অনুভূতিরা মৃত উনিশ পর্ব

0
129

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
উনিশ পর্ব
.
শাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ আছে, এই ঘ্রাণটা সরাসরি নাকে লাগে না। শাড়ির আঁচল ধরলে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, বনলতা আমার সামনে এখন। খুব অাদি হয়ে চোখের কাজলটুকু দেখিয়ে জানতে চাইছে– শাড়িতে কেমন লাগছে আমায়? আর খুব শক্ত গলায় বলে দিচ্ছে, একদম সবসময়ের মতাে বলবা না যে পরীর মতো লাগছে। ওর কথা থামিয়ে নিজের অচেতনে বলে ফেললাম, আজ একদম পরিদের রাণীর মতো লাগছে। বনলতা হাসছে আর ওর লাজুক নাকটা কাপছে।
.
শহরের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমাদের প্রেম কাহিনী। শুরুটা তো রূপকথার গল্পের মতো। হয়তো রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে। শাড়ি পরিহিত বনলতা সামনে দাঁড়িয়ে আমি ছোট করে প্রশ্ন করলাম। — আজ কোথাও যাবে?
— হ্যাঁ!
বলতেই টেনে আমায় রিকশায় বসাল। রিকশা চলছে বনলতা হাসছে, মুখে তার অদ্ভুত হাসি। সচরাচর দেখা যায়না এই হাসি। রিকশার গতির সাথে সে বলে উঠল, তোমায় নিয়ে একদিন রাতের শহর ঘুরতে চাই সেটা আবার রিকশায় করে। আমি মুচকি হেসে বলি, আচ্ছা। রিকশা এসে থামল হসপিটালের গেইটে। মনের ভিতর প্রশ্ন হসপিটালে কেন? কিছু সময়ের মধ্যেই উত্তর পেয়ে গেলাম। আমি বসে আছি হসপিটালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের রুমে, পাশেই বনলতা। খানিকক্ষণ পর একজন ভদ্র-মহিলার আগমণ। শরীরে ডাক্তারী পোশাক। উনি আসতেই, আমি সালাম দিলাম। আমার সালাম শুনে আড় চোখে তাকালেন। সালামের উত্তর না দিয়ে বলে উঠলেন, তুমি রুয়েল? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর করলাম। বনলতা বলে উঠল।
— পিসি তোমায় বলেছিলাম না রুয়েলের কথা।
— আমার মেয়ের কাছ থেকে তোমার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। তাই বললাম একদিন নিয়ে আসিস।
আমাদের কথার ফাঁকে বনলতা বলে উঠল।
— জানো পিসি ও খুব ভালো গল্প লিখে, ওকে কতবার বললাম একুশে বইমেলার জন্য পাণ্ডুলিপি বানাতে ও শুধু বলে ভয় করে।
বনলতার কথা শেষ হতেই পিসি বলল।
— ভয়ের কিছু নেই, একবার বইয়ের পাতায় নাম চলে আসলে সকল ভয় কেটে যাবে।
.
সন্ধ্যা নিয়ে ঘনিয়ে আসছে, পশ্চিমা আকাশে সূর্য ডুবতে বসেছে, হসপিটাল থেকে বিদায় নিলাম। বনলতার পিসি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। মায়ের মত আদর করে তাকে। মা হারানোর পর পিসির কাছেই বড় হয়েছে। মায়ের আদর স্নেহ সব পিসির কাছ থেকেই পাওয়া। মায়ের মতোই ভালোবাসে পিসিকে, আমাকে পিসির কাছে নিয়ে আসার একটাই কারণ পিসি দেখতে চেয়েছিল আমায়৷ বনলতা সবটা বলেছে, কথা দিয়েছে পিসি। সবটা সহজ করে তুলবে উনি৷ কিন্তু গ্রাম্য ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে, শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা। হ্যাঁ, আমাদেরও ঠিক এমনটাই হয়েছিল।
.
