সৎ_মা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩

0
366

#সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩

আমি এরপর এস.এস.সি, এইচ.এস.সি দিলাম, গ্রাজুয়েশনও কম্পিলিট করলাম। সীমান্ত তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র। বাসায় দাদি আমাকে বিয়ের জন্য জিজ্ঞেস করলো, আমি তো পুরো হতোবাক, মাত্র পড়াশুনা শেষ করলাম। চাকরিবাকরি খুঁজবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর না হয় বিয়ে। দাদীকে একথা বললে দাদীর একটাই কথা তোর বাপের কারবার দেখে মানুষে আর তুই করবি পরের কাম। ক্যানরে ব্যাটা…

এসব শুনে আমি আমতা আমতা করতাম। কারন বাবার থেকে দূরে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই অদৃশ্য এক দেওয়াল টেনে নিয়েছি আমি। ঠিক কবে এটা করেছি আমি জানি না। তার থেকে নিজেকে লুকাতেই বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করি। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে কথা বলি না। কিছু জিজ্ঞেস করলে এক শব্দে উত্তর দেই

এর অনেক পরে বাবা আমাকে একদিন ডেকে তার ব্যাবসা দেখার কথা বললেন। ততোদিনে আমি বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন করছি। সেখানেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা। মা ও বোঝানোর চেষ্টা করছে বাবার বয়স হয়েছে, তার এখন রেস্টের দরকার। নিতান্ত অনিচ্ছায়ই আমি বাবার ব্যাবসার হাল ধরলাম।

বেশ কিছু সময় লাগলো ব্যাবসার নাড়িনক্ষত্র বুঝতে। আস্তে আস্তে পুরোদমে ব্যাবসায়ী হয়ে পরলাম আমি। এক এক করে বাবাও সব দিকটা বুঝিয়ে দিলেন আমাকে। বছর দুই পর আমি ফুলটাইম বিজনেস ম্যান। খুব সকালে বেরিয়ে পরি, নিজে ঘুরে ঘুরে কারখানার মালামাল কিনি, কখনো খুলনা, যশোর, কিংবা কখনো চট্টগ্রাম। পাইকারদের কাছে মাল পৌছানোর তদারকি থেকে সপ্তাহান্তে টাকা তোলা, সবই আমি দেখতাম। বাবা মাঝেমাঝে এসে কিছু সময় থেকে চলে যেতেন। দুপুরের খাবার প্রায়ই বাইরে খেতে হতো আমার। মা ফোন করে মনে না করলে কোন কোন দিন ভুলেই যেতাম। তবে মা ঠিকই বুঝতে পারতেন। এখন তাই নিয়ম করে ফোন দেয় প্রতিদিন দুপুরে। আর রাতে ফিরতে ফিরতে এগারো-বারোটা বাজতো প্রতিদিনই। এসেই দেখতাম বাবা টিভি দেখছেন। আসলে তিনি, আমার জন্য অপেক্ষা করছেন…!

মা আমাকে খাবার গরম করে দিতো। প্রথম প্রথম বাবা প্রায়ই আমাকে লুকিয়ে দেখতো। আমি না তাকিয়েও বুঝতাম ব্যাপারটা। হয়তো ভাবতো আনাড়ি আমি ব্যাবসাটা কি সুন্দর গুছিয়ে নিয়েছি৷ ব্যাবসা আমি যে এত ভালো বুঝি আমি নিজেই জানতাম না। ব্যাবসায়ী রক্ত শরীরে তাই হয়তো। আমার দাদা, তার দাদা ও নাকি ব্যাবসায়ী ছিলেন। বাবার সাথে শখ্যতা না থাকায় আমি একটু চেষ্টা করেছিলাম রীতিটা ভাঙতে। তবে মধ্য পথে শরীরে বয়ে যাওয়া রক্ত বাঁধা দিলো। ব্যাপারটা জেনেটিক্যালি না হলে ব্যাবসা টা হয়তো কন্টিনিউ করতে পারতাম না।

এরপর কোনদিক দিয়ে যে সময় যেতে লাগলো টেরই পেলাম না। এখন আমার বয়স একত্রিশ। দাদী আমাকে হাতের কাছে পেলেই বিয়ের কথা বলে। মাও মেয়ে দেখা শুরু করেছেন বেশ কিছুদিন আগেথেকে। তবে এসব ব্যাপারে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমার যত ইন্টারেস্ট ব্যাবসা নিয়ে। কোন প্রোডাক্টে কত ইনভেস্ট করলে কতগুন রিটার্ন পাওয়া যাবে কিংবা কখন কোনটা মার্কেটে ছাড়লে কোম্পানির লাভ বেশী হবে এই যেন আমার ধ্যান জ্ঞান, আমার দুনিয়া। আপাততঃ লক্ষ্য এই প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক করা। এক মুহূর্ত সময় নেই নিজেকে নিয়ে ভাবার। এত ব্যাস্ত থাকি সবসময়।

