#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৫ম পরিচ্ছেদ
__________________________
আদিবের সাথে সপ্তাহখানেকের মাঝেই বিয়ে হয়ে গেল রেণুর। সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলো রেণু। কিন্তু সবচেয়ে সমস্যা হলো চারুকে নিয়ে, রেণুকে সে কিছুতেই যেতে দেবে না, আবার এদিকে নতুন দম্পতির মাঝে চারুকে পাঠাতে একেবারেই নারাজ রিহান।
চারুকে সামলাতেই সবচেয়ে বেগ পেতে হলো সবাইকে। বাধ্য হয়ে রিহান ওকে নিয়ে ঘুরতে গেল। এরমাঝে রেণু চলে গেল।
দুইদিন পরেই রেণুর ওয়ালিমা ছিল। কিন্তু বিয়ের পরদিনই আদিব এসে হাজির। রেণু চারুকে নিতে পাঠিয়েছে। চারুর কথা শুনে আদিবের বাবা মা ও বারবার বলে দিয়েছে চারুকে রেখে যেন আদিব কোনোভাবেই না আসে।
মেয়েকে পাঠাতো না রিহান, কিন্তু ছোটমণির কাছে যাওয়ার কথা শুনে চারু যেভাবে খুশিতে আটখানা হয়ে আছে, সেই খুশিকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না রিহানের, অগত্যা চারুকে পাঠিয়ে দিলো রিহান। দুইদিন পরেই আনতে যাবে ভেবে আশ্বস্ত হয়ে কিছুটা দমিয়ে রাখলো মনকে।
জন্মের পর এই প্রথম চারু রাতে বাবা থেকে আলাদা থাকছে। চিন্তায় সারারাতই ঘুমাতে পারলো না রিহান। আবার অনেক রাতে সংকোচে কল দিতেও পারলো না।
দুইদিন পুরো দমবন্ধের মতো দিন কাটলো ওর। এরমাঝে যদিও কথা হলো চারুর সাথে কিন্তু কাছে না পেয়ে একেবারে হাঁপিয়ে উঠল রিহান।
এদিকে রেণুর শ্বশুরবাড়িতে চারুর দিনগুলো খুব ভাল কাটছিল, সবাই আদরে আদরে ভরিয়ে রাখছে। কখনো বা রেণু কখনো আদিব কখনো আদিবের বাবা মা সবার মধ্যমণি হয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফোনে আদিবের মুখে এগুলো শুনে অনেকটাই আশ্বস্ত হলো রিহান।
ওয়ালিমার দিন গাড়ি থেকে নেমেই চারুকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে একেবারে চেপে ধরল রিহান, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে, মাথায় এলোপাতাড়ি চুমু খেতে লাগল।
-আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়নি তোমার আম্মু?
-হ্যাঁ বাবা, তখনই তো তোমার সাথে কথা বলতাম।
বিজ্ঞের মতো জবাব দেয় চারু।
ওয়ালিমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর চারুকে নিয়ে বাড়ি ফিরল রিহান। এবার আর চারু তেমন কিছুই বলল না, বোধ করি বাবাকে দূরে রেখে চারু আর বাবাকে ছেড়ে থাকতে চাইছিল না।
চারুকে নিয়ে আরো এক সপ্তাহ চারুর নানা বাড়িতে রইল রিহান। এর মাঝে রেণু এসে ঘুরে গেল। চারুকে নিয়ে যেতে চাইলে এবার বাঁধা দেয় রিহান।
এই দিনগুলোতে চারু অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে রেণুর জন্য। কিন্তু পরের দিনগুলো নিয়ে খুব চিন্তিত রিহান। আবার এদিকে তরুকে রেখে যেতে চাইছে না চারু। আবার চারুকে এখানে রেখে থাকা রিহানের পক্ষে অসম্ভব, চারুর রেণুর শ্বশুরবাড়িতে থাকার দিনগুলোতে হাড়েমজ্জায় বুঝতে পেরেছে।
চারু রিহানকে রেখে থাকতে পারবে না, আবার তরুকে রেখেও যেতে চাইছে না। রিহান নিজেরও তরুকে রেখে যেতে মন চাইছে না।
কিন্তু কিছু তো মেনে নিতে হবেই। বাধ্য হয়ে রিহানকে শক্ত হতে হলো,
-আমি ভাইয়াকে ছেড়ে যাবো না!
চিৎকার করতে লাগল চারু।
-তবে এখানে থাকো আমি যাই?
বাবার কথা শুনে কেঁদে দিলো চারু।
-মা ছেড়ে গেল তুমিও যেতে চাইছ?
