রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_৪

0
430

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

রেহেনা ডিনারের পর ডেজার্টের মত করে একটু ফিরনি বাটিতে নিয়ে শোয়েবের ঘরে এলেন। শোয়েব টেবিলের উপর পা তুলে বসে লো ভলিউমে শ্রীকান্ত’র গান শুনছে! এই ছেলেটা গান শুনে মনোযোগী হয়ে। চেয়ারে দুলতে দুলতে নয়, একদম কান খাড়া করে; যেন সে গভীর মনোযোগে লিরিকটা মুখস্থ করছে!
রেহেনা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই শোয়েব বললো,
-মা, বুয়ার কি হয়েছে বলোতো? ভাল্লুক সেজে বসে আছে কেন?
রেহেনা পাশে বসে বাটি থেকে চামচে করে শোয়েবকে ফিরনি খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,
-ইচ্ছে করেছে তাই সেজেছে! তোর যেমন এই বোটকা টুপিটা মাথায় দিয়ে মাঝে মাঝে ঘর রং চং করে রং মিস্ত্রি সাজতে ইচ্ছে করে তেমন!
শোয়েব বিরক্ত চোখে তাকালো! অর্থাৎ এই জবাবে সে সন্তুষ্ট হয়নি।
রেহেনা হাসলেন।
-তুই কি ভাবলি?
শোয়েব পানির গ্লাসটা থেকে একচুমুক পানি খেয়ে বললো,
-জয়েন করবো আরো আস্তে ধীরে মা। এর আগে একটা ট্রিপ দরকার। সমুদ্র দেখে আসি, চলো মা।
রেহেনা আঁচলে শোয়েবের মুখের কোণাটা মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-আমি পৃথিলার ব্যাপারে বলেছি……
শোয়েব মিউজিক প্লেয়ারটা অফ করে ফিরনির বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে চামচে করে রেহানার দিকে এগিয়ে ধরে বললো,
-মা, সৌন্দর্য খুব তুচ্ছ ব্যাপার জেনেও কিন্তু আমরা সুন্দরকে ভালোবাসি। এই যেমন ধরো ময়ূর কোনো কাজে লাগে না, তাও ভালোবাসি। পৃথিলা সুন্দরি, ব্রিলিয়ান্ট তাও কোনোকালেই আমার তাকে বিশেষ মনে হয়নি; মনে হয়েছে সব ছক করা! দেখি হা করোতো।
রেহেনা ছেলের হাত থেকে ফিরনি মুখে নিতে নিতে বললেন,
-মেয়েটা তোকে পাগলের মত পছন্দ করে! এত বছর ধরে চেনে তোকে। তাছাড়া দেখতে ভালো! বুদ্ধি ভালো।
-এটাকে পছন্দ বলে না মা। এটা একটা ঘোর! বোকা বোকা জেদের ঘোর!
-দুদিন পরেই পাশ করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হবে। কত যোগ্য তোর……
শোয়েব মাকে পানি খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
-আমি আকারে ইঙ্গিতে অনেকবার ‘না’ বুঝিয়েছি মা; পৃথিলা বোঝেনি। তাই এত দূরের পোস্টিংএ ভালো লাগছে।

