আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১৬

0
243

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১৬তম পর্ব
____________________
-তারানা এসব কি বলছিস তুই! আমাকে না জানিয়ে এতদূর ভেবে ফেলেছিস!
তারানার কথায় চমকে ওঠে মাহমুদ।
-ভাইয়া তুই বুঝতে চাইছিস না কেন! আমি চারুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। প্রথমে এতটা ধারণা করিনি। একটু ভেবে দেখ কতটা বড় মন না হলে একটা মেয়ে সবার বিপরীতে গিয়ে একটা রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে একাই বড় করার সিদ্ধান্ত নেয়?
তবুও নিজের মনকে বোঝাতে পারেনা মাহমুদ। বোনের সাথে তর্কে পেরে উঠবে না জানে ও। তাই কোনো কথা না বলেই উঠে যায় ওখান থেকে।
জীবনের পিছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে বিয়ে নামক কোনো বন্ধনে জড়াতে ইচ্ছে করে না মাহমুদের।
পরিবারের সিদ্ধান্তেই জবার সাথে বিয়ে হয়েছিল ওর। আর্থিক অবস্থা আহামরি কিছুই না, স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই।
জবাও কোনো ধনী পরিবারের মেয়ে ছিল না, কিন্তু মনে উচ্চাভিলাষী মানসিকতা ছিল অনেক অনেক বেশি। জবা মাহমুদের সাথে বিয়ে করেছিল শুধুমাত্র জবার বাবার শাসনে পড়ে।
জবার বাবার খাঁটি সোনা চিনতেন, ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো পালটে যাবে মাহমুদ আর তার পরিবারের সংস্পর্শে থেকে।
প্রমথ চৌধুরী একটা কথা বলেছিলেন,
ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।
তেমনিভাবে জবা মাহমুদের কাছে থেকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হতে পারেনি, এমনকি প্রথম সন্তান মেহরিন হওয়ার পরেও না।
যতদিন পর্যন্ত জবার বাবা বেঁচে ছিল ততদিন জবা সাহস পায়নি মাহমুদের থেকে দূরে যাওয়ার। মাকে পাত্তা দেয় না জবা। বাবা মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই ও মাহমুদ আর নিজের মেয়ে মেহরিনকে রেখে পালিয়ে যায় নিষিদ্ধ প্রণয়লীলায় লিপ্ত হওয়া প্রেমিকপুরুষের সাথে। মেহরীনের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর।
জবা চলে যাওয়াতে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিল মাহমুদ, কিন্তু ফিরেও তাকায়নি জবার দিকে।
এমন হাজারো জবা আছে আমার এই সমাজ ঘিরে। পরিণতি না ভেবেই জড়িয়ে যায় অবৈধ প্রণয়ে! হায়! তারা যদি একবার গভীরতা সাথে নিজেদের কাজকে উপলব্ধি করত!
পবিত্র কুরআনের সূরা আন নূর (النّور) এর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ সুবহানওয়া তায়ালা এরশাদ করেন,

ٱلزَّانِيَةُ وَٱلزَّانِى فَٱجْلِدُوا۟ كُلَّ وَٰحِدٍ مِّنْهُمَا مِا۟ئَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِى دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَآئِفَةٌ مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ

