দাম্পত্য সুখ(৫ম পর্ব)

0
202

#দাম্পত্য সুখ(৫ম পর্ব)
#লাকি রশীদ

আমার ছোট ভাই জোহা শব্দ শুনে উঠে এসেছে। বিস্মিত কন্ঠে বলল,”আজ তো অষ্টম আশ্চর্য্য হয়ে গেল ছোটপা। তুমি কি করে এলে এখানে? আমি তো ভাবছি, তোমাকে তোমার বর ছাড়লো ক্যামনে”? আমি হেসে বলি,”ছাড়তে কি আর চায়
রে? অন্য এক ঘটে যাওয়া ঘটনায়,এই ছুটি দিয়েছে”। বলে গেট টুগেদার পার্টির কথা বললাম
জোহা ফুঁসছে,”তুমি শেষ পর্যন্ত গেলে না কেন”?
আমি বলি,”গেলে আমার ১৮ বছরের কষ্ট জলে
ভেসে যেতো রে। এসব অশান্তির মাঝে, ছেলেরা পড়তো কিভাবে বল্? এদের কে ছোট থেকে স্কুল,
হোম ওয়ার্ক,টিউশন,স্যারের বাসা…..এসব করে করে এতদূর এনেছি মাশাআল্লাহ। এখন তীরে এসে তরী ডুবলে, আমার ই তো ক্ষতি বল? তাই,
যাইনি”।

জোহা এবার বলে,”তাহলে কি শাহীন সাহেব সারা জীবন, বাচ্চাদের বদৌলতে এভাবে গা বাঁচিয়ে চলবে না কি”? আমি বলি,”না, উনাকে এতোটাও
ছাড় দেয়া উচিত হবে না। একটা কথা আছে না,
“অতিরিক্ত কিছু ই ভালো নয়”। এরা মা ছেলে মিলে একদম অতিরিক্ত করে ফেলেছে। পরীক্ষা টা শেষ হোক, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু,যা ই করি না কেন, সংসার ছেড়ে পালাবো না। এতো বছরের, এতো কষ্টের সংসার আমার”।

জোহা বলে,”এদের হালকা ঝাঁকুনি তে হবে না। বেশ বড় একটা ঝাঁকুনি দরকার”। মা এবার জোহা
কে ধমকে উঠে,”হয়েছে, তুমি আর ধোঁয়া তুলো না”। বাবা এবার কেঁদে কেঁদে বলছে,”আমি তো বুঝেছি সংসারে শশুর আর শাশুড়ি সব মিলিয়ে ৪ জন মানুষ মাত্র। আমার মেয়ে কতো সুখে থাকবে। এরা যে আমার মেয়ের উপর এভাবে ষ্টীম
রোলার চালাবে…. আমার কল্পনায়ও ছিল না”। আমি এবার বলি,”কেঁদো না তো বাবা, তুমি কি করবে, এটা হবার ই ছিল। যাইহোক,এসব মন খারাপ করা বাদ দাও তো”। মা এরমধ্যে একবার
কিচেনে গিয়েছিল। এসে বলছে,”এ কি রে? আমরা রাহির বাবাকে কখনো কিছু ই দিতে পারি না। সে ৬ পদের এতো তরকারি দিয়েছে কেন? কি
লজ্জা বলো তো”? আমি বলি,”সে ভালোবেসে দিয়েছে,খাও”।

