আলোকিত অন্ধকার পর্ব-৬

0
364

#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ
_________________________

-সালিহা তুই একটা বিয়ে করে নে।
বান্ধবীর কথায় অবাক হয়ে গেল সালিহা,
-কি বলছিস তুহিনা! একে তো প্রথম বিয়েটা টিকলো না, তারপরের বিয়েটা বিয়ের আসরেই ভেঙে গেল! কে বিয়ে করবে আমাকে, ওসব স্বপ্ন দেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি! হতাশ গলায় উত্তর দেয় সালিহা।
-আরে বাবা লাইফটা কি এভাবে কাটাবি নাকি! আমি বলছি নতুন ভাবে শুরু কর সবকিছু! অবশ্য আমার দেখাশোনা একটা মানুষ আছে তাই এত বলছি।
তুহিনার কথা শুনে আরো অবাক হয়ে যায় সালিহা। সালিহাকে চুপ থাকতে দেখে তুহিনা আবার বলে,
-আমার ভাসুর, তার বউটা অকালে মারা গেল ছেলে হতে গিয়ে। তুইও একা সেও একা হয়ে গিয়েছে। আমার শ্বশুরবাড়ির খবর তো তুই জানিস, ভেবে আমাকে জানা, তুই রাজি হলে বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিবো। এখন আমি রাখছি”
সালিহাকে আর কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিল তুহিনা। সালিহা তার বান্ধবী, রিহানের সাথে সালিহাকে মেলাচ্ছে অনেক দিন থেকে কিন্তু সালিহা বলব বলব করেও কথাটা বলতে মনে থাকে না তুহিনার। আজ সুযোগ বুঝে কথার ছলে বলে দিলো। তার ধারণা যদি খুব ভুল হয় তবে সালিহা রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু রিহানকে নিয়ে চিন্তিত তুহিনা। রিহানকে রাজি করাতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে।
রাতে সিহান সব শুনে বলল,
-আমারো মনে হয় ভাইয়ার ব্যাপারে, একটা বিয়ে করে নেওয়ায় ভাল। কতদিন থাকবে এভাবে একা!
সিহানের কথাতে তাল মিলিয়ে তুহিনা বলল,
-রিহান ভাইকে বুঝাতে হবে, চারুর নানা নানিকে গিয়ে বলতে হবে।
সম্মতি জানায় সিহান,
-ঠিক বলেছ, আমাদের কথা পাত্তা না দিলেও গুরুজন হিসেবে ওদের কথা ভাইয়া ফেলবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ…
পরদিনই তুহিনা চলে গেল চারুর নানু বাড়িতে। নিজের ভিতর যতটা বোঝানোর ক্ষমতা আছে ততটা দিয়েই বোঝালো রিহানার বাবা মাকে। রিহানার বাবা মা বরাবরই রিহানের বিয়ের পক্ষে ছিলেন তাই এবার তুহিনার কথাতে বিশ্বাস করলেন রিহান এতে ভাল থাকবে।
কিন্তু বিয়ে করতে রিহানের ঘোর আপত্তি! কিছুতেই বিয়ে করবে না সে। কিন্তু নাছোড়বান্দা রিহানার বাবা মা। রেণুর বিয়ের প্রস্তাব যেমন করে দিয়েছিলেন সেভাবেই আবার বুঝালেন রিহানকে।
অবশেষে হার মানতে হলো রিহানকে। তার সঙ্গী দরকার, চারুর একটা মায়ের কোল দরকার, সব ভেবে রাজি হতে হলো রিহানকে এবং
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই রিহান দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হলো আর রিহানের সাথে জড়িয়ে থাকা জীবন গুলোর শুরু হলো নতুন জীবন…
রিহানের বিয়ের পর চারুকে ওর নানা নানি তাদের কাছে রাখতে চাইলেও রাজি হয়নি রিহান। চারুকে ছাড়া থাকা তার পক্ষে সম্ভব না বলে জানায় রিহান।
