সৎ_মা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ১

0
652

#সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ১

আমার বয়স যখন ৭ বছর তখন বাবা আমার নতুন মাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন । তার আগমণে পুরো বাড়িটা কেমন যেন স্তম্ভিতো হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক যেমন হয়েছিলো দাদা মরবার সময় তেমনি।

দাদির মুখটাও গোমরা ছিলো সেদিন । পুরো বাড়ি জুড়ে একমাত্র আমিই খুশি ছিলাম নতুন মা আসায়। আমার এ খুশি দেখে আমার ফুফু দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়িয়েছিলো “তোর এখন কি হবে ” এই বলে । আমি ফুফুর এমন রূপ দেখে অভস্ত্য ছিলাম না, তাই কিছুটা বিচলিত হয়ে পরেছিলাম। জীবণে কোনদিনও আমাকে নিয়ে চিন্তা না করা ফুফু হঠাৎই কেন যেন ভীষণ দরদী
হয়ে উঠেছিলো।

কোন মতে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে গেলাম নতুন মায়ের ঘরে , যেই ঘরটা অল্প কিছু দিন আগেই ছিলো
আমার মায়ের। গিয়ে দেখি নতুন মা চেয়ারটাতে বসা, বাবা যেন কোথায় গিয়েছে নতুন মাকে একা রেখে । নতুন মা মাটিতে তাকিয়ে কি যেন দেখছিলো , কি আর দেখবে বেচারী……
হয়তো দেখছিলো তার দূর্গম ভবিষৎ-নামা….

আমি অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে ,তবুও নতুন মা একবার ও তাকালো না আমার দিকে। তখন আমি রাগ হয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম । নতুন বৌ যে এমনও হয় তা আমি সেদিনই জেনেছিলাম । কারন নতুন মা সেদিন কোন শাড়ি ,গহণা পরা ছিলেন না । মলিন একটা জামা পরেছিলেন সেদিন। মলিন এ জামাটা নতুন মায়ের সৌন্দর্য একটুও কমাতে পারেনি বরং বুঝিয়েছিলো এমনিতেই তিনি কত্ত ‍সুন্দরী ।

নতুন মাকে দেখে আমি মুগ্ধ । ওটুকু বয়স ছিলো তবুও বুঝেছি তিনি আমার মা হবার নয়, কারন আমার বাবা ছিলেন চল্লিশ ছুই ছুই আর নতুন মায়ের আর কত হবে ২০ কি ২১………..

(ফুফু বাবাকে বকছিলো আর বলছিলো আমার বড় বোন বেচেঁ থাকলে নাকি নতুন মায়ের বয়সী হতো। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে কিভাবে পারলো বিয়ে করতে। পাশের বাড়ির খালারা বলছিলো নতুন মা কাল-নাগীনী সাপ নাকি । তখন আমি ভাবছিলাম মানুষ আবার সাপ হয় কি করে….)

এতক্ষণে নতুন মা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকালেন, মুহূর্তেই চোখ নিচে নামিয়ে
আবার ব্যাস্ত হয়ে গেল তার ভবিষৎনামা পড়ায়।পরের দিন পরীক্ষা হলে আমি যেমন ব্যাস্ত হয়ে যাই ঠিক তেমন……

আমি না কষ্ট পেয়েছিলাম তার এমন আচরণে , মনে হচ্ছিলো বাইরের মানুষ গুলোই ঠিক বলছে, নতুন মা ভালোনা।

কিছুক্ষণ পরই বাবা এসেছিলেন, বাবাকে বাড়ির সবাই ভয় পায় এমনকি আমিও,বাবাকে দেখে আমি ঘর থেকে বের হতেই বাবা আমার হাত ধরে তার কাছে নিয়ে বললো….
: বুঝলে আয়শা ও আমার একমাত্র ছেলে ,তুমিই আজ থেকে ওর মা । ও খুব দুষ্ট কিন্তু বড্ড ভালো ছেলে। ওকে কখনো তুমি খারাপ জেনো না। ওকে নিজের সন্তানের মতো দেখবে এটুকুই চাওয়া আমার তোমার প্রতি । নতুন মা তখনো মাটিতে তাকিয়ে, এমন ভাব যেন উনি কিছু শুনেনই নাই।

