবনে কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না।
আরো দুই একটা কথা বলে ফোন রেখে দেয় তারানা। তারানার কথা শুনে বেশ ভাল লাগলো রেণুর।
তবু মানুষের মুখের কথায় বিশ্বাস করাটা চরম বোকামি হবে। কিন্তু আদিব কি রাজি হবে এক্ষুনি যেতে যেখানে এক বছর পরে যাওয়ার কথা সেখানে দুমাসে! হুট করে বলে তো দিলাম আমি!
দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায় রেণু। ‘চারুর কথা শুনলে নিশ্চয়ই রাজি হবে’ মনকে প্রবোধ দেয় রেণু।
.
তুর্যরা চলে যাওয়ার পর থেকেই তিন্নি উদভ্রান্তের মতো ব্যবহার করছে। কুমকুম ওর মেয়ে এই ধারণা হুট করে ওর মাথায় বাসা বেঁধেছিল।
কিন্তু টিনা যেদিন থেকে সে ভুল ভেঙে দিয়েছে তখন দেখা গেল তিন্নির আর কুমকুমের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। তিন্নি এখন খুঁজতে থাকে নিজের মেয়েকে।
নিজের লাখ টাকার নরম তুলতুলে বিছানায় শুয়েও আজ ঘুম নেই তিন্নির চোখে।
অস্থিরভাবে মোবাইল নাড়াচাড়া করতে থাকে তিন্নি। রাত আড়াইটা, তিন্নি ডায়াল করে আতিফের নম্বরে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করে আতিফ।
-ঘুমাওনি?
-না
-কেন গার্লফ্রেন্ড?
-আর ধুত্তোরি গার্লফ্রেন্ড… অকথ্য গালি দেয় আতিফ।
সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তিন্নি বলে,
-বাচ্চাটাকে খুঁজতে গেলে হয় না?
চমকে উঠে আতিফ। নিজেও ভুলতে পারছে না। রাত জেগে অকারণ বসে থাকার কারণ শুধুই বাচ্চাটা। নিজেকে সামলে বলে,
-কোথায় খুঁজবে?
-যেখানে ফেলে এসেছিলাম…
বলতে গিয়ে গলা কেঁপে যায় তিন্নির। তারপরই ডুকরে কেঁদে ওঠে। আতিফ চুপ করতে বলে না। কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই থেমে যায় তিন্নি। বলে,
-আতিফ আমি এই অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি!
-আমিও, খুব আস্তে করে বলে আতিফ।
আতিফের “আমিও” শব্দটা তিন্নি শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারে না আতিফ। হঠাৎ তিন্নি জোর গলায় বলে,
-আমরা কাল খুঁজতে যাবো ওখানে কেমন?
-আচ্ছা।
-রাখি, কাল দশটায় গাড়ি নিয়ে বের হবো। ওকে?
-হু
সেদিনের মতো দুজনেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় আতিফ তিন্নি দুজনেই।
.
“মা
আমি চলে যাচ্ছি আশিকের সাথে। আমাকে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করো না, জানোই তো আমি তোমার বাধ্য মেয়ে নই! তাই যত বেশি খোঁজাখুঁজি করবে, হয়রান তো হবেই, মানসম্মান ও যাবে। কথায় আছে না- পানি যত নাড়বে শুধুই ঘোলা হবে!
আর আমি বড়পু না যে হ্যাংলার মতো মাভক্তি দেখিয়ে তোমার সব ন্যায়-অন্যায় আবদার মানবো। তাছাড়া বড়পুর তো মা নেই, তাই তোমার মাঝে মাকে খুঁজতো, আর আমার তো মাবাবা সব আছে আমার অত ভাল হওয়ার দরকার নেই।
ভাল থেকো, আর বাবার দিকে খেয়াল রেখো। সব চেঁচামেচি আবার বাবার উপর করো না। চেঁচাতে না পারলে তোমার কি হাল হবে আল্লাহ জানে! আর এই চিঠি পড়ে কান্না শুরু করার আগে আমার জন্য দোয়া করো আমি যেন স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে থাকি
ইতি নিধি”
চিঠি পড়ে সালিহা সত্যিই কান্না শুরু করল! তারই পেটের মেয়ে এ কি শুরু করলো! আজ ছুটির দিন, সবাই একসাথে খাবে বলে কত রান্না করেছে।
রিহানকে কি জবাব দেবে!
সালিহা খুব ভয় পেয়ে গেল।
ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে রিহান ঘুমাচ্ছে। সালিহা রিহানকে ডাকার সাহস পাচ্ছে না। কিছু না বলে চুপচাপ নিধির ঘরে গিয়ে কাঁদতে থাকে। সে জানে রিহানকে সে জানাতে পারবে না। আবার নিধিকেও থামাতে পারবে না। এসব রিহানকে বললে যদি সালিহাকে কিছু বলে নয়তো রিহানের যদি কিছু হয়ে যায়!
সালিহা নিধির বিছানায় শুয়ে নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদতে থাকে।
.
“Sharp 10 am, At University Gate”
ঘুম থেকে উঠেই আতিফের মেসেজটা পায় তিন্নি। অলরেডি আটটা ত্রিশ বেজে গেছে। দ্রুত উঠে মিনিট বিশেকের মাঝেই ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।
-মা বের হচ্ছি।
-নাস্তা? নাস্তা করে যা, বুয়াকে বলে দিচ্ছি।
-ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো।
-গাড়ি নিয়ে যা।
-হু, কিন্তু ড্রাইভার নিবো না।
-কেন!
বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে থাকে টিনা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তিন্নি বলে,
-ভাল লাগেনা তাই! গেলাম।
টিনাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে যায় তিন্নি।
কলেজের কাছাকাছি এসে ড্রাইভ করতে করতে ওর হঠাৎ মনে হয় সবে তো নয়টা পার হয়েছে। আতিফ তো দশটায় আসতে বলেছিল, এই এক ঘন্টা… উফ!
নিজের উপর বিরক্ত হয় তিন্নি।
কিন্তু কলেজ গেইটে আসতেই বিরক্তি কেটে যায়, দেখতে পায় আতিফকে।
আতিফের পাশে গাড়ি থামাতেই গাড়িতে উঠে আসে আতিফ।
-তুমিও দ্রুত এলে?
তিন্নির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আতিফ।
-হু, বুঝতে পারিনি।
-হুম আমিও, আমি ড্রাইভ করি?
-তুমি জানো জায়গাটা? আমি ড্রাইভ করলে ক্ষতি কি!
তিন্নির কথায় বিরক্ত হলেও প্রকাশ করে না আতিফ,
-ওকে ওকে চলো।
বাচ্চাটি যে জায়গায় ফেলে এসেছিল সেই উদ্দেশ্যে চলতে থাকে তিন্নিদের গাড়িটি।
-অনেক দূর এখনো?
-না এসে গিয়েছি প্রায়।
আতিফের প্রশ্নে জবাব দেয় তিন্নি।
-এত দূরে আসতে হয়েছে!
বিরক্তিভরে মন্তব্য করে আতিফ।
-তোমার জন্যই তো!
-কিহ আমার জন্য? তুমি বুঝি ধোয়া তুলসীপাতা ছিলে?
আতিফের ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারে না তিন্নি।
-তোমার দোষ অবশ্যই বেশি! কোনো খোঁজই রাখোনি তুমি!
-তুমি খুব রেখেছিলে! পেটে রেখে রাস্তায় দিয়ে এসেছ আমার বাচ্চাকে!
আতিফের কথাটাকেই আবার ঠোঁট উলটে বিকৃত করে তিন্নি,
-আমার বাচ্চা! হুহ! কই ছিল তখন সব!
এভাবে কথা কাটাকাটি চলতেই থাকে ওদের। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আতিফ রেগে গিয়ে হাত ওঠায় তিন্নিকে মারার জন্য।
তিন্নি বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচাতে সরে যেতে গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দেয়, আর তাল সামলাতে পারে না। গাড়ি রাস্তার মাঝেই গতি এলোমেলো করে ফেলে, অপর দিকে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দ্রুর গতিতে আসা ট্রাক সজোরে ধাক্কা দেয় তিন্নিদের গাড়িটিকে। গাড়িটি ছিটকে ধাক্কা খায় রাস্তার পাশের গাছের সাথে।
মাত্র কয়েকটা মূহুর্ত!
এরই মাঝে সব শেষ!
তিন্নি আতিফসহ উলটানো গাড়ি সেখানেই পড়ে ঠিক যেখানে তিন্নি বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।
মানুষ ভুল করবেই! ভুলের মাশুল ও দিতে হয়। কিন্তু জেনেবুঝে পাপ করে সেটা ভুলের খাতায় চালান দিলেই সব শেষ হয়ে যায় না। জেনেবুঝে ভুল করা অপরাধ। আর সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হয়।
আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ধৈর্যশীল কিন্তু কিছু পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।
ন্যাচারাল রিভেঞ্জ বা প্রাকৃতিক প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে, যেটা স্রষ্টার পক্ষ থেকেই আসে।
আতিফ তিন্নিও হয়তো তারই শিকার….
হয়তো কয়েকঘন্টার মাঝে দুই পরিবারই জানবে তাদের মৃত্যু সংবাদ, জানবে ফ্রেন্ডের সাথে হ্যাংআউট করতে গিয়ে রোড এক্সিডেন্টে স্পটডেড!
শুধু জানবে না আজ তাদেরই অমনোযোগীতা, ভুল শিক্ষার জন্য চিরদিনের মতো হারালো তাদেরই প্রিয় সন্তানদের!
আলোর মাঝে আসার আগেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল দুটো সম্ভবনাময় জীবন!
.
চারু ক্লাস থেকে বের হতেই আরেক জুনিয়র টিচার এসে বলে,
-ম্যাম আপনার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছেন।
-আমার সাথে? কে এসেছে?
অবাক হয় চারু।
-তা জানিনা, আমাকে অফিস থেকে আপনাকে বলতে বলল। ওয়েটিং রুমে আছে।
-আচ্ছা যাচ্ছি।
এসময়টা তনু ঘুমাচ্ছে, আর স্কুলের আয়া খেয়াল রাখেই সবসময়ই। তাই তনুর কাছে না গিয়ে হাতের খাতাপত্র নিয়েই সোজা ওয়েটিংরুমের দিকে পা বাড়ালো চারু।
ওয়েটিংরুমে ঢুকে সালাম দিয়ে যাকে দেখতে পেলো তাকে দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না চারু…!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here