অর্থঃ ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী — তাদের দুজনের প্রত্যেককে একশ’ বেত্রাঘাতে চাবুক মার, আর আল্লাহ্‌র বিধান পালনে তাদের প্রতি অনুকম্পা যেন তোমাদের পাকড়াও না করে, যদি তোমরা আল্লাহ্‌তে ও আখেরাতের দিনে বিশ্বাস কর, আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি দেখতে পায়।
এছাড়াও বুখারী ও মুসলিম হাদিসে যিনা-ব্যাভিচারকারীদের কঠিন শাস্তির বিশদ উল্লেখ হয়েছে। বুখারী হাদিসের ৬৩৫০ থেকে ৬৩৮২ নাম্বার হাদিস পর্যন্ত বিস্তারিত হাদিস রয়েছে।
আফসোস জবার জন্য! একবার যদি জানতো তার পাপের ভয়াবহতা তাহলে হয়তো স্বামী-সন্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে একবার ভাবত।
জবা তুমি একবার যদি বুঝতে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ।
-বাবা! ঘুমাবো।
ছয় বছর বয়সী মেহরীনের ডাকে সম্বিত ফিরে মাহমুদের। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে মেহরীন।
মেয়েকে নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় মাহমুদ। জবা চলে যাওয়ার পরও মেহরীনকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে। বোন আর ভগ্নীপতির অনেকবার তার সাথে এসে থাকতে বলা সত্ত্বেও বোনের বাসায় এসে ঝামেলা করার ইচ্ছে হয়নি মাহমুদের।
তবুও অধিকাংশ সময়ই তারানার বাসায় আসা হয় মেহরীনের জন্য। মিফা আর মেহরীন একসাথে থাকলে মেহরীনের একাকিত্বটা দূর হয়, আর ছোট থেকেই তারানা সামলেছে ওকে, তাই মাহমুদের সপ্তাহে প্রায় ৪/৫ দিনই আসতে হয় তারানার বাসায়।
বাসার ব্যাপারে তারানা তেমন কিছু না বললেই চারুর ব্যাপারে নাছোড়বান্দা হয়ে যায়। প্রতিদিন বোঝাতে থাকে ভাইকে।
.
“ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়”
ঠকে যাওয়া মানুষের মনে বিশ্বাসের জায়গা জুড়ে বিচরণ করে ভয়। মাহমুদের মতো চারুর মনেও একই ভয়, একই সংশয়।
-তারানা এ সম্ভব না! কিছু মনে করো আমি বিশ্বাস করতে পারিনা কাউকে।
-কিন্তু চারু তুমি ভেবেছ দুনিয়ার সব ছেলেদেরকে তুমি যদি তাহেরের সাথে একই পাল্লায় রেখে তুলনা করতে চাও তা কি সঠিক হবে? আমার ভাবি চলে গিয়েছে আমার ভাইয়া কোনো মেয়েদের বিশ্বাস করে না। অথচ আমি কিন্তু মেয়ে…
আবার আমি আরেকজনের স্ত্রী। আবার তোমার বাবাকে দেখো এখনো তোমার মা কে ভালবাসেন। সবাই এক হয়না চারু। হায়াতের কথা আল্লাহ জানেন, তবু সামনে পড়ে থাকা জীবনের জন্য একটা সঙ্গী দরকার হবে, একটা শক্ত হাত দরকার হবে, তোমারও আর আমার ভাইয়ারও।
তারানার কথাগুলো সত্যি মনে হলেও মন থেকে মানতে পারে না চারু। মনের ভয়-সংশয় বাসা বেঁধে আছে।
-তারানা আমি কখনো মা হতে পারব না!
-তুমি কখনো পরীক্ষা করে দেখেছ তোমার কোনো জটিলতা আছে কিনা বা মা হওয়ার কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা?
-না
নতমুখে উত্তর দেয় চারু। তারপর আবার বলে,
-আমার আগের শাশুড়ী জানতে দেননি।
চারুর কথায় হাসিমুখে তারানা বলে,
-তাহলে? আল্লাহ চাইলে সবই হয়। আর যদি সত্যিই আল্লাহ সেই তাওফিক না দেন তবুও, তনু তোমার মেয়ে নয়? মেহরীন আছে, তবে তুমি যদি চাও মেহরীনকে আমি আমার কাছে রাখবো।
-আরে না না কি বলছ তারানা, মেহরীনকে তুমি কেন কাছে রাখবে, আমিই পারব।
এবার মৃদুস্বরে হেসে ওঠে তারানা,
-বিয়েতে রাজি হচ্ছ না আর মেহেরীনকে নিজের কাছে রাখার চিন্তা করে ফেলেছ?
তারানার কথা শুনে লজ্জা পায় চারু। তারানা সেটা খেয়াল করে বলে,
-তাহলে তোমার দ্বিমত নেই তো?
তবুও নিজেকে নতুন কোনো বন্ধনে বাঁধার কথা ভাবতে পারে না চারু।
-তারানা….
অস্পষ্ট স্বরে বলে চারু। তারানা চারুর দ্বিধা দেখে শেষ চেষ্টা করে,
-চারু, তনুর বড় হতে গেলে একটা পরিচয় লাগবে। ভেবেছ আমাদের সমাজ তনুকে কোন চোখে দেখবে?
তারানার কথায় চমকে ওঠে চারু। এ বিষয়ে অনেক অনেক ভেবেছে চারু, কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। আজ আরেকবার মনে হওয়াতে কেঁপে ওঠে ও।
চারুর অস্বস্তি দেখে তারানা নরমভাবে বলে,
-চারু রিহান আঙ্কেল রাজি, আমি কথা বলেছি আঙ্কেলের সাথে, তুমি দরকার হলে তোমার খালামণির সাথে কথা বলে নাও।
নিরবে মাথা নাড়ে চারু।
সেদিনের মতো এই পর্যন্ত কথা হয় চারুর সাথে। তারানা সেদিন আর চারুকে জানায় না মাহমুদ চারুর সাথে দেখা করতে চায় একবার। ভাইয়ের এবার বিয়ে নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করতে চায় না তারানা।
ধীরেসুস্থে চারুকে বলবে, ততক্ষণে চারু নিজের সিদ্ধান্তটা ঠিক করুক।
দুটো একাকি মানুষকে যদি এক করে দেওয়া যায় তাতে ক্ষতি কি! বাচ্চাদুটোও একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি পাবে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? ভাবতেই ভাল লাগছে তারানার।
(চলবে)
(পর্বটা ছোট হয়ে গেল, পরের পর্বে বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। -নাঈমা বিনতে আয়েশা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here