পতিতা বউ – পর্ব শেষ

0
554

#পতিতা_বউ

৪৬তম পর্ব আও শেষ পর্ব

গিফট আর ফুলের বুক্যে হাতে নিয়ে আফিফ গুটি গুটি পাঁয়ে সোহানদের বাসাই ঢুকলো। কতকাল পর এসেছে এখানে তা তার নিজের ও মনে নেই। সোহান একটু দূরে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছিলো আফিফ কে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো।

>>ওয়েলকাম ওয়েলকাম তুই আসবি মনেই হয়নি যাই হোক এসেছিস তার জন্যে ধন্যবাদ।
(আফিফের কাছ থেকে গিফট নিতে নিতে।)

>>না আসলে কি হতো নাকি আমার এক কালের বেষ্টফ্রেন্ড এর বিয়ে।

>>তা ঠিক কিন্তু এতদিন কই ছিলি তুই? তোকে আমার বোনটা কত মিস করেছে জানিস?

>>বোন বলতে?

>>তোর বউ আমার বোন লাগে বুঝলি

>>ওহ আমি এখানে ছিলাম নাহ সেমিনারে ছিলাম তাই।

>>আয় ভেতরে চল।

সোহান আফিফকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। দু’জনেই গল্প জুড়ে দিলো। আফিফের ভেতরে প্রথম একটু জড়তা কাজ
করলেও পরে তা দূর হয়ে যায়।

নুহা শেষবার এর মত অনুর সব কিছু চেক করে নিচ্ছিলো। এরপর অনুকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে এলো। সে সময় নিচে বেশ হৈ-হুল্লোর পড়ে গেলো। আফিফ আর সোহান দুজনেই সিড়ির দিকে তাকালো। সোহানের চোখ অনুতে আটকে গেছে আর আফিফের চোখ নুহা তে।
শ্যাওলা বর্ণের একটা কাতান তার মধ্যে সিলভার কালারের কারুকার্য। গায়ে হুয়াইট স্টোনের গয়না। চুলে খোঁপা আর তাতে ফুল দেয়া। কপালে টিকলি বেশ সুন্দর লাগছে নুহাকে। কিন্তু এই কয়দিনে কেমন যেন রোগা হয়ে গিয়েছে। মুখ টা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।
আফিফ অপলক সেদিকে তাকিয়ে আছে।

একসময় নুহার ও আফিফের দিকে চোখ যাই।দু’জনেরই চোখাচোখি হয়ে যায়। ব্লু কালারের স্যুটে বেশ দারুণ লাগছে আফিফকে। চোখে খুশির ঝলক ফুটে ওঠে নুহার কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সেই কথাগুলো। মাথা নিচে করে ফেলে নুহা এরপর অনুকে নিয়ে নেমে আসে।

অনুকে বসিয়ে দিয়ে সে ও অনুর পাশে বসে পড়ে একটু পরেই সোহান এসে বসে ওদের পাশে আর সোহানের পাশে আফিফ।
অনু,সোহান আর নুহা টুকটাক কথাবার্তা বললেও আফিফ চুপচাপ নুহার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এক পর্যায়ে নুহার তাতে অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। সে ওঠে চলে যায়। বাকিরা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু। অনু বললো,

>>মনে হয় আফিফ ভাই এর উপর বেশ রাগ করে আছে ও।

>>হ্যাঁ রে আমার শালিকা বেশ রাগ করেছে আমার উপর অবশ্য দোষ আমারই। এখন মানাতে গেলে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হবে মনে হয়।
(বলে আফিফ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো)

>>যা গিয়ে আমার বোনের রাগ ভাঙ। তোর থেকে আমিও শিখে নিবোনে ভবিষ্যতে কাজে আসবে। (সোহান অনুর দিকে চোখ মেরে বললো)

>>হুম শিখে নিলে আপনারই ভালো।

>>আমি দেখে আসি ওকে।

বলে আফিফ ও নুহার পিছে পিছে গেলো। নুহা ফাইজা বেগমের সাথে কথা বলছিল। আফিফ গিয়ে সেখানে দাঁড়ালো। নুহা একটু বিরক্ত বোধ করলো তাতে। আফিফ কে দেখে ফাইজা বেগম বললেন,

>>আরে আফিফ যে, কেমন আছো বাবা?

