#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৩
– গুডমর্নিং এভ্রিওয়ান!কালকে রাতে বাবাই যা যা বলল সেটা মনে আছে তো সবার?
সকালের নাস্তা করার জন্য সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে।গোধূলিও এসে বসতে বসতে কথাটা সবাইকে জিজ্ঞাস করলো।সবাই গোধূলির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।সবাইকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গোধূলি বললো,
– কি হলো সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?এইভাবে তাকিয়ে থাকার মতো তো আমি কিছু বলি নি।জাস্ট সিম্পল একটা প্রশ্ন করেছি!খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের এক্ষুনি বেরুতে হবে সে খেয়াল আছে তোমাদের?আমরা দেরি করে গিয়েছি এটা যদি বাবাই জানতে পারে তাহলে কিন্তু খুব বকবে।
সবাই গালে দিয়ে গোধূলির কথা শুনছে আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে।কেউ কোনো কথা বলছে না।পুরো টেবিল জুড়ে পিনপিনে নীরবতা।সবার এমন নীরবতার কারণ বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে গোধূলিই সেই নীরবতা ভেঙ্গে বললো,
– আচ্ছা বড়দাভাই সবাই এত চুপচাপ কেন? সবাই টেবিলে বসে এইভাবে ঝিমাচ্ছেই বা কেন?তোমরা কি বুবুর বিয়ের আনন্দে সারারাত কেউ ঘুমাও নি নাকি?আর সামনে এইভাবে খাবার নিয়ে সবাই বসে আছো কেন?
– বোন কয়টা বাজে রে?
করুন স্বরে বললো ইহান।ইহানের কথায় গোধূলি মাথা ঘুরিয়ে পিছনের দেওয়ালে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এগারোটা!
– সবাই সামনে খাবার নিয়ে এইভাবে বসে আছি যাতে একটু পরে কষ্ট করে আবার খাবার খেতে না হয়!ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চটা যাতে এক সাথেই করতে পারি!
দীপ্তের কথায় গোধূলি হুশ ফিরে!এতক্ষণে বুঝতে পারলো ওর ঠিক কি ভুল হয়েছে।ঘুম থেকে উঠে একবারো ঘড়ি দেখে নি ও।ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে চলে এসেছে।ওর নিজেরই লেইট হয়েছে আর ও এসে সবাইকে শাসাচ্ছে?গোধূলি গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– ওহ শীট!এগারোটা বেজে গেছে!এত বেলা হয়ে গেছে দেখেও তোমরা কেউ আমাকে ডাকো নি কেন?
গোধূলির কথায় দীপ্ত বিরক্ত হয়ে বলে,
– এই তুই চুপ কর তো!অনেকক্ষণ ধরেই খুব বকবক করছিস তুই!তোর কি মনে হয় তোকে ডাকা হয় নি?অনেক ডাকাডাকি করা হয়েছে তোকে।ঘুমালে কোনো হুশ থাকে তোর।কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম দিস তুই।ঢাক ঢোল পিঠিয়ে ঘুম ভাঙ্গাতে হয়!
দীপ্তের কথায় গোধূলি রাগ উঠলেও তা সংবরন করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– সরি!আসলে শরীরটা তো খুব একটা ভালো না তাই কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি!
– ইটস ওকে গোধূলি।আমরা বুঝতে পেরেছি তুমি অসুস্থ তাই সকালে উঠতে পারো নি।
ইফতির কথায় গোধূলি নরম গলায় বললো,
– হুম,কিন্তু ইফতি ভাইয়া আমি তো এটা বুঝতে পারছি না সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল তোমরা এখনো কেউ সকালের নাস্তা করো নি কেন?
– তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম!
ইফতির কথায় গোধূলি বেশ অবাক হলো।ওর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে মানে?বললো,
– মানে?আমার জন্য সবাই না খেয়ে বসে আছো?এটা কোনো কথা হলো?তোমরা সবাই খেয়ে নিতে আমি না হয় ওইখানে গিয়েই কিছু খেয়ে নিতাম।
আহান বুঝতে পারছে এদের এই কথোপকথন সারাদিনেও শেষ হবে না।এ একটা বলবে তো ও উল্টে আরেকটা বলবে।আর এই করতে করতে সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তাও এদের কথা শেষ হবে।তাই আহান বললো,
– হয়েছে বাদ দে তো বোন।আজকে সকালে সবাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে শুধু তোর একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে এই আরকি।এখন তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নে। বাসার সবাই সেই কখন চলে গেছে শুধু আমরাই রয়ে গেছি।
★
– বুবু আজকে কি সত্যিই তোমার এনগেজমেন্টেই তো নাকি?
গোধূলি আশ্চর্য হয়ে আদিবাকে জিজ্ঞাস করলো।রিসোর্টে এসে পুরো অবাক হয়ে গেছে ও।এত্ত সুন্দর ডেকোরেশন এর আগে কখনো গোধূলি দেখে নি।চোখ ধাধানো ডেকোরেশন করা হয়েছে।গোধূলি কথায় আদিবা স্মিত হেসে বললো,
– ওমা এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
– বুবু বুবু….
গোধূলি আদিবার হাত ধরে গোল গোল করে ঘুরতে লাগলো।খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে ও।কয়েক মিনিটের জন্য ভুলেই গেছে এটা ওদের বাড়ি না রিসোর্ট!গোধূলির কান্ড দেখে বাকি সবাই হাসতে হাসতে শেষ।রিসোর্টের সব লোক হা করে গোধূলি আর আদিবার দিকে তাকিয়ে আছে।আদিবা চারপাশে তাকিয়ে লজ্জামিশ্রত মুখে ফিসফিস করে বললো,
– আরে সাজি ছাড়।পড়ে যাবো তো এবার।দেখ সবাই দেখছে!
