নীল চিরকুট লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৬৪.

0
808

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৬৪.

শাহাবাগ পার্কের এক বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নাদিম। গায়ে ঢিলাঢালা টি-শার্ট। পিঠে ঝুলন্ত গিটার। বাম হাতে বাদামের ঠোঙা। নাদিম অগোছালো চুলগুলো গোছাতে গোছাতে হাই তুলল। আশেপাশে বৃদ্ধ,বাচ্চা,যুবতীদের ভীর। বেশকিছু প্রেমীযুগলও চোখে পড়ার মতো। নাদিম কৌতূহলী চোখে রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে আছে। লাল টকটকে শাড়ি পরা মেয়েটা ক্ষেপে আছে প্রায় ঘন্টাখানেক। নিরীহ প্রেমিক অসহায় মুখে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। চেষ্টা কাজে আসছে না। নাদিম আগ্রহ নিয়ে শেষটা দেখার অপেক্ষায় রইল। অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। মেয়েটির রাগ ভাঙছে না। নাদিম বিরক্ত ভঙ্গিতে বাদাম মুখে নিল। খোসাসমেত বাদাম চিবোতে চিবোতে আবারও তাদের দিকে তাকাল। নাদিমের কোনো ব্যস্ততা নেই। প্রেমিকের রাগ ভাঙানোর ঘটনাটা আরও ঘন্টাখানেক দেখা যেতে পারে। তারপর ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড হিসেব করে তাদেরকে চমকে দেওয়া যেতে পারে। নাদিম যদি মেয়েটির রাগ ভাঙার সাথে সাথেই গিয়ে বলে, আপু?আপনি ঠিক এক ঘন্টা বিশ মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড রেগে ছিলেন। রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আপনার উচিত বেশি বেশি রাগ করা। তাহলে কী মেয়েটি চমকে তাকাবে না? নাদিমের ভাবনার মাঝেই চট করে কান ধরে ফেলল ছেলেটি। এমন জনসমাগম রাস্তায় দুই একবার উঠবসও করে ফেলল সে। ঠিক সেই সময়ই রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল লাল রঙা মার্সিডিস। প্রেমীযুগল গাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেল। নাদিম তখন ভয়ানক বিরক্ত। গাড়ি থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসা মানবীকে দেখেও বিরক্তি কাটল না। মেয়েটিকে আজ বড় বড় লাগছে। লাগারই কথা৷ মৌশি এখন বড় হয়েছে। অনার্স পড়ুয়া কোনো মেয়েকে পিচ্চি বলা যায় না। ভার্সিটির ফটকে পা দিতেই মেয়েদের মধ্যে ‘পিচ্চি বলবি তো কেটে ফেলব’ ধরনের মনোভাব চলে আসে। চাল-চলনে দেখা যায় বিস্তর তফাৎ। মৌশির চাল-চলনেও বিস্তর পরিবর্তন চোখে পড়ছে। মেয়েটি আজ শাড়ি পরেছে। গোলাপি আর সাদার মিশেল শাড়িতে মৌশিকে ভয়াবহ সুন্দর লাগছে। সারা গা’জুড়ে নারীত্বের সাথে সাথে ফুটে উঠেছে তীব্র সপ্রতিভ ভাব। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাস। মৌশি গুটি গুটি পায়ে নাদিমের পাশে এসে দাঁড়াল। নাদিম সুন্দর করে হাসল। পাশের জায়গাটুকু দেখিয়ে বলল,

‘ এখানে বসতে সমস্যা?’

মৌশি জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল। নাদিম হেসে বলল,

‘ কেমন আছো মৌশি?’

মৌশি জবাব দিল না। নাদিম অবাক হয়ে খেয়াল করল, তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাসী মেয়েটির চোখ জলে টলমল করছে। মৌশি কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হচ্ছে না। নাদিম চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। মৌশিকে সামলে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে বলল,

‘ শুনলাম জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি হয়েছ। জিওলজি ভালো সাবজেক্ট। অল দ্যা বেস্ট।’

মৌশি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

‘ বাহ! আমার খবরও রাখেন নাকি আজকাল?’

