রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_১

0
779

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_১

রিমি ভালো করে গেটওয়ের নেমপ্লেটটাতে চোখ বুলালো।
বাড়ির নাম “ক্ষণিকের বিশ্রামাগার”! মানে কি? এ বাড়িতে সবাই কি ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে? গেটে বড় সাইনবোর্ডে লিখা, বাগান হইতে সাবধান। ফুলে হাত দেওয়া নিষেধ! লোকে কুকুর হইতে সাবধান লিখে, এখানে বাগান লিখা।
এই বাড়িতে টিউশানি করতে আসার প্রথম দিনেই রিমির মাথা এলোমেলো। এ বাড়ির ভাব-সাব সে কিছুই বুঝতে পারছে না। গেটের দারোয়ান কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, এ বাড়ির বড় সাহেব আব্দুস সালামের সাহেবের শরীর খারাপ! তার মানে কি? রিমি কি চলে যাবে? আব্দুস সালাম সাহেবই তো রিমিকে এপয়েন্ট করেছে এখানে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভাবতে ভাবতে রিমি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বড় লনে সুন্দর বিশাল বাগান। বাগানের মাঝখানে সবুজ মার্বেল পাথরের ফোয়ারা! বাগান বাহারী ফুলে ভরা। রিমি ফিসফিস করে বললো, ও আলাহ গো.. এটাতো বেহেশত!

রিমি বড় দরজা দিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই হতবাক। এ যেন পুরো বিশাল মিউজিয়াম। সোফা থেকে শুরু করে ঝারবাতি সব ইউনিক ডিজাইনের। একটা শ্বেতপাথরের বিরাট পদ্মফুল কর্ণারে রাখা। তার পাশেই একুরিয়াম। বিশাল পেন্ডুলামের একটা কাঁটাঘড়ি। সোফার রং দেখে মনে হলো স্বর্ণের। রিমি বসলো না ভয়ে। জীবনে অত দামী সোফা সে দেখেইনি… আর বসবে। নিজের ঘরে হাতল ভাঙ্গা চেয়ার আর পায়া ভাঙ্গা টুল ছাড়া সে কিই-বা আর দেখেছে?

অবশ্য যে বাড়িতে একজন প্রাইভেট টিউটরকে ইন্টারভিউ করে চিঠি দিয়ে চাকরিতে ডাকা হয়, সে বাড়ি যে বিশাল কিছু হবে, রিমি আগেই ধারণা করে ছিল। কিন্তু এত জাঁকজমক হবে তা কল্পনাও করেনি। এক কোণায় জড়সড় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সাদা-শার্ট, কালো প্যান্ট পরা মাঝারি বয়সের একজন লোক এসে বললো,
-আপনি কে?
-জি। রিমি সুলতানা। আমায় গৃহশিক্ষক হিসেবে ডাকা হয়েছে। এই যে আমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার।
লোকটি তার নিজের পরিচয় দিলো।
-আমি ম্যানেজার হাফিজ উদ্দিন, বি.এ বি.এড। আসুন আপনার ছাত্রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তবে আজ পড়া হবে না। বড় স্যার অসুস্থ! উনার প্রেশার হাই।
রিমির পেট পাক দিয়ে উঠলো। যে বাড়ির ম্যানেজার বি.এ বি.এড। সে বাড়িতে এইচ.এস.সি পাশ গৃহশিক্ষক কেন নিয়োগ করা হলো কে জানে? রিমি মনে মনে বললো, আল্লাহ চাকরি যেন টিকে যায় আমার। ১২দিনে চার হাজার।এত ভালো বেতন সে অন্য দুটো টিউশনির একত্রেও পায় না।
রিমি ভীত মুখে ম্যানেজারের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। দোতলার সিঁড়ির কাছে যেতেই বয়স্কমতন একজন মহিলা রাগীস্বরে ম্যানেজার সাহেবকে ডাকলেন,
-হাফিজ, হাফিজ…. এই তোমার ইয়া বড় বড় টেংরা মাছ।এগুলো তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হবে।সারাবাজারের মাছ নিয়ে এসেছো নাকি? লাকি বুয়ার কোমর ব্যথা। কাটবে কে?
ম্যানেজার সাহেব মাথা নিচু করে হাত কচলে কথাগুলো শুনলেন। তারপর বিনীত ভাবে বললেন,
-ম্যাডাম, এই যে রিংকু ঝিংকুর নতুন টিচার। এই যে টিচার ম্যাডাম ইনি বড় ম্যাডাম এ বাড়ির, মিসেস রেহেনা সালাম।
রিমি তড়িঘড়ি করে সালাম করতে যেয়ে কদমবুসি করে ফেললো।
রেহেনা হতচকিত হয়ে গেলেন।
-নাম কি তোমার?
-জি রিমি সুলতানা।
-টেংরা মাছ কাটতে পারো? রিমি বিস্মিত চোখে একবার ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকালো তারপর ধীর কণ্ঠে বললো,
-জি পারি।
রেহেনা আঁচল টেনে মুখ মুছলেন।
-তাহলে এসো, আমাকে সাহায্য করো। এমনিতেও তোমার ছাত্ররা আজ পড়বে না। তাদের দাদু অসুস্থ! তারা এটা সেলিব্রেট করছে।