>>এইতো আন্টি ভালো আপনি?

>>আমিও ভালো বাবা। কতদিন পরে দেখলাম তোমাকে। তোমার বউটা কিন্তু বেশ লক্ষী আফিফ।
ফাইজা বেগম নুহার থুতনি ধরে বললেন।

>>থ্যাংকস আন্টি।

>>আচ্ছা তোরা এঞ্জয় কর আমি ওইদিক টা দেখে আসছি।

ফাইজা বেগম চলে গেলে নুহা ও উনার পেছন পেছন যেতে লাগলে আফিফ নুহা হাত ধরে আটকায় তাকে। আফিফ যেই না কিছু বলতে যাবে ওইদিকে হৈ-হুল্লোর পড়ে গেলো। নুহা কোনরকম হাত ছুটিয়ে সেদিকে ছুটে গেলো।

সোহান আর অনিমার সাইন নেওয়া হচ্ছে ম্যারিজ রেজিস্টার এ।এরপর কাজি এসে আবারো বিয়ে পড়ালো ওদের।দু’জনেই বেশ খুশি।
বেশ জাঁকজমক ভাবেই নিকাহ অনুষ্ঠান টি শেষ হলো।

রাত ১১বেজে ৩৪মিনিট,

নুহা অনুকে বাসর ঘরে এনে বসিয়ে দেয়।পুরো রুম টা ক্যান্ডেল আর অর্কিড দিয়ে সাজানো। ফুলের সৌরভে ম ম করছে চারদিক। তা দেখে অনুর হাত পা রীতিমত ঘামছে। সে নুহাকে বলে,

>>দোস্ত ভয় লাগছে খুব।

>>লাগারই কথা। তবে আমার মনে হয়না সোহান ভাই জোড় করবে তোর উপর। তোকে সময় দেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে। তবে এই প্যাকেট টা নে।

নুহা অনুর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো।অনু প্যাকেট খুলে টকটকে লাল রঙা একটি জর্জেট এর শাড়ি পেলো।

>>আয় তোকে রেডি করিয়ে দেয়। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।

>>আচ্ছা।

অনু ওয়াশরুম এ চলে গেলো ফ্রেশ হতে।তার বেশ অস্থির লাগছে। সে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এলো।

নুহা অনুকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে হালকা সাজিয়ে দিলো।

সোহান আর আফিফ ব্যাল্কুনি তে দাঁড়িয়ে সিগারেট ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। আর বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আফিফ বললো,

>>আজ তোর বিড়াল মারার পালা এলো অবশেষে।

>>কি যে বলিস না। আমি কোন জোরাজুরি করতে চাই না। ও যেদিন নিজেই আসবে সেদিনই দেখে নেবো।

>>তাই ভালো। হুট করে বিয়ে হলো ওর টাইম লাগবেই মানিয়ে নিতে। ভালো রাখিস ওকে বুঝলি।

>>অবশ্যই। তা তুই আমার বোন কে কতটা ভালো রেখেছিস তাই বল দেখি? জানিস আসছে পর্যন্ত মন খুলে হাসতে দেখলাম না ওকে।

>>একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। ভয় নেই মিটিয়ে নেবো আজকেই।

>>তাই ভালো। ওকে হ্যাপি রাখার দায়িত্ব তোর আমার বোন এর চোখে পানি আসলে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেবো তোকে।
(মজার ছলে)

>>আর আমি তোকে পেটাবো আমার শালির চোখে পানি আসলে।

দু’জনেই হো হো করে হেসে উঠলো। আফিফ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
এদিকে নুহা অনুকে রেডি করে দিয়ে সোহানকে বলতে চলে গেলো।
নুহা সোহান কে এসে বললো,

>>যাও যাও ভাবি অপেক্ষা করছে।

>>ভাইরে এমনিতেই লজ্জা লাগছে আমার ভয় করছে যেতে।

>>বাহ রে এদিকে তুমি ভয় পাও অইদিকে অনু। এমন হলে তখন জড়িয়ে ধরলে কেমনে?