নাদিম হাসল,

‘ বাদাম খাবে?’

মৌশি নিষ্পলক চেয়ে রইল, হ্যাঁ-না কিছু বলল না। নাদিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী মৌশি? কতটুকু জানো আমায়?’

‘ এই প্রশ্ন করতে ডেকেছেন?’

‘ উহু। গল্প করতে ডেকেছি। দীর্ঘ গল্প। সেই গল্পের সূচনা এই প্রশ্ন দিয়ে। আপাতত প্রশ্নের উত্তরটা দাও।’

মৌশি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। নাদিমের দিকে চেয়ে নির্দ্বিধায় বলল,

‘ আমার জানার পরিধি খুব সীমিত। সেই সীমিত জানার মাঝে দুটো বাক্যেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। এক. আমার আপনাকে ভীষণ দরকার। দুই.আপনাকে আমার চাইই চাই।’

মৌশির উত্তরে হেসে ফেলল নাদিম। আকাশের দিকে চেয়ে ভীষণ মজার গল্প বলছে এমন ভাব নিয়ে কথা শুরু করল,

‘ সাইকোলজির দিক থেকে চিন্তা করলে আমার বাবা,আদিব হোসেন ছিলেন একজন মানসিক রোগী। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তিনি চমৎকার একজন মানুষ। তাঁর কাছে জীবনের সজ্ঞাটাই ছিল ভিন্ন রকম। অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। নামের পাশে ডক্টর শব্দটা জ্বলজ্বল করলেও তার সম্মানীয় কোনো জীবিকা ছিল না। তার একমাত্র কাজ ছিল যাযাবরের মতো ঘুরাঘুরি করা। এই রহস্যময় পৃথিবীর যতটা পারা যায় দেখে নেওয়া। এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া। তাদের ভেতরকার রহস্যগুলো যতটা পারা যায় জেনে ফেলা। বাবা প্রচন্ড উদাসীন ছিলেন। সেই সাথে প্রচন্ড বুদ্ধিমানও। তাঁর উদ্ভট কর্মকান্ডের অধিকাংশেরই স্পষ্ট ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। অনেক ভেবেও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি। বাবা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। কিন্তু তার পরিবারটা কোথায়? তাদের পরিচয়ই-বা কী ছিল? তার কোনো হদিশ আমি পাইনি। বাবা নিজের সম্পর্কে বলতে পছন্দ করতেন না। তিনি এমন ধরনের মানুষ ছিলেন, যে কিনা নিজের ইচ্ছের বাইরে একটা আঙ্গুলও নাড়তেন না। কথা বলতেন কম। চাহনী ছিল আকর্ষণীয়। আমার মা হঠাৎ এই অদ্ভুত, উদাসীন মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেললেন। শুধু ভালোবেসেই থামলেন না, রীতিমতো পাগলামো শুরু করলেন। এক অপরিচিত যুবকের প্রতি মায়ের এমন পাগলামোতে বিপাকে পড়ে গেলেন নানাজান। আদরের কন্যাকে শান্ত করতে গ্রামে বেড়াতে আসা সেই অপরিচিত যুবককে ধরে আনলেন বিয়ে পড়াবেন বলে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, বাবা রাজি হয়ে গেলেন। যে মানুষটিকে পরিবার, বাবা-মা, অর্থ-সম্পদ কোনো কিছুই বেঁধে রাখতে পারেনি। সেই মানুষটিকে ভালোবাসার পাগলামোতে বেঁধে ফেললেন মা। আর বাবাও স্বইচ্ছায় বাঁধা পড়লেন।
ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’

মৌশি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। নাদিমের প্রশ্নে খানিক থমকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ অদ্ভুত কেন হবে? ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়। আপনার বাবা নিশ্চয় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাই…’

