গোধূলি লগ্ন – পর্ব ২৭+২৮

0
221

#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#Part_27+28

০৬.০২.২০১৮

তার চোখেও আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। সে ও আমাকে ভালোবাসে। আমার বড্ড ইচ্ছে করছে তাকে চিৎকার করে বলতে আমি ও তোমাকে ভালোবাসি।

অনন্যা মাঝে মাঝে ডায়েরি লিখতো তা পূন্য ডায়েরিতে লিখা তারিখগুলো দেখে বুঝতে পারলো, পরের কয়েকটা পাতা আবার খালি। পূন্য পাতা উল্টাতে লাগলো,

১০.০২.২০১৮

নাহ্,, আমাদের মতো গরিব ঘরের মানুষদের ভালোবাসতে নেই। আজকে তিশানের জীবন দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারলাম। খুব কষ্ট হচ্ছে তিশানের জন্য। বড় ভালো ছিলো, ছেলেটা। মোর্শেদা বেগম, মানুষটা যতটা কঠিন ভেবেছিলাম, তিনি তার থেকেও বেশি কঠিন, তার জেদের জন্যই আজ ছেলেটার জীবন দিয়েছিলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি তখন, যখন তিশানের লাশ দেখেও তিনি কাঁদলেন না, কি হতো তিশানের ভালোবাসাকে মেনে নিলে, হোক না মেয়েটা গরীব,

১১.০২.২০১৮

ভালোবাসার মানুষের চোখে মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠেছে কষ্টের চাপ। তার কষ্ট দেখে আমি কিভাবে ভালো থাকি!

মোর্দেশা ফুপুর কান্না আর সহ্য করা যাচ্ছে না। যখনি একা থাকছেন, তখনি তিশান তিশান বলে কান্না শুরু করে দিচ্ছেন। কাঁদতে কাঁদতে কখনো জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে এখন তিশান তিশান করেই যাচ্ছে। আল্লাহ যেনো তাকে সুস্থ করে দেয়,, আর তিশানের কষ্টা ভুলিয়ে দেয়।

১৩.০২.২০১৮

আলহামদুলিল্লাহ, সব কিছু ভালোই হচ্ছে। আল্লাহ আমার প্রার্থনা শুনেছেন।

১৪.০২.২০১৮

আজ আমার জীবনের বিশেষ একটা দিন ছিলো,ভাবতেই পারি নি এই দিনটা এতো সুন্দর হবে। যখন ভালোবাসার মানুষ এভাবে সারপ্রাইজ দেয় তখন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। ভাবতেই পারি নি আমার ভালোবাসা আজ পূর্ণ হবে। আমি তো কল্পনা ও করি নি যে তিয়ান ও আমাকে ভালোবাসে। যখন তিয়ান আমার হাত ধরে আমার আমাকে ভালোবাসার কথার বলেছিলো তখন আমার অবস্থা যে কি হয়েছিলো, ভাবলেই এখন হাসি পাচ্ছে। প্রথমে তো ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতে তো ও বেশি আমার সাথে কথা বলতো না। তাই যখন আমাকে দাড়াতে বললো,, তখন ভয় পেয়েছিলাম। আর যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি তাকে ভালোবাসি কিনা, তখন তো আমার মুখ দিয়ে কথায় বেরুচ্ছিলো না। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলেছিলাম। তাকে I love you too টা বলায় হয় নি। তার হাসিতে আমি ডুবে গিয়েছিলাম। সত্যি আমি তাকে ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি।

পূন্য কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকলো, মাথার ভিতর সূক্ষ্ম একটা ঝটকা খেয়ে গেলো। তিয়ান অনন্যাকে ভালোবাসতো, আর অনন্যা তিয়ানকে ভালোবাসতো!!! কই তিয়ান তো বললো না। এতো বড় একটা সত্যি লুকিয়ে রেখে ছিলো আমার কাছে! কেনো বলে নি আমার কাছে? আমি তো তাকে সব বলেছিলাম। তাহলে সে কেনো বললো না!! সে তো বলেছিলো তার কোনো অতীত নেই!

“পূন্য”

পূন্য দরজার দিকে তাকালো। মনে হলো কেউ তার নাম ধরে ডাকলো। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়লো, পূন্য ডায়েরি টা বালিশের নিচে রেখে দরজাটা খুলে দিলো। তিয়ান দাড়িয়ে আছে, পূন্য তিয়ানকে দেখছে, আজ কেনো জানি তিয়ানকে চিনতেই পারছে না।

তিয়ান লক্ষ করলো,পূন্য ওকে একদৃষ্টিতে সেই কখন থেকে দেখেই যাচ্ছে। তিয়ান হেসে বললো,,

—যেভাবে দেখছো মনে হচ্ছে এই প্রথম দেখছো।

পূন্য চোখ নামিয়ে নিলো। সত্যিই মনে হচ্ছে আজ তিয়ানকে প্রথম দেখছে। পূন্য স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো, এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়, তিয়ানও তো কতো সহজেই মেনে নিয়েছিলো। থাক তিয়ান যখন বলতে চায় নি তখন আর নাই বা বললো, আমিও না হয় না জানার মতোই থাকি।
পূন্য তিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,,

—এতো রাতে!! কেনো এসেছো?