সালিহা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে সালিহার মাতৃত্ব ছিল কিন্তু তাতে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল স্বার্থপরতা। তাই চারু মা পেলেও মায়ের কোল টা হারিয়ে ফেলল, সাথে বাবার সাথে তৈরি হল দূরত্ব।
এরই মাঝে আদিবের চাকরির সুযোগ এসে গেল বাইরের দেশে, রেণুকে নিয়ে আদিব পাড়ি জমালো আমেরিকায়। সবই ঠিক চলছিল শুধু ছিন্নভিন্ন হলো চারুর শৈশব।
কিন্তু কথায় বলে সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাকে ঘিরে আমরা ভাবি বুঝি আর এগোতে পারব না, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তা কখনো হয়নি আর কখনো হবেও না। আল্লাহ সুবহানওয়া তায়ালা ঠিক করে রেখেছেন তা ঘটতে বাধ্য, অবধারিত।
কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর, সেদিনের ছোট্ট চারু আজ অষ্টাদশী বালিকা। সৎমায়ের ঘরে কেমন ভাবে চারু বড় হয়েছে তা এখন বলা বাহুল্যই বটে।
বিয়ের একবছর পরে জন্ম হয় রিহান আর সালিহার সন্তান নিধির।
মায়ের মৃত্যুর পর চারু যেন কেমন বড় হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কিছু কিছু শিক্ষার কারণে সৎমায়ের খারাপ ব্যবহারও চারু একেবারে ভেঙে যায়নি। তবে পার্থক্য এনেছে চারুর বিশ্বাসে। মুখে মুসলিম হলেও কিছুটা উন্নাসিক আর ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ আসে চারুর মাঝে। আজকাল প্রায়ই এ নিয়ে নিজের মনের সাথে দ্বন্দ্ব হয় তার।
এখন আর বাবাকে ডেকে একটু কথা বলা হয় না চারুর, বাবা কেমন যেন যান্ত্রিক মানুষের মতো হয়ে গিয়েছে। তবে কোনো কিছু চারুকে না ভাবালেও দিনশেষে চারুর শুধু মনে হয় আল্লাহ তার উপর অবিচার করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)।
এই বিশ্বাস চারুকে তার অসীম মহান সৃষ্টিকর্তা ভাবনা থেকে টেনে এনেছে অনেকটা দূরে। চারুর পরিস্থিতি বিচার করে পাঠকগণের হয়তো চারুর অবস্থা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
চারু এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভাল সেকথা আগেই বলেছি। আজ প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষাও শেষ। বেশ হালকা লাগছে নিজেকে, এতদিন যেন একেবারে চাপে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল।
বাসায় এসে সবে বসেছে চারু, তার কানে এলো মা সালিহার কর্কশ কন্ঠস্বর,
-এক মেয়েকে রাজার হালে বিয়ে দিবে, আরেক মেয়ে নেই?
স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনতে অনভ্যস্ত রিহান গত দশ বছরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করতে গিয়েছে, হিতে বিপরীত ফলাফল পাওয়াতে ইদানীং চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে সে। তবু চাপা কন্ঠে বলে,
-আস্তে চারু ফিরেছে, শুনতে পাবে!
সালিহা পুনরায় চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে কি ভেবে আবার চুপ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। মায়ের কথা বার্তার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না চারু! কি নিয়ে কথা বলছে তারা!
