কাননবালা,১৯,২০

0
529

#কাননবালা,১৯,২০
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৯

নীতু পার্স ব্যাগটা শক্ত করে ধরে আছে।চোখ মুখ রাগে থইথই করছে! নীতু ভেবে পায় না, এই আধুনিক যুগেও মানুষ কি করে গায়ের রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে? রাগে বেখেয়ালীতে হাঁটতে গিয়ে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে যায় নীতুর।নীতু চোখ তুলে সরি বলতে নেয়। কিন্তু সরি আর বলা হলো না।সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে রাগের পারদ যেন সীমানা ছাড়ালো। এই মুহুর্তে এই পরিবেশে নীতু এই মানুষটিকে আশা করেনি।নীতু প্রথমে অবাক হলেও এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে।
তাজ নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে দেখছে নীতুকে।আকস্মিক এই দেখা হওয়ায় তাজও বিস্মিত। কিন্তু বিস্ময়ের পাল্লা খুশির থেকে কম!তাজের মনে হচ্ছে দৃষ্টিতে একগুচ্ছ জারুল ফুলের স্নিগ্ধতা আঁটকে গেছে।কি সুন্দর লাগছে নীতুকে!তাজের মনে চাচ্ছে নীতুকে নিয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে, “দেখো তো মা, কে বেশি সুন্দর?জারুল ফুল নাকি আমার নীতু?”

তাজের অচিন্তনীয় ভাবনার সুতো কেটে দিয়ে নীতু রুঢ় স্বরে বলে, “আপনি এখানে কি করছেন? ”

তাজ নীতুর রাগান্বিত মুখ দেখে কষ্ট পেলো।এখানে একটা কাজে এসে এভাবে হুট করে যে নীতুর সাথে দেখা হবে তা কখনোই ভাবে নি। তাই ঠান্ডা স্বরে বলে,”কাজে এসেছিলাম, তুমি এখানে?”
নীতু টিটকারির সুরে বলে, “কেন আপনি জানতেন না আমি এখানে?নাকি ভান করছেন?”

“আমি কিভাবে জানবো তুমি এখানে নীতু?”

নীতু দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলে,”ওহ তাজ! অভিনয়ে আপনাকে আমার দশে দশ দিতে ইচ্ছে করছে।বাহ! ”

“আশ্চর্য আমি কি করে জানবো?কিসব বলছো নীতু?”…. তাজের চোখে মুখে বিস্ময়!

নীতু রুক্ষ স্বরে একটু জোরেই বলে,” আপনি জানতেন আমি এখানে। এখন একদম ভান করবেন না।আমি চাতুরীপনা একদম সহ্য করতে পারিনা।”

তাজের এবার একটু মেজাজ খারাপই হলো।কন্ঠে তেজের ভাব ফুটিয়ে বললো,”আশ্চর্য নীতু তুমি এরকম বিহেভ কেন করছো? রাস্তাঘাটে এরকম সিনক্রিয়েট করা তোমার শোভা পায় না।”

নীতু যেন এবার নিজের দিগবিদিক ভুলে গেলো।চোখ মুখ শক্ত করে কিছুটা চেচিয়েই বললো,” আমার জন্য কোনটা শোভনীয় তা আপনার ভাবতে হবে না।রোজ সকাল বিকেলে আমার অফিসের সামনে ঢুঁ মারা।এগুলো বুঝি খুব শোভনীয়? চুপিচুপি একটা মেয়েকে দেখা এটা বুঝি খুব শোভনীয়? শুক্রবার হলেই আমার বাসার সামনে পায়চারি করা এগুলো বুঝি শোভনীয়?….একজন বিবাহিত পুরুষ কখন অন্য একটা নারীকে ফলো করে জানেন মি.তাজ?যখন তার চরিত্রে দোষ থাকে!আপনি কি নিজেকে চরিত্রহীন হিসেবে পরিচিত করাতে চান?”

তাজের চোখে মুখে একই সাথে বিস্ময়, দুঃখ,অভিমান, রাগের অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো।চোখের দৃষ্টি নতজানু হয়ে গেলো! নীতুর কাছে এমন করে ধরা পরা যাবে কল্পানাও করেনি তাজ।তাজ বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “তুমি আমার জন্য অন্য নারী নও নীতু!কখনোই নও!”

তাজের অস্ফুটস্বরে বলা কথাও নীতু শুনে ফেললো।তাই বলে উঠলো,”আমি আপনার জন্য অন্য নারী।নিষিদ্ধ আপনার জন্য আমি!এইসব পাগলোমো বন্ধ করুন।আমাকে বাঁচতে দিন!”

তাজ আর্তনাদের সুরে বলে,”এভাবে বলো না নীতু।এতটা কঠোর তো তুমি নও।আমার হৃদপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে তোমার তিক্ত ভাষা।আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য যাই না বিশ্বাস করো।তোমার ওই মুখটা আমার জন্য শান্তির নিঃশ্বাস! একটু স্বস্তির আশায় চুপিচুপি তোমাকে দেখে চলে আসি।আর কিছু তো নয়!”

