হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৩

0
425

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩

এভাবেই দিন মাস যেতে লাগল। বিয়ের পাঁচ মাস পর্যন্ত আমি শুধু জানতাম নিলয় আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে এজন্য হয়তো সন্দেহ করে এমন করতেছে। কিন্তু সেদিন নিলয়ের দ্বিতীয় মুখোশটা আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। আর ভাবলাম আমি এত বোকা কেন?

বরাবরের মতো ঐ বাসায় আমার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সারাদিন পরগাছার মতো পড়ে থাকতাম। নিলয়ের কথার বাইরে গেলেই মাইর খেতাম।

পারছিলাম না কোনোভাবে এ জীবন থেকে বের হতে আবার পারছিলাম না সহ্য করতে। স্বাধীনতা না থাকার দরুণ নিলয় ঠিক কী চাকুরি করে বিষয়টা সঠিকভাবে জানতাম না। সত্যি বলতে জানার কোনো উপায় ছিল না। ফেসবুকে কথা বলার সময় বলেছিল একটা সরকারি চাকুরি করে। তবে বিয়ের পাঁচ মাস পর জানতে পারলাম নিলয় কোনো চাকুরি করে না। সে ড্রাগসের ব্যবস্যা করে। আর এ কথাটা জানতে পারি নিলয়ের ড্রয়ারে ড্রাগসের প্যাকেট আর কোথায় কোথায় পাঠাতে হবে সেটার একটা তালিকা দেখে।

এ কথাটা জানার পর কেন জানি না আমি রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। ঐদিন নিলয় বাসায় আসার সাথে সাথে নিলয়কে বললাম

“কী করে পারলে এত বড় মিথ্যা ধোঁকা দিতে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার?”

নিলয় চোখগুলো রক্তবর্ণ করে বলল-

“কী করেছি আমি? এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেন?”

আমি চেঁচাতে চেঁচাতে বললাম-

“চিল্লাব না তো আনন্দে নাচব? তুমি না সরকারি চাকুরি করো তাহলে এসব কী?”

আমি ড্রাগসের প্যাকেট গুলো নিলয়ের দিকে ছুরে মারলাম। নিলয় তখন ড্রাগসের প্যাকেট গুলো দেখে আমার দিকে তেড়ে এসে আমার চুলগুলো ধরে বলল

“তুই আমার অনুমতি ছাড়া আমার ড্রয়ারে ধরেছিস কেন? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?”

আমি চেঁচিয়ে বললাল

“আমি তোমার স্ত্রী হই। তোমার ড্রয়ার ধরার জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হবে কেন? আর আমাকে এভাবে বন্দি করে রেখেছ কেন? আমাকে আমার পরিবারের সাথে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন? আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তো মানুষ। কতদিন এভাবে একা বন্দি পাখির মত থাকব বলো?”

নিলয় আমার চুলগুলো আরও শক্ত করে ধরে বলল-

“তোকে এভাবেই পচিয়ে মারব।ফের যদি অনুমতি ছাড়া কিছু ধরেছিস খবর আছে তোর।”

এ বলে রান্না ঘর থেকে খুন্তি গরম করে এনে আমার পিঠে লাগিয়ে দিল। আমি ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে তখন বলেছিলাম

” আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছ? এগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না।”

নিলয় খুন্তিটা আরও চেপে ধরে বলল-

“যদি আমার অনুমতি ছাড়া আমার ব্যপারে কিছু করতে চাস তাহলে তোকে এভাবেই শাস্তি দিব মনে রাখিস।”

তারপর সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পিঠে হাত দিতে পারছিলাম না ব্যথায়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। শুতেও পারছিলাম না ব্যথায়। কী যে সময় পার করেছিলাম সেটা মনে হলে বুকের ভিতরটা এখনো কেঁপে উঠে।
এমন করে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতেও পারছিলাম না। কারণ আমার করার মতো কিছু ছিল না। হাত পা বাঁধা ছিল। আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও কিছুই বলতে পারতাম না। কারণ সেদিন আমার বলার মতো কোন বাকস্বাধীনতা ছিল না।

সেদিন নিলয় রাতে আবার বাসায় ফিরে। যতই হোক স্বামী তো এতকিছুর পরেও কেন জানি না তার প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল। মেয়েরা তো মায়ের জাত তাই হয়ত মায়াটা বেশি কাজ করত। এত মায়া কাজ করাও যে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ তা তখন টের পাইনি। নিলয় আসার সাথে সাথে আমি একদম স্বাভাবিকভাবে বসেছিলাম। খেয়াল করলাম নিলয় আমার রুমে না এসে পাশের রুমে চলে গেল। আমি পাশের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম দরজা লাগানো। দরজার এপাশ থেকে বুঝতে পারলাম কারও সাথে কথা বলছে সে।

