রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_২_ও_৩

0
490

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_২_ও_৩

#পর্ব_২

বাড়িতে এসেই মায়ের মুখে রিমির প্রথম যে কথাটা শুনতে হলো,
-রিমিরে, সিমির বুক ব্যাথা করছে দুপুর থেকেই। একটু ঔষধ টৌষধ যদি…..
কলতলায় ক্লান্তভাবে বসে রিমি হাতে সাবান মাখতে মাখতে বললো,
-মা, এ অবস্থায় ডাক্তার না দেখিয়ে ঔষধ খাওয়ানো যাবে না।
-অত ডাক্তার লাগবে না। এমনি ঔষধ এনে দে, যা হবার হবে।
-বুকে ব্যাথা তো মা গ্যাস্ট্রিক থেকেও হতে পারে। দুপুর থেকেই খালি পেট; হয়তো গ্যাস হয়ে গেছে। ভাত করে দাও, মাছও তো এনেছি।
মা তাও পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন, রিমির অসহ্য লাগছে।সারাদিনে বড় ক্লান্ত সে। রিমির মা নাসিমা সুলতানা বড্ড কাঁদুনে মানুষ। যেকোনো ছোটোখাটো বিষয়ে কেঁদে ফেলার তাঁর অসাধারণ প্রতিভা। তিনি এখনো সে প্রতিভা দেখাচ্ছেন।
-রেডী হতে বলো আপাকে, ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি বরং!
-ডাক্তার যে দেখাবি, টাকা আছে?
রিমি জবাব দিলোনা। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে তার।
-মা রান্নাটা করো তাড়াতাড়ি, এসেই ভাত খাবো আমি।
মা ইতস্তত করে বললেন,
-নতুন কাপড় কিনলি যে?
-নতুন কাপড় না মা, পুরাতন। ২০টেকি কাপড় বলে এগুলোকে। অতি বড়লোকরা যে কাপড় ২দিন পরেই ফেলে দেয়, সেই কাপড় ফুটপাথে ২০টাকা পিসে বিক্রি করে। টাকা ছিল হাতে, নিয়ে এলাম তাই।

বড় আপাকে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে, রিমি একটা মোবাইলের ব্যাটারি কিনলো। মোবাইলটা চালু করতে হবে।বড়লোক বাড়ির টিউশন বলে কথা। এরা ফোন নাম্বার চাইতে পারে যখন তখন। বড় আপা রোগীর মত কুঁইকুঁই করে বললেন,
-রিমিরে এক কেজি আপেল কিন নারে, পেটেরটা তো কোনো পুষ্টিই পাচ্ছে না।
রিমি বিরক্তি চূড়ান্ত নিয়ে আপেল কিনলো। বড় আপা এক হালি কমলাও কিনলেন। রাস্তার পাশের বেবীশপগুলো পেড়িয়ে যাবার সময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
-রিমি কয় সেট কাপড় যদি কিনে রাখতে পারতামরে বাবুর জন্য, জিনিসপাতির দাম যেভাবে বাড়ছে কাপড়চোপড়েরও তো দাম বাড়ছে, কয়দিন পরে তো….
রিমি অনেকটা ধমকের গলায় বললো,
-আপা তুমি তো সবসময়ই বলো, বাবু হবার সময় তুমি মরেই যাবে আপা। এইসব কাপড়চোপড় বাবুকে পরালে দেখবেই বা কে? বাদ দাও, ফালতু টাকা খরচ!
বড় আপা সারা রাস্তা কেঁদে গেলেন নিশ্চুপ।

ঘরে এসে রিমি আর ভাত খেলো না, ক্ষিধে মরে গেছে! ফর্ম ফিলাপের ডেট কি দিয়ে দিয়েছে? কাল শিউলির কাছে খোঁজ নিতে হবে একবার। নাসিমা ক্রমাগত মেয়েকে ডেঁকে যাচ্ছেন,
-এই রিমি, রিমি…. ভাত খাবি না উঠ, উঠ.. এই রিমি..
রিমি জবাব দিলো না; ভীষণ ঘুম পেয়েছে তার!