নীতু আগের থেকেও রুক্ষ স্বরে বলে, “আমি কোন শান্তিশালা খুলে বসেনি তাজ।নিজের শান্তির এতই যখন পরোয়া তাহলে আপনার উচিত ছিল সময় ফুরাবার আগে গোটা দুনিয়ার সাথে লড়াই করা।তা যখন পারেন নি।এবার আমায় মুক্তি দিন।আর নিজেকেও পিছুটান থেকে মুক্তি করুন।আমি আপনার জন্য ততটাই নিষিদ্ধ যতটা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ নিষিদ্ধ! “…….. এই পর্যায়ে এসে দুপা কিছুটা এগিয়ে তাজের আরো সামনে এসে দাঁড়ায় নীতু।চোখের তারায় আগুন ঝড়িয়ে এক আঙুল শাসিয়ে বলে,” আমার সাথে আপনি আর আপনার মা যাই করুন আমি প্রতিবাদ করিনি।আমার কষ্টের কারণ হিসেবে আপনাকে কখনো আমি দায়ী করিনি কিন্তু আমার বোনের কষ্টের কারণ আপনি হলে আপনাকে আঘাত করতে আমি একমুহূর্ত ভাববো না।সোজা পুলিশে দিবো।যোগ্য প্রেমিক হতে না পারলেও যোগ্য স্বামী হয়ে দেখান।নিজেকে কাপুরুষের দলে ফেলবেন না।আমি আপনার সূচনা হলেও সমাপ্তি হলো সেতু।তাই তাকেই আঁকড়ে ধরুন।”

একদমে এতগুলো কথা বলে তাজকে পাল্টা কিছু বলতে না দিয়ে নীতু সি এনজিতে উঠে পরে ।পিছনে এক আকাশ কষ্ট আর আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাজ!তাজের কাছে এই নীতুকে বড্ড অচেনা লাগে!

এতক্ষণের তাজ ও নীতুর কনভারসন অভীক শুনতে না পেলেও রাস্তার অপজিটে গাড়িতে বসে দুজনকেই দেখতে পেয়েছে।নীতুর এমন রাগী মুখ করে আঙুল নাচিয়ে কথা বলা দেখে অভীকও আশ্চর্য হয়েছে।শান্ত মুখশ্রীর আড়ালে যে এমন রণচন্ডীর রুপ লুকিয়ে আছে তা কখনো ভাবেনি অভীক।নীতু নামের মেয়েটা দিন কে দিন তাকে আশ্চর্য করছে।এতকিছু ছাপিয়েও অভীকের মনের মধ্যে খচখচ করে শুধু দুটো প্রশ্নই বিঁধছে, “কেন নীতু এতটা রেগে কথা বললো ছেলেটির সাথে? আর ছেলেটিও বা কে?”

সিএনজি ছেড়ে দিতেই নীতু দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে দিল।নীতু জানে আজকের ব্যবহারে তাজ কষ্ট পেয়েছে।তবুও নীতু ইচ্ছাকৃত ভাবে রুক্ষ বিহেভ করেছে। এটা ছাড়া তো কোন গতি নেই।নীতুর কি তাজের জন্য খারাপ লাগে না?লাগে।তবুও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে কিন্তু তাজ সেটা পারেনি।তাজের কাছে এখন কেবল একটাই অপশন, সে হলো সেতু!শুধুমাত্র সেতু!নীতু তাজের জীবনে কোন ম্যাটার করে না।তাজকে পিছুটান ফেলে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।আর আজকের ব্যবহারের পর তাজের জন্য তা খুবই সহজ হবে!নীতু চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছে দিয়ে ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে বলে,”একদম কাঁদবি না নীতু।কান্নার মত কিছুই হয়নি।তাজ কখনোই তোর ছিল না।অযথা ছোট বাচ্চাদের মত কান্না করে লাভ নেই!আর কারো জন্য চোখের জল ফেলবিনা সেই ওয়াদা ভুলে যাচ্ছিস কেন?”
নীতুকে একা একা কথা বলতে দেখে সিএনজি ওয়ালা অবাক চোখে পিছনে ফিরে তাকায়। সিএনজি ওয়ালার চোখের দৃষ্টি বলছে তার গাড়িতে কোন মেয়ে প্যাসেঞ্জার নয় বরং কোন জিনে ধরা মেয়ে বসেছে।

*************

সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসের সবার সাথে কাজ করেছে নীতু।ভীষণ টায়ার্ড থাকলেও নতুন ডাটা প্রোজেক্ট নিয়ে সবাই ব্যস্ত।ছেড়ে দেয়া চুল গুলো এখন হাত খোঁপা করা।চোখের কাজলেও লেপ্টে রয়েছে।ঠোঁটের লিপস্টিক শুকিয়ে অবহেলায় পেলব ঠোঁটে লেপ্টে রয়েছে।নীতুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে একমনে কাজ করে যাচ্ছে।