দরজা নক করার সাহস ও হলো না। কারণ আমি জানতাম আমি দরজা নক করলেই আমাকে এসে পিটাবে। শরীরের ও একটা সহ্য ক্ষমতা থাকে যেটা আমি হারিয়ে ফেলতেছিলাম দিন দিন।

তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখটা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হল হালকা, তখন মনে হল কেউ একজন আমার হাতটা ধরে কিছু করছে। কিন্তু শরীরে শক্তি ছিল না আর পিঠের ব্যথায় এপাশ হতে পারছিলাম না তাই উঠতেও পারছিলাম না। কেন জানি না সে রাতে কড়া ঘুম হল । এত ভালো ঘুম কখনও হয় নি। তবে উঠার পর থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড়ের দাগ পেলাম। শরীরে কামড়ের দাগগুলো দেখে বেশ ভয় পেতে লাগলাম। কীভাবে এগুলো হল ভাবতে লাগলাম। ভাবনার কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অপরদিকে পিঠের ব্যথা তো আছেই।

কাপড় চোপড় ও আমার এলোমেলো হয়ে আছে বিছানাও এলোমেলো হয়ে আছে। আমি এটা নিশ্চিত ছিলাম যে কেউ আমার সাথে নোংরা কাজ করেছে। আশে পাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। হুট করে খেয়াল করলাম একটা সিরন্জ পড়ে আছে। আমি সিরিন্জটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম আমার সাথে কী হয়েছে আর কে করেছে। আর কেন আমার এত কড়া ঘুম হলো।

কারণ সিরিন্জটা ছিল ঘুমের ঔষধের। আমি হালকা ঘুমের পর আমাকে এটা দেওয়া হয়েছিল। ঐ যে আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন আমার হাত ধরে কিছু করছে তখন নিলয়েই ছিল সেটা আর আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল। এরপর আমার সাথে কুকর্ম করেছিল। এমনিতে তো আমাকে কাছে পেতে চাইলে চিল্লাতাম। হয়তো তার আমার আর্তনাদ ভালো লাগত না। তাই নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য এমন করেছিল। তার উপর সেদিন আমার পিঠে ব্যথা ছিল। কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের সে, আমি আরও ভালো করে বুঝে গিয়েছিলাম।

ঘঁড়ির কাটায় খেয়াল করে দেখলাম নয় টা বাজে। আর নিলয় বাথরুমে গোসল করছে। লক্ষ্য করে দেখলাম নিলয়ের ফোনটা বিছানায় রেখে গেছে। ফোনটা হাতে নিতে বেশ ভয় লাগছিল। বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছিল। হার্টবিটটাও যেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে স্পন্দিত হচ্ছিল ভয়ে। এত জোরেই স্পন্দিত হচ্ছিল যে আমি নিজের হার্টবিটের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবুও আমি সাহস করে কাঁপা কাঁপা হাতে নিলয়ের ফোনটা হাতে নিলাম।

নিলয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে প্রথমেই খেয়াল করলাম ফোনে কোন লক দেওয়া নেই। এর আগে মায়ের কাছে যেদিন ফোন দিয়েছিলাম এরপর থেকে ফোন লক করে রাখত। চাইলেও কাউকে কল দিতে পারতাম না। ভাবলাম মাকে কল দেই। যখন কল দিতে যাব ঠিক এ মুহুর্তে প্রাপ্তি নামের একটা মেয়ের মেসেজ মেসেন্জারে আসলো। আমি মেসেজটা ওপেন করে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর যাইহোক এটা ভেবেছিলাম যে নিলয় আমাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ের সাথে কিছু করবে না।তবে সে বিশ্বাসটাও সেদিন উঠে গেল। প্রাপ্তি নামের মেয়েটা মেসেজ দিল-

“কী গো বাবুই তুমি কোথায় তোমাকে খুব মিস করছি। সেদিনের আদর এখনও ভুলতে পারছি না।”

মেসেজটা দেখে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। আমি নিলয়কে এভাবে আবিষ্কার করব কখনও চিন্তা করিনি। মেসেন্জারটা চেক করতে থাকলাম। চেক করতে করতে দেখলাম মেসেন্জারে এরকম আট থেকে দশটা মেয়ে ছিল যাদের সাথে নিলয়ের প্রেম চলতেছে। হায়রে আমি কতটা বোকার রাজ্যে ছিলাম এখনো ভাবলে হাসি পাই। একের পর এক মেসেজ দেখতে লাগলাম আর বিস্মিত হতে লাগলাম। খেয়াল করলাম সবার সাথে একইরকম কথা একই রকম মেসেজ। সব মেয়েকে একইভাবে ফাঁদে ফেলতেছে। কারও কারও সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে। কারও কারও সাথে দেখা করার তারিখ বরাদ্ধ করেছে। সেদিনের পর থেকে নিলয়ের প্রতি যে মায়াটা অবশিষ্ট ছিল সে মায়াটা চলে গিয়েছিল। নিলয়ের এমন প্রতরণা মেনে নিতে পারছিলাম না।