মার যে সেদিন কেন মন খারাপ ছিলো তা এতো বছরেও কেও জানে না আমি ছাড়া । সবার ধারণা নতুন মা গরিবের মেয়ে তাই হয়তো বাবাকে চালাকি করে বিয়ে করেছেন অর্থ সম্পদের লোভে। কিন্ত আসল ঘটনা ছিলো অন্য —–

নতুন মায়ের এ বিয়েতে কোন মত ছিলো না ,ঘরে তার সৎ মা। ঘাড়ের বোঝা নামাতেই তার বিয়েতে এত্ত তড়িঘরি। নতুন মা নাকি তার মায়ের কাছে পা ধরে বলেছিলো তাকে এখানে বিয়ে না দিতে । তিনি (মানে আমার নতুন নানী) নাকি নতুন মাকে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বলেছিলো “বিয়া যদি না করো তবে এটা নিয়ে যেখানে মন চায় চইলা যাও , আমি কিছু কমু না, যা মন চায় করো, তয় জলদি, দয়া কইরা আমারে একটু মুক্তি দাও”

মা নাকি ৩ দিন না খেয়ে ছিলো তবুও মন গলেনি তার……
আপন মা হলে হয়তো এমন করতে পারতেন না । নতুন মায়ের হাতটা ধরার কেও ছিলো না তখন কেও থাকলে মা ঠিক চলে যেতো। হাত ধরবার মানুষটি তাখন প্রবাসে ছিলো। কথা দিয়েছিলো ফিরে তাকেএ জীবণ থেকে মুক্ত করে ঘরে তুলবে। কিন্ত তার ফিরবার আগেই নতুন মাকে এক সৎ মায়ের হাত থেকে বেচেঁ নিজে সৎ মায়ের দায়িত্ব নিতে ঢাকায় আসতে হয়েছিলো। সেখানে তার সৎ মায়ের ভাইয়ের বাড়িতেই বিয়ে হয় তার। এ কথাগুলো আমি নতুন মায়ের ডায়রী পরে জেনেছিলাম, ঠিক ডায়েরি না, ছোট্ট রুল টানা বাংলা খাতা। তাও অনেক অনেক দিন পর। সবচেয়ে কষ্ট লেগেছিলো ডায়রীর একটা কথা পড়ে, নতুন মা একটা পাতার কোন এক লাইনে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ লিখেছিলো “সৎ মা তাকে নিজের বয়সের দ্বিগুন, বাবার বয়সী একটা লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তাও তো ভাত কাপড়ের একটা নিশ্চয়তা আছে এখানে। অন্ততো রাস্তায় তো নামায় নি” এত বড় ক্ষতি করার পরও তিনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ব্যাপারগুলো আমি তখন এত ভালো বুঝিনি, তবে এই ডায়রী আমি তাকে নতুন মা থেকে আমার মা করে নেবার দিন পড়েছিলাম। যদিও এটা অন্যায় করেছি আমি। তবে তখন ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্যটা আমার দৃষ্টির সীমানার বাইরে ছিলো। নিতান্তই ক্লাস ফাইভে পড়া বালক ছিলাম।

নতুন মাকে বসার কেওই পছন্দ করতো না। শুধু আমি আর বাবা ছাড়া। আমি পছন্দ করতাম কারন নতুন মা আমার মা ছিলো না, ছিলো আমার বন্ধু। এটা সবার মাথা ব্যাথার কারণ ছিলো। সত্য কথা বলতে আমি ও নতুন মাকে প্রথম প্রথম দেখতে পারতাম না। কারন আমার দাদী আর ফুফু আমার মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যে উনি আমার সৎ মা। আমার শুভাকাঙ্খী নন…

বাড়িতে কাজের লোক থাকায় সব কাজ তারাই করতো মার কাজ ছিলো দাদী আর আমাকে দেখাশুনা করা। ৪ জনের সংসার আমাদের। দাদী নতুন মায়ের প্রতি মনে মনে সন্তুষ্ট ছিলো তবে প্রকাশ করতো না। সারাদিন আমার মায়ের কথা বলে বলে নতুন মাকে কষ্ট দেওয়াই ছিলো আমার দাদীর একমাত্র কাজ। কেও একটা বারের জন্যও ভাবতো না তিনি কুমারী মেয়ে তারও তো স্বপ্ন ছিলো অন্যরকম একটা জীবণের। এমন একটা লোক ওনার স্বামী হবে তা কোন দিনও কল্পনায় ভাবেনি হয়তো। সেই হিসেবে সমবেদনা, ভালো ব্যাবহার তো দূরে থাক উল্টো কারী কারী কথা শুনাতো তাকে। কারণ তার বাবা গরীব আর তিনি একা এসেছেন বৌ হয়ে….