ঘন্টাদুয়েক পর অফিস ছুটি হলে নীতু কিছু কেনা কাটার জন্য বাজারে ঢুকে।নতুর প্রেজেন্টেশন নিয়ে সামনের দিনগুলো ব্যস্ত থাকতে হবে।বাসায় কিছু মুদি বাজার লাগবে তাই করা প্রয়োজন।আর সাথি ফোলা পেট নিয়ে এখন কিছুতেই এসব পারবেনা।
হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে নীতু।শাড়ির আঁচল কাঁধের উপর গুটানো।খোঁপাটাও পিঠের কাছে এলিয়ে পড়েছে। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে রিকশা খুঁজে যাচ্ছে নীতু।
অভীক মায়ের ঔষধ কিনে ফিরছিল রিকশায়। দূর থেকেই নীতুকে দেখতে পেয়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে নীতুর সামনে এসে দাঁড়ায়। ভুতের মত অভীককে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীতু চমকে ওঠে। অভীক হাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,”বাজার করলেন বুঝি?”
নীতু জবাব দিল না।চোখে মুখে বিরক্তি আর রাগ খেলে গেলো নীতুর।দুপুরের আচরণ মনে হতেই চোখের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললো।নীতুর এমন আচরণে অভীক ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো।তারপর বললো,”এখানে ভীর হয় বলে কোন রিকশা পাবেন না।কিছুটা গলির সামনে আগাতে হবে।চলুন একই সাথে না হয় হাঁটি যেহেতু গন্তব্য একটাই!”

নীতু অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁটা ধরলো। ব্যগের ভারে হাত ব্যথা করছে।দাঁড়িয়ে না থেকে চলাই ভালো।নীতুকে হাঁটতে দেখে অভীক মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে নীতুর পাশাপাশি হাঁটা শুরু করে।কয়েক মিনিট পরেই অভীক নীতুর হাত থেকে ব্যগ টান মেরে নিজের হাতে নিয়ে অভীকের হাতে থাকা ঔষধের প্যাকেট আর কোটটা নীতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে।এত দ্রুত সব ঘটে যাওয়ায় নীতু বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে পরে।তবুও অভীককে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেনা।অভীক কয়েক পা সামনে হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। পিছনে ঘুরে নীতুর উদ্দেশ্যে বলে,”মিস নীতু দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?আপনার মতলব কি?আপনি নিশ্চয়ই এটা আশা করছেন না?আমি আপনাকেও ব্যাগের মত কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করি?এসব চিন্তা মাথায় আসলেও ঝেড়ে ফেলে দিন। আমি এতটাও পরোপকারী নই।বুঝেছেন?দ্রুত আসুন!”

অভীকের এমন ধারার কথায় নীতুর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। অভীকের কাছে এসে নীতু শাসিয়ে বলে,”আপনি কি চাইছেন স্যার?আমি রাগের মাথায় আপনাকে খুন করি?”‘

“আমি কিছুই চাইছিনা।আর এখানে আপনার স্যার নই আমি।এখন আমি একজন কেবল দায়িত্বশীল প্রতিবেশী। বুঝেছেন মিস নীতু? ”

নীতু আর কিছুই বললো না।এখন কথা খরচ করা শুধুই বেকার। তাই ফুটপাতের রাস্তার পাশ ঘেঁষে নীতু হাঁটতে শুরু করে।পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটছে অভীকও।মৃদু বাতাসে নীতুর শাড়ির আঁচল উড়ছে।হাতে ধরা অভীকের কোট আর চোখে অজস্র বিরক্তির নিশান! সোডিয়ামের আলোয় মাখামাখি নীতুর অন্যরকম এক রুপ!অভীক আড়চোখে সবটাই পর্যবেক্ষণ করছে।হুট করে একটা বেসামাল হোন্ডাচালক এলোমেলো ভাবে একদম নীতুর গা ঘেঁষে চলে যেতে নিলে অভীক একমুহূর্ত দেরি না করে নীতুর হাত ধরে অভীকের ডান পাশে নীতুকে সরিয়ে আনে। সাথে সাথেই আবার নীতুর হাত ছেড়ে দেয় অভীক এবং স্বাভাবিক ভাবে আবার চলতে শুরু করে।কিন্তু নীতু স্বাভাবিক হতে পারলো না।অভীকের এমন নিঃশ্চুপ অধিকার খাটানো কর্মকান্ডে নীতুর দম আটকে আসলো। হাত পা তিরতির করে কাঁপতে লাগলো।নীতুকে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভীক শান্ত স্বরে বলে,”এবার কিন্তু ইভটিজিংয়ের স্বীকার হচ্ছি আমি!”

