#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
সকালে ঘোরাঘুরি করে বেলা বারোটার আগেই খাগড়াছড়ি এসেছে। খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নামল আর ওরা সবাই কক্সবাজার কলাতলী পৌছাল। কলাতলী বিচের ও সুগন্ধা বিচের মাঝামাঝিতে হোটেল নিয়েছে। দুইটা ডাবল বেডের ও দুইটা সিঙ্গেল বেডের রুম নিয়েছে। হোটেলে গিয়ে ফর্মালিটি পূরণ করে ফ্রেশ হয়ে বিচে যাওয়ার জন্য বের হলো। সমুদ্র সৈকতে ওরা পাঁয়ে হেঁটেই যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকান। শুঁটকি মাছের দোকান বেশি দেখা যায়। বার্মিজ মার্কেটে এখন রমরমা অবস্থা। সুগন্ধা বিচের দিক দিয়ে ওরা বিচে গেল। বিচের কিছুটা আগে সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, অক্টোপাস, কাঁকড়া এসব ফ্রাই করা ও বিক্রির দোকান। ওরা আগে সৈকতে ঘুরবে তারপর এসে খাবে।
আদিরা সবকিছু অবাক নজরে দেখছে। আদিরার পাহাড় ও সমুদ্রের মধ্যে দুইটাই প্রিয় তবে সমুদ্র ওর ভিষণ ভালো লাগে। হুমায়ুন আহমেদের “দারুচিনির দ্বীপ” বইটাও সে আহনাফদের বাড়িতে পড়েছিল তাছাড়া গ্রামে দোকানের সাদা-কালো টিভিতে এই মুভিটা ছোটোবেলাতে দেখেছিল। সাজেকে ঘন সবুজ পাহাড় ও মেঘ দেখে সে অনেকটাই উৎফুল্লিত। এখন সমুদ্র দেখে তার দৌঁড়ে পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে। সমুদ্রের শীতল নোনাজলের ছোঁয়া পেতে মন বারংবার আঁকুপাঁকু করছে। গ্রামে থাকতে ছোটোবেলায় সে পুকুরের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াত। সমুদ্র সৈকতের শীতল বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ছে ওর আর ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করছে। আঁধারে ঢাকা অম্বরে একফালি চাঁদ সমুদ্রের জলের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে। জোয়ারের সময় তাই সৈকতে বড়ো-ছোটো ঢেউয়ের আছড়ে পরছে। সমুদ্রের গর্জনে হৃদয়ে কাঁপন সৃষ্টি করে। আদিরা মারসাদকে টেনে নিয়ে যায় পানিতে পা ভিজাবে বলে। দুজন একত্রে পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিরার দৃষ্টি সম্মুখপানে যেখানে বিশাল জলরাশির কোনো কূল-কিনারা দৃশ্যমান না। আর মারসাদের নজরে সমুদ্রের জোৎসনা প্রতিফলিত জলরাশির থেকেও নিজের হৃদয়রাণীর চোখে-মুখে প্রশস্ত হাসিটা বেশি আকর্ষণীয়। আদিরার পায়ের উপর যখন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পরছে তখন শীতল জলের ছোঁয়ায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এদিকে রিন্তি এই অন্ধকারে সেলফি তোলার চেষ্টা করছে তখন রাহিন এসে বলে,
–তুমি কী অন্ধকারে কিছু দেখবে? ক্যামোরায় তো কিছুই উঠবে না। এক কাজ করো। আমি ফোনের ফ্লাশলাইট অন করি তারপর তুমি ছবি তুলো।
রিন্তির কাছে আইডিয়াটা পছন্দ হয় তাই সে রাজি হয়। রাহিন রিন্তির হাতে একটা ঝিনুক দেয়। ঝিনুকটা সে এতক্ষণ যেখানে ঝিনুকে নাম লেখে সেখান থেকে নাম লিখিয়ে এনেছে। রিন্তি ঝিনকা হাতে নিয়ে একবার রাহিনের দিকে তাকায় আরেকবার ঝিনুকের দিকে। রাহিন মাথা চুলকাতে চুলকাতে রিন্তির কাছ থেকে চলে যায়। রিন্তি অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে। তার মনে প্রশ্ন, এটা কী কোনোরকম প্রপোজ ছিল?
