সৎ মা, লেখা: মাহাবুবা মিতু, পর্ব: ২৬

0
224

সৎ মা,
লেখা: মাহাবুবা মিতু,
পর্ব: ২৬

হলুদের দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমি বাড়িতে ফিরি। সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি যাতে কোন ঝামেলা না হয়, মা আমার সাথে রাগ করেছেন দেরী করে আসায়। রাগী গলায় বজুলকে বলে তার রাগ আমাকে বোঝাচ্ছে। যাতে জলদি আমি তৈরী হই। আমি কোনমতে তৈরী হয়ে তার সামনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম
– মা আমার চটি জুতা গুলো পাচ্ছি না,
মা মিনি বুয়াকে বললেন
– দেখতো পুরাতন কাবার্ডটায় আছে…
আমি মাকে বলি
– দেখেন তো মা সব ঠিক আছে কি না।
মা আমার দিকে বেশ কিছু সময় পর তাকালন।
মুহুর্তেই মার রাগ পরে গেলো। ওদেরকে বললো জলদি ওকে উপরে নিয়ে যাও। আমি মাকে বললাম
– আমি দেরী করায় রাগ করছেন আপনি, আপনিও তো রেডি হন নি…
– হুম হচ্ছি.. তুমি জলদি উপরে যাও
– মা নাক ফুলটা পছন্দ হয়েছে আপনার…?
– হুম, কোন দরকার ছিলো না এটার,
– আপনার জন্য…
– হুম, ছোট্ট আর স্মার্টও, পছন্দ হয়েছে আমার, তবে এ সময়ে এতগুলো টাকা খরচের কোন দরকার ছিলো না, সব কিছুর একটা সময় আছে…
– মা মানুষ দিনরাত এতো পরিশ্রম কেন করে জানেন…
এ কথায় মা তার সেই বিখ্যাত চাহনিতে তাকালো আমার দিকে..
– কাছের জনদের জন্য
– হুম বুঝলাম,
– মা একটা কথা..
– কি বলো
– নাক ফুলটা আপনি পরবেন আজ..
মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন .. বললেন
– আচ্ছা যাও তুমি আমি পরবো নি…

বাড়ি ফিরে বাড়ির সাজগোজ দেখে আমি মুগ্ধ। ইভেন্ট প্ল্যানার যে ওতোগুলো টাকা নিয়েছেন এখন মনে হচ্ছে টাকা টা বেশী নেন নি।

এখন দেখি বাড়ির সিড়ি থেকে বেলকনি, ছাদ,সব জায়গায় তারা তাদের নিপুণ কাজের দক্ষতা দেখিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ফটো বুথটা। কয়েক হাজার তাজা ফুল দিয়ে সেটিকে তৈরী করেছেন তারা। স্টেজটাকে যে কি বানিয়েছে বলা মুশকিল। এত বিশদ ব্যাখ্যা বলা সমঁব না তবে এককথায় অসাধারণ…! স্টেজে যেতে সিড়ি আর হাঁটবার জায়গাটাতে আয়না বসানো। এই স্টাইলটা খুব সম্ভবত বলিউড থেকে ধার করে সামান্য এডিট করা। অস্টিন ক্লেয়নের লেখা – “Steal Like An Artist” বইটার কথা মনে পরলো।

আমি উপরে যাবার আগে সবকিছুর খবরাখবর নিলাম। ছেলে মানুষ আগে গিয়ে বসে থাকতে হবে না। তাছাড়া আমি সবার বড়, সবার আমার প্রতি ভালোবাসা অনেক, আর আমার….. দায়িত্বটাও বেশী। কে আসলো, কে না, কার রেডি হওয়া বাকী, কে রাগ করে বসে আছে এসব দেখা লাগে আমাকে। বড় হওয়ার দায়িত্ব এটা।

আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম সীমান্ত আসে নি। নাঈফাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভিতরটা কষ্টে ছেঁয়ে গেলো। এমনটা না করলেও পারতো ও। সম্পদের জন্য ও এমনটা করলো। সম্পদ জিনিসটা আগুনের মতো। যা সবাই ধরে রাখতে পারে না…

আর বাবা তা জেনেই ওকে তা দিচ্ছেন না। এসব পেলেই ও এগুলো বিক্রি করে নিশ্চিত বিদেশ পাড়ি দিবে। একটা সময় দেখা যাবে সব শেষ। বাবা এখন কঠিন হয়ে বসে আছেন ওর ভবিষ্যতের ভালোর জন্য। এটা একটা বার ও যদি বুঝতো।