নীতু সাথে সাথেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেললো।কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা পেতেই অভীক হাতের ইশারায় রিকশা থামিয়ে নীতুকে উঠতে ইশারা করলো।নীতু যন্ত্রচালিত পুতুলের মত উঠে পরলো।নীতু যে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি তা অভীক বেশ বুঝতে পারলো।একটু হাতের ছোঁয়ায় কোন নারীযে এতটা লজ্জা পেতে পারে তা অভীকের ধারণা ছিলনা।নীতু বসতেই অভীক খুবই যত্নের সাথে বাজারের ব্যাগটা নীতুর পায়ের কাছে রাখলো।উদ্ধত শাড়ির আঁচলটা পায়ের কাছ থেকে উঠিয়ে নীতুর কোলের কাছে রাখলো।ঔষধের প্যাকেট হাতে তুলে নিলো।তারপর নীতুর চোখের দিকে একরাশ সম্মোহনী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”মিস নীতু, ময়ুর বা কাক কখনোই আমার পছন্দের তালিকায় নেই।না আছে কোন বিশ্বসুন্দরীর স্থান।আমার তো পছন্দ নাকের ডগায় মুক্তোর মত জ্বলজ্বল করতে থাকা রাগের ন্যায় আত্মসম্মানটুকু!একটু রাগলেই যার নাক ঘামে সেটুকুই আমার পছন্দের তালিকায় বিদ্যমান!”

নীতু বিস্মিত বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভীকের দিকে।অভীক রিকশাওয়ালার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো,”মামা সাবধানে যাবেন।আর ভাড়াটা ম্যাডামই আপনাকে দেবে।”
তারপর নীতুর দিকে ফিরে বলে,”মিস নীতু খুচরো টাকা নেই আমার কাছে ভাড়াটা দিয়ে দিবেন।কিছু মনে করবেন না যেন? আর মুখের হা বন্ধ করুন নতুবা পোকা মাকড় প্রবেশের সম্ভাবনা আছে! ”
এরপরই অভীক চলে গেলো।নীতুর হাতে তখনো শক্ত করে আঁকড়ে ধরা অভীকের কালো রঙের কোটটা।যা সম্পর্কে নীতু পুরোপুরি ভুলে বসে আছে।এই এতকিছু ছাপিয়ে অভীক যে তার পাশে রিকশায় বসলো না একটুকু ভদ্রতা নীতুর ভালো লেগেছে!এই ভালো লাগা দিয়ে নীতু অভীকের উপর দুপুরের রাগ কাটাকাটি করে ফেললো, ঠিক কাটাকাটি অংকের মত!

*************

রাত এগারোটা। সেতু কল করলো তাজকে।তাজ বিষন্ন মনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।অফিস থেকে ফিরে কিছুই খায়নি তাজ।দরজা আটকে বসে আছে বারান্দায়। আজকে নীতুর ব্যবহার আর নীতু দুটোই কেন যেন তাজ মানতে পারছে না।ভীষণ অস্থির লাগছে।ঠিক সেই মুহুর্তে সেতু কল করে।অনিচ্ছা সত্বেও তাজ কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সেতু উদ্ধিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে, “কি ব্যাপার আপনি নাকি অফিস থেকে ফিরে কিছুই খাননি?তারউপর রুম আটকে বসে আছেন।শরীর ঠিক আছে তো?”
এতক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারলেও এখন আর সামলাতে পারলো না তাজ।হুট করেই সকল রাগ, মেজাজ খারাপ গিয়ে পরলো সেতুর উপর।এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো,এই মেয়েটাই সব কিছুর জন্য দায়ী? না সেতুর সাথে মায়ের দেখা হত আর না সেতু তার বউ হতো।আর না আজ নীতু তার জন্য নিষিদ্ধ কেউ হতো।
তাজ চিৎকার করে বলে ওঠে, “সব কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে?কে তুই?বউগিরি দেখাস…..তোর বউগিরি *****!”

বিচ্ছিরি কিছু স্ল্যাংয়ের শব্দে সেতু বিমূঢ় হয়ে পড়ে।হাত থেকে খসে পড়ে মোবাইলটা। দুচোখের পাতা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে।চোখের সামনে তাজের মুখটাকে বড় কুৎসিত হয়ে ভেসে ওঠে! সেতু মুখচেপে হু হু করে কেঁদে দেয়!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২০

সকাল সকাল মহিমা বেগম বড় ভাই আর ভাইয়ের বউকে বাসায় দেখে অবাক হলেন।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সুরভি এসেও হাত লাগালো। সুরভি চার পাঁচ দিন পরই ফিরে এসেছিল। বাপের বাড়ি ভাবিদের কটকটে চোখ আর টিটকারি মূলক কথা শুনার থেকে নিজের শশুর বাড়িই ভালো। চার পাঁচ দিন পর যখন সুরভি নিখিল কল করলো। তখন নিখিল কোন উচ্চবাচ্য করেনি।ঠান্ডা স্বরে কথা বলেছে।এরপরই যখন সুরভি বললো,”আমি বাড়ি আসতে চাই।”
নিখিল কেবল প্রতিত্তোরে বলেছিল,”বিকেলে তৈরি থেকো। অফিস শেষে নিতে আসবো।”
সুরভি লজ্জায় কেঁদে দিয়ে ছিল।নিখিল কোন খোঁটা দিল না।একবারো জানতে চাইলো না, চলে তো গিয়েছিলে ফিরে আসতে চাইছো কেন?
নিখিল যেন বুঝে গিয়েছিল সুরভি সেখানে ভালো নেই। সুরভি এ বাড়িতে আসার পর কেউ কোন খারাপ ব্যবহার করেনি।নিখিলও স্বাভাবিক আচরণ করেছে কিন্তু নিখিল আগের মত সুরভির সাথে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার করছে না।

সুরভি নিচু স্বরে শাশুড়ীকে বলে,”মা হুট করে মামা মামি আসলো।ব্যপার কি?”