আমাদের বাড়িতে এখন একটাই গান, আমার বিয়ে..! আমি সবসময় কথার ফাঁকফোকর দিয়ে কেটে পরি৷ কেটে পরতে পরতে এখন আমি সিদ্ধ হস্ত। আগের মতো বেগ পেতে হয়না আর।

দাদী আর ফুফু এই দুজন মিলে সারাদিন ফন্দি আটে রাইসা আর আমার বিয়ে দেওয়াার জন্য , দাদীর নিয়ম করে বিয়ের জন্য তাগাদা দেওয়া ঐ পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ । আমি বরাবরের মতো পাত্তা না দিয়ে আমার ঘরে গিয়ে ফোণ করলাম রাইসাক…

: কিরে বুড়ি ….., কেমন আছিস….?
: ভালো নারে ভাইয়া
: কেন কি হলো আবার, সায়মনের সাথে কিছু হলো নাকি….?
: আরে নারে ভাইয়া….., মা কি যে শুরু করছেন,
: কেন কি হয়েছে…
: প্রতিদিনই তোর আর আমার বিয়ের কথা শুনতে শুনতে আমি তিতা হয়ে গেছি…আমার আর ভাল্লাগে না বুঝলি, বুড়া ধামড়া হচ্ছিস, বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে সেই কবে, এখনও
বিয়ে করছিস না, তুই বিয়ে করলে তো এসব গান আর শোনা লাগতো না …
: তিতা হয়ে গেছিস! বলিস কি….!
: হুম…
: যাক তোকে আর চিন্তা করতে হবে না, আমি আজই দাদীকে বলে দিবো আমি রাজি এই বিয়েতে…..
: কি বলছিস তুই ভাইয়া……..
তোর কি মাথা নষ্ট হয়েছে…..
কিছু সময় চুপ থেকে হেসে বললাম
: কেন তুই ই তো বললি বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। সময় নষ্ট করার সময় নাই…
: কি…!
একটু হসে বললাম
: আরে পাগলী, মজা করলাম,
: মজা করলা না….. সায়মন কনফারেন্সে ছিলো, এ কথা শুনে কল কেটে দিয়েছে…. আল্লা মালুম কি আছে কপালে..
ফোণ রাখ হারামী……
: শোন শোন , কথা শেষ করে কল দিস কথা আছে……
বলে শেষ করারা আগেই কলটা কেটে গেলো।
আল্লাহই জানে কোন ঝামেলা লাগালাম…

ওদের এমন খুনসুটি দেখে ভালোই লাগে। অনেকদিন পর একটু যেন সময় পেলাম ভাববার। এত ব্যাস্ত থাকি আর আজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে রেস্ট নিতে হচ্ছে, সবই কপাল….
তবে সময়টা ভালোই কাটছে, ভাগ্যিস গতকাল রাতে ফিরবার সময় হঠাৎ সামনে আসা এক কুকুরকে সাইড দিতে গিয়ে বাইক নিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরে গিয়ে হাতটা ভেঙে গিয়েছিলো । ভাগ্যিস মেইন রোড না হয়ে গলির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছিলো। তাই সামান্য ব্যাথায় পার পাওয়া গেছে।
হাতের অবস্থা তেমন মারাত্মক না, সামান্য মচকে গেছে, কিন্তু তখন আমার মনে হচ্ছিলো আমার হাত বোধহয় ভেঙেই গেছে এমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিলো।

এ ঘটনায় এতদিনে একটু ফুরসত পেলাম। বাবা বললো রেস্টে থাক তুই, এ কয়দিন না হয় আমিই দেখি ব্যাবসাটা।

আমি আবছা আলোয় বিছানায় শুয়ে আকাশ দেখছি, আমার ঘরের বারান্দার দিকের দেয়ালটা পুরো কাঁচের। থাই গ্লাসটা খোলা। বাতাসে সেখানকার সাদা পর্দাগুলো দুলছে। সেই দুলুনির তালেতালে চাঁদ যেন উঁকি দিচ্ছে।আজকের চাঁদটা অনান্য দিনের থেকে বেশ বড় আর উজ্জ্বল। কেমন যেন মায়াময় আচ্ছন্নতা ঘিরে ধরছে আমাকে । উঠে আমি বারান্দায় রাখা বেতের রকিং চেয়ারটায় বসে দুলছিলাম। এখন চাঁদটাকে আরো কাছে মনে হচ্ছে। আজকের পরিবেশটা সুন্দর। হালকা বাতাস, বারান্দার গাছগুলো, আর এই অপরূপ চাঁদ। দেখছি আর ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে যাচ্ছি। একেবারে আগের জীবণে….
চলবে..

previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=900904483704077&id=659404701187391
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/902500376877821/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here