আলোকিত অন্ধকার পর্ব-৭

0
374

#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৭ম পরিচ্ছেদ
____________________________

-আমাকে বিয়ে দেওয়াটা যদি তোমার কাছে ভাল মনে হয় তবে তুমি তা দিতে পারো।
বাবার প্রশ্নে অস্পষ্ট স্বরে জবাব দেয় চারু। উত্তর দেওয়ার পর আর দাঁড়ায় না সে।
-কথা শুনে তো বোঝাই যায় না মেয়ে বাপের সামনে কথা বলছে! লাজ-লজ্জার মাথা একেবারে খেয়ে বসে আছে, ঝাঁজিয়ে ওঠে সালিহা।
-কি দিন আসলো রে বাবা, আমাদের বিয়ের কথা শুনলে লজ্জায় আমরা একেবারে কুঁকড়ে যেতাম।
সালিহা বলে, তবে বলার সময় খুবই সতর্কতার সাথে ভুলে যায় প্রথম জীবনে নিজের প্রেমিকপুরুষের সাথে বিয়ে করার জন্য বাবা মায়ের সাথে সে কেমন ব্যবহার করেছিল।
সালিহার বলা প্রত্যেকটি কথা চারুর বুকে শেলের মতো বিঁধছে। চারুর মনে হয় এই মহিলা চারুর কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। খুব কষ্ট হচ্ছে চারুর, তবু ধীরস্থির ভাবে বসে আছে।
নিজেকে মাঝে মাঝে নিষ্প্রাণ মনে হয় ওর। এ বাড়িতেও এক মূহুর্ত ভাল লাগেনা।
তাই কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে যায় বিয়েতে, আর রাজি না হয়েও উপায় নেই তার কথা বাবা শুনলেও সালিহা শুনবে না, চারুকে তাড়ানোর এত বড় সুযোগ কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না সে।
রিহান মেয়ের কথা শুনে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছেন। মেয়েটা যেন কেমন একটা হয়ে গিয়েছে। আগের মত উচ্ছলতা চঞ্চলতা নেই ওর মাঝে।
রিহান সবকিছু বুঝতে পারেন কিন্তু হুট করে সবকিছু যেন কেমন উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে।
আচ্ছা তিনি নিজে নিজের মেয়ের সর্বনাশ করলেন না তো? রেণু তো কতবার চারুকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। তিনি কিছুতেই যেতে দেননি। চারুর ইচ্ছে থাকলেও বাবার অমত দেখে সেও আর কিছু বলেনি।
রিহানের আজকাল মনে হয় তিনিই দায়ী মেয়ের কষ্টের জন্য, এবাড়িতে মেয়ের প্রতিরক্ষা দিতে পারছেন না আবার রেণুর বা চারুর নানাবাড়িতে পাঠিয়েও শান্তি পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে একটা অযাচিত জেদই হয়তো করে ফেলেছেন।
রিহান বুঝেও কিছু করতে পারেন না তিনি সালিহাকে কিছু গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাই ভাবলেন চারুর বিয়ে দেওয়াই ভাল কাজ হবে। তবে এবার চারুকে রেখে কি করে থাকবেন তা ভাবেননি, তার মনে হয় আর কিছুই করার নেই।
যার সাথে চারুর বিয়ের কথা ভাবছেন তিনি তারই এক কলিগের দূর সম্পর্কের আত্মীয় সাথে। ছেলেটা যথেষ্ট বড় লোক, শিক্ষিত তবে চারুর থেকে বয়স একটু বেশিই হবে তবে রিহানের মনে হয় যে খুব বেশি অসুবিধা হবে না।
বাবার কাছ থেকে চলে এসে এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চারু। আজ তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। কেন কেড়ে নিল আল্লাহ আমার মা কে! কি দোষ ছিল আমার! ভাবতে ভাবতে দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চারুর। অনেকদিন পর কাঁদছে সে এখন বড্ড মনে হচ্ছে কেউ যদি তার মাথায় একটু হাত রাখত।
-আপু শোন?
নিধির ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় চারু।
-কি হয়েছে বল।
-এই ছবিটা দেখতে বলেছে বাবা।
ছবিটা চারুর হাতে গুজে দিয়েই নিধি চলে যায় নিজের কাজে। বোনের চোখের পানি খেয়াল করা হয় না তার। কৌতুহলী হয়েই ছবির খাম টা হাতে নিল চারু কাঁপা কাঁপা হাতে খাম থেকে ছবিটা বের করে মোটামুটি একটা ধাক্কা খায় চারু, মোটামুটি হ্যান্ডসাম একটা ছেলে অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বয়সটা বেশি হলেও সেটা আন্দাজ করার উপায় নেই ছবি দেখে।
ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে নিল ছেলেটা দেখতে খারাপ নয় বরং মোটামুটি বেশ ভালো চারুর মনে আঁকা ছবিটার মতো প্রায়। আগেই বলেছি ধর্মীয় বিধি নিষেধ আর ধর্মীয় জ্ঞান ওর মাঝে শিথিল হয়ে এসেছিল, কিছুটা উন্নাসিক মন মানসিকতার হয়ে গিয়েছে যার তথাকথিত আধুনিক যাকে বলে। তাই শুধু ছবি দেখেই অত্যাধুনিক ছেলেটাকে পছন্দ হয়ে যাবে এটা আর এমন কি!
সৎমায়ের থেকে বেঁচে নতুন জীবনে যাওয়ার জন্য হোক বা বাবার কথা মেনে নেওয়ার জন্য হোক চারু বিয়েতে সাগ্রহে রাজি হয়ে যায়।
এরপরের ঘটনা খুবই সাধারণ, অনাড়ম্বরে চারুর বিয়েটা হয়ে গেল আবু তাহেরের সাথে। রিহানের ইচ্ছে ছিল খুব জাঁকজমকভাবে না হলেও মোটামুটি ভাবে দেওয়ার মেয়ের বিয়ে দিবেন, কিন্তু সালিহার সাথে পেরে ওঠা তার জন্য শুধু মুশকিল ছিল না বরং একেবারে অসাধ্য ছিল।
তবে বিয়েটা যতটা সহজ ভাবে সম্পন্ন হয়, আবু তাহেরের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস রক্ষা করতে চারুর ওয়ালিমা ততটাই আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়।