গোধূলিও চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে আসলেই সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।জিভ কেটে ধীর কন্ঠে বললো,
– ওপসস!সরি বুবু।আসলে এক্সাইটমেন্টে ভুলেই গিয়েছিলাম এটা আমাদের বাড়ি না,রিসোর্ট।বুবু গো বুবু আমার যে কি খুশি লাগছে তোমায় বলে বুঝাতে পারবো না।
গোধূলি আদিবাকে জড়িয়ে ধরে বোনের গালে ইচ্ছা মতো নন স্টপ চুমু দিতে থাকে।এটা দেখে দীপ্ত ওদের কাছে এসে বলে,
– কিছু চুমু বরের জন্যও জমিয়ে রাখলে ভালো হতো না কি?
দীপ্তের দিকে চোখ গোলগোল করে তাকায় গোধূলি।গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– হোয়াট?
– না মানে বলছিলাম, সব চুমো যদি তুইয়েই দিয়ে দিবি তাহলে রায়ান ভাইয়া কি দিবে?
– আপনি কিন্তু……..
– হয়েছে হয়েছে তোদের আর ঝগড়াঝাটি করার দরকার নেই।এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন চল গিয়ে দেখি আমাদের রুমগুলো কোনদিকে নেওয়া হয়েছে।
আদিবা ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো।তারপর দুজন দিকে মুখ করে দুদিক তাকিয়ে থাকে।ওদের দিকে তাকিয়ে স্মিথ হাসলো আদিবা।বাকিদের কোথাও দেখতে না পেয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আদিবা।তারপর চোখ পড়ে স্টেজের দিকে।ওইখানে সবাই জড়ো হয়ে ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত।আদিবা গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– এই তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করিস?আরে ইয়ার তোরা সেলফি তোলার সময় অনেক পাবি আগে আয় গিয়ে দেখি বাড়ির বড়রা কোথায় আছে।
– এই বুঝি তোদের আসার সময় হলো!দূরের সব আত্মীয় স্বজনরা চলে এসেছে আর তোরা বাড়ির লোক হয়ে আসতে এত দেরি করলি।
আহসান সাহেবের কঠোরভাবে বললেন।রাগ করাটাই স্বাভাবিক।নিজেদের বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে যদি কেউ এতটা কেয়ারলেস থাকে তাহলে যে কারোরই রাগ উঠে যাবে।আহসান সাহেবকে গাম্ভীর্যমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহান কাচুমাচু মুখ করে বললো,
– সরি আব্বু!আসলে আমাদের…….
আহানকে বলতে না দিয়ে গোধূলি বললো,
– সরি বাবাই!দাভাইয়ের কোনো দোষ নেই।আসলে আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলেছিলাম তাই আসতে দেরি হয়েছে।সব দোষ আমারই বাবাই।
গোধূলি কাঁদোকাঁদো ফেইস করে কথাটা বলেই মাথাটা নিচু করে নেয়।গোধূলি যে মিথ্যা বলে না এটা সবাই জানে তবে কখনো কখনো নিজের ভাই বোনদের বাঁচতে মিথ্যা বলে থাকে।তাই আজও হয়তো আহানকে যাতে বকা না খেতে হয় তাই হয়তো গোধূলি মিথ্যে বলছে এমনটা ভেবে আহসান সাহেব গোধূলির মাথায় হাত রেখে বলেন,
– সাজি মা!তুই ওদের দোষ তোর উপর কেন নিচ্ছিস?আমি জানি সব ওদেরই দোষ!
আহসান সাহেবের কথা শুনে সবাই হা করে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।আর কেউ কিছু না বললেও দীপ্ত ঠিকই বলবে।কারণ দোষ করলে তাও এই অপবাদ মানা যেতো কিন্তু বিনা দোষে অপবাদ হজম করার ছেলে দীপ্ত না।তাই দীপ্ত বললো,
– কেন গো মামু?তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না যে দোষটা ওরই?
– না!
দীপ্তের প্রশ্নের আহসান সাহেবের ঝটপট সোজাসাপটা উত্তর।
– বাবাই!সত্যেই আজকে আমার জন্যেই দেরি হয়েছে।
গোধূলির চোখে পানি টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তে চোখ বেঁয়ে সেই পানি গড়িয়ে পড়বে।আহসান সাহেব গোধূলিকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বলেন,
– কে বলেছে দেরি হয়েছে!আমি তো এমনি এমনি বলছিলাম!দেখ মাত্র দুইটা বাজে।
আহসান সাহেবের মুহুর্তের মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখে দীপ্ত অবাক হয়ে বলে,
– মামু তুমিও পারোও বটে!গিরগিটির মতো রং পাল্টে ফেললে?ওর জায়গা যদি আজকে আদিবাপু থাকতো তাহলে তো ঠিকই কানটা মুলে দিতে।
– বেশ করতাম!আয় তোরটাও মুলে দেই!
আহসান সাহেব গোধূলিকে ছেড়ে দিয়ে যেই দীপ্তের দিকে এগোতে যাবে দীপ্ত এক দৌঁড় দিয়ে চলে যায়।উপস্থিত সবাই মামা ভাগ্নের কান্ডে হেসে উঠে। তারপর সবাই রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে যার যার রুমে চলে যায়।
চলবে….