সৎ মা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ২৭

0
214

সৎ মা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২৭

এরপরের দিনগুলো স্বপ্নের মতো সুন্দর। ঘুমিয়ে থাকা আমরা যেমন কখনো কখনো দুঃস্বপ্ন দেখি, ঠিক তেমনি ঐ দিনগুলোর আকাশ কখনো কখনো কালো মেঘে ছেয়ে যেতো। প্রসূন অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে। অসম্ভব বলার কারণ হচ্ছে আমাদের সংসার জীবনে কখনোই দুজনের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ হতো না, ওর কোন পার্থিব চাহিদা ও নেই। তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিসে ও এত খুশি হয় যা কল্পনাতীত।

একদিন রাস্তায় আসার সময় ঝড়ো বাতাসে গাছ থেকে বাবুই পাখির বাসা পরে গেলো। আমার পায়ের কাছে পরায় তা আমি তুলে বাসায় আনি। সেই পাখির বাসা দেখে ওর উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। এরপর একদিন বেইলি রোডে গেলাম ঘুরতে, ওর বায়না রিকশায় করে ঘুরবে। আমি তাই গাড়ি রেখে রিকশা ধরলাম। কি যে খুশি ছিলো ও, বলার মতো না।
ও একেবারে সাদামাটা জীবণযাপন করে ।ওর পরিবারের অন্য সবাই ই ভীষণ স্মার্ট, আর প্রসূন ভীষণ সাদামাটা। তবুও এত সাধারণ যিনি তিনি যে কত অসাধারণ এই সাদামাটা ভাবটাতে, তা বলে বোঝানো যাবে না।

কিন্তু এত ভালো প্রসূন আর আমার মায়ের সম্পর্ক আজও শীতল, অনেকটা বরফের মতো। প্রয়োজনের বাইরে কেওই কারো সাথে কথা বলে না। কোনদিনই দেখি নি দুজনে একসাথে বসে কথা বলতে। প্রসূন অনেকটা আমার বড় মায়ের মতো। লোক, ঝটলা, আড্ডা, এসব ওর পছন্দ না। দরকারী কাজ শেষে ও ওর রুমে দড়জাটা ভিড়িয়ে হয় বই পড়বে না হয় অন্য কিছু নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম একসময় ঠিক হয়ে যাবে।

প্রসূনের একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে আপনাদের সুবিধা হবে- যেমন আমাদের পরিবারের বৌ হওয়া সত্ত্বেও ওকে না ডাকা পর্যন্ত ও খেতে যেতো না। বাইরের কেও আসলে কাছে এসে জিজ্ঞেস করতো না কেমন আছেন..! ও ওর দুনিয়ায় ব্যাস্ত। এমন একটা ভাব যেন নিজ গৃহে পরবাসী। ব্যাপারটা আমি অবজার্ভে রাখলাম। ও কি স্বভাবতই এমন নাকি মাকে ওর পছন্দ না….

মা কখনোই এসব নিয়ে আমাকে কিছু না বললেও আমি ঠিকই বুঝতাম। কারন মা আর প্রসূন দু’জনেই আমার কাছের মানুষ। আমি দুজনের মাঝে কিছু না বোঝার ভান করতাম। অপেক্ষায় থাকতাম কার মুখ আগে খুলে।

আমার মা এসব ব্যাপারে কষ্ট পেলেও কখনোই কারো কাছে কিছু বলতো না। বাাইরে থেকে কেও এলে বুঝতেই পারবে না তাদের সম্পর্ক শীতল। বাবা আর দাদীর সাথে প্রসূনের ভীষণ ভাব। বাবা, দাদীর ঔষধ,অন্যন্য টুকটাক কাজ ও করতো। রান্নাঘর মা একাই সামলাতেন। ওর পড়াশুনায় যেন কোন সমস্যা না হয় তাই।