বাসররাতে তাহেরের প্রথম কথা ছিল,
-তোমাকে আমার মায়ের কথা মেনে চলতে হবে, আমি আমার মাকে ভালবাসি তাই উনি যাই বলুন না কেন আমার কাছে তাই সঠিক, আর এটা যত বেশি মেনে নিতে পারবে আমার থেকে ভালবাসাও তত বেশি পাবে।
চারু কিছুটা অবাক হয়ে তাকায় তাহেরের দিকে। কি বলে লোকটা! একটা মানুষ ভুল করলেও অন্ধভাবে মেনে নিতে হবে? নতুন বউ হয়ে সংকোচে আর জানতে চাওয়া হয়না ওর।
চারুর নিরবতা দেখে আবু তাহের আবার বলে,
-নামাজ পড়তে হয় তো তাই না?
-মনে হয়, আমি ঠিক জানিনা।
মৃদুস্বরে উত্তর দেয় চারু। তাহের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে চারুর দিকে। ভেবেছিল সে না জানলেও চারু ঠিকঠাক জানবে।
তাহেরের চাহনিতে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় চারু, কিন্তু ওর ও কোনো ধারণা নেই।
অগত্যা ধারণার বশে দুজন কোনোভাবে নামাজ শেষ করে।
নামাজ শেষে তাহের একটা ডায়ামন্ডের খুব একটা রিং এগিয়ে দেয় চারুর দিকে। বিস্ময়ে চারু তাকিয়ে থাকে তাহেরের দিকে। চারুর বিস্ময়পূর্ন চাহনি খুব ভাল লাগে তাহেরের। মুচকি হেসে চারুর হাত টেনে নিয়ে রিংটা পরিয়ে দেয় ওর হাতে। চারু আর তাহের থাকুক কিছুটা সময় নিজেদের মতো। ততক্ষণে জেনে আসা যাক তাহেরের সম্পর্কে কিছু কথা,
তাহের বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, বাবা গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। মা মাহিমা আর তাহেরের ছোট সংসার। ব্যবসায়ী শিক্ষা নিয়ে মাস্টার্স করা তাহেরের চাকরির জন্য ধন্না দিতে হয়নি কোথাও, লেখাপড়া করেই বাবার বিরাট ব্যবসার হাল ধরেছে।
আমাদের সমাজে কিছু কিছু নারী আছেন যারা ছেলের বিয়ে দিয়েও ছেলের হাতটা ছাড়তে ভয় পান, ছেলে যদি বউয়ের হয়ে যায়, যদি বউয়ের আঁচল না ছাড়ে। আসলে বিষয়টা তেমন না, এখানে সবার আগে ব্যক্তিত্বের প্রশ্ন আসে। আঁচল ধরা ছেলে আঁচল ধরবেই, মায়ের, স্ত্রী বা প্রেমিকার। স্ত্রী আর মায়ের মাঝে যারা সমতা করতে পারে তারাই প্রকৃত পুরুষ। কারণ একটা পুরুষ মায়ের সাথে সম্পর্ক হলো নাড়ীর, আর সম্মানের সম্পর্ক। আর স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক হলো প্রতিশ্রুতির, আত্মার সম্পর্ক… একজন সত্যিকারের পুরুষ কোনোটাকেই অবহেলা করতে পারবে না।
মাহিমা ছিলেন ছেলেকে নিয়ে সন্দিহান, এই বুঝি ছেলে তার অবাধ্য হলো। কারণ ছোট থেকে ছেলে তাই করেছে তিনি যা বলেছেন, ভুল বা সঠিক নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস ছেলেকে দেননি।
ছেলের বিয়ে দিতে নিজের মনকে জোর করে রাজি করালেও ছেলেকে হাতছাড়া করতে একেবারেই রাজি নন তিনি।
এ বাড়িতে চারুর একটাই সুবিধা তাকে তেমন কোনো কাজ করতে হয় না। কাজের লোকেরাই সব করে। চারু সালিহার আদেশে কাজ করতে গিয়ে মোটামুটি কাজ শিখে নিয়েছে, কিন্তু এখানে এসে দেখে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ম সব ভিন্ন। সে না পারলে কাজের লোক আছে তাই প্রথম প্রথম কাজ শিখতে চারুর একটু সুবিধা হয় বইকি!
সালিহা মোটামুটি রান্নাবান্না করার দরকার তাই করত, কিন্তু চারু খেয়াল করেছে এবাড়ির কেউ রান্না খারাপ হলে তা খেতে পারে না, একেবারে ফেলেই দেয়।
তাহের মাঝে মাঝে চায় খাওয়ার সময় চারু একটু পাশে থাকুক। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই হয়ে ওঠে না চারুর শাশুড়ী মাহিমার জন্য।
চারু আসতে গেলেই তিনি কোনো না কোনো কারণে চারুকে কাজে পাঠিয়ে দিবেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারু আবার শাশুড়ী দেখানো কাজে হাত লাগায়। তাহের খেয়াল করে কিন্তু মায়ের উপর কথা বলার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই।
লেখাপড়ার প্রতি তাহেরের একটা আলাদা আগ্রহ ছিল, তাই চারুকে স্থানীয় কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়, মাহিমার আগ্রহ না থাকলেও এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে চান না, একটা বাচ্চা হয়ে গেলে তো আর তিনি বাড়ির বউকে বাইরে যেতে দিবেন না। তাই আপাতত চুপ থাকেন।
অন্যান্য কারণে মন খারাপ হলেও তাই এই একটা কারণে চারু খুবই খুশি হয়। এছাড়া তাহেরের সাথে ওর বোঝাপড়াটা বেশ ভাল, একারণে শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না চারুর।
.