রিমি কনফিউজড। এটা কি টিউশন, না বুয়ার কাজ? আচ্ছা এরা তো বলেছিলো প্রথম দিনে একমাসের টাকা এডভান্স দিবে। মাছ কাটলে দিবে তো? কাজ রিমির কাছে ফ্যাক্টর না, ফ্যাক্টর হলো টাকা। টাকা পেলেই রিমির প্রাণ বাঁচে। আজ রিমির চাল নিয়ে যাওয়ার কথা। সকালের পর দুপুরবেলা কারোরই খাওয়া হয়নি। রিমির বড় আপার এটা ছ-মাস চলছে প্রেগন্যান্সির; সে বেশিক্ষণ উপোস থাকতে পারেনা। একটু পর খাই খাই। কথায় কথায় বলেন, আমি তো মরে যাবো রে রিমি। জিহ্বা ভালো মন্দ রুচিতে চায়, খাওয়ায় দে; আফসোস মিটুক। মরে গেলে তো মুক্তি পেলি।
এদিকে দোকানদার বাকি চাইলে এমনভাবে তাকায় যেন সে রিমিকে গুলি করে মেরে ফেলবে। এমনিতেই দোকানে অনেক দেনা। এসব ভাবতে ভাবতে রিমির মুখ তেঁতো হয়ে এলো।
-কি ব্যাপার মেয়ে? দাঁড়িয়ে কেন? মাছ কাটতে বলায় প্রেস্টিজে লাগলো? তোমার প্রতিদিন দু-ঘন্টা ছাত্র পড়িয়ে বেতন নেবার কথা। সেই বেতন যদি এক ঘন্টা মাছ কেটে পাও আপত্তি?
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বললো,
-কোথায় মাছ?
-ঐ তো কিচেন বারান্দায়।
রিমি বিষন্ন মুখে মাছ কাটতে বসলো, সাথে রেহেনাও কাটছেন। রিমির মাছ কেটে অভ্যাস আছে, কুটনা বাটনা রান্না এসব তো তার জনম সঙ্গী! এতবড় বাড়ির ভেতরে ঢুকে একটু মাছ কেটে যদি টাকা পাওয়া যায় ক্ষতি কি? কেউ তো আর বাইরে থেকে দেখছে না, রিমি ভেতরে কি করছে?

রিমি মাছ কেটে, ধুয়ে টুয়ে বাকি সব্জিও কেটে দিলো। রেহেনা খুশি হয়ে বললেন,
-বাহ্! তুমি তো চমৎকার কাজের। বুঝলে মা, এ বাড়িতে কেউ কাজের না। সব আছে খাওয়ার তালে। সকাল সন্ধ্যা এদের রেডিমেড নাশতা খাবার চাই। এদের অত্যাচারে কোনো বুয়া টেকে না বেশিদিন। কিন্তু আমি টিকে গেছি। আমি হলাম গিয়ে এ বাড়ির বান্ধা বুয়া। কবুল বলে এসেছি তো, তাই যেতে পারি না।

