#বিরহ_ভালোবাসা-০৫
#Tahmina_Akhter
জ্বরে তেঁতো মুখ নিয়ে মামার বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে সেজেগুজে হাজির হলাম। বেবি পিংক কালারের গাউন,, চুলে রোজকার ন্যায় খোঁপা। কিন্তু, এবার বেলিফুলের মালা দিয়ে খোঁপাটাকে আর্কষনীয় করে তুললাম। ঠোঁটে পিংক লিপ গ্লোস। কানে সাদা স্টনের দুল। মেকআপের আড়ালে আমার জ্বরে কাতর হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর শরীরটা হারিয়ে গেছে। তবে, ভীষণ ভালো লাগছে আমার। মামার বৌ-ভাত বলে কথা।
নানুর ঘর থেকে বের হতেই বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা হাসি দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
— বাব্বাহ, সেদিনের বুড়িটা আজ কত্ত বড়ো হয়ে গেছে! তা এত সেজেগুজে কোনো পরীর দেশে যাওয়ার পায়তারা করছেন?
বাবার দুুুষ্টুমির ছলে বলা কথা শুনে আমি হেসে বাবাকে বলি,
— আজ আমাদের রাজ্য না-হয় ভ্রমণ করি। পরে ভেবে দেখব কোন পরীর দেশে যাওয়া যায়।
বাবা আর আমি যখন কথা বলতে ব্যস্ত তখন কোত্থেকে হতদন্ত হয়ে মা আমাদের দিকে ছুটে আসছেন। আমাদের সামনে এসে বাবাকে বললেন,
— সে কি তুমি এখনো তৈরি হওনি! এদিকে আমার শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে আনা জুতো জোড়া পাচ্ছি না।
বাবা নিজের কপালে চাপড় দিতে গিয়েও থেমে যায়। মাকে জুতোর চিন্তা থেকে বের করে আনার জন্য মাকে বললো,
— জুতো দিয়ে কি করবে বলো? পায়ের দিকে তো আর তাকিয়ে থাকবে না। তোমাকে আজ এমনিতেই সুচরিতার মতো দেখাচ্ছে।
ব্যস,আমার মা জুতো হারানোর চিন্তা বাদ দিয়ে লজ্জা পেয়ে আমার হাত ধরে নীচে যেতে যেতেই বাবাকে বলে গেলো যেন অতি শীগ্রই তৈরি হয়ে চলে আসে।
রুপা আপা, পলাশ, শিপলু, নূর আপাকে দেখলাম জুই মামিকে ঘিরে বসে আছে। মামির সঙ্গে গতকাল বিয়ের সময়েও দেখা হলো না। রাতেও হলো না জ্বরের কারণে। তাই সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি মামির সঙ্গে দেখা করব বলে।
— ভালো আছেন, মামী?
আমার কথায় মামী ডাগরডাগর চোখ দিয়ে আমার দিকে দৃষ্টি জোড়া তাক করে বললো,
— ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমার মামার কাছ থেকে শুনলাম, তোমার নাকি জ্বর এসেছিল।
— জ্বর ভালো হয়ে গেছে।
এমন সময় মামির পরিবারের লোকেরা এসে হাজির হলো। মামি সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন। মামির উচ্ছ্বসিত চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, পরিবারকে দেখতে পেয়ে কতটা আনন্দিত হয়েছেন তিনি।
হুট করে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। একদিন আমারও বিয়ে হবে আর আমি অচেনা অজানা একটি সংসারে যাব। বাবা-মায়ের একমাত্র রাজকন্যা আমি বাবা-মাকে ছাড়া থাকব কি করে?
——————
খাওয়া-দাওয়া শেষ, ফটোসেশন পর্ব শেষ। এবার মামা মামিকে নিয়ে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। মামা আমাকে বেশ কয়েকবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু, আমি যাইনি। ভালো লাগছিল না এতটা হৈ-হুল্লোড়। তবে, মামার সঙ্গে শাদাদ ভাই, পলাশ আর আমার বাবা গেলেন।
একে একে বাড়ির সকল মেহমানেরা যেতে শুরু করেছেন। আমরা আগামীকাল চলে যাব। কারণ, সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা। সন্ধ্যার পর ব্যাগ গুছিয়ে রুমে রেখে ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, হুট করে লোডশেডিং হলো ব্যস পুরো বাড়ি অন্ধকার। আমি তো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদি অন্ধকারে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ব্যথা পাই? মাকে ডাক দিলাম। মা বললো, আইপিএসে কি যেন সমস্যা হয়েছে। মা পলাশকে পাঠাচ্ছেন, আমি যেন ভয় না পাই।
মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ছি আর দোয়া করছি যেন বিদুৎ অতি শীগ্রই ফিরে আসে।
— কি রে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাকে ভয় দেখানোর ফন্দি এঁটেছিস?
এক চোখ খুলে তাকাতেই চোখের সামনে শাদাদ ভাইকে দেখে দিলাম এক চিৎকার। বাড়ির লোক কি হয়েছে? কি হয়েছে? বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন। ততক্ষণে বিদ্যুৎ চলে এসেছে।
মা এসে আমার মাথায় হালকা থাপ্পড় দিয়ে বললেন,
— এত্ত জোড়ে চিৎকার দিলি কেন? আমি বলেছিলাম না পলাশকে পাঠাচ্ছি।
আমি মায়ের দিকে অভিমানী চোখে তাকিয়ে বললাম,
—সাধে কি আর এমন করেছি! শাদাদ ভাই হুট করে চোখের সামনে এসেছে বলেই তো ভয় পেয়েছি। উনি না মামীদের বাড়িতে ছিলেন! এখানে এসেছেন কখন?