পড়ন্ত বিকেল, এলোমেলো হাওয়া বয়ে চলছে বৃক্ষের ঢালে। রৌদ্দুর বইছে মাঠ ঘাট পেরিয়ে। সাথে বেড়ে চলছে বনলতার অভিমান। বনলতা আজ অভিমান করছে। খুব অভিমান। এই প্রথমবার তার জন্য গোলাপ আনিনি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস ভুলিনি। কিছু জিনিস ভুলা অসম্ভব। বনলতার জন্য গোলাপ নেওয়াটা তেমনি এক অভুলা কাজ। লন্ডন ম্যানশনে কাজ শেষ করে রিকশায় বসে উঠলাম। সূর্যের উত্তাপ। এই উত্তাপ নিয়ে রিকশার প্যাডেল মেরে চলছে রিকশাওয়ালা। এই শহরের আনাচে কানাচে রিকশাওয়ালারা এক প্যাডেল যুদ্ধা। যারা যুদ্ধ করে বৃষ্টির সাথে, তারা যুদ্ধ করে রোদের তাপের সাথে, কখনো আবার ঘুমের সাথে। গভীর রাত। শহরে যখন পিনপতন নীরবতা। আপনাকে যেতে হবে হসপিটালের উদ্দেশ্যে নয়তো কোন জরুরি কাজে, বাইরে বের হতেই যানবাহনের সঙ্কট। গভীর রাতে এটাই স্বাভাবিক। আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে তখন হাজির এক রিকশাওয়ালা। আশেপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন, একজন রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে বসে আছে আপনার অপেক্ষায়। নিরাপদে পৌঁছে দেয় আপনার গন্তব্যে।
.
রিকশা ছুটে চলছে বনলতার উদ্দেশ্যে। অপেক্ষারত বনলতা আমার অপেক্ষায়। রিকশা এসে থামল গন্তব্যে। নির্ধারিত ত্রিশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে চলে যাবো তখনি রিকশাওয়ালার ডাক– মামা। অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। কখনো কোন রিকশাওয়ালা এভাবে ডাকেনি। ছোট করে বললাম।
— জ্বি বলুন।
রিকশাওয়ালা বলে উঠলেন।
— মামা বিশ টাকা বেশি দেওয়া যাবে?
আবারও অবাক হলাম। অবাক দৃষ্টিতে বললাম।
— ত্রিশ টাকা ভাড়া তো মেটালাম। তো আবার বিশ টাকা চাচ্ছেন কেন?
— মামা, বিশ টাকা ভাড়া বেশি দিলে আমার বউয়ের জন্য একটা কেক নিতাম। আজ আমাদের দশ বছরের বিবাহ বার্ষিকী। একটা কেক দেখছিলাম। এখনও বিশ টাকা কমতি আছে, আপনি দিলে কেক নিয়ে সোজা বাসায় চলে যেতাম। বউ আমার অপেক্ষা করছে।
বিশ টাকা হাতে ধরিয়ে বলে উঠলাম। আহা ভালোবাসা। নতুন করে ভালোবাসার যত্ন শিখলাম। ভালোবাসলে যত্ন করতে হয় নয়তো মরিচা ধরে, ধীরে ধীরে অবহেলা আর অযত্নে হারিয়ে যায়। বাম পকেটে থাকা টকটকে লাল গোলাপটি তুলে দেওয়ার আগে শুভকামনা জানাতে ভুল করিনি। এক দশক পেরিয়ে ভালোবাসাময় সংসারে ভরে উঠুক।
.
সব শুনে বনলতার অভিমান মূহুর্তেই হারিয়ে যায়। আনন্দে আত্মহারা বনলতা বলে উঠল, এখনো পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসা বিরল। প্রিয় মানুষটির জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। শত ব্যস্ততায় একটু সময় বের করা। হাজার ঝড়-ঝাপটার ভিতরেও হাত ধরে রাখা। এটাই প্রকৃত ভালোবাসার নিদর্শন। কথাগুলো বলতে বলতে সে আরো জানালো। পিসি বাবাকে বলেছে আমাদের কথা। বাবা আমাদের মেনে নিবে। সবকিছু গুছিয়ে তুলে দিবে তোমার হাতে। আমি নিশ্চুপ। মনের অন্তরালে বলে উঠলাম। বোকা মেয়ে, পৃথিবীতে এমন কোন পিতা নেই। মেয়েকে অন্য ধর্মের একটি ছেলের হাতে তুলে দেবে। বনলতা যতটা সহজ ভাবছে বিষয় তত জটিল। তারপরও আমি তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললাম মেনে নিলেই হলো। মাঝেমধ্যে মনের বিরুদ্ধে যেয়েও বলতে হয়। প্রিয় মানুষকে আনন্দে দিতে হাসাতে হয়। এতে ভালো থাকে প্রিয়তমারা। ভালো থাকে প্রিয়রা।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here