রাগে শরীরটা গিজ গিজ করতে লাগল। এতটা রাগ কখনো উঠেছে কি ‘না মনে নেই। তবে সেদিনের সে রাগটা আমাকে আরও বেশি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সেই সময়টাই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি এটা আমার চরম ভুল ছিল।

নিলয় বাথরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমি নিলয়ের দিকে তেড়ে গেলাম। নিলয় ও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল আমার এরকম তেড়ে আসাতে। নিলয় কিছু বুঝে উঠার আগেই নিলয়ের দিকে তেড়ে গিয়ে মোবাইলটা আছার মেরে বললাম

“এসব কী নিলয়? আমাকে তুমি এত কষ্ট দিয়েছ আমি কখনও তোমাকে কিছু বলিনি। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। বন্দি পাখির মতো আটকে রেখেছ কিছু বলার সুযোগ দাও নি। তোমাকে কখনো আমি কিছু বলতে গেলেই ইচ্ছামতো শারিরীক নির্যাতন করেছ। আমার সারা শরীরে তোমার আঘাতের চিন্হ ছাড়া কিছু নেই। বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে দাও না।বাবা, মা যেন আসতে না পারে তাই বাসা বদলে ফেলেছ। তাও আমি মেনে নিয়েছি। যেদিন জানতে পারি তোমার ড্রাগসের ব্যবস্যা আছে সেদিনও তোমাকে মেনে নিয়েছি। শত কষ্ট হলে ও আমি চুপ করে সব সহ্য করেছি। তবে এটুকু বিশ্বাস করেছিলাম যে তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আজকে সে বিশ্বাসটাও ভেঙ্গে দিলে। একটা না, দুইটা না,দশ থেকে বারোটা মেয়ের সাথে তোমার চক্কর চলতেছে। কোনো স্ত্রী এসব মানবে বলো?

আমাকে রেহাই দাও নিলয়। আমাকে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি বাবা, মায়ের কাছে চলে যাব। আমার পক্ষে এসব মানা সম্ভব না। জীবনে কী পাপ করেছিলাম আর তোমার মতো মানুষের সাথে আমার পরিচয় হলো। ছয়টা মাসে আমি একটা মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছি। শারিরীক মানসিক সবভাবে নির্যাতিত হচ্ছি। আর সহ্য করতে পারব না।”

আরও কিছু বলতে নিব ঠিক এমন সময় আচমকা একটা লাথি আমার পেটের উপর পড়ল। আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলাম। এত জোরে লেগেছিল যে আমি ব্যাথায় বলে উঠলাম

“আল্লাহ্ গো আমায় বাঁচাও। মা গো সহ্য করতে পারছি না।”

তখন নিলয় আমার কাছে এসে আমার মুখটা চেপে ধরে বলল

“একদম চিল্লাবি না। চিল্লালে মুখটা ভেঙ্গে দিব।
সাহস কী করে হয় আমার ফোন ধরার। তোকে হাজার বার নিষেধ করেছি যে ফোন ধরবি না। তাহলে ফোন ধরলি কেন? আর তুই কি ভেবেছিস এসব বললে আমি তোকে ছেড়ে দেব? আর তোকে ছেড়ে দিলে তুই আমার নামে মামলা করবি তাই না? আমার ড্রাগসের ব্যবস্যার কথা ফাঁস করে দিবি। আমি কী তোর নাটক বুঝি না। আর আমার ফোন দিয়ে আমি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলব তাতে তোর কি আসে যায়?”

আমি ব্যাথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে বললাম-ল

“আমি কিছুই করব না। কোন মামলা করব না।একদম মায়ের কাছে গিয়ে থাকব। তোমার এসব কথা কাউকে বলব না। আমাকে শুধু যেতে দাও। না যেতে দিলে মায়ের সাথে একটু কথা বলতে দাও। কতদিন যাবৎ মায়ের সাথে কথা বলি না। মাকে খুব মনে পড়ে।”

এটা বলার পর নিলয় আমাকে আরও দুইটা লাথি দিয়ে বলল

” তুই কী আমাকে বোকা পেয়েছিস? তোর মাকে আমি কল দেই আর তোর মা আমার নামে মামলা করুক তারপর পুলিশ আমার নম্বর ট্র্যাক করে আমার ঠিকানা জেনে যাক তাই না? আর তখন আমার সব কুকর্ম ফাঁস করে দিবি তাই তো?”

কথায় আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি এরকম কিছুই ভাবিনি। আর নিলয় কত কিছু ভেবে বলে ফেলল। একে আর কী বলব আমি। পেটের ব্যাথায় তখন মোচড়ে যেতে লাগলাম। মাথাটা বেশ ঘুরতে লাগল। মনে হল ঘরটা উল্টে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here