আলোকিত অন্ধকার পর্ব-২

0
449

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
২য় পরিচ্ছেদ
____________________________________
-মা আমি ফার্স্ট হয়েছি!
চারুর বিজয়োল্লাসে রান্নাঘরের কাজ ফেলেই ছুটে এলেন চারুর মা রিহানা, রিহানা অবশ্য চারুর মায়ের আসল নাম নয়, এ বাড়িতে বিয়ে হওয়ার পরই চারুর বাবা নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রিহানা বলেই ডাকেন, সেটাই এখন আসল নামে পরিণত হয়ে গিয়েছে। মাকে দেখে জড়িয়ে ধরল চারু।
-আলহামদুলিল্লাহ
মেয়েকে কোলে নিয়ে বলেন রিহানা। চারু সবে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেছে, বয়সের তুলনায় বেশ দ্রুত ক্লাসে উঠে গেলেও যথেষ্ট মেধাবী মেয়ে ও।
-আমায় কি দেবে বলো আগে?
হাসি হাসি মুখ করে মায়ের দিকে তাকাল চারু। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গালে চুমু দিয়ে রিহানা বললেন,
-সেটা সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক! তোর বাবাকে ফোন করে জানিয়েছিস?
-ওহো ভুলেই গেছি আম্মু!
চোখ বড় বড় করে বলল চারু
-আচ্ছা যা জানিয়ে দে, আর শোন ফ্রেশ হয়ে নে
মাথা নেড়ে চারু চলে গেল নিজের রুমে। আস্তে আস্তে আবার রান্নাঘরের দিকে এগোলেন রিহানা। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তিনি, হাঁটাচলা করাটাই এখন কষ্টকর হয়ে উঠেছে দিন দিন। চারুর বেলায় এত দুর্বলবোধ করেননি তিনি। কাপড় ধোয়া, ঘর মোছার কাজ টা একজন করে দিয়ে যায়। চারুর বাবা বারবার রান্নার জন্যও একজন মানুষ রাখতে চাইছিলেন কিন্তু রিহানা তাতে একদম না করে দিয়েছেন। কারণ তিনি জানেন রিহান তার হাতের রান্না পছন্দ করেন। তাই আর রান্নার ব্যাপারে কাউকে নিতে চাননি। তাছাড়া তিনি নিজেই রান্নাবান্নার ব্যাপারে একটু সেনসিটিভ।
রান্নাঘরে গিয়ে কেটে রাখা সবজিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন রিহানা। কাজ প্রায় শেষ খুব বেশি বাকি নেই, তবু যেন আজ মন চাইছেনা কিচ্ছু করতে!
তারপরও আস্তে আস্তে সবজি গুলো চুলায় বসালেন। তারপর ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলেন, শসা, গাজর আর টমেটো গুলো বের করে রাখলেন। রিহান বাসায় এলে তারপর সালাদটা সুন্দর করে সাজিয়ে নেবেন। আগে থেকে কেটে রাখলে সালাদের সবজি নরম হয়ে পানি বের হবে। চারুর জন্যই এত আয়োজন, মন বলছিল চারু ফার্স্ট হবে।
রান্না শেষ করে কোনোমতে কাপড় বদলে শুয়ে পড়লেন রিহানা। কলিংবেলের শব্দে দরজার দিকে এগিয়ে গেল চারু, সে জানে বাবা এসেছে। চোখে মুখে আনন্দ চকচক করছে চারুর। দরজা খুলেই চিৎকার করে,
-বাবা….!
রিহান হেসে জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। হাতে থাকা চকলেটের বক্সটা মেয়ের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন,
-এই যে মা তোর গিফট
-ওয়াও! প্রিয় চকলেট পেয়ে লাফিয়ে ওঠে চারু।
চারুকে কোলে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন রিহান। শোবার ঘরে ঢুকে রিহানাকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে আর ডাকলেন না তিনি। রুমের বাইরে এসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-তোমরা খেয়েছ মা?
-না বাবা
দুদিকে মাথা নাড়ল চারু।
চারুকে নামিয়ে দিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজেই টেবিলের দিকে এগোলেন রিহান। অসুস্থতার মাঝেও রিহানা মেয়ের রেজাল্ট এর কথা ভেবে এত রান্না করেছেন ভাবতেই স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে উঠল রিহানের। বিরিয়ানি টা প্লেটে প্লেটে নামিয়ে রাখলেন। রান্না ঘর থেকে মাংসটা এনে টেবিলে রাখলেন। সালাদ টা রিহানার স্টাইলে বারবার সাজাতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন, শসা দিয়ে গোলাপ বানাতে কতবার দেখেছেন, তিনি কিছুতেই সুন্দর করে তুলতে পারছেন না। মনে মনে বললেন, ‘সত্যিই নারী তুমি দশভুজা! সৃষ্টিকর্তার অসাধারণ সৃষ্টি’
অবশেষে অনেকটা সময় নিয়ে কোনোরকমে খাবার গুলো সাজিয়ে রিহানার ঘরের দিকে এগোলেন। পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আস্তে করে ডাকলেন,
-রিহানা?
রিহানা ধড়মড়িয়ে উঠলেন!
-আরে তুমি কখন এলে! একটু শুয়েছি ওমনি ঘুম চলে এল! আচ্ছা আমি খাবার দিই, বলে উঠতে শুরু করলেন রিহানা। রিহানার অস্থিরতা দেখে রিহান শুধু হাসি মুখে বললেন,