নাদিম হাসল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমিও একসময় এমনই ভাবতাম মৌশি। বয়স হলে বুঝতে পারলাম, আমার ভাবনাটা ঠিক হচ্ছে না। মা বাবাকে বেঁধে ফেলেছিল এই ভাবনাটা সঠিক নয়। বাবার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে বেঁধে ফেলা যায় না। মাকে বিয়ে করার পেছনেও প্রচ্ছন্ন কোনো উদ্দেশ্য তাঁর নিশ্চয় ছিল। বাবা তাঁর জীবনটাকে একটা এক্সপেরিমেন্টের মতো দেখতেন। মা ছিলেন তারই একটা গিনিপিগ মাত্র। আমার ধারণা, তিনি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। বাবা-মার সংসার জীবন ছিল দীর্ঘ চৌদ্দ বছর। এই চৌদ্দ বছরে বাবাকে কখনও উঁচু গলায় কথা বলতে দেখা যায়নি। তাঁর আচার-আচরণ বলত তিনি মাকে ভালোবাসেন। কিন্তু বয়স হয়ে বুঝতে পারলাম, বাবা মাকে ভালোবেসেও ভালোবাসেনি। মাকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। প্রচন্ড ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু নিজে বাসেননি। তার কারণ হয়ত তিনি নারী ভালোবাসার শেষ পর্যায়টা দেখতে চাচ্ছিলেন।’

মৌশি অবাক চোখে চেয়ে রইল। হতভম্ব কন্ঠে বলল,

‘ আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কোনো মানুষ এই ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে এতোগুলো বছর নষ্ট করবে না।’

‘ কোনো মানুষ আর আমার বাবা এক নয় মৌশি। উনি ছিলেন ভিন্ন রকম। একদম আলাদা। বাবা বিস্তৃত ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলেন। নিজের ভালোবাসা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে সমান ভাবে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর ভাবনা। কারো প্রতি কম বা বেশি নয়। আমি আর মিষ্টি বাবার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রতি বিশেষ টান তাঁর ছিল না। তবুও আমাদের দুজনেরই প্রিয় ছিলেন বাবা। তার কারণ তাঁর আকর্ষণ শক্তি।’

মৌশি অসহায় চোখে চেয়ে রইল। নাদিম মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,

‘ আমি বোধহয় ব্যাপারটাকে কমপ্লিকেট করে ফেলছি। ঘটনা বর্ননার ক্ষেত্রে উল্টোপাল্টা সমীকরণ টানছি। আচ্ছা, যেখানে ছিলাম। বাবা-মার বিয়েটা এক রকম অদ্ভুত ভাবেই হলো। নানাজান নিজের সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ মায়ের নামে লিখে দিয়ে সেই গ্রামেই তাদের থাকার জায়গা করে দিলেন। বাবা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। বিয়ের এক বছরের মাথায় আমি হলাম। দিনকে দিন বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসা বাড়তে লাগল। সেই ভালোবাসা যখন শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাল তখন হঠাৎ একদিন এক মাসের বাচ্চা কোলে বাড়ি ফিরলেন বাবা। আমার বয়স তখন ছয় কী সাত বছর। বাবা বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে তুলে দিয়ে বললেন, ‘শী ইজ মাই ডটার।’ এর বাইরে আর একটি কথাও বললেন না। মায়ের ভালোবাসা, বিশ্বাস প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল। প্রথম কিছুদিন চিল্লাপাল্লা করে বাবার কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শান্ত হয়ে গেলেন। মিষ্টি অর্থাৎ বাবার মেয়ের ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে লাগলেন। তার ঠিক ছয়-সাত বছর পর কোনো এক দুপুর বেলায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করলেন মা। ফর্সা মা চোখের পলকে পুড়ে যাওয়া রক্তাক্ত লাশে পরিণত হলো। আমি আর বাবা তা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমাকে আর মিষ্টিকে ফেলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন বাবা। তাঁকে কাছে পেলে চোখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করতাম, সত্যিই কী ভালোবেসেছিলে মাকে? কিন্তু সেই সুযোগটি নেই। বাবা কোথায় আছেন জানা নেই। বেঁচে আছেন কী-না তাও বলা যাচ্ছে না।’