-ওই ছেলেটাকেই আমার চাই!
জেদি দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকালো তিন্নি।
-আরে বাদ দে তো! কে না কোন ছেলে! এসব প্রেমের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে!
তিন্নিকে থামানোর চেষ্টা করে তিন্নির বান্ধবী রাফিয়া। কিন্তু ফলাফল হয় উলটো, তিন্নির জেদ আরো বেড়ে যায়। যেখানে এত ছেলে তার পাণিপ্রার্থী, সেখানে এই ছেলে তাকে অবহেলা করছে! আতিফকে তাই চাইই চাই!
নিজের মনে আওড়াতে আওড়াতে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এল। বারান্দায় কয়েকটি ছেলেদের সাথে আতিফ ও দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে সোজা নিজের গাড়িতে উঠলো তিন্নি। পিছন থেকে বারবার ডাকছে রাফিয়া, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওর।
-আমার কথাটা তো শোন!
-আমার কোনো কথা শোনার মুড নেই, বাড়িতে যাবি তুই? গেলে গাড়িতে ওঠ, আর হ্যাঁ মুখে একদম স্কচটেপ লাগিয়ে রাখবি!
তিন্নির কথা শুনে রাফিয়া চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। আপাতত এই মেয়েকে আর কিছুই বলা যাবে না জানে সে।
তিন্নি অবশ্য খেয়াল করেনি তার চলে যাওয়া বেশ ভালভাবেই লক্ষ্য করেছে আতিফের কৌতুহল চোখ জোড়া। চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল আতিফের। তবে সেটা কিসের জন্য তা বোঝা গেল না।

(আসছে নতুন চরিত্র… গল্প কেমন লাগছে জানাবেন। গল্পের আর একদুই পর্ব টাইমলাইনে দিবো হয়তো, বাকি পর্ব গ্রুপে দেওয়া হবে। গল্প পড়তে চাইলে গ্রুপে জয়েন করবেন। গ্রুপে গল্প দেওয়ার কারণ আর গ্রুপ লিংক আমার আগের পোস্টে পাবেন। হ্যাপি রিডিং। জাযাকাল্লাহ খায়রান- নাঈমা বিনতে আয়েশা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here