-আস্তে যাও
টেবিলের কাছে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন রিহানা। সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে বসে আছেন।
-তোমার মত সাজাতে পারিনি, বলে মুখ কাঁচুমাচু করে রিহানার পাশে দাঁড়ালেন রিহান।
-তুমিও না…! চারুকে ডাকো, কপট রাগ রাগ স্বরে রিহানা। রিহান হাসতে হাসতে চারুকে নিয়ে এসে টেবিলে বসলেন। খেতে খেতে হঠাৎ উঠে পড়লেন রিহানা।
-সে কি! আর খাবে না?
-নাহ কষ্ট হচ্ছে খেতে! হাত ধুয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন রিহানা। কপাল কুঁচকে চিন্তিত হয়ে রিহানার চলে যাওয়ার দিকে তাকালেন রিহান। রিহানের খাওয়া প্রায় শেষ তবু চারুকে খাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে ধীরে ধীরে খাচ্ছেন। হঠাৎ রিহানার চিৎকারে চমকে উঠলেন তিনি! দ্রুত হাত ধুয়ে ছুটলেন ঘরের দিকে। চারুও দৌড়াল বাবার পিছু পিছু। বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে পড়ে গেছে রিহানা! প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে!
.
ব্যস্তভাবে ডাক্তার রিহানকে বললেন,
-কাকে বাঁচাতে চান? বাচ্চা নাকি মা?
কাঁপা কাঁপা গলায় রিহান বললেন,
-ও…ওর…ওর মাকে চাই আমি!
ডাক্তারদের জীবনে এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। রিহানের দিকে আর এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
-রক্ত রেডি আছে তো?
-জ্বি…মানে ছিল তো, কিন্তু ডেলিভারি ডেট আরো পরে ছিল, এই মুহূর্তে! আচ্ছা আমি দেখছি!
-দেখুন আপনার স্ত্রীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, রক্তের ব্যবস্থা করুন দ্রুত, কিছুক্ষণের মাঝেই, বলেই চেম্বার ছেড়ে উঠে গেলেন ডাক্তার।
দিশেহারা হয়ে গেলেন রিহান। হাতঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা ৩টা ছুঁই ছুঁই করছে!
কয়েকজনের কাছে ফোন করলেন, কয়েক জায়গায় খোঁজও নিলেন কিন্তু সবাই কাজে ব্যস্ত বা অফিসে কিংবা দূরে। খুব দ্রুত আসলেও মিনিমাম ৩ ঘন্টার নিচে কেউই পৌঁছাতে পারবে না। এ কেমন নিয়তি! ভাবতে পারছেনা রিহান। সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব আসতে বললেন রিহান। চারুকে রেখে এসেছেন বাসায়। চারুর কাকিমণি আছে। রিহানের ছোট ভাই সিহান আছে হাসপাতালেই সেও চারিদিকে ফোন করছে।
কিন্তু রিহান কে আর শেষ চেষ্টা করার অবসর দিলো না রিহানা। তার রিযিক আর আয়ু শেষ হয়ে দুটোই পরপারের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিল তাকে। আর তাই অবশেষে সেদিন সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে ছোট্ট সংসার আর চারুকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল রিহানা! রেখেছিল সদ্যোজাত মা হারা এক নিষ্পাপ শিশু! তরু…..
হ্যাঁ, সেদিন তরুকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে শেষ বিদায় নিয়েছিলেন রিহানা। সেই সাথে মা হারা হল চারু। মা হারা কাউকে দেখলেই জসীমউদ্দিন এর সেই কবিতার লাইন টা মনে পড়ে যায়
“বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই” সন্তান মুখে বলুক বা না বলুক সব আদর্শ সন্তানরাই জানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্পদ হল মা!
রিহান হারালো তার ভালবাসাকে।
কিন্তু জীবন কি থেমে গেল? রিহান অন্তত তাই ভেবেছিল যে তার জীবন থেমে গেছে। কিন্তু আল্লাহ হয়তো চান অন্য কিছু।
আল্লাহ বলেন,
وَلَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَلَدَيْنَا كِتَٰبٌ يَنطِقُ بِٱلْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

অর্থঃ আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পন করি না। আমার এক কিতাব আছে, যা সত্য ব্যক্ত করে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।
(সূরা আল মু’মিনূন (المؤمنون), আয়াত: ৬২)
রিহান কি মনে রাখবে এই কথা? সে কি সামলে নিবে সব ধাক্কা!

(চলবে)
(গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কমেন্ট বা মন্তব্য। আপনাদের মন্তব্যই আমার অনুপ্রেরণা। আমি গঠনমূলক কমেন্ট আশা করি সব সময়ই, হোক সেটা অন্তত একটি বাক্যে। ধারাবাহিক গল্পে পরবর্তী পর্ব যথাসময়ে দেওয়া হবে। অর্থহীন নেক্সট, ন, ফ, এসব বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here