বাবা এবার বলল,”হৃদয়ের কৃতজ্ঞতায় দিয়েছে বলো। হয়তো বা মনে হয়েছে, এতো ভালো একটা
মেয়ে যারা জন্ম দিয়েছে, তাদের প্রতি এ ভালবাসা
টুকু দেখানো উচিত”। আমি বলি,”আসলেই তা ই
বাবা। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে এমন একেকটা কান্ড
করেন…. অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এবারের পার্টিতে
হঠাৎ করে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে শুনি ভদ্রমহিলা উনার অফিসের ডিএমডি। শাহীনও বেশ অবাক দেখলাম। বারবার বলছে,”এরা কতো পাওয়ারফুল তুমি জানো না”। বাবা বলল,”আমি নিজেও প্রাউড ফিল করি মা, তোকে নিয়ে। নিজের ছেলেমেয়ে কে সবাই অনেক
ভালবাসে কিন্তু পরের বাচ্চাকে কতোজন নিজের
মতো ভালবাসতে পারে। বাচ্চাদের আমরা অবুঝ বুঝি, কিন্তু বাচ্চারা বড়দের ভান সবচেয়ে আগে বূঝতে পারে, কোন টা আসল ভালবাসা সেটাও বুঝে”।

মা উঠে কিচেনে যাচ্ছিল বললাম,”মা দয়া করে তুমি খাওয়া-দাওয়ার যন্ত্রণায় যেও না। আনুর মা
যা পারে করুক। আজকে সবাই মিলে গল্প করবো শুধু। জোহার কি নাইট ডিউটি না কি”। বলল,”হ্যা,
রাত ৮ টা থেকে সকাল ৮ টা। সন্ধ্যা ৭ টায় বের হয়ে যাই”। আমাকে বিস্মিত করে, আমার সব প্রিয় নাস্তা দিয়ে ভরা ট্রে নিয়ে মা হাজির। বিন্নি চাল, নারকেল ও চিনি দিয়ে আমাদের এখানে একটা পিঠা হয়, স্থানীয় ভাষায় আমরা তাকে
“খাজুরি পিঠা”বলি। পিঠার আকৃতি অনেক টা খেজুরের মতো বলে, হয়তো এটার এই নাম দেয়া
হয়েছে।

বিয়ের আগে কিছুদিন পর পর আমি এই পিঠা
বানানোর আবদার করে করে, মাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতাম। নুডুলস পাগলা আমার জন্য ২ ধরণের নুডলস,পাস্তা,নুনের পিঠা আসছে। তখন আমার চোখ জ্বালা করছে। পোড়া চোখে পানি তো নেই, কিন্তু বুকে ঝড় ঠিক ই আছে। মা বলল,
“ভালো হয়েছিল কাল দিনে জানিয়েছিলি। নয়তো তোর প্রিয় কিছু ই ভালো করে খাওয়াতে পারতাম না। সারারাত তোর বাবা শুধু অস্থিরতা করেছে। তোর আসা ঠিক থাকবে তো,সে চিন্তা করে। তোর সব প্রিয় খাবার এখানে,পেট ভরে খেয়ে চা খা”।

আমি মনে মনে হাসছি আর ভাবছি, আমার প্রিয়
খাবার কি কি, সেটা তো আমি নিজেই ভুলে গেছি। সবার মুখে প্রিয় ও পছন্দসই খাবার তুলে দিতে দিতে, নিজের টা ই বিস্মৃত হয়ে গেছে। আর
আমাকে কেউ বলেও না, “এই নাও, তোমার প্রিয়
খাবার এনেছি”। খাবারে হাত দেয়ার আগে, বাবার
ফতুয়া টা খুলে দিয়ে বলি,”এবার শান্তি মতো বসে
আমাদের সাথে নাস্তা করো”। আমি খাচ্ছি, প্লেট খালি হবার আগেই, মা বাবা নতুন করে তুলে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, “রাহমানির রাহিম !!! তুমি আমরা মেয়েদের জন্য,এরকম বিশ্রামাগার রেখো যাতে অঙ্গারের উপর হেটে এসে ৬ মাসে,৯ মাসে অন্তত কিছুটা সময় শান্তি পেতে পারি”।

বাবা চা খেতে খেতে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করছে,”এতো কাজে চরকির মতো সারাটা সময় ঘুরিস, ঘুম ঠিক মতো হয় তো মা”? মাথা নেড়ে বলি,”হ্যা বাবা ঠিকমতো হয়”। বাবা বলে যাচ্ছে,
“জানিস তো রাত ১০ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত এই ৪
ঘন্টা, ঘুমানোর জন্য বেষ্ট সময়। এর আগে তুই খেয়াল করে বিছানায় যাবি”। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছি আর মনে মনে হাসছি। কিন্তু, কিছু বলে শুধু শুধু বাবার কষ্ট টা বাড়িয়ে লাভ কি”?