মৌশি কোনো কথা খুঁজে পেল না। নাদিমের কোনো কথারই মর্মার্থ করতে পারা যাচ্ছে না। মাথার ভেতর এলোমেলো হয়ে প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে সব। মৌশির ঘোলাটে দৃষ্টি দেখে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল নাদিম। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ তোমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়? এই প্রশ্নগুলো আমার মনেও জেগেছিল খুব। বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই প্রশ্নগুলোকে জিইয়ে রেখেছিলাম আমি। তার মাঝে কিছু উত্তর খুঁজে পেয়েছি। কিছু এখনও অস্পষ্ট, ঘোলাটে। বাবা মিষ্টিকে আনার এক সপ্তাহ পরেই মায়ের অভিযোগ কমে এসেছিল। সংসারে ঝামেলা তেমন হতো না। তবুও মা আত্মহত্যা করল কেন? মিষ্টিকে বাড়ি আনার উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? মিষ্টি কী সত্যিই বাবার মেয়ে ছিল? আমার বোন ছিল? এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরে বেড়াত আমার। তার কিছু উত্তর এখন আমার জানা। অনেকে বলে মা মানসিকভাবে স্টেবল ছিলেন না। মানসিক সমস্যার কারণেই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমার ধারণা ব্যাপারটা সঠিক নয়। বাবা ধীরে ধীরে মাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছেন। মাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। আ শার্প মার্ডার।’

মৌশি চমকে উঠল। নাদিম বলল,

‘ বিয়ের পর মাকে ভালোবাসার শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে মিষ্টির মাধ্যমে এই ধাক্কাটা দেওয়া ছিল বাবার ইচ্ছেকৃত। শুধুমাত্র মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই কোনো এক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। সেই মহিলার মাধ্যমে মিষ্টিকে জন্ম দেওয়ায় ছিল বাবার উদ্দেশ্য, এছাড়া কিছুই না। তিনি অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলে মিষ্টিকে বাড়ি আনার প্রয়োজন ছিল না। মিষ্টির প্রতি দায়িত্ববোধ বা ভালোবাসা থেকে বাড়ি আনা হয়েছিল এমনটাও নয়। মিষ্টির প্রতি বাবার বিশেষ কোনো টান ছিল না। বাবার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল মাকে প্রচন্ড ধাক্কা দেওয়া এবং তার প্রতিক্রিয়া দেখা।’

মৌশি আর্তনাদ করে বলল,

‘ উনি কী পাগল?’

নাদিম হেসে ফেলে বলল,

‘ তোমাকে তো প্রথমেই বলেছি মৌশি। সাইকোলজির ভাষায় তিনি একজন মানসিক রোগী।’

মৌশি কোনো কথা খুঁজে পেল না। নাদিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল,

