যখন_দুজনে_একা ৬১ পর্ব

0
649

#যখন_দুজনে_একা

৬১ পর্ব

বাসায় ফিরে আসার সময় মাহি বলল,
: খুব অবলিলায় বলে দিলে রুবা তুমি বাচ্চাদের দেখতে পাবে না !
: সরি তোমার কষ্ট হয় শুনতে জানি , কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে খুব!
: ভয় হলেই এসব কথা বলতে হবে ?
: আর বলব না যাও!
: তুমি দেখো টের ই পাবেনা সি সেকশন এর সময়, দেখবে দশ পনের মিনিটের ভেতর বেবি রা তোমার সামনে! ওরা চিৎকার করে কাঁদছে!
: তাই ?
: হুম , এই অপারেশনের নাম সিজারিয়ান সেকশন কেন জানো রুবা। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের জন্মের সময় তার মা মারা যায় , যে ধাত্রী ছিল সে বুঝে গেছে মা অলমোস্ট মৃত সে সঙ্গে সঙ্গে ধারালো ছুরি দিয়ে মায়ের পেট কেটে বাচ্চা বের করে ফেলে এবং জন্ম নেয় জুলিয়াস সিজার । তার নাম অনুসারে নাম সিজারিয়ান সেকশন !
: জানতাম না তো রুবা অবাক হয়ে বলল!
: এই যে জানলে!
রুবা বাসায় এসে সব জিনিস শ্বাশুড়ি কে দেখালো। সাফিয়া বেগম বললেন,সব জিনিস ডাবল এনেছোতো ?
: হ্যাঁ মা দুজনের জিনিস এনেছি!
: যা কিনবে এখন থেকে দুটো করে কিনবে ! আমি তো ঠিক করে রেখেছি রুবাকে বেবি হ‌ওয়ার পর যে গিফট দিব দুটো গিফট দিব !
: মা আমার‌ও তো তাহলে দুটো গিফট দিতে হবে রুবাকে , দুজনের বাবা হচ্ছি !
: অবশ্যই মাহি !

রুবার শরীরে অতিরিক্ত পানি এসে হাত পা ফুলে গেছে! প্রেসার খুব বেশি । ডাক্তার সারডোপা দিয়েও প্রেসার কন্ট্রোল করতে পারছে না । ঘুম নেই । প্রি- একলাম্পশিয়ার লক্ষন, মাহি ভয় পেয়ে গেল । পঁয়ত্রিশ সপ্তাহে রুবার সিজারিয়ান করতে বাধ্য হলো ডাক্তার সুরাইয়া!
ওটিতে মাহি আর নিঝুম ছিল রুবার সঙ্গে। রুবা ভয়ে কাঁদছে মাহি ওর মাথার কাছে ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল !
: রুবা একটু ও ভয় পেয়ো না আমি আছি এখানে , তুমি না আমার সাহসী মুরগির বাচ্চা! আর কিছুক্ষণ পর তোমার এত দিনের সব কষ্ট দেখবে আনন্দে পরিনত হয়েছে!
: রুবার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেল !
মাহি অক্সিজেন লাগিয়ে দিল ! নিঝুম তাকিয়ে দেখে মাহি নিজেই নার্ভাস হয়ে গেছে। মাহির কাছে এসে বলল,
: তুই এত নার্ভাস হচ্ছিস কেন বোকা !
: আমার কেমন অস্থির লাগছে নিঝুম !
: তাহলে বের হয়ে যা ওটি থেকে আমরা আছি এখানে , ঐ যে রিয়াদ ভাই এসেছে !
ডাক্তার রিয়াদ মাহির কাঁধে হাত রাখলো !
মাহি নিঝুমকে বলল,আমি রুবাকে রেখে কোথাও যাব না ! মাহি আবার গিয়ে রুবার হাত ধরলো !
এর দুই মিনিট পর‌ই মাহি আর রুবার প্রথম ছেলে আর তার তিন মিনিট পর দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হলো ! চিৎকার করে কেঁদে পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিচ্ছে দুজন!
ডাক্তার সুরাইয়া মাহিকে ডেকে বললেন,
: এদিকে এসো এম্বোলিক কর্ড তুমি কাটো !
মাহি এগিয়ে গেল কেন জানি ওর হাত কাঁপছে এত সহজ একটা কাজে আজ!
রিয়াদ এগিয়ে গিয়ে বলল, কি সার্জন আজ হাত কাঁপছে কেন?
: মাহির চোখে পানি চলে এসেছে, ছেলেদের কোলে নিয়ে সে পুরাই কেঁদে দিল! রুবাকে কি সামলাবে সে নিজেই কাঁদছে!
রুবার কাছে নিয়ে যখন বেবিদের দেখাচ্ছে রুবা মাহি দুজনেই কাঁদছে বাচ্চাদের দেখে।
: রুবা আমাদের ছেলেরা দেখো তোমার মত পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে চলে এসেছে ! মাহি রুবার ঠোঁটে চুমু খেল!
রুবা তাকিয়ে দেখে ছোট দুটো গোল মুখ, চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে সাদা ধবধবে গায়ের রং, গোলাপী লাল ঠোঁট!
: মাহি এদিকে তাকা তোদের ছবি তুলছি বলে নিঝুম মোবাইল এ ওদের সবার ছবি তুলে দিল।
নিঝুমের চোখ দিয়েও পানি পড়ছে আনন্দে!
কষ্ট যেমন সংক্রামিত হয় কিছু কিছু আনন্দ ও হয়!
রুবা মাহিকে বলল,
: সব ঠিক আছে না বেবিদের ?
ডাক্তার সুরাইয়া বললেন সবার সব ঠিক আছে রুবা তুমি এখন ঘুমাও। তোমার এখন ঘুম দরকার! ছেলেদের মাহি দেখবে এখন । তোমার দ্বায়িত্ব শেষ! তুমি অনেক কষ্ট করেছো।
রুবা গভীর ঘুমে অচেতন হ‌ওয়ার আগে মাহিকে বলল,
: মায়ের কাছে নিয়ে যাও মা অপেক্ষা করছে !

