সৎ মা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ২৮

0
217

সৎ মা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২৮

বাবা মা দু’জনে রাতে আমাকে রুমে ডাকলেন। বাবার শরীরটা বেশী ভালো না। আমি গিয়ে দেখও বাবা বিছানায় শোয়া, মা সুই সুতার কাজ করছেন। আমাকে দেখে ওগুলো হাত থেকে সরিয়ে রাখলেন সাইড টেবিলে। বসা থেকে উঠে আমাকে জায়গা করে দিলেন।

আমি বাবার পাশে বসলাম। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরটা আছে কি না। দেখলাম শরীর ঠান্ডা। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সীমান্তকে ওর পাওনা ফিরিয়ে দিবো। তবে ওকে এই বাড়িতে কোন ভাগ দিবো না, ও যখন এত বছরেও ঘরমুখো হলো না, থাকুক ও বাড়ির বাইরে। সম্পত্তির সমান দুই অংশ করা হয়েছে। যেহেতু বাড়ির দাম টাকার মূল্যে বেশী তাই এই পাচঁ তলা বাড়ি বাদে তুমি কিছুই পাবে না। রায়েরবাগ আর সাভরের জায়গা ওকে দিবো, এ ব্যাপার তোমার মা আর আমি দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার কোন মতামত আমরা শুনতে চাই না। শুধুমাত্র তোমাকে জানানো হলো। কাল বিকেলে উকিল এসে তোমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিবে। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি একদম স্বাভাবিক ছিলেন।

আমি বাবাকে বললাম
– বাবা ও না হয় অবুঝ, আমরাও অবুঝের মতে কাজ করছি না তো…
এর উত্তরে মা বললেন
– এই বাড়ি তোমার বাবার অনেক কষ্টের টাকায় কেনা। ও সম্পদ বেশীদিন রাখতে পারবে না তা আমরা দুজনেই জানি । কোন একদিন হঠাৎ করে শুনবে বাড়ির অর্ধেক বিক্রি করে ফেলেছে। তাই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

পরদিন বিকেলে উকিল এলো, যে সীমান্ত গত সাড়ে তিন বছর ধরে বাড়ি ছাড়া, তাকেও দেখা গেলো ঠিক সময়ের আগেই পৌঁছে যেতে। সম্পদের লোভ মানুষের চোখে পর্দা ফেলে দেয়, তা ও প্রমাণ করে দিলো। আমি তখন বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু বাবা না ডাকা পর্যন্ত যেতে পারি নি, কেমন যেন লজ্জা কাজ করছিলো সেখানে যেতে ।

সীমান্ত বাবা আর উকিলের কথা শুনে হল্লা শুরু করে দিলো। আমার এত তেজী বাবাও অবাক হয়ে দেখছিল ওর এমন কান্ড। ও চিৎকার করে বলছিলো কেন ওকে বাড়িতে কোন ভাগ দেওয়া হয় নি। আমি শুনে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। এমন একটা ভাব যেন আমি কিছু দেখছি না, কিছু শুনছিনা।

শেষে আমি যখন ওকে শান্ত করতে গেলাম ও আমার সাথেও বাজে রকমের ব্যাবহার করলো। এমন কিছু কথা বললো যা শুনে আমার কান দিয়ে ধোঁয়ার মতো বেরুতে লাগলো।
আমি ওর বড় ভাই তবুও ওকে শাসন করার সব শক্তি আমি হারিয়ে ফেললাম।

আমি বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলাম, রাতে ফিরে বাবাকে জানিয়ে দিলাম বাড়ির যেই অর্ধেক ও চায় তা ওকে দিয়ে দিতে আর সাভরের কারখানাটা আমাকে দিতে।

এসব সম্পদের ভাগবাটোয়ারা হলো ওর পছন্দ মতো। বাড়ির প্রথম ও দু’তলার মোট আটটা ফ্ল্যাট আর সাভারের কারখানা ও নিবে। তিনতলার ফ্ল্যাট বাবা মার জন্য বরাদ্দ। তারা মারা যাবার পর সমান ভাগ হবে দুই ভাইয়ের মধ্যে।

আমি একটা টু শব্দ ও করলাম না। বাবাকে দেখা গেলো বিমর্ষ। এ ঘটনার পর হঠাৎ করে তার অসুস্থতা বেড়ে গেলো। হসপিটালে করা রিপোর্ট দেখে জানা গেলো বাবার কিডনি ড্যামেজ, হার্টে ও দুটো ব্লক। পানির মতো খরচ হতে লাগলো টাকা পয়সা। ব্যাবসা দুই ভাগ হয়ে যাওয়ায় তেমন ভালো যাচ্ছিলো না। সবদিক থেকে বিপদে ঘিরে ফেললো আমাদের সুখের পরিবারটাকে।