সাবিহা সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে তার ফিয়ন্সে আহানের সাথে ফোনে কথা বলছে। আহান অফিসের কাজের জন্য ওদের সাথে আসতে পারেনি। এমনিতেও আহানের সাথে সাবিহার খুব একটা দেখা হয়না। আহান একমাস হলো ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে। সাবিহার ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলে আহানের সাথে বিয়ের কথা বলছে সাবিহার বাবা-মা। সুমি, মৃদুল ও রবিন হাঁটছে তখন ওদের সাথে রাহিন এসে যোগ দিল। মাহি ও আহনাফ পাশাপাশি হাঁটছে। মাহি অন্যমনা হয়ে আহনাফকে জিজ্ঞেসা করে,
–সব কি ঠিক করা যায় না? মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না তাতে আমার আফসোস নেই কারণ উনি উনার মতো ব্যাস্ত। আমার কেয়ার করে বলেই আমি তাকে খুব একটা বাজে কথা বলি না। শুধু তার সব কথা চুপচাপ শুনে যাই আর দাভাইকে নিয়ে কিছু বললে বলি। উনি একটু স্বাভাবিক হলে খুব কী ক্ষতি হতো? জানেন? বাবার হার্টে প্রবলেম বাড়ছে। আমাদের না বললেও সে লুকিয়ে ডাক্তার দেখায়। আমি কয়েকদিন আগে তার স্টাডিরুমে তার রিপোর্ট দেখেছি। বাবাকে সে কোনোদিনও বিয়ে করতে পারত না যদি না মীরামা বাবাকে জোর করত। মীরা মায়ের মৃ*ত্যুর পরে তো বাবা বিয়ে করতোই না। মীরামা তার জীবিত অবস্থায় বিয়ে দিয়েছে বলে। অকৃতজ্ঞ আমার মা। নিজের মায়ের সম্পর্কে এসব ভাবতেও খারাপ লাগে। বিশ্বাস করুন, আপিলির মৃ*ত্যুর আগ পর্যন্ত আমি মায়ের সাথে ভালোই কথা বলতাম। দাভাই ও আপিলিকে নিয়ে বাজে কথা না বললে তার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু আপিলির মৃ*ত্যুতে আমি মনে করি আমার মায়ের অবহেলাটা বেশি ছিল। বাবা তো আগে থেকেই ছন্নছাড়া। তাও বাবা আমাদের সাথে কথা বলত। সবকিছু এখন আমাকে বিষণ্ণ করে। দাদীর শরীরও অতো ভালো নেই। দাভাই বিয়ে করেছে তা নিজে না জানানোতে দাদী ও বাবা খুব কস্ট পেয়েছে।
আহনাফ মনোযোগী শ্রোতার মতো মাহির প্রতিটা অভিযোগ শুনলো। আহনাফ সবসময় খুব ভালো শ্রোতা। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–সবকিছু নিমিষেই মিটে যায় না। অনেক অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। আদিরা পারলে পারতে পারে মারসাদ ও আঙ্কেলের সম্পর্ক ঠিক করতে। মারসাদের মনে আঙ্কেলের প্রতি রাগ নেই আমি জানি কিন্তু আছে একরাশ অভিমান। অভিমান ভাঙাতে হবে। আদিরা এখন মারসাদের স্ত্রী। সে পারবে বলে আমি মনে করি।
মাহি ও আহনাফ বালু উপত্যকায় বসল। দুজন বিশাল জলরাশি উপভোগ করছে নিরবে নিভৃতে।
_________
ফেরার পথে রাস্তার ধারে রেস্তোরায় ওরা সামুদ্রিক মাছ খেলো। ছেলেরা সবাই অক্টোপাস ও কাঁকড়াও নিয়েছে। মাহিও এগুলো নিয়েছে। আদিরা অক্টোপাস দেখে মুখ চেপে বসে আছে। ওর কাছে অক্টোপাসের নাম শুনেই পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে। মারসাদদের খেতে দেখে আদিরা চোখ মুখ কুঁচকে বিদঘুটে মুখের ভাব করে তাকিয়ে আছে আর বারবার মুখে হাত দিচ্ছে। মারসাদ খেতে খেতে বলে,
–মুখ এমন বিদঘুটে করেছ কেনো? তুমি আমাদের দিকে তাকিও না তাহলেই হলো। নিজের প্লেটে তাকিয়ে খাও। এমনেই বমি করে শরীর খারাপ।
আদিরা চুপ করে চোখমুখ খিঁচে নিজের খাবার খাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার শেষে হোটেলে ফিরে গেল। আদিরা একটা ঝিনুকের মালা ও খোঁপার কাঠি কিনেছে সাথে কিছু প্রবাল। সবাই টুকটাক কিছু কিনেছে। বাকি কেনাকাটা কাল সকালে করবে।
আদিরা হোটেলে গিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পরেছে। কক্সবাজার আসার পথে বাস থামিয়ে সে বমি করেছিল তাই শরীর দুর্বল। সমুদ্র দেখে তার দুর্বলতা এক নিমিষেই উবে গিয়েছিল। এখন তার শরীর ভাড় ছেড়ে দিচ্ছে। মারসাদ হোটেলের হেল্পলাইনে কল করে লেবুপানি আনিয়েছে। এখন আদিরার সামনে ধরে বলে,
–এটা খাও তারপর ঘুমাও। কালকে অনেক জায়গায় ঘুরব আমরা। সমুদ্রে ভিজবও তো।
আদিরা পানিটা পান করে। তারপর শুয়ে পরে। মারসাদের হঠাৎ ফোন বাজাতে সে ব্যালকনিতে গিয়ে রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ থেকে নিহাদ বলে,
–রুহুল আমিনের আজকে রাত তিনটায় একটা বড়ো এমাউন্টের টাকার ড্রা*গ পাচার হবে। আমি অলরেডি শফিক ভাইকে ইনফর্ম করেছি। শফিক ভাই বর্ডারে ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছে।
মারসাদ কপালে ঘষতে ঘষতে চিন্তিত স্বরে বলে,
–এটাকে সে আগেরবারের মতো ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিবে। তার ফ্যাক্টরির খোঁজ পেলে ভালো হতো।
নিহাদ হাসতে হাসতে বলে,
–সেটাও পেয়েছি। গাজিপুরে আরেকটা রূপগঞ্জে। সেখানে একটু পরে রেট হবে। (কাল্পনিক)
মারসাদ অবাক হয়ে বলে,
–কখন করলে এসব?
