#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৩য় পরিচ্ছেদ
____________________________
সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলো সবাই। সিহানের কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। দৌড়ে এল সিহানের স্ত্রী তুহিনা। বাচ্চাটাকে এক নিমেষে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরল.. দুই চোখে তখন অঝোর শ্রাবণ! সিহান চুপচাপ তাকিয়ে রইল সন্তানহীনা স্ত্রীর দিকে,
-তুহিনার কোল কি তবে আল্লাহ ভরে দিলেন?
আপন মনে নিজেকে প্রশ্ন করে সিহান। ‘যাহ কি ভাবছে সে!’ আবার নিজেকে ধমক দেয়!
তুহিনা মুখ তুলে বলে,
-ভাবী….?
-লাশ এম্বুলেন্সে আসছে, এই এক্ষুনি এসে পড়বে।
লাশ শব্দটা শুনে কেঁপে উঠল তুহিনা।
-ভাইয়া কোথায়?
-এসেছে, চারু কোথায়? উত্তর দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে সিহান।
-চারু বিকালের পরে ঘুমিয়েছে, ভাইয়া ভাইয়া করে ঘুমাতেই পারেনি!
এবার চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে নিচুস্বরে তুহিনা বলল,
-বাচ্চাটাকে আমাদের দেবে ওরা?
তুহিনার আকুলতা দেখে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো সিহানের। তবু নিজেকে সামলে মুখ শক্ত করে বলল,
-এখন চুপ করো!
থতমত খেয়ে গেল তুহিনা! তাই তো… এসব কি ভাবছে এক্ষুনি! তবু এই বাচ্চাটা পেলে বড্ড ভাল হত! ভাবতে ভাবতে বাবুকে নিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল তুহিনা, বাবুর খাওয়ার আর শোয়ার ব্যবস্থা করতে।
লোকজনে পরিপূর্ণ হয়ে আছে রিহানদের ছোট্ট বাসাটা। মফস্বল শহরে ছোটখাট একটা বাড়ি করেছিল রিহান, রিহানার পছন্দ মতোই সবকিছু সাজানো হয়েছে। রিহান সিহানের বাবা মা মারা গেছে অনেক আগে। বড় বোন রাইনার বিয়ের প্রায় পরপরই মারা যায় ওদের বাবা, বছর না ঘুরতেই মা ও চলে গিয়েছিল। ওরা চাচার কাছেই বড় হয়েছে, বাবার জমি জায়গা একেবারে কম ছিল না তাই খুব বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি ওদের। চাচা ও গত হয়েছেন বছর তিনেক আগে। তবে এখনো চাচাতো ভাইবোনের সাথে খুব ভাল যোগাযোগ আছে রিহানদের।
নানা রকম মানুষের কথা বার্তা, শোকে ভারি হয়ে উঠেছে সন্ধ্যার আকাশ। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে চারু। আড়মোড়া ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে এলো চারু। সবাই চমকে উঠল চারুকে দেখে। নিরব হয়ে এলো পরিবেশ।
এত মানুষ কেন চারিদিকে? তার ভাইয়া কোথায়? আম্মু কোথায়? হঠাৎ চারুর চোখ গেল সাদা কাপড়ে জড়ানো কাউকে। হঠাৎ এসব বুঝতে একটু সময় লাগলেও বেশ বুঝতে পারল তার মা আর নেই! তখনি মনে পড়ে গেল তার বান্ধবী আভনির কথা! কত্ত দুঃখ আভনির মা নেই!… দাপাদাপি করে কান্না শুরু করে দিল চারু, একটাই কথা সে মায়ের কাছে যাবে, এক্ষুনি। মায়ের লাশের পাশে বসিয়ে দেওয়া হল চারুকে। হঠাৎই চুপ করে যায় চারু, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ছোট্ট ছোট্ট হাত বুলাচ্ছে মায়ের মুখে!…,
-ও মা কথা বলো না মা! আমি তোমার সব কথা শুনব, একবার চোখ খুলো মা! আমার আর ভাইয়া লাগবে না, আমি আর ভাইয়া চাইব না মা, ও আম্মু! আবার কেঁদে উঠে ও। চারুর আর্তনাদে আকাশ বাতাশ ভারি হয়ে যাচ্ছে। চারুকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। অঝোরে কেঁদে চলেছে সে।
রিহান চুপচাপ তাকিয়ে আছে চারুর দিকে৷ হঠাৎ ওঠা ঝড়ের তাণ্ডবে গৃহহারা মানুষ যেমন বুঝতে পারে না কি হলো, আর তার কি করা উচিত… ঠিক তেমনি রিহান বুঝতে পারছে তার জীবনে কি ঘটে গেল। স্বপ্নাবিষ্টের মতো এগিয়ে গেল চারুর দিকে৷ ধীরে ধীরে কোলে তুলে নিলো চারুকে। চারু এবার ফোঁপাতে শুরু করল!
-বাবা ও বাবা আমি মায়ের কাছে যাব, বাবা, মা কেন আসছে না?
নির্বাক হয়ে চারুকে বুকে চেপে ধরলেন রিহান। স্রষ্টা কি জানেনা অত ছোট বুকে এত বড় কষ্ট সামলাতে পারবে না চারু! ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল রিহানের চোখ থেকে৷ চারু কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে গেছে। এত কিছুর মাঝেও রিহান রিহানাকে পূর্ণ পর্দার মাঝে রাখল৷ এতে অনেক রকম ভাল মন্দ মন্তব্য আসতে লাগল চারিদিক থেকে। অনেকেই লাশ দেখতে না পেয়ে রীতিমতো মনোক্ষুণ্ণ হয়ে গেল।
একজন তো লোকলজ্জা ভুলে বলেই উঠলেন,
-বুঝিনা বাবা, এদের সবই বেশি বেশি!