মহিমা বেগম নিজেও জানেন না। তিনি নিজেও চিন্তিত বোধ করছেন।তার এই ভাই ভাবি প্যাচানো স্বভাবের মানুষ। আবার কি ঝামেলা বাঁধলো কে জানে?
সুরভির মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,”জানি না বউমা। দেখি কি বলে?”…..তারপর একটু চুপ থেকে বলে উঠলেন,”বউ, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে রাগারাগি হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু সেটা দীর্ঘদিন বয়ে বেড়ানো বোকামি! এইসব মনোমালিন্য সম্পর্কে ফাঁক ফোঁকরের সৃষ্টি করে।তাই দ্রুত মিটাইয়া ফেলাও।নিখিল হয়তো রেগে নেই কিন্তু মনে ক্ষোভ চাপিয়ে রেখেছে। স্বামীর ক্ষোভ কি করে জলে পরিনত করতে হয় আশা করি তা তোমায় আমার শিখিয়ে দিতে হবে না।”
শাশুড়ী নাস্তা নিয়ে চলে গেলে সুরভি কেঁদে ফেললো।এই সংসারের সবার প্রতি সুরভির উদাসিনতা থাকলেও নিখিলকে সে খুব ভালোবাসে।সেই মানুষটার নিরবতা যেন বুকে কাঁটার মত বিঁধছে!

“শোন মহিমা আমরা তোর ভালো চাই।দুলাভাই বিছানায় পড়ে থাকেন।তোগো জন্য চিন্তা হয় আমার।তাই বলছিলাম কি…..”
ভাইয়ের বউয়ের কথায় মহিমা বেগম কপাল কুঁচকে বড় ভাইয়ের দিকে তাকান। অপর পাশে বসা নিখিলের দিকে তাকিয়ে দেখেন ছেলের কপালেও ভাঁজ পড়েছে।

“শোন নীতুর বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে। তারউপরে গায়ের রঙ ময়লা।ওর তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।তোর ভাইয়ের পরিচিত এক ছেলে আছে।বয়সটা একটু বেশি, তাতে কি? আমগো নীতুর বয়সটাও তো আর বসে নেই। ছেলেটা ভীষণ ভালো।বউ মরে গেছে।দুইটা বাচ্চা আছে।ভরা সংসার।আমাগো নীতু মাশাল্লাহ লক্ষী মেয়ে।এই ছেলের জন্য নীতুই ঠিক আছে।”

নিখিল বিস্মিত হলো।নিজের উষ্মা কিছুতেই চেপে রাখতে পারলো না।বলে উঠলো,”মামি দুই বাচ্চার বাপ কি করে ছেলে হয়?বলুন বুড়া লোক।”

মামি ধমকে ওঠে, “আহা! পোলাপান মানুষ তোরা এসব কি বুঝিস?ছেলে অল্প বয়সে বিয়ে করছিল।ছেলেদের আবার বুড়া আর জোয়ান!মহিমা তুই কি বলোস?”

আগে হলে মহিমা বেগম ভাবির কথায় রাজি হয়ে যেতেন।ছেলের উপর থেকে চাপ কমাতে পাত্রস্থ মেয়েকে বিদায়ের চেষ্টা করতো কিন্তু এখন সম্ভব না। নীতু এমনিতেই অভিমান করে আছে তাদের উপর।তার উপর ভালো একটা চাকরি করছে।নিজেই সাবলম্বী।এখন আবার নীতুকে বিয়ের কথা বলে আর কষ্ট দিতে পারবেন না।তাই বললো,”আমরা জানি,তোমরা আমাদের ভালো চাও।কিন্তু নীতু এখন চাকরি করে।তাছাড়া পূর্ব বিবাহিত পুরুষের সাথে নীতুকে আমরা বিয়ে দিবো না।”

ভাই তেতে উঠে বললো,”চাকরি করে বলে কি মেয়ে কে বিয়ে দিবি না।কালো মেয়ে, বয়স বাড়ছে এরপর কে বিয়ে করবে?ছেলের অনেক বড় আড়দের ব্যবসা।এত ভালো সম্বন্ধ পায়ে ঠেলিস না মহি!”

পূর্বের নিখিল হলে কোন কথা বলতো না।কিন্তু নীতুর শূন্যতা নিখিলকে বদলে ফেলেছে।তাই বলে উঠলো,”মামা মামি এসেছেন, থাকুন দুপুরে ভালো মন্দ খেয়ে যাবেন।কিন্তু নীতুর বিয়ে সম্পর্কে আর একটা কথাও বলবেন না। এই প্রস্তাব আনার আগে আপনাদের ভাবা উচিত ছিল। ”

“আগে তো বোনের বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাওনি বাপধন।এখন বুঝি বোনের চাকরির পয়সা খেয়ে বোনকে নিয়ে বড় চিন্তা করা হচ্ছে?ওই তো গায়ের রঙ? বয়স আরো বাড়লে মাছিও নাক সিটকাবে তারপর তো পুরুষ মানুষ! ”

