আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️পর্ব-৩৫

0
661

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৫

গাড়ি একটা জায়গায় থেমে গেছে ব্যাপারটা বুঝতেই চোখ খুলে মায়া।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাসায় এসে পৌঁছেছে তারা।আরিয়ান নেমে গিয়ে তার পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
মায়া এক পা বাড়িয়ে মুচকি হেসে তার হাত ধরার আগেই তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খায়।
আরিয়ান দ্রুতহাতে তার কোমড় পেচিয়ে ধরে বলে,
—“হোয়াট হেপেন্ড?খারাপ লাগছে?”

মায়া দুবার পিটপিট করে পলক ফেলে।নিজেকে সামলে নিয়ে মিহি স্বরে বলে,

—“নাহ্,ঠিক আছি।মিসব্যালেন্সড্ হয়ে গিয়েছিলাম।”

আরিয়ানের কুঁচকানো কপালটা স্বাভাবিক হয়।ভ্রু জোড়া স্হির করে সে মায়াকে সোজা করে দাড় করায়।গাড়ির দরজা আটকে দিয়ে একবার নিজের ফোনে চোখ বুলিয়ে মায়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে।ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছে কয়েকজন।
মায়া সেদিকে একবার তাকায়।অত:পর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে।যত তারাতারি সম্ভব শাওয়ার নিয়ে নিচে নামবে সে।যদিও সন্ধ্যার দিকেও অফিসে খাবার আনিয়ে দিয়েছিলো আরিয়ান।তবুও প্রচন্ড খুদা পেয়েছে।একদম সহ্য হচ্ছে না।
।।
পাশের রুমের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে আসে আরিয়ান।মায়াও শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে তখন।তার পরণে হাঁটু অবধি সাদা রংয়ের ফ্রক,সাদা পায়জামা,সাদা ওড়না।পরিপূর্ণ সাদা শুভ্রময়ী রুপ।আধভেজা চুলগুলো থেকে ঝড়ঝড় করে পানি পরছে।
চুলে তোয়ালে পেচিয়ে সে আরিয়ানকে দ্রুত বলে,
—“চলুন,খেতে চলুন।”

আরিয়ান শপিং ব্যাগগুলো কাবার্ডে রাখতে রাখতে একবার তাকিয়ে বলে,
—“চুলটা মুছে নাও।তারপর যাই।”

—“চুল মোছা লাগবেনা।আমার ক্ষুদা লেগেছে।আপনি আসেনতো।”বলে দরজার দিকে যেতে উদ্যত হয় সে।

আরিয়ান ভ্রু কুচকে তাকায়।মেয়েটার হঠাৎ এতো ক্ষুধা কেন লাগলো।এভাবে ভেজা চুলে থাকলে নির্ঘাত ঠান্ডা জ্বর হয়ে অসুস্থ হবে।
আরিয়ান ঘুরে গিয়ে তার হাত টেনে বিছানায় বসায়।পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে নিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বলে,
—“আরে বাবা,ঠান্ডা লেগে যাবেতো।পাঁচটা মিনিট দাও,মুছে দেই।তারপর যাচ্ছি”

মায়া বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।পাঁচমিনিট শেষ হলেই আরিয়ান তোয়ালে পাশে রেখে দেয়।চুলগুলো হাত দিয়ে সারা পিঠে সুন্দরমতো ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
—“চলো,বাকিটা এমনিই শুকিয়ে যাবে।’

খাবার টেবিলে বসে আছে ইতি,তন্ময়।আরিয়ান,মায়া নিচে নেমে তাদের সাথে বসলে খেতে শুরু করলো তারা।মায়া মাঝেমধ্য এটা ওটা বলছে।তন্ময়কে কোথায় গিয়েছিলো কি করেছে এসব জিজ্ঞেস করছে।তন্ময়ও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে সুন্দরভাবে সবকিছুর উওর দিচ্ছে।


খাওয়া দাওয়া শেষ।তন্ময়,ইতি যার যার রুমে চলে গিয়েছে।মায়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচরাচ্ছে।ঘড়িতে বারোটা বেজে যাচ্ছে।ঘুমানোর জন্য আগেই বিছানা গুছিয়ে রেখেছে সে।কানে ফোন নিয়ে একটু আগে ব্যালকনিতে গিয়েছে আরিয়ান।হয়তো জরুরি কোনো ফোন!

হঠাৎই রুমে এসে মায়াকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় আরিয়ান।হাতের চিরুনিটা ফ্লোরে পরে যায়।
মায়া তার গলা জড়িয়ে ধরে আৎকে উঠে বলে,
—“কি করছেন?”

আরিয়ান উওরে স্মিত হাসে।মায়াকে কোলে নিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।সিড়িঘর অনেকটাই অন্ধকার।মায়াকে কোলে করে ছাদের দিকে উঠতে নিলেই মায়া বিস্মিত কন্ঠে বলে,
—“এতরাতে ছাদে কি করবেন?অন্ধকারে পড়ে যাবোতো।”

আরিয়ান উঠতে উঠতেই বলে,
—“আমার কোল থেকে পড়ে যাবে তুমি?আর আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিব?”