সালিহা চলে গেলে রিহান ফোন করে তরুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে,
-রাইয়্যানকে দেওয়া যাবে? আমি রাইয়্যানের বাবা বলছি।
-জ্বি একটু অপেক্ষা করুন,
ওপাশ থেকে উত্তর আসে।
তরু একটা হাফিজিয়া মাদ্রাসায় কুরআন হেফজ করছে। এটা তরুর মায়ের ইচ্ছে ছিল। নানাবাড়িতে থাকায় আর বাইরে পড়াশোনার কারণে চারুর মতো সাংসারিক বিভিন্ন কাঠিন্য তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
তরুর সাথে কথা বলা শেষে চারুকে ডাকে রিহান তরুর সাথে কথা বলার জন্য। এই একটা সময় সবচেয়ে উপভোগ করে চারু। রিহান মুগ্ধ চোখে ওদের ভাইবোনের খুঁনসুটিতে অনুভব করে। তরু খুবই কম এ বাড়িতে আসে, তবু চারু যতক্ষণ তরুর সাথে থাকে ওর মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর সময় পার করছে।
তরুর সাথে কথা বলা শেষে নিজের ঘরে যাওয়ার পথে একবার রান্নাঘরে উঁকি দেয় চারু। সালিহার রাগী মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের ঘরে পা বাড়ায়।
-নিধি, ও নিধি
ঘরে ঢুকে হঠাৎ কি মনে পড়ায় চারু ডাকতে থাকে নিধিকে।
-জ্বি বলো
-আবার আমার পার্স থেকে টাকা নিয়েছিস?
রাগী চোখে তাকায় চারু।
-আস্তে বলো আপু বাবা শুনে ফেলবে!
নিধি এসে মুখ চেপে ধরে চারুর। মুখ থেকে নিধির হাত সরিয়ে চারু বলে,
-আচ্ছা বল তো সবে পড়িস ক্লাস ফোরে, রোজ এত টাকা লাগে? এত টাকার রোজ খেতে হবে?”
বিরক্ত চোখে তাকায় চারু।
নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিধি বলে,
-আমার বান্ধবীরা আছে তো!
বয়সের তুলনায় নিধি বড্ড বুঝতে শিখেছে, কখনোই এটা ভাল না, কিন্তু কে বুঝাবে। বাবা জানলে হয়তো বকা দেবে কিন্তু বাবার কান পর্যন্ত মা যেতে দিলে তারপর তো!
এর আগেও নিধি টাকা নিতেই থাকে চারুর ব্যাগ থেকে, চারু অতিষ্ঠ হয়ে মাকে বলাতে, সালিহা তেতে উঠেছিলেন একেবারে,
-সামান্য টাকার ব্যাপার নিয়ে নালিশ করতে এসেছিস? ছোট বোনেরা অমন টাকা নেয় না?
অথচ চারু বুঝাতে গিয়েছিল নিধিকে এভাবে টাকা দেওয়া ঠিক না। আবার এদিকে চারুর হিসাবের টাকা থেকে নিধি টাকা নিলে চারুর গাড়ি ভাড়া, টিফিন এসবে সমস্যা হয়। বাবার থেকে চাইতেও গেলেও সালিহার বকা শুনতে হয়। বাধ্য হয়ে চারু ব্যাগের আলাদা এক জায়গায় টাকা রাখতো। আজ ভুল করে ব্যাগের সাইড জিপারে রেখেছে, সেখান থেকে টাকা বের করে নিয়েছে নিধি। তবু কয়েকদিন বাসা থেকে বের হতে হবে না ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ও। অভ্যাস থাকলেও দিনরাত মুখ ঝামটা খেতে কারই বা ভাল লাগে!
-আপু!
নিধির ডাকে ফিরে তাকায় চারু।
-বল
-তোর বিয়ে! বলে মুচকি হাসে।
নিধির কথায় মোটামুটি চমকে উঠে চারু। বাবার ঘরে শুনে আসা কথা হঠাৎ মনে পড়ে। আর নিধির কথা শুনে দুই দুই চার মেলাতে অসুবিধা হচ্ছে না চারুর। কিন্তু নিধি খুব পাকা, তাই দ্রুত বলে উঠে
-কিসের বিয়ে! এতটুকু বয়সে খুব বুঝতে শিখেছিস! যা যা পড়তে বস।
নিধিকে কিছু জিজ্ঞাসা করা নিরাপদ না চারু জানে তাই মনে ভয় আর বুকে ধুকপুকানিটা রয়েই গেল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here