‘ তোমাকে একটা ঘটনা বলি। তখন মিষ্টির ছয় মাস বা এক বছর চলছে। মা মিষ্টিকে খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ কী হলো জানি না, মা মিষ্টিকে ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। মিষ্টি তারস্বরে কাঁদছে। তার কপাল কেঁটে রক্ত পড়ছে। বাবা বারান্দায় বসে পুরো ব্যাপারটা দেখলেন অথচ উঠে আসলেন না। আমি দৌঁড়ে গিয়ে মিষ্টিকে কোলে তুললাম। মা আশেপাশের সব কিছু ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর থেকে শুরু হলো মায়ের এই হঠাৎ রেগে যাওয়ার সমস্যা। মিষ্টি যতই বড় হতে লাগল, মায়ের এই সমস্যা বাড়তে লাগল। মিষ্টির দিকে চেয়ে হঠাৎই তিনি রেগে যান। চিল্লাচিল্লি করেন। বাবার দিকে এটা ওটা ছুঁড়ে মারেন। তারপর হাউমাউ করে কাঁদেন। বাবা কোনো প্রতিবাদ করতেন না। মায়ের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে থাকতেন। সেই ছোট্ট বেলায়, মায়ের প্রতি খুব ক্ষোভ জন্মাতো আমার। ভীষণ নিরীহ বাবার উপর এই অত্যাচারে ভয়াবহ রাগ লাগত। কিন্তু এই এতো বছর পর, ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম মায়ের সেই মানসিক বিপর্যয়ের কারণটা ছিলেন স্বয়ং বাবা। মিষ্টির চেহারা দেখতে বাবার মতো। তার দিকে চাইলেই বুঝে ফেলা যায়, সে আদিব হোসেনের মেয়ে। মা মিষ্টির দেখাশোনা করতেন ঠিক। কিন্তু মিষ্টির বেড়ে উঠার সাথে সাথে তার চেহারায় বাবার স্পষ্ট ছাপটা মেনে নিতে পারতেন না। বাবার প্রতি মায়ের প্রচন্ড ভালোবাসা আর বাবার বিশ্বাসহানী মিষ্টির মুখটা দেখলেই মনে পড়ে যেত একের পর এক। বাবাও হয়ত এমনটাই চাইতো। মায়ের মন ও মস্তিষ্কের যুদ্ধের শেষটা দেখায় ছিল বাবার উদ্দেশ্য। মায়ের ধৈর্যশক্তির শেষটা ঠিক কোথায়? মানুষ ঠিক কতটা সহ্য করতে পারে? সহ্যশক্তির পরিমান কত? বাবার এমনই কিছু উত্তরের প্রয়োজন ছিল। শারিরীক দিক থেকে অত্যাচার না করলেও, এ ছিল বাবার দেওয়া তীব্র মানসিক অত্যাচার। মা প্রতিনিয়ত কতটা অত্যাচারিত হয়েছে বুঝতে পারছ?’

মৌশির মাথা ধপধপ করছে। সে একহাতে কপাল চেপে ধরে বলল,

‘ আপনার মা উনাকে ছেড়ে দেননি কেন? উনার তো বাবার সাপোর্ট ছিল। তিনি চাইলেই তাকে ছাড়তে পারতেন।’

‘ তুমি হয়তো মায়ের ভালোবাসার তীব্রতাটা বুঝতে পারোনি মৌশি। আমি তোমাকে বলেছি, মা বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসত। এটাই বাবার এক্সপেরিমেন্টের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মা এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলেন যেখানে বাবাকে ছেড়ে দেওয়া বা আঁকড়ে ধরা কোনটাই তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। মস্তিষ্ক ও মনের ভয়াবহ যুদ্ধ নিয়েই কেটেছে তাঁর সাত সাতটা বছর।’

মৌশি দুই হাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে রইল। নাদিমের বলা কথাগুলো তার মস্তিষ্কে এলোমেলো প্যাঁচ লেগে গিয়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ পুরো ব্যাপারটা আমি গুছিয়ে বলতে পারিনি বলে দুঃখিত মৌশি। বাবার ঘটনাগুলো ভাবতে গেলেও এলোমেলো হয়ে পড়ি। ধারাবাহিকতা থাকে না। তবে আমার বিশ্বাস, তুমি আমার বাবার উদ্ভট মানসিক ব্যাপারটা বুঝতে পারছ। বুঝতে পারছ না?’

মৌশি মাথা নাড়ল। নাদিম মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ গুড।’

একটু থেমে আবারও বলল,

‘ সবাই বলে এবং আমিও বিশ্বাস করি, আমি অনেক ক্ষেত্রেই আমার বাবার মতো হয়েছি। বড় মামার মতে আমাদের কথাবার্তা, চাল-চলন, আচরণ,চাহনী একই। বাবা হারিয়ে যাওয়ার আগে আমার মাঝে নিজের বীজটা বুনে যেতে পুরোপুরি সমর্থ্য হয়েছেন। এইযে, বাবার এই ভয়াবহ মানসিক এক্সপেরিমেন্টে এতোগুলো জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও আমি বাবাকে ঘৃণা করতে পারি না। বাবাকে আমি মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসি।’

নাদিম একটু থেমে বলল,

‘ আমার এই গল্পটা গুটিকতক মানুষ ছাড়া কেউ জানে না। যারা জানে তাদের কাছেও গল্পটা বড় অস্পষ্ট। না-জানার মতোই। এই অস্পষ্ট গল্পটা স্পষ্ট করে তোমাকেই প্রথম বলছি। কারণটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ মৌশি? প্রকৃতি ঘটনার পুনরাবৃত্তি পছন্দ করলেও আমি তা পছন্দ করি না। বুঝতে পারছ, আমি কী বলছি?’