রেহেনা পেপার পড়ছিলেন, সারাদিন কাজের চাপে তার সকালের খবরের কাগজ রাতে পড়তে হয়। আব্দুস সালাম সাহেবের প্রেশার এখন নরমাল, তিনি পাশে বসেই মহানন্দে টিভিতে একটা ওল্ড ইন্ডিয়ান মুভি দেখছেন।
লীনা দরজায় দাঁড়িয়েই বললো,
-বাবা আসবো?
লীনা আব্দুস সালামের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সোহানের স্ত্রী। লীনা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে, চাকরির জন্য প্রায়ই তাকে বাইরে থাকতে হয়। রাত করে ফিরতে হয়,
-এসো বৌমা। বসো এখানটায়, দারুণ একটা মুভি হচ্ছে….
-বাবা আমি মাত্র এলাম, চেইঞ্জ করিনি এখনো। ভাবলাম আপনি যদি আবার ঘুমিয়ে পড়েন, কথাটা সাড়তে এলাম। সালাম সাহেব টিভির ভলিউমটা লো করতে করতে বললেন,
-কি কথা মা?
-শোয়েব নাকি ওখানেই জয়েন করছে?
শোয়েব আব্দুস সালাম সাহেবের ছোট ছেলে। স্থাপত্যবিদ্যায় পাশ করলেও তার প্রধান কাজ বাড়িঘরের দেয়াল রং করা। প্রতি মাসে একবার করে সে তার ঘরের রং বদলায়!
আব্দুস সালাম অবজ্ঞার স্বরে বললেন,
-তাই তো বললো
-বাবা, ওসব বিসিএস বিসিএস করে লাভ নেই! মফস্বলে পঁচতে হবে! স্যালারি দিয়ে ফার্স্ট ক্যাটাগরির….
রেহেনা গলার স্বর যথাসাধ্য কঠিন করে বললেন,
-বৌমা, সোহানও বিসিএস করেছিলো। তুমি বারণ করে ঢাকায় প্রাইভেট জবে সেটল করলে। শোয়েবকে অন্তত ছাড়ো! ওর মাথাটা খেয়ো না….
লীনা মিষ্টি করে হেসে বললো,
-মা, শহরে থাকার মজাই আলাদা। ঢাকায় তো না খেয়ে থাকলেও শান্তি; তাছাড়া বিয়ে টিয়ে করতে গেলে…….
রেহেনা না শোনবার ভাব করে, পেপারে মনোযোগ দিলেন। লীনা হাসলো শুধু।
-বাবা, রিংকু ঝিংকুর নতুন টিচার মেয়েটা কেমন? আজ নাকি এসেছিলো?
রেহেনা মনে মনে দুঃখ পেলেন, বৌমাটা যে কি? শ্বশুর অসুস্থ, কই তার শরীরের কথা একটু জিজ্ঞেস করবে, তা না নিজের বাচ্চার টিচারের কথা জানতে! হায়রে সম্পর্ক….
রেহেনা পেপারে চোখ রেখেই বললেন,
-বেশ ভালো টিচার। বললো, আজ প্রথম তো পড়াবে না। আজ শুধু দুর থেকে অবজার্ভ করে চলে গেল…..
লীনা একটু শংকিত হয়ে বললো,
-এটা টিকবে তো মা? কোনো টিচারই তো ২য় দিন টেকে না।
আব্দুস সালাম আশ্বাসের স্বরে বললেন,
-এই মেয়েটা পারবে। ধৈর্য্য ধরে পড়াবে। এই মেয়ের কাছে এই চাকরি সোনার হরিণ; সে যেকোনো উপায়ে দুষ্টু দুটোকে সিস্টেমে ফেলবেই!
লীনা চলে যেতে যেতে বললো,
-সিস্টেমটাই দরকার বাবা; নাহলে অত কম একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের টিচার দিয়ে পড়া হয় নাকি? যাই মা…..
রেহেনা পিছু ডাকলেন,
-তুমি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো বৌমা, আমি খাবার বাড়ছি।
-আমি খাবো না মা, ডিনার করেই এসেছি।গুড নাইট মা! লীনা বেড়িয়ে যেতেই, আব্দুস সালাম একটু রূঢ়ভাবে বললেন,
-শোয়েবের কথাটা বৌমাকে ওভাবে কেন বললে?
রেহেনা জবাব দিলেন না।