মা বেশকিছু সময় পরে উপরে এলেন, খেয়াল করে দেখলাম মা নাক ফুলটা পরে এসেছেন। এরপর তিনি হলুদের কি সব নিয়ম কানুন করলেন।

অনেক আনন্দ আর উত্তেজনায় হলুদের অনুষ্ঠান হলো। আমি বেশীক্ষণ বসে থাকি নি। মা আর আত্মীয়রা হলুদ দিতেই নেমে গিয়েছি স্টেজ থেকে৷ এরপর খালি খাওয়া দাওয়া গমগম আর আড্ডা। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো আড়াইটায়। এরপর কাজিনরা মিলে আবারও আড্ডা। বিয়ে হবে একদিন পর। কারন এতো রাত জেগে পরদিন এত লম্বা জার্নি করা যাবে না তাই হলুদের ডেট একদিন সময় হাতে রেখে করেছেন মা। তাই করো ঘুমানোর তাড়া নেই। ফুফু বলছে আহনাফের বিয়েতেও এমনি একদিন সময় হাতে রেখে হলুদের ডেট ফিক্সড করবে।

রাতে রুমে গেলাম আড়াইটায়। এর মধ্যে বাড়ি ফেরার আগে একবার কথা হয়েছে প্রসূনের সাথে। ব্যাস্ততায় আর কথা বলতে পারি নি। রুমে ফিরে কথা হলো ওর সাথে।

ঘুমানোর আগে বালিশের নিচে কিছু একটা হাতে লাগলো আমার৷ লাইট অন করে যে দেখবো কি এটা তা আর ইচ্ছে আর শক্তি কোনটাই ছিলো না এতো ক্লান্ত লাগছিলো । শেষে গভীর ঘুমে ডুব দিলাম। যা ভাঙলো সকাল সাড়ে আটটায়। ঐদিন আমার কোথাও যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। তাই আরেকটু ঘুমাতে বালিশ টানতেই চোখে পরে সেই প্যাকেটটা…

উবু হয়ে শুয়ে ব্যাগটা খুলতেই দেখলাম ছোট্ট সুন্দর একটা বক্স, আর ভাজকরা একটা কাগজ। বক্স টা রেখে কাগজটা আমি আগে খুললাম।

সম্বোধন দেখেই কাগজটা ভাজ করে রেখে দিলাম। কারন আমি বুঝে গেছি চিঠিটা কার…
বিছানা ছেড়ে আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। সকাল সকাল মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মনের সাথে কয়েক দফা যুদ্ধ হলো পড়বো কি না…

শেষমেশ পড়লাম ঐ ছোট্ট চিরকুটটা

প্রিয় দ্বিগু,
তুমি আমার দ্বিতীয় সন্তান হওয়ায় অনেক আদুরে ছিলে। কতটা ভালোবাসি তোমাকে তা বোঝাতে পারবো না। তোমাকে রাতে বুকে নিয়ে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। তোমার কোন অসুখ হলে আমার ঘুম গায়েব হয়ে যেতো৷ একটা বার নিজেকে প্রশ্ন করো তো- এত ভালােবাসার
সন্তানকে কেন ছেড়ে চলে আসলাম…?!

প্রতিটা সন্তানের কাছে তার বাবার একটা প্রতিচ্ছবি থাকে যা অনেকে আদর্শ হিসেবে ধারন করে। তাই আমি কোনদিনও আমার সাথে ঘটা বিশ্রী ঘটনা গুলো কখনো আমার সন্তানদের সাথে শেয়ার করতাম না। কারন আমি চাইতাম না এসব আমার সন্তানরা জানুক। তোমার বোন মিলি কিছুটা জানতো, বুঝতো… কারন বেশ বড় ছিলো বয়সে তাছাড়া ও ওতো একজন মেয়ে। তুমি তো ছিলে ছোট্ট একটা ছেলে। তাই তুমি অনেক কিছুই জানো না, তোমার নতুন মা হয়তো জেনে থাকবে কিছুটা…
কারন যা আমার সাথে হয়েছে তা তার সাথেও হয়….
“ঢেঁকি স্বর্গে গেলোও ধানই ভানে”

আমি আজও তোমার বাবাকে তোমার চোখে ছোট করবো না। শুধু একটু বলবো আমি যাই করেছি, তা আমি না করেই এসব শুনে হজম করেছি। তাই রাগের মাথায় ওদের অসত্যটাকে সত্যি করে দিয়েছি।

সেসব বিশ্রী বিষয় তোমাকে আমি বলতে চিঠি লিখি নি। শুধু একটু জেনো, আমি তোমাকে ততোটাই ভালোবাসি যতটা তুৃমি আমাকে ঘৃনা করো। আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমার দেয়া এই উপহারটা তুমি তোমার বৌকে দিবে, সেই আশায়ই অনেক সাহস সঞ্চয় করে এটা তোমাকে পাঠালাম।
ইতি,
তোমার……..