ভাইয়ের বউয়ের মুখরা কথায় মহিমা বেগম বিরক্ত হলেন।নিখিল বলে উঠলো,”আপনারা যা ভাবেন তাই সই।তারপরও আমার বোনের জন্য আপনাদের এত চিন্তা করতে হবে না।”

এই কথা বলে নিখিল উঠে দাঁড়ালো।চেঁচিয়ে সুরভিকে ডেকে বললো,”সুরভি আমার ব্যাগ দিয়ে যাও।অফিসের লেট হচ্ছে। ”

সুরভি কাছাকাছি ছিল।স্বামীর ডাক শুনে হাতে ব্যাগ নিয়ে ছুটে আসলো।সুরভিকে দেখতে পেয়ে মামি বলে উঠলেন,” বউমা তুমি নিখিলরে বুঝাও।ঘরে আসা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই।তুমি সবই শুনছো।আমরা কি ভুল বলছি?তুমি কও?”
সুরভি আঁড়চোখে নিখিলের দিকে তাকালো।কঠিন মুখটার দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো। তারপর আস্তে করে বললো,”মামি নীতুর জন্য কোনটা ভালো তা না আপনারা ঠিক করবেন না নীতুর ভাই।নীতুর সিদ্ধান্ত নীতু নিলেই ভালো হবে।আর আমার মনে হয় নীতু কিছুতেই এই প্রস্তাবে রাজি হবে না।”

নিজের স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে উঠতে বলে বললেন,”এখনো বসে আছো কেন?আরো অপমান হতে চাও?সবাই এখন ধোয়া তুলসি পাতা সাজছে।দেখি ওই কালো মেয়েকে কোথায় বিয়ে দেয়?”

এরপর দুজনেই চলে গেলেন।নিখিল সুরভির কথায় চমকালেও কোন ভাবান্তর দেখালো না।নিখিল চলে যেতেই সুরভি বড়সড় নিঃশ্বাস ছাড়লো!

************
সেতু কল করে সবটা নীতুকে বলেছে।মামা মামিকে ভাইয়া কি জবাব দিছে সেটাও বলেছে।সব শুনে নীতু কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুই বললো না।আগের মত মনখারাপও করলো না।ভাইয়ার নির্লিপ্ত মুখটা কেবল চোখের সামনে ভেসে উঠলো! ঠিক তখনই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। দূরে চলে গেলেই কেন আপন মানুষগুলো গুরুত্ব বোঝে?

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া বেগম আৎকে উঠলেন। মুখ শুকিয়ে গেছে।চুল গুলো উসকো খুসকো।চোখের কোলে রাতজাগা ক্লান্তির ছাপ!
তাজ অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল। রাবেয়া বেগম কাছে ডাকলেন ছেলেকে।তাজ নিঃশব্দে বসলো।রাবেয়া বেগম নাক কুঁচকে ফেললেন সিগারেটের গন্ধে। যে ছেলে সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারতো না আজ তার শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে?ভেবে অবাক হলেন। এতটা অধপতন? রাগ চেপে বললেন,”এভাবে অফিসে যাচ্ছিস কেন?”
তাজ অবহেলিত দৃষ্টিতে নিজের দিকে একপলক তাকালো।এরপরই চোখ ফিরিয়ে মনোযোগ দিল সামনে চলতে থাকা টিভির স্ক্রিনে। বাংলা সিনেমা হচ্ছে। নায়ক ইনিয়ে বিনিয়ে নায়িকাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে।রাবেয়া বেগম হতাশ হলেন।তাজ তার কথার জবাব না দিয়ে টিভি দেখছে।বিনে আয়রনের শার্ট, টাই পড়েনি,চুল আঁচড়ায়নি,ঘড়ি পড়েনি, পায়ে সু পড়েনি।এলোমেলো বেশে ছেলে অফিসের জন্য রওনা করেছে। রাবেয়া বেগম টিভি অফ করে দিয়ে বললেন,”এরকম করে তুই কি প্রমাণ করেতে চাইছিস তাজ?যে তুই ভালো নেই?সিগারেট ধরেছিস কবে থেকে?এতটা উচ্ছন্নপনা কেন?”

তাজ বন্ধ হওয়া টিভি স্ক্রিনের দিকে তখনও একমনে তাকিয়ে আছে।মায়ের এই কথারও কোন উত্তর দিল না।
রাবেয়া বেগম ফের বললেন,”নাস্তা দিচ্ছি। খেয়ে তারপর যা।”

এবার তাজ ঠান্ডা গলায় বললো,” ক্ষিদে নেই।”

রাবেয়া বেগম চিৎকার করে উঠলেন,”রাতেও খাসনি।তারপরও তোর ক্ষুদা লাগেনি?”