মাহি ছেলেদের কোলে নিয়ে ওটির বাহিরে এসে দাঁড়ালো!
সাফিয়া বেগম অস্থির হয়ে হাঁটছেন করিডোরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা! তিনি এক মনে আল্লাহকে ডাকছেন।
নিঝুমের মা, রিয়া, তারানা মামি সবাই উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে!
মাহির কোলে বেবিদের দেখে সাফিয়া বেগম ছুটে এলেন!
মাহি মাকে দেখে বলে উঠলো, মা আমার আর রুবার ছেলেরা চলে এসেছে দাদীর কাছে !
বাচ্চাদের কোলে নেয়ার পর সাফিয়া বেগম আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না , ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকলেন!
বাচ্চাদের নিয়ে আজগর সাহেবের এর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
: শিহাবের বাবা তোমার শিহাব চলে এসেছে দেখেছো এক শিহাব চলে গেছে আল্লাহ দুটো শিহাব পাঠিয়ে দিয়েছে দেখো! একদম শিহাবের মুখ , মনে আছে তোমার? একদিন শিহাব এরকম ছোট ছিল। আমাদের জীবনে আবার শিহাব এসেছে।
আজগর সাহেব ও কাদছেন !
আশেপাশের সবার চোখে পানি। আজকের এই চোখের পানি আনন্দে র।
: খালাম্মা কি শুরু করলেন বাচ্চারা তো ভয় পাচ্ছে, ভাবছে কোথায় আসলাম সবাই দেখি কাঁদছে খালি !
রিয়ার কথায় সবাই হেসে দিল!
: মাহি রুবা কেমন আছে , ও ঠিক আছে তো ! সাফিয়া বেগম উদ্বেগ নিয়ে মাহির কাছে জানতে চাইলেন।
: মা রুবা ঠিক আছে , অস্থির হয়ো না রুবা এখন ঘুমাচ্ছে!
আর বেবিদের নিয়ে যেতে হবে এখন এন‌আইসিইউ তে থাকবে কয়দিন , ঘাবড়ানোর কিছু নেই ।
সাফিয়া বেগম মাহিকে বললেন, কেন মাহি এই না বললে সব ঠিক আছে, তাহলে আবার কোথায় নিয়ে যাবে ?
মা ওরা প্রিমেচুয়্যর বেবী ওদের কিছুদিন অবজারভেশন এ রাখতে হবে। তুমি টেনশন করো না। আমি আছি তো।