নতুন মাকে আমি আমার মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম সেই দিন যেদিন মা আমাকে বাচাঁতে নিজে বাবার হাতে মার খেয়েছিলেন। আমার বাবার এই এক দোষ কথার আগে তার হাতটা চলে। মাও বুঝে উঠতে পারেনি বাবা যে তার গায়ে হাত তুলবে। আমি ভয়ে ফুফুর বাসায় চলে গিয়েছিলাম। ফুফুকে কিছুই বলিনি।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি নতুন মা কোথাও নেই। বুকটা কেমন যেন ছেৎ করে উঠেছিল। পা টিপেটিপে এদিক সেদিক খুঁজি কোথাও নেই। এমন সময় প্রতিদিন মা সবার জন্য নাশতা বানান রান্নাঘরে। সেখানটাও আজ বাতি নেভানো,

শেষমেষ তাকে পেলাম তার ঘরে। তখন তিনি খাটে শোয়া। জানালার পর্দা সরিয়ে যখন মার চেহারাটা দেখলাম, খেয়াল করলাম কেমন যেন ফোলা, মাথায় ও ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। আমি কেমন যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।

দৌড়ে দাদীর ঘরে গিয়ে খাটের উপর বসে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম নতুন মায়ের কি হয়েছে। দাদী বললো তোর বাবা নতুন মালের যে স্যাম্পল চায়না থেকে আনছে তার প্যাকেট তর নতুন মা হারায়ে ফেলছে। কেমন বেখেয়ালি মহিলা, স্বামীর কামের জিনিস একটু হুস কইরা রাখব না ক দেহি…

আমার মনে কেমন যেন একটা মোচর দিলো। কারন ঐ প্যাকেটটা আমার কাছে। কাগজগুলে আছে কিন্ত ভিতরের জিনিসটা ভেঙে ফেলেছি আমি। তা নতুন মা ও জানে।

নতুন মা বলেছিলো তুমি ভেবো না আমি আমার কথা বললে তোমার বাবা রাগ করবেন না। কিন্ত রাগ যে হাতে গড়াবে তা মা স্বপ্নেও ভাবেন নি। কারন নতুন মাকে বাবা অনেক ভালোবাসেন….

পরদিনই মা রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যান কারন বাবা বলেছিলো মাকে যেন না দেখে এসে। আমার বাবা ভালো যেমন বাসতে পারেন ঠিক তেমনি কথার, শারীরিক ও মানসিক অাঘাত দেওয়ার বেলায়ও উনি সিদ্ধ হস্ত। এমন সব কথা বলে ঘিন্নায় তখন মনে হয় ছাদ থেকে পরে নিজেকে শেষ করে ফেলি।

মা নতুন মানুষ, বাবার মতিগতিতে এখনো অভস্ত্য হয়ে উঠেনি তাই হজম করতে পারেনি, তাই রাতটুকুন কাটিয়ে সকালেই কাওকে কিছু না বলে চলে যায় ময়মনসিংহ। বাবা সে রাতে বাড়ি ফিরেন নি।।সেদিন বিকালেই বগুড়া গিয়েছিলেন। মা এমনিতেই সবার এমন আচরণ, বাড়ির এমন বৈরী পরিবেশ নিতে পারছিলো না তার উপর বাবার এ আচরণ। অতিষ্ঠ হয়ে বেচারী ঘর ছেড়েছেন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মার ঘর ফাঁকা দেখে কষ্টটা বেড়ে গেলো বহু গুনে। সাথে সাথে আমি ডাইরিতে নম্বর খুঁজে বগুড়ায় বাবাকে টেলিফোণ করে জানালাম। বাবা একথা শুনে তো রেগে আগুন। আর ফুফু সেই আগুনে সময়মতো ঘি দিতে একটুও ভুল করেন নি। ফুফু বলেছিলো কত্ত বড় সাহস ওর, কাওকে না বলে চলে যায়। এই বাড়ির দড়জা ওর জন্য বন্ধ…….
আমি মনে মনে তাকে বলি – আপনি কে তার দরজা বন্ধ করার। সাহসের অভাবে কথাগুলো অব্যাক্তই রয়ে গিয়েছিল সেদিন।

চলবে…

Next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=900904483704077&id=659404701187391

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here