জোহা বললো,”চলো ছোটপা বড়চাচা কে দেখে আসি। বললাম,”কিছু তো আনি নাই,খালি হাতে যাই কি করে”? জোহা বললো,”পরে বাইরে গেলে
আনবো না হয়”। আমি বলি,”ধ্যাত তা আবার হয় নাকি”? হঠাৎ মনে হলো, বড়চাচা আইসক্রিমের জন্য পাগল, উনার এতো ভালো লাগে এটা। বলি,
“জোহা পাড়ার দোকানে আইসক্রিম এর বক্স পাওয়া যাবে”? সে মাথা নাড়তেই দুজনে বাবা মা কে বলে বেরিয়ে পড়লাম।

জোহা বললো,”তুমি জানো না কি ছোটপা, আপা
দুই মাস পরে এসে, মাসখানেক থাকবে। তুমি আগে থেকে বলে দেখো না তোমার বর কে,যেন
এসময় তোমাকে এখানে আসতে দেয়”। আমি হা
হা করে হেসে বলি,” আজকে একটা দিন সংসারে
কাটাচ্ছে…. গিয়ে শুনবো কতো কতো অভিযোগ।
আর এতো দিন বললে তো সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাবে”। ২ লিটারের আইক্রিমের একটা বক্স কিনে,
জোহাকে বলি,”তুই একটা কিছু কিনে নে না ভাই”। সে বড় দেখে একটা চকলেট নিল। আমার মনে হলো, আমি যেন সেই স্কুল জীবনের দুই বেণী
ওয়ালা নদী। মনে হচ্ছে চোখ বুজে, এই মুহূর্তে সেই সময় টা শুধু উপভোগ করতে থাকি।

বড়চাচার ঘরে ঢুকতেই শোনা যাচ্ছে উনি চেঁচিয়ে
বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছেন,”আমাকে কেন এসব অখাদ্য,কুখাদ্য খাওয়াচ্ছ শূনি?আমি মরে গেলেই
তুমি তো স্বাধীন হয়ে,টো টো কোম্পানির মতো শুধু ঘুরতে পারবা….. সেজন্য”? বড়চাচি কোনো কথা না বলে,হালছাড়া ভঙ্গিতে পাশের চেয়ারে বসে আছেন। আমাদের দেখে দুজনেই খুব খুশি।
জোহা চাচা কে বকছে,”আজকে আবার তুমি চাচিকে খাবার নিয়ে জ্বালাচ্ছো”? চাচা আত্মপক্ষ সমর্থন করছে,”দেখ্না পেঁপে ভাজি এনেছে রুটি
দিয়ে খাবো বলে। পৃথিবীতে কি আর সব সব্জি
নাই হয়ে গেছে না কি?এসব আমাকে খাইয়ে মেরে
ফেলতে চায়। আমি বলি,”তা কত বছর ধরে চাচি
তোমার সাথে আছে”? হিসাব করে বললেন,”৫১
বছর ধরে”। আমি বলি,”এতো দিন যখন মারেননি
তাহলে, এখনো মারবেন না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো”।