নিহাদ বলে,
–এক গুপ্তচর ঢুকিয়েছি তার ফ্যাক্টরিতে। সেই খোঁজ দিলো। কাল ব্রেকিং নিউজে চোখ রেখো। তুমি এখন তোমার হানিমুন এন্জয় করো ব্রো।
মারসাদ বাঁকা হেসে ফোন রেখে দেয়। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করে,
“এবার রুহুল আমিনের চাপ্টার ক্লোজ। দুইটা ফ্যাক্টরিতে কয়েক কোটি টাকার চালান। জেলের চারদেয়াল তার অপেক্ষায়।”
_________
সূর্যোদয়ের সময় সকলে সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হয়। সবাই উদীয়মান সূর্যের সাথে অনেক ছবি তুলল। সূর্যোদয় দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির তল থেকে আ*গুনের গোলক বের হয়ে পূর্বাকাশে দিকে জ্বলজ্বল করছে। এখন ভাটার সময়। ওরা সকলে গল্প করতে করতে সৈকতে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটে। সুগন্ধা বিচ থেকে কলাতলী বিচে হেঁটে সকাল আটটায় নাস্তা খেতে একটা রেস্তোরাতে ঢুকল। তারপর সমুদ্রে গোসল করা, খেলা করা, বাইক চালিয়ে বারোটার দিকে হোটেলে ফিরল। হোটেলে ফিরে শরীরের বালি ছাড়িয়ে গোসল করে একটুক্ষণ রেস্ট করে দুপুরের খাবার খেয়ে হিমছড়ি, ইনানী বিচ ও তার থেকে কিছুটা দূরে যাবে।
হিমছড়িতে ঝর্ণার কাছে পাশ দিয়ে ঘুরে হালকা করে হাতে পানির ছোঁয়া নিয়ে ওরা পাহাড়ে উঠছে। মারসাদ আদিরাকে বলেছিল উঠতে না পারলে না যেতে। কারণ খাড়া সিঁড়িতে অনেক রিস্ক থাকে। কিন্তু কৌতুহলী মন কী মানে? ওরা পাহাড়ের উপর উঠার সময় অনেক ছবি তুলেছে তারপর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সেখান থেকে আশেপাশের পরিবেশ দেখছে। আশেপাশের ছোটো বড়ো পাহাড় গুলো অনিন্দ্য সুন্দর দেখায়। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়া যায় তবে পথ অনেকটা সরু ও পরে যাবার সম্ভাবনা অনেকটা।
এরপর ওরা ইনানী বিচে কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে হালকা করে পা ভিজিয়ে গাড়িতে করে আরও কিছুটা দূরে একটা জায়গায় ওরা গেল। সেখানে প্রবাল পাথরের সমাহার। যেতে কিছুটা সময় লাগে তবে জায়গাটা অনেক সুন্দর। প্রবালের উপর বসে সমুদ্রের পানে চেয়ে হেলে পরা সূর্য আকর্ষণীয় দেখায়। সেখানেই ওরা সূর্যাস্ত দেখবে। সেখানে আর্মি ক্যাম্পও আছে। ওরা বারোজনে একটা গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। মাহি সমুদ্রের অনেকটা দূরে গিয়েছে কারণ এখানে গভীরতা কম। অন্যসব বিচে ঢালু থাকলেও এখানে ঢালু না। সূর্যাস্ত দেখে ওরা গাড়িতে উঠল ফিরে আসতে। সূর্যাস্তের পর এখানে কারও থাকার অনুমতি নেই। ফেরার পথে আবারও হিমছড়ি নেমে কিছু আচার ও বাদাম কিনে নিলো। কোনো রেস্তোরা থেকে ডিনার শেষে হোটেলে ফিরল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।