বাক্সটা খুলে দেখি সর্টার চেইন আর ছোট্ট একজোড়া দুল। খুব সম্ভবতো প্লাটিনামের হবে… ওগুলো আমি আলমারিতে তুলে রাখলাম।

এরপর আমি ভাবলাম এটা এখানে কে রাখলো…
মা কে জিজ্ঞেস করবো কি না তা ভাবতেই কাজিনরা এসে হানা দিলো ঘরে।

সারাটা দিন কাটলো ফালতু ব্যাস্ততায়। পরদিন বিয়ে। এসব ভাবা বা বলারও সময় পেলাম না৷ পরদিন ভোর সকালে রওনা দিলাম রাজশাহী। মা আমার সাথে গেলেন না। মা সাথে যাওয়ার নিয়ম নাকি নেই। যাওয়ার আগে আমি বেঁকে বসলাম। তাঁকে যেতেই হবে সাথে। আমার এমন পাগলামি দেখে কাজিনরাও সাপোর্ট করলো, চলেন না মামি…
এই যুগে কেও এসব নিয়ে বসে থাকে। নামিরা বললো
– মামি, আপনি এ যুগের শ্বাশুড়ি হতে যাচ্ছেন। এসব নিয়ে বসে থাকলে হবে না,
মা বললেন
– এসব নিয়ম আমিও মানি না, কিন্তু মা অসুস্থ, তিনি একা কিভাবে থাকবেন,
দাদীও বললো
– যাও বৌ… পোলার বিয়া তো একবারই হয়, আমি মিনির সাথে থাকতে পারবো,
– আর ঘরবাড়ির গুছগাছ…
না না, তোমরাই যাও, আমি না থাকলে এসব কে বলে দিবে বলো,
তারপর বাবার ধমকে আমরা বের হলাম, যাওয়ার আগে মাকে সালাম করলাম। মা আমার কপালে চুমো খেয়ে বললেন,
– সাবধানে যেও…

গাড়িতে বসে উত্তেজনা ভয়ের পাশাপাশি বিরক্তি ও কাজ করছিলো, এতো দূরে বাড়ি করার কি দরকার ছিলো, প্রসূনকে টেক্সট করলাম তা…

উত্তরে ও লিখেছে
– আমিও তাই ভাবি… তারপর একটা হাসির ইমজো দেয়া
পরের টেক্সটে বললো আমি পার্লারে, পরে কথা বলছি..

শেষমেশ রাজশাহী পৌছালাম দেড়টায়…
বিয়েটাও হয়ে গেলো ধুম করে। আহনাফ বললো বউ নাকি কবুল বলার সময় খুব কেঁদেছে, কাজী এতবার বলার পরে কবুল বললো,

আমি বুঝলাম ওর মনের অবস্থা। একসাথে বসিয়ে আয়না দেখার সময় ও ও তাকায় নি…
মেয়ে হওয়ার এই এক কষ্ট, শিকড় ছিড়েখুঁড়ে চলে যেতে হয় অজানা অচেনা পরিবেশে।

বিদায় দেওয়ার সময় খুব কাঁদলো প্রসূন। কারো কান্নাও যে এত্ত সুন্দর হয় তা আমি এর আগেও একবার শুনেছিলাম, আজ দেখলাম ও। এরপর আমরা রওনা দিলাম, তখন বাজে চারটা। দূরের পথ তাই তারা সবকিছু দ্রুত করেছেন।

গাড়িতে পাশাপাশি আমি আর প্রসূন বসা। কাঁদছে অনবরত..
ওর মনটা হয়তো ভালো নেই, বাবা মা ছেড়ে এসেছে। কিছু বলে যে সান্ত্বনা দিবো তারও উপায় নেই, সামনে ড্রাইভারের পাশে ওর বোন বসা, একটু পরপর পিছনে তাকিয়ে দেখছে।
আমি ওর হাতটা আলতো করে ধরলাম। বোঝাতে যে কেঁদো না আমি আছি তো তোমার সাথে…

চলবে….

previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/920936545034204/
next : https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=922516208209571&id=659404701187391

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here