আইসক্রিম দেখে বাচ্চাদের মতো খুশি। জোহা চাচিকে বললো,”তোমরা ভেতরে গিয়ে গল্প করো,
আমি চাচাকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছি”। বাসনের ষ্ট্যান্ড থেকে দেখি বাটি নিচ্ছে। জোহার বড় চাচার
প্রতি, আলাদা একটা দুর্বলতা আছে। বড়চাচার ছেলে নাবিদ জোহার সমবয়সী ছিল,যে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। বড়চাচাও জোহার কথা বিনা তর্কে মানেন। চাচি আমাকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। বললেন,”যতো দিন যাচ্ছে,তোর
চাচার পাগলামি বাড়ছে রে মা। এখন এক জপ ই
জপছে, আমি না কি মেরে শান্তিতে থাকবো। সারা জীবন অশান্তিতে গেল, এখন শান্তি পেলেই বা কি লাভ হবে”? এটা সত্যি চাচি অনেক ধৈর্য্যশীলা, বাবা বলতো ধৈর্য্য দেখতে চাইলে, ভাবিকে দেখলে ই হবে।

আসলে চাচা কোনো দিন ই চাচিকে শান্তি দেন নি। বিয়ের পর থেকেই না কি,চাচিকে কোথাও যেতে দিতেন না। বাসায় এলেই চেঁচামেচি করতেন।এসব দেখে বিয়ের কিছুদিন পরে ই, উনি বাবার বাড়ি চলে যান। আর, আসবেন না সেটাই তার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার বাবা,”ভালো মানুষের মেয়েদের দুইবার বিয়ে হয় না” বলে চাচার কাছে
আবার দিয়ে গেছেন। সময়ের পরিক্রমায় ৫ টা বাচ্চাও হয়েছে, শুধু সুখটা ই অধরা রয়ে গেছে।

চাচি বলে যাচ্ছে,”তোর মার কপালে কতো সুখ দেখ্। আর আমার কপাল দেখ্। অথচ, তোর বাপ
চাচা তো একই মায়ের পেটের ভাই”। এটা সত্যি, আমার বাবার মতো রোমান্টিক পুরুষ খুব কমই আছে। বাবা দেশে, বিদেশে যখনি ঘুরতে গেছে, মা
কে সাথে নিয়ে গেছে। সবসময় বলতো,”ও তো ওর বাবা মা, পরিবার সবাই কে ছেড়ে আমার কাছে এসেছে, ওকে খুশি রাখা আমার কর্তব্য”।ট্যুরে গেলে একটা সুতি শাড়ি অন্তত আনতো।মার বেশিরভাগ শাড়ি ই বাবার কেনা। মা ই বলতো,
“আমার পছন্দ থেকে তোর বাবার পছন্দ অনেক ভালো”।

“এইমাত্র এতো কিছু খেয়ে এসেছি, আজকে আর খাবো না” বলতেই চাচি বড়ই এর আচারের এক বৈয়াম নিয়ে এসেছে। চামচ আর ১টা বাটি দিয়ে বলছে,”খা, এবার বানিয়েছি”। আমার চাচির দিকে তাকিয়ে এতো দুঃখ লেগেছে বললাম,”তুমি
একা না চাচি, তোমার মতো অনেকেই আছে। কি
অদ্ভুত এক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে মেয়েরা… না সইতে
পারছে না কইতে পারছে। একদল সুখী লোক আবার এদের দেখে বলে,”এসব মেয়েদের কি কোনো আত্মসম্মান নাই না কি”? এটা বুঝে না যে,
বাচ্চাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় ফেলতে অনেক
মা ই চায় না। আবার আরেক শ্রেণীর মেয়ে হচ্ছে আমার মতো। আত্মনির্ভরশীল নয় বলে,এ বৃত্ত থেকে বের হতে ই ভয় পায়। মনে হয় বাপের বাড়ি
গেলে, দুদিন পর হয়তো কথার জুতো ই জুটবে। তারচেয়ে, এখানেই বাস করে দেখি। চাচি এবার
দুঃখের হাসি হেসে বলে,”তাহলে আমাকে বলতো,
৫১ বছরে বদলালো টা কি”? দুই অসীম বেদনা বুকে রাখা নারী,দুজনে দুজনের হাত ধরে সেটাই
ভাবছি।