বলতে বলতেই ছাদে এসে দাড়ায় তারা।ছাদ অন্ধকার।সুনসান নিরবতা।
মায়াকে কোল থেকে নামাতেই চারিদিকে সোনালী রংয়ের লাইট জ্বলে উঠে।মায়ার উপর আছড়ে পরে কতগুলো গোলাপের পাপড়ি।বিস্ময়ে থমকে যায় মায়া।দুহাতে মুখ চেপে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।পুরো ছাদ লালগোলাপ দিয়ে সাজানো।একটা কর্নার বেলুন দিয়ে ঘেরা।
আরিযান তাকে বাহু ধরে কাছে টেনে চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুইয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
—“হ্যাপি বার্থডে মায়াবতী”।

মায়া ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়।ইতি,তন্ময় বেরিয়ে আসছে।দুজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি।তারা দুজনই হাসিমুখে বলে,
—“হ্যাপি বার্থডে ম্যাম।”

মায়া মিষ্টি করে হাসে।তার মনেই ছিলোনা তার জন্মদিনের কথা।মূলত নিজের জন্মদিনটা তার কাছে খুব বেশি অপ্রিয়।কোনোকালেই জন্মদিন পালন করেনি সে।তাই এই দিনটা বিশেষভাবে কখনোই মনে থাকেনা তার।
কারণ এতদিন সে জানতো তার জন্মদিনের দিনই তার মা মারা গিয়েছে।তার বাবাতো তাকে এটাই বলেছিলো যে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।তাই এ দিনটা তার মায়ের মৃত্যুদিনও বটে।সেজন্যই এ দিনটার উপর বিতৃষ্ণা ছিল তার।বরং জন্মদিনটা অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে একটু মন খারাপেই কাটতো তার।
তবে এখন সে জানে তার মা কে তার বাবা মেরেছে।সে তার জন্মদিনের দিন মারা যায়নি।তার মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী না।
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে পরে মায়ার।আরিয়ান খুব সন্তর্পনে তার চোখের জলটা মুছিয়ে দিতে বলে,
—“আমি জানি তুমি কখনো এ দিনটা কখনো সেলিব্রেট করোনি।আর তার পিছে ছিলো একটা মিথ্যে কারণ।
যেটা তুমি জানো।তাই,এখন আর মন খারাপ করোনা।বারোটা বেঁজে গেছে।চলো কেক কাটি।”

মায়া নিজেই চোখদুটো ভালো করে মুছে নেয়।হেসে বলে,
—“আপনি এমন কেন?সবসময় মন ভালো করে দেন।”

বেলুন ঘেরা জায়গাটায় কেক কাটার টেবিল রাখা।টেবিলের চারপাশে বেলুন দেয়া।পিছে ফোলা ফোলা বেলুনে ইংলিশ অক্ষরে “Happy Birthday Maya” লেখা।কেকের উপরেও একই লেখা।আরিয়ান তাকে কারো সামনে”মায়াবতী”ডাকেনা।যখন তারা একান্তে থাকে তখনই মায়াবতী ডাকে।তাই হয়তো এখানে “মায়াবতী” লেখেনি।তার কন্ঠ থেকে “মায়াবতী” ডাকটা একমাত্র মায়াই শুনেছে।

মায়া কেক কাটে।সর্বপ্রথম আরিয়ানকে খাইয়ে দেয়।আরিয়ান তখন একহাতে মায়ার এলো চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিচ্ছিলো।মায়ার মুখে উজ্জল হাসি।সে অবস্থাতেই ছবি তুলে তন্ময়।ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায় একটা স্বৃতি।আশেপাশে সবকিছু লাল রং দিয়ে সাজানো।তার মাঝে সাদা জামা পরিহিত মায়াকে যেন একটা শুভ্রপরী লাগছে।
ইতিকে খাইয়ে তন্ময়কে ডাকে মায়া,
—“তন্ময় ভাইয়া,আসেন।ইতি যাওতো তুমি ছবি তুলে দাও।”

তন্ময় ইতস্তত কন্ঠে বলে,
—” না না ম্যাম।আমাকে খাইয়ে দেয়া লাগবেনা।”

আরিয়ান ধমকে উঠে বলে,
—“কেন?তুই কি পর কেও?আয় জলদি।”

তন্ময় ইতির দিকে ক্যামেরা এগিয়ে দেয়।মায়া মুচকি হেসে এক টুকরো কেক তুলে দেয় তার মুখে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার,জ্যাক আর জেনিও বসে আছে মায়ার পায়ের কাছে।আফটার অল,তারাও পরিবারের একটা অংশ।কিন্তু তাদের কেক খাওয়ানো যাবেনা।কেকের ক্রিমে পেট খারাপ করবে।নয়তো তাদেরও কেক দিতো মায়া।আরিয়ান বারণ করায় আর দেয়নি।