মৌশি তাকাল। ছলছল করে উঠল তার দৃষ্টি। ফিসফিসানোর মতো করে বলল,

‘ স্টিল, আমি আপনাকে চাইছি। পরিণতি সম্পর্কে জেনেও চাইছি।’

নাদিম হেসে ফেলল। মৌশির দিকে খানিকটা সরে বসে বলল,

‘ বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসার তীব্রতাটা এখন বুঝতে পারছ মৌশি?’

মৌশির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। পরমুহূর্তেই ডুকরে উঠে বলল,

‘ আমার কেন এমন হচ্ছে? দুটো বছর থেকে ঘুমোতে পারছি না। খেতে পারছি না। আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি আপনাকে ভালোবাসবো না ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ প্লিজ, আমি মারা যাচ্ছি!’

নাদিমের মন খারাপ হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো মৌশির মাথায় হাত রেখে খুব নরম কন্ঠে বলল,

‘ ইউ আর আ ওয়ান্ডাফুল গার্ল। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমায় খুব ভালোবাসি মৌশি। তুমি এখন এডাল্ট। বুঝার চেষ্টা করো, আমি তোমার জন্য পার্ফেক্ট নই। কখনও পার্ফেক্ট ছিলাম না। ইউ ডিজার্ভ মোর এন্ড মোর বেটার দেন মি। পাগলামো নয়। তোমাকে মুভ অন করতে হবে। নিজেকে এতো অবহেলা না করে ভালোবাসো। সবার থেকে বেশি ভালো নিজেকে বাসো। আমি জানি তুমি পারবে।’

মৌশি ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিল। বেঞ্চিতে পা তুলে বসে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। নাদিম অপ্রস্তুত বসে রইল। এতোদিন পরও মৌশির এমন ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে জানলে কখনোই পার্কে ডেকে পাঠাত না। নাদিম কাঁধ থেকে গিটারটা নিয়ে কোলের উপর রাখল। শাড়ি পরিহিতা অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তারপাশে বসে বাউণ্ডুলে, ফালতু এক ছেলে নির্বিকার গান গাইছে। বিষয়টা অদ্ভুত না? নাদিমের অদ্ভুত কাজটা করে ফেলতে ইচ্ছে করল। গিটারে সুর তুলে কোনো একটা গানের মাঝ থেকেই গাইতে লাগল হঠাৎ,

‘যদি তুমি ভালোবাসো,
ভালো করে ভেবে এসো
খেলে ধরা কোনোখানে রবে না
আমি ছুঁয়ে দিলে পরে,
অকালেই যাবে ঝরে
গলে যাবে যে বরফ গলে না

আমি গলা বেচে খাবো,
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না
কারো একদিন হবো,
কারো একরাত হবো
এর বেশি কারো রুচি হবে না…’

নাদিমের গানে চোখ তুলে তাকাল মৌশি। এমন একটা সময়ে এমন উদ্ভট গান শুনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে মৌশির। নাদিম এমন কেন? কেন এতো অনুভূতিহীন? মানুষের কষ্ট কী তাকে স্পর্শ করে না? মৌশির ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে। এই মানুষটিকে ভালোবাসার অপরাধে নিজেকে ভয়াবহ কিছু শাস্তি দিতে মন চাইছে। পরমুহূর্তেই এই মানুষটিকে ভালোবেসেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আহ! জীবনে এতো কষ্ট কেন? ভালোবেসেও না পাওয়ার কষ্ট এত জ্বালায় কেন? মৌশির বুকে বেয়ে উতলে উঠল এক আকাশ কান্না। চোখদুটো ভারী হয়ে এলো। এই আচ্ছন্ন কান্নার কারণ মৌশি জানে না। শুধু জানে এই কান্না তাকে কাঁদতে হবে। নয়তো বেঁচে থাকা যাবে না। মরে যাবে। একদম নিঃশেষ হয়ে যাবে! মৌশি কাঁদতে কাঁদতেই নাদিমের গান শুনল,