— আসতে পারি না নাকি!মানা আছে?

— না মানে,,,

— কফি করে দাও। আমিই করে নিতাম, কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে আলো বেরুচ্ছিলো, তোমরা এখনও জেগে আছো কি না চেক করার জন্যই নক করলাম।

— যাও,,

— কি??

— সামনে থেকে সরে যাও,, আমি রান্নাঘরে যাবো তো,,

— ওহ্,,, আমি রুমে যাচ্ছি।

পূন্য রান্নাঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো, সে কেনো জানি তিয়ানের অতীত লুকিয়ে রাখাটা মেনে নিতে পারছে না। আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতে পারছে না।

তিয়ান সোফায় বসে অফিসের কাগজ গুলো দেখতে লাগলো। রাতে ঘুম আসাতে ভালোই হয়েছে,, এই সপ্তাহ খানেকে অফিসের কাজ অনেক জমে গেছে। এখন কাজ করতে একদম ইচ্ছা করে না।

পূন্য কফিটা নিয়ে রুমে গেলো। এতো রাতে তিয়ান আবার কাগজ পত্র নিয়ে বসেছে কেনো? বেশ অবাক হলো। কফিটা তিয়ানের সামনে রেখে বললো,

— এতো রাতে কাগজ পত্র নিয়ে বসেছো কেনো? শুয়ে পড়ো।

কথাটা বলে তিয়ানের পাশে বসলো।

তিয়ান পূন্যর দিকে তাকিয়ে হাসলো, তারপর কফিটা নিয়ে কয়েক চুমুক খেলো, তারপর হেসে বললো,,

— ইদানীং তুমি বেশি হয়ে গেছো, আর মিষ্টি প্রেমীও হয়ে গেছো।

পূন্য তিয়ানের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু হা করে তিয়ানের মুখ পানে চেয়ে রইলো।

তিয়ান বুঝতে পারলো পূন্য কিছুই বুঝে নি, কাগজ গুলো নাড়তে নাড়তে বললো,

— কফিতে অনেক মিষ্টি হয়েছে।

পূন্য কিছু বললো না, একটা হাসি দিলো। আসলে সে ঘোরের মাথায় কফি বানিয়ে অনন্যা আর তিয়ানের সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিলো, তাই গড়বড় হয়ে গেছে।

কফিটা হাতে নিয়ে, পূন্য বললো,

— আমি নতুন করে বানিয়ে আনছি।

—কোনো দরকার নেই। আমি এই কফিই খাবো। বউকে বেশি কষ্ট দিতে চাই না।

পূন্য হাত ধরে টেনে ওর পাশে বসিয়ে দিলো হাত দিয়ে পূন্যর কাধ জড়িয়ে ধরে কথাটা বললো তিয়ান, মুখে একটা মিষ্টি হাসি। এই হাসির কথায় তো লিখেছিলো অনন্যা। সত্যিই তিয়ানের এই হাসিতে এক ধরনের জাদু আছে।

পূন্য কাগজ পত্র গুছাতে গুছাতে বললো,
— ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে কাজ করবে।

— ঘুম আসছে না তো।

— তাহলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো।

তিয়ান পূন্যকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,
— তোমাকে প্রয়োজন।

তিয়ান পূন্যর গলার ভাঁজে মুখ লুকালো। পূন্য তিয়ানের মাথার চুল মুঠোয় নিলো, চোখ বন্ধ করলো। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠলো, অনন্যার ডায়েরির সেই লেখাটা, অনন্যার সেই স্থির চাহনি। তিয়ানের কাছে আসাটা সে আর মেনে নিতে পারলো না, মুহূর্তের মধ্যেই তিয়ানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো।

তিয়ানের ঘোরটা কেটে গেলো, পূন্যর ধাক্কা খেয়ে, ছিটকে পরলো, হঠাৎ করে ধাক্কা মারলো কেনো?? কি হলো ওর? তিয়ান আবার কাছে আসলো।

পূন্য দাড়িয়ে গেলো। নিচে পরে শাড়ির আঁচল টা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

— ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়ে গেছে।
রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