রেহেনা ছেলের চুলগুলো আদুরেভাবে এলোমেলো করে দিলেন। ভালোবাসা আর মমতাপূর্ণ চোখে তাকালেন।
কি সুন্দরই না লাগছে শোয়েবকে, বড় বড় চোখে কি গভীর বাচ্চামি! গেঞ্জি একটা পরেছে, পেট বেড়িয়ে আছে! ছোট সাইজ নিশ্চয়ই টিশার্টের পেটের ধারটা টেনে দিতে দিতে রেহেনা বললেন,
-জামা কাপড় তো আরো একটু লম্বা পরতে পারিস নাকিরে? তোর হাইট কতরে শোয়েব?
শোয়েব হেসে বললো,
-৬ফুট তিন! ও জন্যই তো গার্লফ্রেন্ড হয়নি কেউ আমার… হুহ.
রেহেনা হেসে ফেললেন,
-আমি জানি তোর কটা ছিল!
-ওটা তো মা, ওয়ান সাইডেড! আমি নই। প্রেম ও সংসার ওসব অনেক ধৈর্য্যর ব্যাপার। ওসব আমার দ্বারা হবে না।
শোয়েব মায়ের হাতটা গালে ছুঁইয়ে বললো,
-এতো কেন ইনসিকিউর ফিল করছো মা? চাকরি হলো বলেই আমি একদিনে বড় হয়ে যাইনি? আমি এখনো বিয়ের কথা ভাবছি না তো। যখন ভাববো, তোমায় সবার আগে বলবো মা!
রেহেনা গভীর ভালোবাসায় শোয়েবের গালে হাত বুলালেন।
শোয়েব ফিসফিস করে বললো,
-আমি তোমাকে প্রমিস করছি মা, আমি সবসময় তোমাকে ভালোবাসবো।
রেহেনা আহলাদী গলায় বললেন,
-যাহ্।পাগল ছেলে! মাকে প্রমিস করতে হয় নারে!

রেহেনা নিশ্চিন্ত মনে শোয়েবের ঘর থেকে বের হলেন। যাক পৃথিলার সমস্যা মিটলো। মেয়েটাকে একদমই পছন্দ না রেহেনার। উগ্র চলাফেরা, কটকটা সাঁজ! বেহিসাবি খরচ!
তাছাড়া বড় বৌমার কাজিন। দুটোয় মিলে সংসার গিলে নিতো একেবারে। বড় ছেলেকে চাকরির পরপরই বিয়ে দিলেন, বৌমা এসেই সব লা-পাত্তা করে দিলো। তাঁর এতদিনের শ্রম, যত্ন, আদর কিছুই না। সোহানের সাথে কথাই হয় না এখন ঠিকমত! রেহেনার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে বলতে, ‘এই দেখ, মা ডালের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মাখিয়েছি; খাবি সোহান? নে হা কর…..’
প্রায়ই অফিস যাবার আগে রেহেনার ইচ্ছে করে সোহানের হাতে একশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলতে, ‘কিছু খাস তোর ইচ্ছেমত!’
সে আর হয় কই? ছেলে লক্ষ টাকা বেতন পায়। বৌমাও।টাকার ছড়াছড়ি; মায়ের একশ টাকার কি দরকার?

রেহেনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। এই ছেলেমেয়েরা কেন যে বড় হয়? ছোট্টই তো ভালো ছিল, সব এসে মায়ের কাছে চাইতো!

রিমি একটার পর একটা পেপার সিরিয়াল করছে। নাসিমা বিরক্ত মুখে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরে এক ফোঁটা সয়াবিন তেল নেই! রাতের রান্না কি করে হবে?
রিমি কাগজ ভাজ করতেই ব্যস্ত! নাসিমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।
-কি এত জরুরী কাগজ তোর বলতো, রিমি? এখনি না গোছালে হবেনা?
-কাগজ না মা, বই! শিউলির বই থেকে ইম্পর্টেন্ট প্রশ্নগুলো ও’র মোবাইলে ছবি তুলে নিলাম। এগুলো প্রিন্ট করালাম। এখন সাবজেক্ট ওয়াইজ মেলাচ্ছি।
-বই কিনলেই তো পারতি? এত ঝামেলা!
-৪২০০টাকার বই মা! ৫৩০টাকায় কেল্লা ফতে। পাশ করার ব্যবস্থা করে ফেলেছি মা। বই কিনে টাকা নষ্ট করার কি মানে হয় বলো?
রেহেনা আবার কান্না শুরু করলেন।
-আর কত কষ্ট করবি বল! আমাদের জন্যই তোর এত টানাটানি। কেন যে মরণ হয়না?
রিমির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মাথা ধরে আছে দুপুর থেকেই। রিমি ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বললো,
-আর কি লাগবে মা?
-কোনো সব্জি নেই ঘরে। চা-পাতা চিনি দুধ! সিমির সকাল বিকাল চা চাই।
রিমি মুখটা আয়নায় দেখে চুলটা বিণুনি করতে করতে বললো,
-গত মাসের ইলেকট্রিসিটি বিলটা দাওনি কেন মা? এ মাসে গত মাসেরটা সহ….
নাসিমা রিমির দৃষ্টি এড়াতে একটু দূরে গিয়ে বললেন,
-এত মাস হয়ে গেল, সিমির একবার আলট্রাসনোগ্রাফি করা তো দরকার ছিল… তাই দিয়ে……..
মায়ের কথা শেষ না হতেই রিমি বেড়িয়ে গেল। বাইরে বেড়িয়েই রিমির মনে হলো, বৃষ্টি হবে; আকাশ সাঁজ করা! ইশ্! ছাতা হাতে বেড়োনো দরকার ছিল।