‘আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না।’

_

রোজ বিকেলে পাশের বাড়ির ভাবি-চাচিদের হামলাটা ভীষণ বিশ্রী লাগে নীরার। ঘরদোর ফেলে শরীর মেলে গল্প করতে বসে যেতে দেখলেই গা জ্বলে যায় তার। নীরা বিরক্তি নিয়ে চা বানাল। চায়ের ট্রেটা বসার ঘরে নিয়ে যেতেই এক মহিলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার মতো ভঙ্গিমা করে বলল,

‘ ছেলের বিয়ের তো অনেকদিন হলো ভাবি। নাতি-নাতনি আসবে কবে? এখনও কোনো খোঁজ নেই যে? কোনো সমস্যা টমস্যা নেই তো আবার?’

জাহানারা তৎক্ষনাৎ জ্বলে উঠলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

‘ সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো, আমাদের নাতি-নাতনীর দরকার নাই। আর এখনই নাতি-নাতনী কিসের? আমরা কী মরে যাচ্ছি? পোলা-বউ কী বুড়ো হয়ে গেছে?এই বয়সে তো ছেলেই বিয়ে করাতে চাই নাই। যা হয়েছে, তা হয়েছে। আগে ছেলের পড়াশোনা শেষ হোক। চাকরি-বাকরি পাক তারপর নাতি-নাতনীর চিন্তা। বিয়ে করেই ছেলের যে পেরেশানি যাচ্ছে… ‘

জাহানারার আলাপের মাঝেই বাড়ি ফিরল অন্তু। থমথমে মুখে সোজাসুজি ঢুকে গেল নিজের ঘরে। নীরা এক পা দুই পা করে সরে এসেই নিজের ঘরে দৌঁড় লাগাল। অন্তু ফাইলটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে শার্টের বোতাম খুলছে। মেজাজ তার তিরিক্ষি। নীরা আসতেই বলল,

‘ চাকরি-বাকরি কিছু হবে না বুঝছিস? যত্তসব ফালতু সিস্টেম। শুধু শুধু তো মানুষ দেশ ছাড়ে না। জ্বালায় পড়ে ছাড়ে। আছেটা কী এই দেশে? দূর্নীতি আর ক্ষমতার দাপট ছাড়া কিছুই না।’

নীরা উত্তর দিল না। বুঝতে পারল, অন্তুর ইন্টারভিউ সন্তোষজনক হয়নি। অন্তু দুইহাতে মুখ ঢেকে নীরব বসে রইল। নীরা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল অন্তুর চুলে। অন্তু মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ তুলে তাকাল। দুই হাতে নীরার কোমর জড়িয়ে ধরে ক্লান্ত মাথা এলিয়ে দিল বুকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ যে তিনটা টিউশনি ছিল সব কটা স্টুডেন্টই এবার ভার্সিটিতে পা রাখল। নতুন কোনো টিউশনিই পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে চাকরির ব্যাপারগুলোও এগুচ্ছে না। মাস্টার্সেও ভর্তি হতে হবে। অনেকগুলো জবের শর্তই থাকে মাস্টার্স এন্ড এক্সপেরিয়েন্সড।’

অন্তু মাথা তুলে তাকাল। চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ দুজনের মাস্টার্স ভর্তি হতে প্রায় তেরো চৌদ্দ হাজার টাকা লেগে যাবে, তাই না?’

নীরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভীষণ মন খারাপ লাগছে তার। সামনের দিনগুলো যে ভয়াবহ ধাক্কা নিয়ে আসছে তা বুঝতে বাকি রইল না তার।’

#চলবে…

[ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহগুলো খুব দ্রুত এগুবে আশা রাখছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here