তিয়ান কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।মেয়েটার যে মাঝে মাঝে কি হয় বুঝতে পারে না সে। এই তো ভালোই ছিলো,, এখন আবার কি হলো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার কাগজগুলো নিয়ে বসে গেলো৷

পূন্য রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। কি করলো এটা সে! কেনো তিয়ানকে এভাবে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো! তিয়ান হয়তো কষ্ট পেয়েছে তার আচরণে। হয়তো না, নিশ্চিত কষ্ট পেয়েছে। একবার ভাবলো এখন কি আবার যাবে? তখন কেনো বারবার অনন্যার লিখা লাইনটার কথা মনে পড়ছিলো। পূন্য বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে বালিশের নিচ থেকে ডায়েরি টা বের করলো। ইচ্ছা করছে না ডায়েরি টা পড়ার, পড়ার পর যদি সে তিয়ানের থেকে আরও দূরে সরে যায়, যদি এমন কিছু লিখা থাকে যা পূন্য মানতে না পারে।
কিন্তু ডায়েরি টা পড়ার একটা ইচ্ছা মনের ভিতর জোরেসোরে চেঁপে বসেছে। তাই ডায়েরি টা খুলে ফেললো,

তৃপ্তি একটু নড়েচড়ে উঠতেই ডায়েরি টা বন্ধ করে ফেললো পূন্য। তৃপ্তির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। নাহ্, ঘুমিয়ে পড়েছে, আবার ডায়েরি টা খুললো,

চলবে

#গোধূলি_লগ্ন

#writer_Tabassum_Tajnim

#part_28

তৃপ্তি একটু নড়েচড়ে উঠতেই ডায়েরি টা বন্ধ করে ফেললো পূন্য। তৃপ্তির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। নাহ্, ঘুমিয়ে পড়েছে, আবার ডায়েরি টা খুললো,

মনের মধ্যে অনেকটা সাহস জমিয়ে নিলো, চোখ ডায়েরির পাতায়। পড়তে শুরু করলো,

২০.০২.২০১৮

জানি না, কোনটা ভূল, কোনটা সঠিক। আমি তো তিয়ান কে ভালোবাসি, তাকে ভালোবেসে যদি মন দিতে পারি তাহলে শরীর কেনো নয়!! হয়তো যা হয়েছে তা ভুল বশত। এর জন্য তিয়ান দায়ী নয়। কিন্তু তিয়ান তো নিজেকেই দায়ী করছে, আমার সাথে কথাও বলছে না, আমার চোখে চোখ রাখতে পারছে না, লজ্জায় বারবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।

পূন্যর হাতটা কেঁপে উঠলো, সে আর ডায়েরি টা পড়তে পারছে না, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য টানে ডায়েরি টা পরেই যাচ্ছে। কতো কিছু তার অজানা, তাকে তো সব কিছু জানতেই হবে, পড়তেই হবে,

আস্তে করে পাতা টা উল্টিয়ে দিলো।

২২.০২.২০১৮

আমার কাছে ভালোবাসাটাই সবচেয়ে বড়। এরপর অন্য কিছু। হয়তো সমাজ মেনে নিবে না বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক। তাতে কি, আমি নিজে মেনে নিয়েছি। তিয়ান মেনে নিয়েছে, আর কি। ভালোবাসার জন্য আমি সব করতে পারি। আমার নজরে ভুল কিছু করছি না আমরা।

পরের কয়েকটা পাতা এমন কথায় লিখা ছিলো।
পূন্য একেএকে পড়তে লাগলো সব কয়টা পৃষ্ঠা। থমকে গেলো একটা জায়গায়,

০২.০৩.২০১৮

কয়েকদিন ধরেই দেখছি ছেলেটা আমার পিছু নিচ্ছে। বাসার সামনের বড় গাছটার নিচে বসে থাকছে। বড় জানতে ইচ্ছে করছে ছেলেটা কে?
আজ ফুপু তিয়ানকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলো, তিয়ানের মুখে শুনলাম মেয়ে দেখতে খুব সুন্দর। এই কদিন ওর সাথে থেকে এটা বুঝেছি ওর রুচি অতন্ত্য উন্নতমানের, তাই বুঝার বাকি রইলো না মেয়েটা আসলে কতোটা সুন্দর। ফুপু তো জেদ ধরে বসেই আছে, ঐ মেয়েকেই বাড়ির বউ বানাবে। কোথায় থেকে মনের ভিতর একটা ভয় ঢুকে গেছে, তিয়ান আমার জীবন থেকে সরে যাবে না তো!