#পর্ব_৩

ক্ষণিকের বিশ্রামাগারে পড়ানো শুরু করার এই কয়দিনে রিমির জীবন তেজপাতা! ছাত্র ২টা দুনিয়ার ত্যাঁদর; এরা একেকদিন একেক বেশ ধরে থাকে। আজ কোন বেশ ধরেছে কে জানে?
রিমির মাঝে মাঝে মনে হয়, এই দুইটাকে পিটিয়ে তক্তা করা উচিত। এদের পড়ানোর চাইতে রান্নাবান্না করা অনেক সহজ! যেদিন রিমির রান্নাবান্নার কাজ থাকে রিমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
রিমি ঘরে এসে বসেই ডাকলো,
-রিংকু ঝিংকু কোথায়? তাড়াতাড়ি এসো, দেখে যাও ম্যাম তোমাদের জন্য কি এনেছি…..
রিংকু ঝিংকু মহানন্দে খাটের তলা থেকে বেড়িয়ে এলো,
-ইয়েস ম্যাম।
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-ও মাই গড! এসব কি?
-ম্যাম আজ আমরা ভাল্লুক সেজেছি। সুন্দর হয়েছে না ম্যাম?
রিমি বিষণ্ণ ভাবে তাকালো,
ইচ্ছে করছে দুইটাকে সটান দুইটা চড় দিতে। ভুতুরে চেহারা করে বসে আছে শয়তান ২টা। সাদা ক্রিম লাগানো মুখে চোখের ধারের অংশ কালো গোল করা……
রিমি রিংকু ঝিংকুকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
-বাহ্ আফ্রিকান ভাল্লুক লাগছে দেখতে….
-ম্যাম আমরা আজ পড়বো না।
রিমি মনে মনে বললো,
তোরা কবেই পড়িসরে খাইশটার দল। তোদের পিটিয়ে ছাল তোলা দরকার।
-আচ্ছা, তাহলে আজ আমরা কি করবো?
-ভাল্লুক ভাল্লুক খেলবো। ম্যাম তুমি কি ভাল্লুক সাজবে?
রিমি ঘড়ি দেখলো, মাত্র ১০মিনিট পেরিয়েছে। দু-ঘন্টা কিভাবে কাটবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-তাহলে ভাল্লুকই সাজা যাক!

রেহেনা চিন্তিত ভাবে রিংকু ঝিংকুর ঘরে উঁকি দিলেন,
-রিমি মা একটু রান্নাঘরে… ও আল্লাহ! এই কি অবস্থা?
-ম্যাডাম ভাল্লুক সেজেছি! একমিনিট; আমি মুখ ধুয়েই আসছি….
-মুখ ধুতে হবেনা। যাস্ট ২০মিনিটের কাজ। ফিরনিটা করে দিয়ে যাও একটু… গেস্ট এসেছে কয়েকজন। আমি নামায পড়েই আসছি…

রিমি ব্যাগটা নিয়েই রান্নাঘরে এলো। ওড়নাটা গাট করে চুলোর ফিরনি নাড়তে থাকলো; বাহ্ কি চমৎকার ঘ্রাণ!

শোয়েব রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই বললো,
-বুয়া ছ-কাপ চা দিতে পারবে আমার ঘরে?
রিমি মুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো! মেরুন টি-শার্টের সাথে ব্লু হাফপ্যান্ট পরা একটি চমৎকার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তার সারা গায়ে-মুখে রং মাখামাখি…. বোধহয় রং মিস্ত্রি!
শোয়েব তখনি আৎকে উঠে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
-ও মাই গুডনেস; হু আর ইউ? হাউ টেরিবল! হোয়াট ইজ দিস? মুখে কি?
রিমি দুখী দুখী গলা করে বললো,
-আমি ভাল্লুক। আফ্রিকার জঙ্গল থেকে এসেছি….
শোয়েব আতংকিতভাবে, রান্নাঘর থেকে সড়ে এলো। বুয়া ভাল্লুক হলো কিভাবে? আফ্রিকার ভাল্লুক এখানে কেন আসবে?

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here