শোয়েব গ্লাস ওয়াইপারটা আরো স্পিডি করে দিলো, ঝুম বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ১৫মিনিটের টানা বৃষ্টিতেই, রাস্তার বেহাল দশা, রাস্তার অধিকাংশ জায়গায় ড্রেনের পানি ওভারফ্লো করছে। পানি হলেই যেন রাস্তার গর্তের সংখ্যা বেড়ে যায়…..
শোয়েব চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললো,
“হে ঢাকার রাস্তা, আই হেইট ইউ”…..
মিস্টেকটা তখনি হলো! শোয়েব সাথেই সাথেই গাড়িটা পেছনে নিলো। দরজাটা খুলে দ্রুত নেমে এগিয়ে গেল… মেয়েটা পড়ে গেছে! হাতের ব্যাগের সব ছড়িয়ে পড়া। সবজি আর ডালের ব্যাগ ছিড়ে পানির তোড়ে সব ধুয়ে যাচ্ছে।
ইশ্… আচ্ছা এত ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটা একলা পথে কেন এত জিনিসপাতি বাজার করেছে! বাজার করা কি এতই জরুরি? বৃষ্টির এত ঠান্ডা গা বিধানো পানি, বাচ্চা মেয়েটা এরকমভাবে কেন বেড়িয়েছে? লম্বা চুলের বিণুনিটার পুরোটাতেই রাস্তার ময়লা আটকে গেছে….
শোয়েব প্রায় চিৎকার করেই বললো,
-এই যে আপু আমার ভুল হয়েছে… সরি সরি….
ঝুম বৃষ্টিতে কথাও ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছেনা।
রিমি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, রাস্তার নোংরা পানিতে পুরো শরীর মাখামাখি! ওড়নাটা চিপতে চিপতে হতাশ চোখে নিজের কেনা জিনিসগুলোর দিকে তাকালো রিমি। সব শেষ! দুধের প্যাকেট আর তেলটা নেয়া যাবে। রিমি তুলতে যাবার আগেই শোয়েব কুড়াতে লাগলো…..
রিমি এবার শোয়েবের দিকে খেয়াল করলো। ছেলেটা অফ হোয়াইট টিশার্টের সাথে জিন্স পড়ে আছে। হাতে ভীষণ দামী একটা ঘড়ি। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ছেলেটার ঠোট কাঁপছে।ছেলেটা কি ড্রাইভার গোছের? এত দামী কাপড়চোপড়; না না! আচ্ছা, মুখটা এতো চেনা লাগছে? আগে কি কোথাও দেখেছে? মনে পড়ছে না।
শোয়েব বিনীতভাবে যথেষ্ট করুণ স্বর করে বললো,
-আপু আমারই দোষ! আপনি আমার সাথে আসুন।আমি পৌঁছে দিচ্ছি!
রিমি বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-না না লাগবে না!
-প্লিজ আপু… আমি দেখেছি গাড়ির চাকার পানির ছিটেয় চমকে তাকিয়ে আপনি পড়ে গিয়েছিলেন।
শোয়েব লজ্জিত ভাবে রিমির বাজারের ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির এপাশের দরজাটা খুলে দিলো। বৃষ্টির ঝাপটায় বাইরে দাঁড়ানোই মুশকিল। এই ভরা বৃষ্টিতে এরকম সুনসান পথে কোনো মেয়ে এভাবে একলা চলে কখনো? হুহ..