তবুও আমরা বাবাকে নিয়ে সিংঙ্গাপুর গেলাম। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যাবে বাবা গেলে বাবাকে পাওয়া যাবে না। খরচ বাঁচাতে আমি আর বাবা দুজনেই গেলাম। বাবার ২ টা অপারেশন টা হলেও আরো একটা করা বাকী ছিলো৷ টাকার অভাবে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাকী চিকিৎসা দেশেই হবে।

বাবার সাথে থাকার কারনে ব্যাবসার একেবারে দূরহ অবস্থা।
দেশে ফিরে আমরা টাকা ম্যানেজ করতে আমাদের সম্পদের দিকে তাকালাম। সীমান্ত একবার শুধু দু’লাখ টাকা দিয়েছে, আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও আমাদের টাকা জোগাড়ের যুদ্ধের কোন টেরই পেলো না ওরা। শেষে মা তার গহনা আর ব্যাংক ডিপোজিট সব ক্লোজ করে দিলেন।

এমন সময় প্রসূনও বিয়ের গহনা বের করে দিয়েছিলো আমার হাতে। কিন্তু মা ওর গহনা নেয় নি। বলেছে শেষে যদি সমস্যা হয় তবেই নিবে, তা না হলে না….

অবশেষে টানা তিনমাস নিজের সাথে যুদ্ধ করে বাবা মারা যান। আমার জীবণের সবচেয়ে দুঃখময় স্মৃতি হচ্ছে বাবার চলে যাওয়া। হঠাৎ করে মানুষ মরে গেলে আগে থেকে কোন কষ্ট হয় না, কিন্তু আপনি যদি জানতে পারেন আপনার অতি প্রিয় কেও আর কিছুদিন বেঁচে আছে তার বেঁচে থাকার আর কোন আশাই নেই, তখন তার কাছের মানুষগুলো বেঁচে থেকে ও অসুস্থ ব্যাক্তির আগেই মরে যায়।

তেমনি আমরা বেঁচেও মরে ছিলাম। বাবা মারা যাবার পর আমাদের বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে চলতে হলো। ব্যাবসায় অনেক টাকা ইনভেস্ট করা জরুরী কিন্তু সেই টাকা যে কোথাও পাবো সেই আশাও নেই ৷

আত্মীয়রা কেও এগিয়ে এলো না, সবাই দুঃখ প্রকাশ পর্যন্তই রইলো, মা আমাকে পরামর্শ দিলেন চারতলার ফ্ল্যাট গুলো মর্টগেজ দিয়ে ঐ টাকা দিয়ে শুরু করতে। আমার ফুফু যখন শুনলেন ব্যাবসার টাকার জন্য ফ্ল্যাট মর্টগেজের দিয়েছি তারা ভীষণ আফসোস করলেন। কেন তাদেরকে জানানো হলো না, তারা জানলে তারাই নিজেদের মধ্যে রাখতেন ফ্ল্যাটগুলো, বাইরের লোক ঢুকানোর দরকার পরতো না। মা সেদিন অনেক কেঁদেছেন৷

বিপদের দিনে টাকা দিয়ে সাহায্য করার মতে কেও নেই, কিন্তু ফ্ল্যাট মর্টগেজের টাকা আছে তাদের। তখন আমি বুঝলাম আপন আর আত্মীয়র পার্থক্য।

সেইদিন গুলো আমাদের অনেক সারভাইভ করতে হয়েছে। মা আর প্রসূন আমার পাশে থেকে সাপোর্ট করেছেন। আমি আগের মতো পরিশ্রমি হয়ে গেলাম। টাকার অভাবে বাড়িতেই অফিস খুললাম। প্রসূন অফিস দেখতো বায়ারদের অর্ডার নিতো, আর আমি খাটতাম বাইরে। ঘুরে ঘুরে কাজ নিতাম।

প্রথমটা ভিষণ কষ্টের ছিলো। এমনও হয়েছে কাজের চাপে আমার খাওয়াও হয় নি, আমার ভাই হওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত একটাবারের জন্য ও খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন মনে করে নি।
আমরা যখন বেঁচে থাকতে যুদ্ধ করি আমার নিচের ফ্ল্যাটে থাকা ভাই তখন ওর ফ্ল্যাট ভেঙে রিনোভেট করে। বাসার আসবাব আনে বিদেশ থেকে ইম্পোর্ট করে।

মা ওর এসব কান্ডে একটুও বিচলিত হতেন না। এমন একটা ভাব যেন তিনি আগেই জানতেন এমনই হবে…

চলবে…

previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/922516208209571/
next :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=923972678063924&id=659404701187391

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here