“বললাম তো খাবো না।এখন কি তোমরা খাবারও জোর করে খাওয়াবে?”…. অধৈর্য্যের সুর তাজের কন্ঠে।

রাবেয়া বেগম মনে মনে কতক্ষণ সেতুকে বকলেন।বিয়ে করে এনেছে কোথায় বরের কাছাকাছি থাকবে তানা সে পরিক্ষা দিচ্ছে। নিজেকে সামলে তাজের শরীরে হাত বুলিয়ে বললেন,” এরকম কেন করছিস?স্বাভাবিক হ বাবা।তুই না আমার ভালো ছেলে, এরকম পাগলামো তোকে মানায় না! ”

মায়ের কথায় ছোট বাচ্চাদের মত তাজের ঠোঁট ফুলে উঠলো।রাবেয়া বেগম বুঝলেন, ছেলে তার কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।তাজের নির্লিপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম সত্যি সত্যি রাবেয়া বেগমের খারাপ লাগলো।বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মাকে ছলছল চোখে তাকাতে দেখে তাজ ফ্যাকাসে হাসলো।সোফার কার্নিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে সরাসরি সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।ওই অবস্থায় মায়ের হাতটা টেনে বুকের বা পাশে ধরে বললো,”মা দেখো, আমার এই খানটায় ভীষণ কষ্ট হয়!জ্বলে পুড়ে যায়!দমবন্ধ হয়ে আসে।তোমার ছেলে ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারে না মা!কলিজাটা খাঁ খাঁ করে!রাত হলে ঘুম হয়না! একটা মুখ চোখের সামনে ভাসতে থাকে! চেষ্টা করি মুছে ফেলতে!পারি না মা।একটুও পারি না।এমন একটা মেয়েকে আমার বউ করে আনলে যাকে দেখলে প্রতিনিয়ত মনে পরে, আমি যাকে ভালোবাসি এই মেয়েটা তারই বোন।এই অনুভূতির যে কি যন্ত্রণা তুমি কি করে বুঝবে? তুমি তো মা!তুমি কেমন করে পারলে আমায় এতটা কষ্ট দিতে?আচ্ছা মা, তুমি আমার নিজের মা তো? নাকি আমি তোমার ছেলে না?কিভাবে পারলে মা?কিভাবে পারলে?তোমাকে ছেড়ে তাকে বেছে নিতে আমি পারিনি।এবার তোমার চোখের সামনেই আমাকে একটু একটু করে শেষ হতে দেখবে,তা সইতে পারবে তো?”…..

রাবেয়া বেগম মুখে আঁচল চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাজ সোজা হয়ে বসলো।আলতো হেসে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো,”কেঁদো না মা।কিছুটা চোখের জল বাঁচিয়ে রাখো মা।এখুনি শেষ করলে পরে কাঁদবে কিভাবে?”…….বলে তাজ হনহন করে চলে গেলো।

রাবেয়া বেগম নিজের ভুল বুঝতে পারলেন কিন্তু তা বড্ড দেরিতে!

**********-

নীতু সাথির চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।সাথি ঘুমিয়ে পড়তেই নিঃশব্দে উঠে বারান্দায় দাঁড়ালো। ব্যস্ত শহরটাকে একটু শান্ত করে দিতে আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।নীতু সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।চুলের খোঁপাটা খুলে দিতেই লম্বা চুলগুলো কোমড় ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়লো।হাত দুটো বারান্দার রেলিং চেপে ধরলো,চোখ দুটো নিবদ্ধ অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা চাঁদের দিকে। নীতুর হুট করেই খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো।চোখ থেকে নিরবে অশ্রু ঝরে পড়লো।চাঁদের আলোয় কৃষ্ণবতীর চোখের জল চিকচিক করে উঠলো।নীতু আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো কয়েকটা লাইন,

খুব নিঃশব্দে যে আসে
সে কেন যাওয়ার ক্ষণে নিঃশব্দে যায় না?
যাওয়ার বেলায় কেন তার এত তোড়জোড়?
কেন এত হইচই?
পুরোটা পাড়া জানিয়ে যায় ‘সে যাচ্ছে’
অথচ কত সহজেই না অনুপ্রবেশ করেছিল!
তুমুল আয়োজন করে যার বিদায়
খুব নিরবেই কেন তার আগমণ?
যদি নেয়ারই ছিল প্রস্থান
তবে কেন মিছে পদার্পন!
খুব নিঃশব্দে যে সুখ কড়া নেড়েছিল দ্বারে
সে কেন যাওয়ার ক্ষণেই হয় দুঃখের রোদন!
খুব নিঃশব্দে যে আসে,
সে কেন যাওয়ার ক্ষণে নিঃশব্দে যায় না?
কেন?

রাতের আকাশের বুক চিড়ে নিঃশব্দে রোদন করে উঠলো নীতুর বলা প্রতিটা লাইন। ঠিক নীতুরই মত!

************
নীতু অফিসে আসতেই পিয়ন বললো,”আপনাকে অভীক স্যার ডেকেছে।”

নীতু অভীকের কেবিনে প্রবেশ করতেই অভীক রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো।নীতু সেই দৃষ্টি দেখে ভিরমি খেলো।এই অভীক কে সে বুঝতে পারে না কিছুতেই।আস্ত একটা ডিপ্লোমেটিক মানুষ! নীতু বললো,”আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?”