বলেই নুহা হেসে ওঠে। সোহান নুহার মাথায় চাপড় মেরে বললো,

>>আমার খিস্তি নিস তাই না। এই নে রাখ তোর গিফট।
নুহার হাতে একটা বক্স দিলো সোহান।

>>এটা কেনো?

>>কেন কি আবার। লাইফে যা কিছু পেয়েছি তোর অনেক অবদান তাতে। সামান্য একটা গিফট তার সামনে এটা তুচ্ছ। বোন হিসেবে দিলাম রাখ। আসি।

সোহান নুহার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো। নুহার চোখ ভরে এসেছিলো। সে কেমন যেন ফ্যামিলি পেয়ে গিয়েছে। মা-বাবার আদর,ভাইয়ের মমতা সবই সোহান এর ফ্যামিলি থেকে পাওয়া।

নুহা দরজা বন্ধ করে কাবার্ড থেকে একটা হালকা শাড়ি বের করলো। এরপর নিজের অর্নামেন্টস গুলো খুলে গায়ের শাড়ির আঁচল টা আলগা করতেই আফিফ বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে হুট করে। হঠাৎ এমন হওয়াই নুহা থ মেরে যায়। আফিফ একদৃষ্টে নুহার দিকে তাকিয়ে থাকে।
নুহা নিজের কাপড় ঠিক করে নিয়ে যেই না দরজা খুলতে যাবে আফিফ দৌড়ে এসে নুহাকে ঝাপটে ধরে আটকাই।

অনুর বেশ অস্থির লাগছে। সে কিছুক্ষণ রুমে পায়চারী করে। হুট করেই তার রাফির কথা মনে পড়ে যায়। সে ব্যাল্কুনি তে চলে যায়। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। পরক্ষণেই সোহানকে নিয়ে ভাবতে থাকে।
সোহান রুমে ঢুকে অনুকে দেখতে না পেয়ে একটু চমকে উঠে। ওয়াশরুমে দেখেও অনুকে পায়না। এরপর ব্যাল্কুনিতে চলে যায়।
ব্যাল্কুনি তে গিয়ে তার চোখ আটকে যায়।
অনু দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের আলো তাকে ঘিরে ধরেছে চারপাশ থেকে। ভেজা খোলা চুল বাতাসে থেকে থেকে উড়ছে। শাড়িটা বেসামাল হয়ে পিঠের দিকে প্রায় নেমে কোমরের নিচে এসে ঠেকেছে। কোমরের উপর থেকে সামান্য কিছু অংশ দেখা আচ্ছে। সেদিক টা অসম্ভব ফর্সা। সোহানের নিজেকে ঠিক রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। হবেই না বা কেন নিজের স্বপ্নের রানীকে কাছে পেতে কার না মন চাই। সোহান ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। অনুর পেছনে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একনজরে দেখতে থাকে।
অনু গুণগুণ করে কিছু গাইছে।
সোহান তা শোনার চেষ্টা করে কান পেতে,

Kis Tarah Se Shukr Tera ab Ada Karun Main
Is Mohabbat Ka Harjana Kis Tarah Varu Main

Khamosh Reh Kar Bhi Keh Gaye
Darriya Sa Dil Tak Beh Gaye

Tum Par Ho Raha Hain Pura Aitbar.

Tum Hi Ho Hifajat Meri Suno Yeh Kahan Hain RuH Ne
Kis Tarah Se Shukr Tera ab Ada Karun Main….

>>বেশ ভালো গাও তো।

পেছন থেকে এই কথাটি শুনে অনু দ্রুত ফিরে তাকায়। সোহান হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসি একে। অনু বেশ লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে,