চাচার কাছে আরো কিছুক্ষণ বসে, ভাইবোন উঠে পড়ি। জোহা চাচিকে বলে,”মা বলে দিয়েছে আজ
কিছু না রাঁধার জন্য তোমাকে। রাহির বাবা অনেক
তরকারি পাঠিয়েছেন, আমি তোমাদের জন্য নিয়ে আসবো”। চাচা বাচ্চাদের মতো বলছে,”কিসের তরকারি রে, ভালো কিছু”? সৌভাগ্যক্রমে চাচার প্রেসার,ডায়বেটিস নেই। তাই, সবকিছু খেতে পারেন। জোহা আইটেম জানানোর জন্য আমার
দিকে তাকাতেই বলি,” টিক্কা, দেশী মুরগীর রোস্ট, মাটন রেজালা,বীফ কারি, বোয়াল মাছ ভুনা ও মুরগির হাড়গোড় দিয়ে মুগডাল”। চাচা এবার খুব খুশি হয়ে বললেন,”এই সজীবের মা, খুব ঝরঝরে
করে কাটারিভোগ চালের ভাত রাধো তো। আজ
কে খুব ভালো ভোজ হবে”।

রাস্তায় নেমে জোহা বলছে,”আমার চাচিকে দেখলে ই এতো দুঃখ লাগে ছোটপা। মাঝে মনে হয়েছিল,চাচা চাচি দুজনকে ই আমাদের বাসায় কয়েক দিন নিয়ে রাখি। বলতেই চাচি রাজি কিন্তু চাচা আর রাজি ই হলেন না। বাবা মাও একদিন এসে অনেক অনুরোধ করে গেল। তাও,আর কাজ হয়নি”। আমি বলি,”চাচা কখনো ই রাজি হবেন না। সঙ্গী খুশি থাক…. এটা অনেক মানুষ ই
চায় না”। জোহা ঠাট্টা করছে,”এটা কি তোমার জীবন থেকে নেয়া উপলব্ধি ছোটপা”? আমি বলি,
“আমার মূল সমস্যা হলো, শাহীন এক নম্বরের একটা স্বার্থপর মানুষ। শুধু নিজের চিন্তা, এরা শুধু নিজেকেই ভালবাসে। তার দ্বিগুণ স্বার্থপর হলো তার মা। আমাকে কিভাবে শুধু সারা দিন কাজ করানো যায়, কষ্ট দেয়া যায়…. এটা ভাবতে ভাবতে ই ভদ্রমহিলার দিন কাটে। ভালবাসা সবার
কপালে থাকে না রে ভাই”।

জোহা এবার বলে,”এসব দেখলে আমার সত্যি ই
ভয় লাগে ছোটপা। আমার তো প্রেম ট্রেম নেই। প্রেমের বিয়ে তেই এখন এতো সমস্যা,এরেনজ ম্যারেজ এ কি হবে”? আমি হেসে বলি,”চিন্তা করিস না। ভালো ই হবে ইনশাআল্লাহ”। বাসায় ঢুকে দেখি, বাবা গাছ থেকে অনেক গুলো ডাব ও নারকেল পাড়িয়েছে। একটা লোক কে টাকা দিয়ে
করাচ্ছে। এখন শুধু ডাকছে,”আয় মা, নারকেল দিয়ে মুড়ি খেয়ে যা”। আমি বলি,”এখন আর কিছু খেলে বমি করবো বাবা। এখানে এতো নাস্তা করে গেলাম, চাচির ওখানে আচার খেয়েছি…… আজ
কে খাওয়া বেশি হয়ে গেছে”। মা কি একটা কাজে এসেছে বারান্দায়……বলি,” আমি এখন ঘুমাবো। না উঠলে তোমরা লাঞ্চ করে ফেলো। অনেকদিন পর নিজের রুমে ঘুমাতে যাই”। বাবা মা কে বলে,
“সবাইকে সাবধান করে দাও, কোনো শব্দ যেন না
করে। আমার মেয়ে আরাম করে যেন ঘুমোয়”।