অভীকের পড়নে সাদা ফর্মাল শার্ট, কালো কোট,কালো ডেনিম প্যান্ট ।চুল গুলো জেল দিয়ে সেট করা।ফর্সা হাতে জ্বলজ্বল করছে কালো রঙের ঘড়ি।ঠোঁটের কোণে রুক্ষতা, চোখের দৃষ্টিতে ধূর্ততা নিয়ে তাকিয়ে রইলো নীতুর মুখের দিকে। অভীকের তাকানো দেখে নীতু মিয়িয়ে গেলো। অভীক কন্ঠে একরাশ গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,”আমি না ডাকলে আপনি এখানে কি করছেন,মিস নীতু?”

নীতু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,”সরি স্যার।”

অভীক চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই হাতের মাঝে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,”এত লেট করে অফিসে কেন আসেন?নাকি ভুলে গেছেন এটা আপনার কর্মক্ষেত্র?”

নীতু একপলক অভীকের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।কি কঠিন মুখ!দৃষ্টি নত করে বললো,”সরি স্যার।আর লেট হবে না।”

অভীক একটা ফাইল টেনে নিয়ে বললো,”আপনার মনে থাকলেই হলো। এবার আপনি আসুন।”

নীতু উঠে দাঁড়াতেই অভীক ফের বললো,”মিস নীতু?”

“জি স্যার।”

“রাস্তাঘাটে আর কখনো দাঁত কেলিয়ে হাসবেন না।এতে শব্দ দূষণ হয়!”

অভীকের উদ্ভট কথা শুনে নীতু আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।কি বলছে এসব মানুষটা?হাসলে যে শব্দ দূষণ হয়, নীতু তা আজ জানলো।পরক্ষণেই কিছু মনে হতেই নীতু হতাশ হলো। কিছু না বলে সোজা কেবিন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।

নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়েও নীতু তব্দা খেয়ে বসে রইলো।এই অভীকের আচরণ তাকে সত্যিই ভাবাচ্ছে।নীতু কারো সাথে বেশিক্ষণ কথা বললে বিশেষ করে ছেলেদের সাথে তাহলে অভীকের রিয়েকশন হয় অন্যরকম।তখন কোন না কোন কাজে ভুল ধরে নীতুকে উদ্ভট ধরনের কথা বলবে। আর সেই ছেলেটা যদি পলাশ হয় তবে তো কথাই নেই।আজ সকালে অফিসে প্রবেশের আগে পলাশের সাথে দেখা।একসাথেই দুজনে অফিসে প্রবেশ করছে।তখন পলাশের কোন কথায় যেন নীতু একটু জোরে হেসে দিয়েছিল সেটা অভীক দেখে ফেলেছে।আর তার রিয়েকশন হলো এমন। নীতু বুঝতে পারে না আবার বুঝতেও পারে অভীক কি বলতে চায়।কিন্তু নীতুর তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! নীতু খেয়াল করেছে অভীকের দৃষ্টি তার প্রতি অন্য রকম। অভীক যখন নীতুর দিকে তাকায় তখন সেই চাহনিতে অশ্লীলতা থাকে না,থাকে কিছুটা সম্মোহনী দৃষ্টি, কিছুটা মাদকতা!নীতু সেই চাহনি যতবার দেখেছে ভিতর থেকে কেঁপে উঠেছে বারংবার ।কি চায় অভীক?যা চায় তা কি সত্যিই চাওয়ার মধ্যে পড়ে?নীতু ভেবে পায় না।

নীতু দু হাতে মাথা চেপে ধরে।ঠিক তখনই পলাশ এসে বলে,”কি ব্যপার নীতু?শরীর খারাপ লাগছে?ঠিক আছো তুমি?”

নীতু মাথা থেকে হাত সরিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায় পলাশের দিকে।পলাশ ভারি চিন্তিত বোধ করে।নীতু জানে এখন যদি আবার পলাশের সাথে কথা বলতে দেখে তবে আবার অভীক স্যার ঝামেলা বাঁধাবে।নীতু বলে,”পলাশ ভাই আমি একদম ঠিক আছি।মাথা ব্যথা করছে কেবল।”

“তাহলে ঔষধ এনে দেই নীতু?নাকি ছুটি নিবে?মাথা ব্যথা নিয়ে অফিস করবে কি করে?”

নীতু এবার হাত জোর করে বলে,”আল্লাহর দোহাই লাগে পলাশ ভাই,আমি ঠিক আছি।আপনি এখন যান।এত চিন্তা করতে হবে না।”

পলাশ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। নীতুকে পুনরায় মাথা চেপে ধরতে দেখে পলাশ কিছু বলতে চাইলো।তার আগেই নীতু বললো,”পলাশ ভাই সরি।একটু রেষ্ট নিলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো।এবার আপনি নিশ্চিন্তে যান।”

পলাশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেলো।ঠিক তখনই পিয়ন এসে আবার বললো,”আপনাকে অভীক স্যার ডাকছে।”

নীতু এবার সত্যি সত্যি হতাশ হলো।নতুন কোন ডিপ্লোমেটিক কথার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে অভীকের কেবিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো…..

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here