একদিন বাইরে বেড়াতে গিয়ে প্রসূনকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কি এমনই নাকি কোন কারনে এমন করছে…(মানে পুরাতন কোন ক্ষোভ) ও ব্যাপারটা একদম লাইটলি বুঝালো আমাকে, ওর এসব গল্প, আড্ডা, মানুষের দলাদলি ভালোলাগে না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কত কঠিন জিনিসটা ও কত সহজে বলে দিলো আমাকে, এটাই প্রসূন৷ এমনিতে কোন দ্বন্দ্ব নাই, কোন অভিমান অভিযোগ কিছুই নাই। তবুও দুজনের মাঝে অদৃশ্য এক দেওয়াল দেয়া। একটা সময় এ জিনিসগুলো স্বাভাবিক হয়ে গেলো।

মা আর প্রসূনের এ সম্পর্কের কারন অনুসন্ধানে হীনমন্যতায় ভুগতাম আমি। মনে মনে ভয় পেতাম সৎ মা ভেবে প্রসূন এমন করছে না তো… তাই প্রসূনকে আমি মাঝে মাঝে বোঝাতাম মা আমার জন্য কত ইম্পর্ট্যান্ট একজন। ওর এক ধারনা আমি অতি মা ভক্ত। তবে এটা অভিযোগ না.. হেসে হেসে মানুষ খুন করা পর্যায়ের কথাবার্তা।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওদের সম্পর্কটাকে উষ্ণ করার জন্য। দল বেঁধে বেড়াতে গিয়েছি সবাই। সেখানে দুজনেই এমন যেন তারা খুব কাছের কেও। প্রসূনের এক সমস্যা। কারো সাথে মিশতে পারে না। আমি আসলে যা ভেবেছিলাম তা নয়। মাকে ও শ্রদ্ধা সম্মান সবই করে, কিন্তু এর মধ্যে ওর নিজেরও একটা দুনিয়া আছে। তাই আমি আর ঘাটলাম না ওদের কে। সবাই খুশি, আমিও খুশি।

এর মধ্যে দাদী এক শীতের সকালে চলে গেলেন পরপারে। রাতেও খাওয়ার সময় কথা বললাম সবাই। সকালে উঠে দেখি মানুষটা নেই, চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। এ ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লেগেছিলো আমাদের। অনেক বছরই তো আগলে রাখলেন আমাদের। শেষের দিনগুলোতে কষ্ট পাচ্ছিলেন খুব। উঠতে বসতে কি কষ্ট বলার অতীত। চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন বেচারি।

বিয়ের বছর তিনেক পর আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। আমাদের ভালোবাসার প্রথম উপহার।
সবার সব দূরত্ব ঘোচানোর দায়িত্ব যেন সেই পুচকির কাঁধে। সারাদিন ঘর গরম করে রাখাই তার একমাত্র কাজ।
মা আর প্রসূনের দূরত্ব যেন একটু ঘুঁচলো। মা সারাদিনই ব্যাস্ত মিমোকে নিয়ে। প্রসনের সুবিধা অসুবিধা সবই দেখছে।
মিমো সারারাত জেগে থাকে দিন হলে ঘুমায়, তাই মাঝে মাঝে মা মিমোকে নিয়ে যেতেন। একটু পরপর এসে দুধ খাইয়ে নিয়ে যেতেন। সকালে আবার ঘরের কাজে ব্যাস্ত থাকতেন। প্রসূনকে প্রথমবারের মতো মার জন্য আফসোস করতে শুনেছিলাম আমি। যে মা মিমোর জন্য রাতে ঘুমোতে পারছে না। আমি মনে মনে বলি আমার মা এমনই, সব সময় পরের সুবিধা অসুবিধা দেখে।

এর ভিতর সীমান্তর ও একটা ছেলে হয়েছে। যদিও ও এখনো ঘরের বাহির। একটা মানুষ কি করে তার সীদ্ধান্তে এতটা অটল হয় সীমান্তকে না দেখলে জানতামই না। আমি ওর ছেলে দেখে একটা চেইন উপহার দিয়েছিলাম। তা ও পরদিনই মিমোর জন্য ফেরত পাঠিয়েছে। এটা রসিকতা নাকি অপমান আমি বুঝলাম না। বাবাকে ডেকে বললাম অনেক হয়েছে বাবা এসব আর ভাল্লাগছে না আমার ওর পাওনা ওকে বুঝিয়ে দিন…

চলবে..

previous : https://www.facebook.com/659404701187391/posts/921698881624637/
next :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=923213914806467&id=659404701187391

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here