চারুর কথা শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল রিহান। রিহানার স্মৃতিগুলোকে কিভাবে যে নিজের মাঝে চেপে রেখেছে শুধু সে আর সৃষ্টিকর্তা জানেন। চারু তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। একটু পর নিজেই বলে উঠল
-সরি বাবা।
রিহান দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো নিজেকে। অনেক বুঝিয়ে চারুকে সাথে নিলো ও। তবুও চারুকে নিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হলো সবাইকে। আবার এদিকে থাকারও উপায় নেই।
এরই মাঝে সিহান ফোন করল,
-ভাইয়া আজ আমাদের এখান থেকে তারপর বাসায় যেও, তুহিনা আসতে বলেছে।
-কিন্তু…
রিহানকে বাঁধা দিল সিহান,
-কিন্তু না ভাইয়া এসে আবার যেও, চারুর ও ভাল লাগবে।
অগত্যা চারুর কথা ভেবে রাজি হলো রিহান।
রিহানদের জন্য অনেক রান্নাবান্না করল তুহিনা। সাধারণত সে এমনটা করেনা। রিহানার দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্সি বা আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ছেলে হওয়ার সংবাদেও খুশি হতে পারেনি সে। যেখানে সে নিজেই এখনো মা হতে পারেনি সেখানে জা’য়ের দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সংবাদে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। এখন তার মনে একটু হলেও আশার আলো জ্বলছে। শুধুই মাতৃত্ব…!
রান্নাবান্না করে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তুহিনা। তরুকে একবার আদর করার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছে তার।
শুধু চারুকে নিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখে বুকটা কেঁপে উঠল তুহিনার। ছুটির দিন বলে সিহান বাসাতেই ছিল। সিহান অবাক হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকতেই রিহানকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো সিহান,
-তরু কোথায় ভাইয়া?
-বাবা তরুকে নানুর বাসায় রেখে এসেছে, বড় না হলে আর আনবে না
কথার মাঝখান থেকে বলে উঠল চারু।
-চারু কি বলছে এসব ভাইয়া?
রিহান ভিতরে ঢুকে বলল,
-সব বলব, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি খুব ক্লান্ত লাগছে, চারু তুমিও ফ্রেশ হয়ে এসো।
বলে বিধ্বস্ত মনে রিহান এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। মনে মনে সাজাতে লাগলো কিভাবে বোঝানো যায় সিহান আর তুহিনাকে। তুহিনা এখনো কিছু জানেনা তবে তরু যে আসেনি এটা বুঝতে পেরেছে।
খাবার টেবিলে তরুকে ওর নানুবাড়িতে রেখে আসার কথা যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলল রিহান। কিন্তু রিহানের কথা সবই বিফলে গেল। তুহিনা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তবে মনে মনে প্রচন্ড রেগে গেল সেটা বলা বাহুল্য।
মানব মন কাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেলে সচারাচরই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে, তুহিনার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো যেকোনো ভাবেই হোক এর প্রতিশোধ সে নেবেই! আজ হোক বা কাল। কেমন মানুষ রিহান ভাই? নিজের ভাইয়ের কোলে একটা বাচ্চা নেই যেখানে সেখানে তার মা হারা সন্তানটিকে নানুর বাসায় রেখে এলো!
সিহান কিছু একটা বলতে গেলে চোখের ইশারায় থামিয়ে দেয় তুহিনা, এখানে আর ছোট হওয়ার কোনো মানে হয় না। এখানে তরুকে চাওয়া মানে নিজেদের দূর্বলতাকে খুঁচিয়ে বের করা। তাই সিহান তুহিনা কেউই কিছু বলল না।
জীবনে যাই ঘটে যাক না কেন মানুষের জীবন থেমে থাকে না। সময়ের টানাপোড়েনে এগিয়ে চলে জীবনের গল্প। প্রচন্ড কষ্টের মাঝে হয়তো কখনো হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে হয়, আপাত দৃষ্টিতে মনে থেমে থাকে তবে সেটা অলিক কল্পনা। কখনো আনন্দের জোয়ার কখনো দুঃখের, এরই মাঝে জীবনকে টেনে নেওয়া। রিহান ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে নিজের জীবনে। চারু নিজের মতো চলাফেরা করে। চারুর দিকে যথেষ্ট খেয়াল করে রিহান। এভাবেই কেটে গেল প্রায় একটা বছর। আজ তরুর জন্মদিবস আর রিহানার মৃত্যুদিবস! কি অদ্ভুত সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা তাই না?
চারু আজ স্কুলে যায়নি। ঘরে দরজা দিয়ে বসেছিল সারাদিন। সন্ধ্যার দিকে অনেক বুঝিয়ে রিহান চারুকে নিয়ে গেল নানুর বাসায়। রেণুও এসেছে, রেণু তার স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বলতায় চারুকে মাতিয়ে তুলল। তরুর সাথে অনেক রাত পর্যন্ত খেলা করলো চারু। এই প্রথম ভাইয়ের জন্য এত বেশি টান অনুভব করলো চারু। আগেও করেছে তবে এতটা না।
পরদিন আর ফিরে গেল না চারু। রিহানও কি ভেবে রেখে গেল। মা হারা মেয়েটাকে জোর করে কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না তার। বেশ তো যাচ্ছে জীবন। একটা লোককথা বলা হয়ে থাকে জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। রিহান, চারু বা তরু কি জানতো তাদের জীবন নেবে আরেক নতুন মোড়!
(চলবে)