মাহি বাচ্চাদের এন‌আইসিইউ তে রেখে পোস্ট অপারেটিভ এ রুবার কাছে এসে বসলো! রুবা অচেতন হয়ে আছে ! রুবার কপালে চুমু খেলো মাহি।
ওর হাত ধরে বসলো । রুবার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
: থ্যাঙ্কস রুবা , আমাকে বাবা বানিয়ে দিলে তুমি !
মনে মনে বলল, এই কত গুলো মাস তুমি যে নিদারুণ কষ্ট করলে তার কোন তুলনা হয় না!
একজন বাবা হ‌ওয়া অনেক সহজ রুবা , একজন মা হ‌ওয়া কি যে কষ্ট এই কয়টা মাস তোমাকে দেখে জানলাম !
তুমি আমার জন্য , আমাদের পরিবারের জন্য যে কষ্ট সহ্য করলে। তুমি জানো না আজ বাবা আর মা আমাদের ছেলেদের কোলে নিয়ে আবার বেঁচে উঠলেন। এত খুশি ছিল তাদের চোখের পানির আড়ালে এত আনন্দ ছিল কি বলব তোমাকে রুবা!
তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে! আমাদের ছেলেরা অপেক্ষা করছে তাদের মায়ের জন্য!
সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করছি আমি রুবা ! তোমার টেনশন হীন, কষ্ট হীন মুখটা কত দিন দেখি না ! কতদিন তোমাকে একটু ভালো করে বুকে জড়িয়ে ধরি না!
মাহির চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে! মাহি রুবার অচেতন হাতটা ধরে চুমু খাচ্ছে।
পর্দা সরিয়ে নিঝুম এসে ঢুকলো‌ তখন।
: কিরে এত কান্নাকাটি কেন করছিস বুঝলাম না তো মাহি? এত আনন্দের মাঝে কাঁদার কি হলো!
মাহি চোখ মুছতে মুছতে বলল,
: নিঝুম এই কয়টা মাস রুবা যে কষ্ট সহ্য করেছে কি বলব তোকে ! হাই রিস্কি প্রেগন্যান্সি ছিল টোটাল বেড রেস্ট। আমি ওকে বেড থেকে নামতে দেই নাই ওয়াস রুমে যাওয়া ছাড়া!
সারাক্ষণ একটা মানুষ শুয়ে, বসে আছে কিছু করার নেই তার ! বমি করতে করতে গলা দিয়ে রক্ত আসতো প্রতিদিন! খেতে পারতো না। সব কিছু তে গন্ধ লাগতো!
টুইন বেবী শরীর তাড়াতাড়ি ভারি হয়ে গেছে কোন কাত হয়ে শুতে পারতো না , রাতের পর রাত জেগে থাকতো! চিত হয়ে শুয়ে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যেত ওর! আমি সারারাত ওকে ধরে বসে থাকতাম। রুবা শুধু কাদতো ! প্রেসার বেড়ে গেল ! শরীরে পানি এসে গেল প্রি একলাম্পশিয়ার ভয়ে আমিই অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম ! অনেক কষ্ট করেছে রুবা আমি তাকিয়ে দেখতাম কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না । বিশ্বাস কর ভালোবাসার মানুষ কষ্ট পাচ্ছে আর তুই অসহায়ের মত কিছুই করতে পারছিস না সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারছিস না , আবার কমিয়েও দিতে পারছিস না এর চেয়ে যন্ত্রণা র আর কিছু নেই!
একটা সময় মনে হতো কিসের ডাক্তার হ‌লাম আমি , যে প্রিয়জনের কষ্ট কমাতে পারি না!
রুবার কষ্ট টা দেখতাম আর বারবার মনে হতো মা ও আমাকে পেটে নিয়ে এত কষ্ট করেছে !
মায়ের জন্য কি করতে পারছি জীবনে! নিঝুম মাহির কাঁধে হাত রাখলো।
: তুই তো খালাম্মা র সবচেয়ে বাধ্য ছেলে , খালাম্মা র জন্য তুই যা করতে পেরেছিস কয়জন পারে বল !
এখন তো সব ঠিক আছে মাহি তাহলে মন খারাপ করছিস না আর।
: মন খারাপ না রে , এই জার্নি টা রুবার জন্য অনেক কঠিন ছিল এখন শুধু ওকে আর ছেলেদের সুস্থ ভাবে বাসায় নিয়ে যেতে চাই আমি!
: ওদের সবাই কে সুস্থ ভাবে বাসায় নিয়ে যাবি চিন্তা করিস না! তুই বাসায় যা একটু ফ্রেস হয়ে রেস্ট নিয়ে আয় আমরা এখানে আছি।
: মাথা নষ্ট রুবা আর ছেলেদের রেখে আমি বাসায় চলে যাব কি বলিস এসব ! আমি সারাক্ষন এখন ওদের কাছে থাকব! বেবিদের দেখেছিস , একেবারে রুবার মত দেখতে হয়েছে !
: আমার কাছে তো তোর মত লাগছে একজন কে !
: তাই আমার ছেলে আমার মত হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু রুবার মত হলে আমি বেশি খুশি হব! ওর মত সুন্দর মনের একটা মানুষ হয় যদি তাহলেই আমি বেশি আনন্দ পাব!
:‌ তো সবার তো মেয়ের খায়েস ছিল , আবার কয়েকবছর পর আর একটা ট্রাই দিবি নাকি মাহি ? নিঝুম হাসতে হাসতে বলল।
: কি যে বলিস যা খেল দেখালো রুবা আবার এই পথে কে যাবে ! ওর ইচ্ছে থাকলেও আমার খায়েস মিটে গেছে ! আমাদের দুটো মেয়ে হলেও আমি বলতাম আর না । রুবা অনেক কষ্ট করেছে! এই কষ্টে ওকে আর দেখতে চাই না!
মাহি আর নিঝুম হাসছে !
তোর হাসি টা দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সুখী মানুষের হাসি !
: আলহামদুলিল্লাহ হ্যাঁ আমি পৃথিবীর সুখী একজন মানুষ নিঝুম!

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here