>>কিজানি ভালো গাই কিনা তবে গাইতে পারি একটু আধটু।

>>না ভালোই গাও। যাক বাসর রাতে বেশ ভালো গিফট পেলাম।

এটি শুনে অনুর লজ্জা আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সোহান একেবারে অনুর সামনে এসে দাঁড়ায়। অনুর কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
>>তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে
বলে অনুর কানে একটা চুমু দিতেই অনু কেপে উঠে সোহানের পড়নের পাঞ্জাবি খামছে ধরে লজ্জায় সোহানের বুকে মুখ লুকাই। অনুর এমন আচরণে সোহান সম্মতি খুঁজে পায়। সেও অনুকে জড়িয়ে ধরে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই থাকে। সোহান তার বাঁধন আলগা করতেই অনু ওপাশ ফিরে দাঁড়ায়। এবার সোহান অনুর পাশে এসে দাঁড়ায়। অনু সোহানের কাঁধে মাথা রাখে। কেমন যেন এক প্রশান্তি ছেয়ে যায় তার মনে। সোহানের বাহু আঁকড়ে ধরে চাঁদ দেখায় মনযোগ দেয়। আর সোহান অপলক দেখতে থাকে তার ভালোবাসা কে।

নুহা বেশ অনেক্ষণ যাবত কান্না করছে আফিফের বুকে মাথা রেখে। দু’জনেই মেঝেতে বসে পড়েছে। প্রথমে জেদ দেখালেও সে পড়ে আর পারেনি। সে ও বাধ্য হয় আফিফ কে কাছে টেনে নিতে। অবশ্য পরিস্থিতি টা তখন অনুকূলে ছিলো আফিফেরও বা দোষ নেই।
একসময় নুহা শান্ত হয়ে পড়ে। থেমে থেমে ফোঁপাতে থাকে। আফিফ তার বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখে নুহা কে। হঠাৎ নুহা বলে,

>>তোমার সেদিনের অবিশ্বাস মুহূর্তেই আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিলো। একটা মানুষ কতটা আঘাত পেলে তাহাজ্জুদে নিজের মৃত্যু চাইতে পারে তা তুমি ভাবতেও পারোনা।
আমি আজ মাফ করে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু সূক্ষ্ম একটা শাস্তি তোমার জন্য অপেক্ষারত।

নুহার কথা শুনে এবার আফিফ নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। নুহার কথার মর্মার্থ বেশ গভীর। কতটা কষ্ট পেলে মানুষ এই কথা গুলো মাথায় আনতে পারে তা বোঝা দায়। তবে মনমালিন্যের পর্ব টা আজ রাতেই শেষ দু’জনের মাঝে। নুহা একসময় আফিফের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আফিফ নুহা শুইয়ে দেয়। বেঘোরে ঘুমোই নুহা কিন্তু আফিফ পারেনা।

“সূক্ষ্ম একটা শাস্তি তোমার জন্য অপেক্ষারত ”
এই কথাটিই তার কানে বাজতে থাকে সারা রাত।

সময় বহমান, কেটে যায় সাতটি বছর।।

বাবার হাত ধরে গুঁটি গুঁটি পায়ে হসপিটালের করিডোরে এগিয়ে যেতে থাকে ছয় বছরের আনুফা। আনুফা আফিফ আর নুহার সন্তান।
তাদের দিকেই এগিয়ে আসে সোহান আর অনু। আর সোহানের কোলে তাদের চার বছরের ছেলে সিদ্রাত।
সবাই মিলে কেবিনে ঢুকে।
নুহা হসপিটালের সিটে একটি ফটোফ্রেম হাতে নিয়ে বসে আছে। আফিফ,সে আর আনুফার হাস্যঔজ্বল একটি ছবি।

অনু ভেতরে ঢুকতেই নুহাকে দেখে তার বুকটা ধক করে ওঠে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ মাথায় একটা চুল ও নেই। ভ্রু জোড়া ও যায় যায় অবস্থা।
অনু নুহাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে।

ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছে নুহা। সবার থেকেই আড়াল করে যায়। এখন লাস্ট স্টেজে। বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তিনবার কেমোথেরাপি দেওয়ার ফলে এই অবস্থা। দিন গুলো হসপিটালের সীটেই কাটছে গত চারমাস ধরে।

সোহান দ্রুত বেড়িয়ে যাই। হাজার হলেও বোনের মতই তার। বোনের এই করুণ অবস্থা ওর পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। বেড়িয়ে চোখের জল ফেলে সে। সিদ্রাত তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,

>>বাপি ফুপ্পির কি হয়েছে? ফুপ্পি বেল্লুমাথা হলো কেনো? ফুপ্পির ও কি গলম লাগে আমার মত?