আমার রুমটা পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। ফুলদানি তে ফ্রেশ ফুলও আছে। মা মনে হয়,
আজকে সকালে এনে রেখেছে। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। বাসায় কি যে হচ্ছে, আল্লাহ মালুম। একটা ফোন দিয়ে দেখবো না কি? থাক, একটা দিন ই তো। মা বেটা চালিয়ে দেখুন না, কেমন লাগে। প্রথমেই মোবাইল সাইলেন্ট মুডে
দেই। দিয়ে শুয়ে পড়ে ভাবছি, এই রুমের কতো স্মৃতি যে আছে। পাশের বাড়ির মিঠু ভাই ক্লাশ নাইনে থাকতে, স্কুল থেকে ফেরার পথে জোর করে হাতে চিঠি গুঁজে দিয়ে ছিল। আমি আমার রুমে এসে ব্যাগটা রেখেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিঠি টা পড়ছি। অনেক রং এর কালিতে প্রথমে শুধু অনেক গুলো হৃদয় ই আঁকা ছিল। প্রথম প্রেমপত্র
পড়ার উত্তেজনায়, খেয়াল ই ছিল না রুম লক্ করিনি।

মা মনে হয়,ডাল রাঁধছিল, হাতে ঘুটনি নিয়ে ই টান
মেরে চিঠি টা নিয়ে যায়। আমার মনে আছে, প্রথম প্যারায় অসংখ্য বার “প্রিয়া” লিখা ছিল। যমদূতের মতো কঠিন চেহারা বানিয়ে, মা প্রথম প্যারা পড়েই আমাকে সে কি মার !!! মারছে আর বলছে,,”প্রিয়া হবার শখ জেগেছে? তাহলে আর পড়াবো কেন? প্রিয়াই হ”। যতো বলি,”আমি কি করবো, মিঠু ভাই জোরে আমার হাতে গুজে দিয়েছে”। এ কথা শুনে মারের গতি বাড়িয়ে বলে,
“মিঠু ভাই হাতে গুজে দিল,আর তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে শুরু করলে, বলি তুমি কি বাচ্চা
না কি? আর হারামী মিঠু না কি বুয়েটে পড়ে। বুয়েটের ছাত্র রা এরকম হয়….. জানতাম না তো”। এই মুহূর্তে মনে পড়ে যেতে, আমার ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। বুয়েটে পড়লে যেন
প্রেমপত্র লেখা যায় না……কি যে অদ্ভুত অদ্ভুত লজিক মা দিতো !!!

সেদিন বাবা না এলে,মা মনে হয় আমাকে মেরেই
ফেলতো। বাবা এসে ই “কি আশ্চর্য্য !!! এরকম পাগলের মতো মেয়েটা কে মারছো কেন” বলে ধাক্কা মেরে মা কে সরায়। মা চিৎকার করে মারের
কারণ বলছে। বাবা অবাক হয়ে বলে,”সেজন্য তুমি ভাল ঘুটনি দিয়ে মেয়ে কে মারবে? এতো বড়
সাহস তোমার,আর একদিন যদি দেখি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছ, দেখবে তোমাকে আমি কি করি”? আমার জন্য বাবা কতো গাল শুনেছে,
কতো মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে মার কাছে…… সেই বাবাকে ই কি করতে পারলাম? একই শহরে থাকা সত্ত্বেও,৩ মাস পর আজ দেখতে এলাম”।
সুখ,দুঃখ,জ্বালা,যন্ত্রণার নানা স্মৃতি মনে পড়ে পড়ে, কখন যে ঘুমের অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছি, আমি নিজেই জানি না।

ঘুম ভাঙ্গার পর বুঝতে পারছি না, কোথায় শুয়ে আছি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here