সিহান এসব লক্ষ্য করে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-দেখুন আমার কথা আপনাদের ভাল লাগতে নাও পারে, সারাজীবন ভাবিকে আমার সামনেও কঠোর পর্দা মানতে দেখেছি, আজ কেন আপনাদের সবার জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে? এতে আপনারা যাই ভাবুন না কেন, গায়রে মাহরাম কাউকে ভাবির মুখ দেখতে দেওয়া হবে না।
সিহানের শক্তপোক্ত কথাতে গুঞ্জন কমে এলো, বলা যায় উপস্থিত সবার মাঝে নিরবতা নেমে এলো৷ ভাল লাগুক বা খারাপ লাগুক কেউ কোনো কথা বলল না।
চারু ঘুমিয়ে গেছে রিহানের কাঁধে মাথা রেখে।©নাঈমা বিনতে আয়েশা।
অতিরিক্ত কান্না মেয়েটাকে একেবারেই দুর্বল করে দিয়েছে। রিহান ছোট্ট তরুর এক পাশে চারুকে শুইয়ে দিয়ে তুহিনাকে খেয়াল রাখতে বলে এলো। তরুর দিকে তাকিয়ে রিহানের বুক টা কেঁপে উঠল৷ কত আশা ছিল তাদের। চারুর নামের সাথে মিলিয়ে তরুর নাম টা রেখেছিল রিহান। আজ সব আছে শুধু তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ রিহানাই নেই!
বেশ কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে। রিহানার বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল, পথের দূরত্বের জন্য আসতে সময় লাগছিল তাদের। রিহানার বোন রেণু আছড়ে পড়লো বোনের খাটিয়ার উপর। কিন্তু কাঁদতে পারছে না খুব কষ্ট হচ্ছে তার। ছোট বেলার সঙ্গী তার এই বোন। ক্রমে যেন নিস্তব্ধতা শব্দগুলো গ্রাস করে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরছে।
রিহানাকে পর্দার সাথে গোসল করিয়ে কাফন পরানো হলো, তারপর জানাযা শেষে রিহানাকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করা হলো। সিহানের আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চারু কে ডেকে তুলল তুহিনা, তারপর চারু, তরুকে নিয়ে এলো তাদের মায়ের পাশে। চারু একেবারে নিরব হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে মা আর কখনো আসবে না! কিন্তু কাঁদতে পারছে না। ছোটমণি রেণুকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে সেদিকে ছুটে গেল চারু। বোনের মেয়েটাকে ভীষণ ভালবাসে রেণু। রিহানার বাবা মা ও পাশেই ছিলেন। তখনকার পরিবেশের সঠিক বর্ণনা কোনো শব্দে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়৷ একটি পরিবার তাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হারিয়ে ফেলল। যাদের নেই তারা বুঝে না থাকার কষ্ট।
সেই রাতেই রিহানার দাফন হয়ে গেল। রিক্তহাতে পরাজিত সৈনিকের মত ফিরে এলো রিহান। মাথা নিচু করে বসে রইল সে।
প্রতিদিনের মত চারুর আজকের সকাল টাও শুরু হয়েছে মিষ্টি রোদ আর পাখির কলকাকলি শুনে। চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে। চারু সাধারণত আযানের পরেই উঠে, মা আযানের পরে আর ঘুমাতে দেয় না, আরো ছোট থেকেই। আজ ব্যতিক্রম হয়ে গেল। হয়তো অতিরিক্ত রাত জেগে থাকার কারণেই… ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো চারু। হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই হঠাৎ গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল! আর বাড়াতে পারলো না সে। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের কোলে মাথা রাখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু……..
রেণু চারুর রুমে ঢুকে দেখে চারু দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-কি হয়েছে মা? এদিকে আসো, বলে নিজেই এগিয়ে গেল চারুর দিকে।
-ছোটমণি আমার আম্মু… এটুকু বলেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল চারু। চারুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো রিহানা, জানে সম্ভব না তবুও কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টায় লেগে পড়ল রেণু।
রিহানার মৃত্যুর এক ছয় দিন পার হয়ে গেছে। আগামীকাল তরুর আকীকা। তুহিনা একবার অবশ্য বলেছিল এসবের মাঝে আবার আকীকা…! রিহান ছাফ জানিয়ে দিয়েছে তার ছেলের আকীকা হবে। তরুর পুরো নাম রাখা হলো রাইয়্যান আহমেদ তরু। রিহানার পছন্দে রাইয়্যান আর রিহানের পছন্দে তরু। দিন কেটে যাচ্ছে এক এক করে, কিন্তু রিহানার বাবা মা চারু, তরু আর রিহানের অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে গেলেন। শেষে রেণুকে রিহানের সাথে বিয়ে দিবেন সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। রেণুকে নিয়ে তারা আশাবাদী হলেও রিহানকে নিয়ে সন্দিহান, এখন রিহানের মতামত নেওয়া দরকার।
(চলবে)
(গল্প সম্পর্কে, ভুল ত্রুটি নিয়ে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, অযথা নেক্সট ফ এসব লিখবেন না।- নাঈমা বিনতে আয়েশা)