সোহান কিছু বলে না। সিদ্রাত কে বুকে জড়িয়ে নেয় শুধু।
কান্নারত অনুকে নুহা শান্তনা দিতে থাকে। পাশেই আনুফা কে দেখে নুহা কাছে ডেকে নেয়। আনুফা দৌড়ে গিয়ে মায়ের কোলে উঠে। আনুফার ছোট্ট চোখ জোড়া তেও পানি দেখে নুহা বলে,

>>আমার আম্মুটার চোখে পানি কেনো?

>>আম্মি তুমি অসুস্ত তাই আনুফার কস্ত হয়। আম্মি সুস্ত হয়ে বাসাই কখন যাবা? এই পচা জায়গায় আর কত থাকবা? এখানে সবাই পচা আম্মি কত বড় বড় সুই নিয়ে ঘুরে ওরা। সবাই কে ব্যাথা দেয়। আম্মি তোমাকেও কি ওরা সুই দিয়ে ব্যাথা দেয়?

মেয়ের কথা মনযোগ দিয়ে স্মিত হাসে নুহা। তারপর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। দূরে দাঁড়ানো আফিফের দিকে নজর যায় তার।
কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ওকে। চোখ জোড়ায় পানি টলটল করছে।

দুপুর গড়াতেই সোহান,অনু চলে যায়। সাথে আনুফা কেউ নিয়ে যায়।
বিকালের দিকে রাফি ভিডিও কল দেয়।

কলে নুহাকে দেখে রাফি আর আয়ুশি দু’জনেই কেঁদে ফেলে। রাফি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

>>এমন কেন করলে ভাবী? সময় থাকতে কেন আড়াল করে গেলে? আনুফার কথাটাও কি মাথায় আসেনি একবার ও?

নুহা স্মিত হাসে। আজকাল এভাবেই হাসতে অভ্যস্ত সে।
>>আল্লাহর কাছ থেকে খুঁজে নিয়েছি বুঝলে। তাই চাইনি কেউ জানুক।খুব দ্রুতই চলে যেতে চাই সব মায়া ছেড়ে। আর আনুফার কথা আমার ভাবতে হবেনা। আফিফ আছে তুমি আছো আর আয়ুশি ও তো আছে। কি বলো আয়ুশি পারবেনা নিজের মেয়ের মত করে আগলে রাখতে?

আয়ুশি রাফির বাহুতে মুখ গুঁজে কাদছিলো। নুহার কথা শুনে মাথা তুলে বলে,

>>আপনি অনেক স্বার্থপর ভাবি। জানেন আমার কত স্বপ্ন ছিলো দুই জা মিলে কত কিছু করবো। কিন্তু আপনার সাথে বেশি সময়ই কাটানো হলোনা আর আপনি চলে যাচ্ছেন আমাদেরকে ছেড়ে।

>>যেতে হবে আমাকে আয়ুশি। হয়তো এরপর যদি পুনঃজন্ম হয় আমার তাহলে আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া তুমি যেন আমার বোন হও। এবার বলো আনুফাকে দেখে রাখবেনা?

>>রাখবো ভাবী নিজের মেয়ের মত দেখে রাখবো। তাও সুস্থ হয়ে যান ভাবি প্লিজ।

আয়ুশি কেঁদে দেয়। রাফি ওকে শান্তনা দিতে থাকে। তা দেখে নুহা বলে,
>>ওকে সামলাও রাফি।

নুহা ল্যাপটপ টা অফ করে পাশে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে
” আজ মৃত্যুপথযাত্রী বলে আমার জন্য সকলের চোখে পানি। সবাই আমার কত খেয়াল রাখছে। সবাই দেখতে আসছে। কিন্তু মামুণি আসলো না। তাই তো মামুণির কাছেই চলে যেতে চাচ্ছি। মামুণি আমিও তোমার মত আকাশের তারা হয়ে যাবো। তারপর তুমি আমি মিলে রাতে আলো ফোটাবো। সত্যি ”

আফিফ কেবিনে ঢুকে দেখে নুহা দাঁড়িয়ে আছে। সে নুহাকে ডেকে নেয়,

>>নুহা?