______________
রাত প্রায় ১টা বাজে নিচে নেমেছে তারা।মায়ার চোখেমুখে খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।হাত ধুয়ে মাত্র বিছানায় বসেছে।তখনই আরিয়ান কাবার্ড থেকে কিছু বের করে নিয়ে আসে।তার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসে মায়ার পায়েল পরানো পা টা টেনে নিজের পায়ের উপর রাখতেই মায়া ভ্রু কুচকে বলে,
—“কি হয়েছে?পায়ে তো কিছু হয়নি।”

আরিয়ান হাতের মুঠো থেকে সেই লাল রুবি পাথরের পায়েলটা বের করে বলে,
—“তোমার জন্মদিনের উপহার।আমি জানি এটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছিল।”

মায়া মূহূর্তেই চুপ হয়ে যায়।এতক্ষনের উজ্জল চেহারাটা নিমিষেই কালো মেঘে ছেঁয়ে যায়।দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে কাতরকন্ঠে সে বলে,
-–-“আমার পায়েলটা খুলবেননা প্লিজ।ওটা বাবা দিয়েছিলো।”

আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মায়ার পায়জামাটা একটু তুলে পায়েলটার দিকে তাকায়।সাথে পাথরের সুন্দর একটা পায়েল।যেদিন এটা মায়াকে পরিয়ে দিয়েছিলো তখন থেকে আজ অবধি মায়াকে একবারের জন্যও এটা খুলতে দেখেনি সে।এমনকি শাওয়ার শেষে মেয়েটা কাপড় দিয়ে রোজ পায়েলটা মুছে।যেন সেটা ভিজে না থাকে।পায়েলটা যে মায়ার জন্য খুব স্পেশাল সেটাও আরিয়ান জানে।রাশেদ চৌধুরি দিয়েছিলো বলেই হয়তো এটাকে এতো ভালোবাসে মায়া।

দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে আরিয়ান।মায়ার কাতর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—“এটা আমি কখনোই খুলবোনা মায়াবতী।তোমার বাবার স্বৃতি তোমার থেকে নিয়ে নেয়ার অধিকার আমার নেই।আর থাকলেও আমি সেই অধিকার ফলাবো না।আমি জানি তোমার বাবাকে তুমি কতটা ভালোবাসো।শত হলেও তোমার বাবা।তোমার বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।তাই এই পায়েলটা খোলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।আমি শুধু এই ভালোবাসাটার সাথেই তোমাকে আমার ভালবাসাটাও পরিয়ে দিতে চাই।মে আই?”

মায়া ছলছল নয়নে তাকায়।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই আরিয়ান ওই পায়েলটার সাথেই লাল পায়েলটা পরিয়ে দেয়।সাদা পাথর আর লাল পাথরটা মিলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে পা টা।
আরিয়ান তার পা টা নামিয়ে উঠে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
—“তুমি কি ভেবেছিলে?তোমার বাবার কথা শুনলে আমি রাগ করবো?”

মায়া উপর নিচে মাথা নাড়ায়।আরিয়ান বলে,
—“তোমাকে কখনো শত্রুতার মাঝে টেনে এনেছি আমি?”
মায়া ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“না”।

আরিয়ান হেসে বলে,
—“আমাদের সম্পর্টার মাঝে যাতে কখনো তোমার বাবা আর আমার সম্পর্কটা না আসে।তোমার সাথে আমার ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন।সবকিছু থেকে আলাদা।বুঝেছো?”

—“হু”।

মায়া আর কিছু বলেনা।আরিয়ান তার বাবার মৃত্যুর কারণ এটা সে কখনোই ভাবেনা।সে মানে তার বাবা তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে এবং সেটা আরিয়ানের দ্বারা।কিন্তু এসবকিছুর উর্ধে তার ভালবাসা।তার জীবনে সে দুজন মানুষকেই প্রচন্ড ভালোবাসে তারা হলো তার বাবা আর আরিয়ান।কোন কারণে কখনোই এদের ঘৃণা করেনি সে।আর না কখনো করবে।

_______________
গভীর রাত…
ঘুম ভেঙে যায় মায়ার।আরিয়ান তাকে বুকে জাপটে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মায়া জড়ানো কন্ঠেই তাকে ডাকে,
—“একটু উঠবেন?”

মায়ার প্রথম ডাকেই ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ভ্রু কুচকে সে বলে,
—“কি হয়েছে?খারাপ সপ্ন দেখেছো?”

—“উহু”।

—“তবে?ঘুম ভেঙেছে কেন?”

মায়া এবার আরিয়ানের হাত সরিয়ে উঠে বসে।ঘাড় ঘুড়িয়ে আরিয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
—“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here