আমার কথা শুনে সবাই শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন। শাদাদ ভাই আমতাআমতা করে বললেন,
— আমি কি জানতাম ও আমাকে দেখলে এতটা ভয় পাবে?
— থাক থাক বহুত কথা কইয়া লাইছস। এবার খাইতে যা৷ মাইয়াডার শইলডা এমনিতেই ভালা না। তার ওপরে এমনে ভয় দেখাইলে জ্বর তো আইবই।
বুঝতে পারলাম নানী শাদাদ ভাই আর মাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো। আমি নানীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
— নানী, আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাবো আমি।
— আইচ্ছা।
নানী হাসিমুখে আমার হাত ধরে এগিয়ে গেলেন খাবার ঘরের দিকে। সবাই একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খেয়ে যার যার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, মায়ের ডাক শুনে সবাই বসে পরলো। মা আমার বড়ো জেঠুর সামনে মাথায় কাপড় দিয়ে আস্তে করে বললেন,
— বড়ো ভাইয়া, আমাদের লতার জন্য মামুনের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে একটি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে উচ্চ শিক্ষিত। বর্তমানে একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছে। বাইরের দেশে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে। যেকোনো মূহুর্তে দেশের বাইরে চলে যাবে।
মায়ের কাছ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর আমি চুপ করে আছি। আড়চোখে একবার শাদাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু, উনার নির্বিকার হয়ে বসে থাকার দৃশ্যটুকু আমার হজম হলো না। হুট করে কান্নারা দলা পেকে চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু, আমি প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন এই মূহুর্তে এমন একটা কান্ড না হোক।
— যদি তৌহিদের কিংবা লতার ছেলেকে পছন্দ হয় তবে আমাদের আপত্তি কিসের? কিন্তু তৃনা, মেয়েটার সামনে পরীক্ষা এসময় বিয়ের বিষয়টা বাদ দিলে হয় না?
জেঠুর কথা শুনে বাবা সম্মতি প্রদান করে মাকে বললো,
— হ্যা তৃনা; মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হোক। তারপর, না-হয় বাকি কথা হবে উনাদের সাথে।
— আমি বলছি না যে এখনই লতাকে বিয়ে দাও। উনারা চাচ্ছেন বিয়ের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে। তেহজিব সেদিন লতাকে দেখেছে এবং লতাকে পছন্দ করেছে। এখন আমাদের যদি পছন্দ হয়। তবে, বিয়ের ডেইট না-হয় উনারা পরীক্ষার পর ফিক্সড করবে।
— তৃনা, উনাদের আগামী শুক্রবারে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। দেখি তোমার পছন্দের পাত্র এবং পরিবারের লোকেরা কেমন মানুষ?
জেঠু কথাগুলো বলতে বলতে ড্রইংরুম থেকে প্রস্থান নিলেন। একে একে সবাই উঠে চলে গেলেন। রয়ে গেছে রুপা আপা আর শাদাদ ভাই। আমার মন খারাপের কারন বুঝতে পেরে রুপা আপা আমাকে আস্বস্ত দিতে বললো,
— বাবা যেহেতু ছেলের পরিবারকে দেখবে। তাহলে চিন্তা করার কোনো কারণই নেই। যদি ছেলে তোর পছন্দ না হয় তবে না করে দিবি। সবাই আগে তোর মতামতকে গুরুত্ব দিবে। যা ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। আগামীকাল বাড়িতেও তো যেতে হবে।
রুপা আপা আমাকে স্বান্তনা দিয়ে চলে গেলেন। শাদাদ ভাই আর আমি তখন একা এই ড্রইংরুমে। শাদাদ ভাইয়ের মুখোমুখি হবার আমার ইচ্ছে নেই। তাই অতি দ্রুত এই জায়গা থেকে বের হতে চাচ্ছি। কিন্তু, শাদাদ ভাইয়ের একটি কথায় আমার পায়ের গতি সহ পুরো জীবনটাই যেন থমকে গেছে এক নিমিষে।
— বিয়েটা করে ফেল তোরও শান্তি আমাদেরও শান্তি।
— কিন্তু, তুমি তো বারণ করেছিলে। আমি যেন তেহজিব সাহেবকে বিয়ের জন্য বারণ করে দেই।
জানতে চাচ্ছিলাম শাদাদ ভাইয়ের এমন কথার মানে। তাই জিজ্ঞেসও করে ফেললাম।
— কেন রে আমি বারণ শুনবি কেন তুই? আমার কি তোর সাথে কোনে কমিটমেন্ট আছে? নাকি প্রেম-ভালোবাসা আছে? তোর আমার কথা শুনতে হবে? বিয়ে করে মন দিয়ে সংসার কর।
কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই সিগারেট জ্বালিয়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শাদাদ ভাই নামক মানুষটার দিকে! এমন কেন মানুষটা? তার কথার এপিঠ-ওপিঠ কিছুই বোঝা যায় না? এই তো সেদিন রাতে বারণ করব শুনেই তো আমাকে লাল পিঁপড়ে মতো কামড়ে দেয়া চুমু দিয়েছিল। আর এখন কিনা বলছে বিয়ে করে সংসার করতে! সবটাই জানতে হবে আমাকে কেন এমন করছে সে? মানছি তার সঙ্গে আমার প্রেম-ভালোবাসা নেই। তাই বলে যে উনি হুটহাট এসে আমার অনুমতি ছাড়াই আমাকে স্পর্শ করবে তা তো হবে না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। কাল বাড়িতে পৌঁছে নেই। এরপর, সকল প্রশ্নের জবাব চেয়ে নিব আমি শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে।
—- কিন্তু, সিগারেট কবে থেকে খাওয়া শুরু করেছে অসভ্যটা?
#চলবে…