>>হুম (জানালার দিকে ফিরেই বলে নুহা)

>>ঔষধ টা খেয়ে নাও।

নুহা আর কিছু না বলে বিছানায় এসে বসে। আফিফ প্রেস্ক্রিপশন দেখে ঔষধ ছিলে নুহাকে খাইয়ে দেয়। এরপর চলে আসতে নিলেই নুহা হাত ধরে আটকিয়ে বলে,

>>এভাবে দূরে দূরে থাকো কেনো? পাশে থাকলে তো সমস্যা নেই,ক্যান্সার তো আর ছোঁয়াচে নয়।

আফিফ নুহার পাশেই বসে পড়ে মাথা নিচু করে । নুহা আফিফের গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরায়। আফিফ কাঁদছে নিঃশব্দে। তার চোখের পানিই তার জানান দিচ্ছে। নুহার বেশ মায়া হয়। সে বলে,

>>এভাবে কান্নার কি আছে? সবাই শুধু কান্না করে কেনো? অনু কেঁদেছে। সোহান ভাই ও,রাফি,আয়ুশি সবাই ই। এখন তুমিও। জানো আমার কান্না কাটি বেশ বিরক্ত লাগে। আর মানুষ কি সারাজীবন বেঁচে থাকে নাকি? এক না একদিন তো মরতেই হয়। আমি নাহয় আগেই গেলাম।

এবার আফিফ শব্দ করে কেঁদে ওঠে নুহাকে জড়িয়ে ধরে,কাঁদতে কাঁদতে বলে,

>>কতটা পাথর হয়ে গিয়েছো তুমি নুহা? নিজের টাই দেখছো শুধু। আনুফার কথা ভাবলে না। আমার কথাও ভাবলে না আমরা কিভাবে বাঁচবো তোমাকে ছাড়া। আমি আনুফাকে কি জবাব দেবো? কেন লুকালে বিষয় টা। তুমি যদি হারিয়ে যাও তাহলে ক হবে আমাদের?

>>সময় গড়ালেই শিখে যাবে আমাকে ছাড়া থাকা। আর আনুফা ও শিখে যাবে। কারো জন্য কাউকেই মরতে হয়না আফিফ। বেঁচে থাকতে হয় লড়াই করে। তোমরাও পারবে।
(নুহা বেশ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়)

আফিফ নুহাকে ছেড়ে দেয়। নুহার ঠোঁটে সেই স্মিত হাসিটি এখনো লেপ্টে আছে। তা দেখে আফিফের ভেতরটা যেনো আরো দুমড়ে মুচড়ে যায়।
তার কানে বাজতে থাকে সাত বছর আগের রাতে নুহার বলা সেই কথাটি,

“সূক্ষ্ম একটা শাস্তি তোমার জন্য অপেক্ষারত ”

হয়তো এই সূক্ষ্ম শাস্তিটির কথায় বলছিলো নুহা। সত্যি এই শাস্তিটা বেশ হৃদয় বিদারক। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে তিলে তিলে মরতে দেখা দুনিয়ার নিষ্ঠুরতম দৃশ্যের মাঝে অন্যতম।

অবিশ্বাস করার শাস্তি টা আফিফ অবশেষে পেয়েই যায়। চলে যায় নুহা চিরতরে। হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে। তাকে সূক্ষ্ম শাস্তিতে দণ্ডিত করে যায় আজীবন এর জন্য।

*সমাপ্ত*

[দীর্ঘদিন যাবত অপেক্ষা করে আমার এই জগাখিচুড়ি পড়ার জন্যে সকলকেই ধন্যবাদ। সবার কাছ থেকেই বেশ ভালোবাসা পেয়েছি। ধন্যবাদ আমাকে উৎসাহিত করার জন্যে।আমার লেখাকে এত ভালোবাসার জন্যে। গল্পটার সম্বন্ধে মন্তব্য জানতে চাই আজকে।আশা করি সবাই জানাবেন। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে পাশে থাকবেন।আসসালামু আলাইকুম❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here