রিমি এর ফাঁকে কয়েকটা টমেটো কেটে দিয়ে বললো,
-টেংরা মাছেরঝোল টমেটো দিয়ে করলে বেশ হয়। দোঁপেয়াজাতেও কয়েকফালি টমেটো দিতে পারেন!
রেহেনা কিছুটা জড়তা, কিছুটা আকুতির হাসি হেসে বললেন,
-তুমি করে ফেলোনা প্রিপারেশানটা।
রিমির অধৈর্য্য লাগলো খুব; তাও হাসিমুখে বললো,
-আচ্ছা করে দিচ্ছি।
তার টাকার দরকার। ভীষণ টাকার দরকার। আজ সে বাকি চাইলে দোকানদার বেটা পাক্কা দু-ঘন্টা বসিয়ে রেখে তারপর দিবে, গত মাসের সাতাশ শো টাকা সে এখনও দিতে পারেনি।
রিমি রান্না করে এসে ক্লান্তভাবে ড্রয়িংরুমে দাঁড়ালো। বড় ম্যাডাম আসছি বলে উপরে গিয়েছেন দশ মিনিট হয়ে গেল। এখনো আসেননি, তবে কি তিনি ভুলে গেছেন? এডভান্সের টাকাটা কি সে পাবে না? টেনশানে আর কষ্টে রিমির বুকে দলা পাকিয়ে কান্না এলো প্রায়।
এর মধ্যেই রেহেনা নিচে এলেন।
-রিমি, তুমি কিন্তু খেয়ে গেলে পারতে। প্রথমদিন পড়াতে এসেই রান্না করতে হলো। তুমি কি খুব রাগ করেছো?
-জি না ম্যাডাম। ইটস ওকে; ঘরের কাজই তো।
-বসো, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও!

রিমি কি টাকাটার কথা বলবে? না থাক। আজ না হয় সে ধার করবে কারো কাছে থেকে। কার কাছে থেকে করবে, মুকুল আন্টি? তিনি কি দিবেন। রিমি ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বললো,
-চা খাবো না ম্যাডাম । আজ যাই আমি ।সোমবার এসে ছাত্রদের সাথে কথা বলবো! ওরা কই এখন?
-আছে, উপরে খেলছে হয়তো। দুইটাই বদের হাড্ডি বুঝলে?কোনো টিচারই এদের পড়াতে পারেনা। মায়ের মত বাউন্ডুলে হয়েছে দুইটাই।

রেহেনা তারপর একটা সাদা খাম বাড়িয়ে ধরে বললেন,
-এই যে ধরো তোমার এডভান্সের টাকাটা। রাখো।
রিমির আনন্দে চোখে প্রায় পানি এসে গেল।
রিমি খামটা হাতে নিয়ে টুপ করে আবার রেহেনার পাঁ ধরে কদমবুসি করে ফেললো। আজ কত চিন্তার হাত থেকে সে বেঁচে গেল। আপ্লুত কণ্ঠে বললো,
-রান্নাঘরের যেকোন কাজে আমার হেল্প লাগলে বলবেন ম্যাডাম। আমি করে দিবো। সমস্যা নেই আমার।
রিমি মনে মনে বললো, আপনি তো আমার মায়ের মত।যেকোনো কাজ আমি করতে রাজি। টাকা দরকার শুধু।

গেট পেড়িয়ে বাইরে এসে রিমি খামটা খুললো, টাকাটা গুণতে গিয়ে তার চক্ষু ছানাবড়া। একি এতে ৮টা এক হাজার টাকার নোট! মানে কি ম্যাডাম কি ভুলে দিয়ে ফেললেন? রিমি চট করে আবার ফিরে গেল বাসায়।
রেহেনা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-কি হয়েছে আবার এলে যে?
-ম্যাম এখানে টাকা বেশি। আমায় একমাসের এডভান্সের কথা বলা হয়েছিলো। চারহাজার। এখানে আট হাজার যে?
-তো কি হয়েছে? দু-মাসের দিয়েছি এডভান্স! টিউশন পড়াতে এসে মাছ কেটেছো, রান্নাবান্না করেছো। আমার মনে হলো, নিশ্চয় টাকার তোমার ভীষণ দরকার ছিল; নাহলে মাছ কাটার কথা শুনেই চলে যেতে। এজন্যই দিয়েছি।
যাও, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। সন্ধ্যা হয়ে গেল তো….
রিমির একবার ইচ্ছে করলো, রেহেনাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ বলবে। কিন্তু সাহসে কুলালো না। বড়লোক মানুষ, রিমির মত মেয়ে তাদের গায়ে ঘেঁষবে, তা মানায় না।

রিমি মহানন্দে বাড়ির পথ ধরলো। আজ রিক্সা নিলে কেমন হয়? তার সাথে পুরো আট হাজার টাকা আছে….

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here