রিমির চূড়ান্ত রাগ হচ্ছে। আবার বাজার করতে হবে। সব গচ্চা গেল।
-আপু দাঁড়িয়ে আছেন যে; প্লিজ আসুন! আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন? বলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি….
মিথ্যে ফর্মালিটির সুরে রিমি বললো,
-না না ঠিক আছে। আপনি যান। শুধু শুধু আপনি কেন নেমে এলেন? এসব কিচ্ছু না। রাস্তায় চলতে গেলে…
-প্লিজ আপু! আসলে ঝুম বৃষ্টিতে আমি ভালো ড্রাইভ করতে পারিনা…
রিমি মনে মনে বললো,
কত দরদ দেখানো হচ্ছে। শালা নবাবি গাড়িওয়ালা।গাড়িতে উঠলে তো আর…. ৯৮০টাকা গজব করে দিয়ে এখন লিফট দেওয়া! বোগলার বোগলা….
নিজের রাগ আর ভেতরে থাকলো না রিমির। তাও কোনোরকমে বললো,
-এই ভিজে গায়ে গাড়িতে উঠবো না আমি। আমি বলছি তো ভাইয়া, আপনার কোনো দোষ হয়নি। প্লিজ, আপনি যান! কিছু হয়নি আমার! প্লিজ যান…
রিমির গলার স্বরে কি একটা যেন ছিলো। শোয়েবের লাগলো খুব; খুউউব… মা রাগ করে বকে দিয়ে যেতে বললে
বুকে যেমন লাগে ঠিক তেমনি……

ছেলেটা গেলেই রিমি বাঁচে। রাস্তায় পড়ে যাওয়া দুএকটা আলু বেগুনও কুড়ানো যাবে। চিনির ব্যাগটা কি আস্ত আছে? দেখতে হবে…
শোয়েবও জেদী গলায় বললো,
-আপনার জন্য আমিও তো ভিজে গেছি। আমি যদি ভিজে গায়ে গাড়িতে বসতে পারি, আপনি কেন নয়? বললামই তো আমি দুঃখিত আপু…. আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
রিমি আর কথা বাড়ালো না। শোয়েবের সামনেই কিছু কিছু তোলবার মত জিনিস কুড়াতে বসলো। বৃষ্টি বাড়ছেই, পানির তোড়ে সবই ভেসে যাবে নাহলে…..

শোয়েবের কেন যেনো হঠাৎ খুব করে রাগ লাগলো। একটু অন্যরকম, একটু ঘোরের মত, একটু অনুভূতির বাইরের কিছু! শোয়েব বাজারের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ড্রেনে! কচুর বাজার!
রিমির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় টেনে হেঁচরে গাড়িতে তুললো। দুম করে সিটে বসিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলো। রিমির গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হয়ে এলো প্রায়! সন্ধ্যা হয়ে গেছে! এরকম ভদ্র একটা ছেলে এরকম করতে পারলো?এরাই কি সেই বড়লোকের ছেলেগুলো… যারা নেশা করে. মেয়েদের…. রিমি আর ভাবতে পারলো না।
শোয়েব গাড়িতে বসে চাবি দিতেই রিমি কান্না ধরে আসা গলায় নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে শক্ত কণ্ঠে বললো,
-ভাই, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার সাথে বেয়াদবি করেছি। সরি! আপনার পায়ে ধরছি ভাই।
বলেই শোয়েবের পায়ে ধরে ফেললো…
শোয়েব প্রায় ধাক্কা দিয়ে রিমিকে উঠিয়ে শক্ত করে বসিয়ে সিট বেল্ট আটকে দিলো।
নিজের ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে দেখিয়ে বললো,
-একদম চুপ আপু; কোনো কথা না। গাড়ি চালানোর সময় চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ!
রিমি এবার আর কান্না আটকাতে পারলো না। চোখের পানি পড়ছে পড়ুক। বৃষ্টিতে এমনিই গাল ভেজা। ছেলেটা বুঝবে না। শুধু ছেলেটাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, যে তাঁর ভয় করছে….
রিমি দাঁতে দাঁত চেপে কাঠ হয়ে বসে রইলো……..
(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here