০৫.০৩.২০১৮

পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো, খনিকের জন্য মনে হয়েছিলো তিয়ান আমাকে জাস্ট ইউজ করে ন্যাপকিনের মতো ছুড়ে মারবে। প্রমাণ হয়ে গেলো, আমি ভুল ভেবেছিলাম। তিয়ানের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়ের বাড়িও রাজি হয়ে গেছে। এদিকে ফুপিও রাজি। শুধু রাজি না তিয়ান, আমার পাশে বসে সারারাত শুধু একটার পর একটা সিগারেট জ্বালিয়েই গেছে। আমি বুঝতে পারছি ওর মনের অবস্থা টা। ওর অসহায় অবস্থা দেখে আমার মনের অবস্থা যে কি হয়েছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছি না। তিয়ান যখন আমাকে বলছিলো, “সে বিয়েটা করবে না, আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমাকে বিয়ে না করলে নাকি আমার প্রতি অন্যায় হবে, আমাকে ঠকানো হবে।” তখন আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সে কি শুধু দ্বায়িত্ব আর কর্তব্যের জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে? যদি এটা দ্বায়িত্ব কর্তব্য আর সম্মানের জন্য হয় তাহলে চাই না আমি তিয়ানকে। আর এমনিতেও ফুপি মেনে নিবে না আমাকে, তখন ভাবি নি। ঝোঁকের মাথায় আবেগের বসে আমি সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি। এখন আর কোনো ভূল করবো না। তখন ভাবতাম ভালোবাসা দিয়ে সমাজকে তোয়াক্কা করা যায়, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সমাজকে তোয়াক্কা করা সহজ নয়। আমি এমন কোনো ভুল করবো না, যার ফল আমার পরিবারকে ভোগ করতে হয়। আমি তিয়ানকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিবো। সে অন্য কারো সাথেই সুখী হোক। হয়তো কয়েকদিন খুব কষ্ট হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। যার নুন খেয়েছি তার ক্ষতি কি করে করবো। ফুপু এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছে, তিশানের শোকে তিনি এমনিতেই ডুবে আছে, আর এখন যদি তিয়ানও না করে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে না। ওনাদের কষ্ট দেওয়ার অধিকার তো আমাদের নেই। আমরা তো ওনাদের দয়াতেই বেঁচে আছি। খুব কষ্ট হবে হয়তো তিয়ানকে কথাগুলো বলার সময়। কি করে বলবো আমি তুমি বিয়ে করে নাও অন্য কাউকে।

হয়তো এই কথাগুলো লিখার সময় অনন্যা কেঁদে ছিলো, কয়েক জায়গায় লেখা গুলো কেমন নীলচে হয়ে গেছে। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো হয়তো তখন, পাওয়ারি কথা। কিন্তু কেনো ছেড়ে দিয়েছিলো, তার তো পুরো অধিকার ছিলো, আর তিয়ান তো তাকে বিয়ে করতেই চেয়েছিলো তাহলে কেনো করলো। যদি অনন্যা এই স্টেপটা না নিয়ে তিয়ানকে বিয়ে করতো তাহলে হয়তো আমাকে আজ এই পরিস্থিতিতে থাকতে হতো না। কিন্তু তিয়ান অনন্যাকে যখন এতোই ভালোবাসতো তাহলে আমাকে কেনো মেনে নিয়েছিলো! কেনো আমার সাথে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো? আর কেনোই বা এতো দিন পর অনন্যা আত্মহত্যা করলো?

নিবিড় আস্তে করে মিতুর কানের পাশের চুল গুলো সরিয়ে দিলো। মিতু ছাদের রেলিং পা ঝুলিয়ে নিবিড় গায়ের উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। অন্য সময় হলে ভয় করতো, এভাবে বসার সাহস পেতো না, মনে হতো এই বুঝি পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখন সেই ভয়টা আর হচ্ছে না কারন নিবিড় আছে সাথে। নিবিড় ওর কিছু হতেই দিবে না,

নিবিড় মিতুকে ধরে দাড়িয়ে আছে, মেয়েটাকে সবাই অবহেলা করে, সে নিজেও এতোদিন অবহেলা করেছে, আর মা তো আগেও অবহেলা করে এসেছে,আর এখনও করে যাচ্ছে। সহ্যই করতে পারে না মিতু কে, সবসময় বকাঝকা করে। যা নিবিড়ের একদম ভালো লাগে না। মিতুকে কেউ কিছু বললে এখন নিবিড়ের গায়েই বেশি লাগে।

আকাশটা আজ অনেক পরিষ্কার। সন্ধায় ও আকাশ মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এখন এক ফোটা মেঘও নেই আকাশে। থালার মতো একটা চাঁদ আকাশে। চাঁদের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে আছে। রুপালি আলোয় সব কিছুতে আবছা রুপালি রং এসেছে। স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় মিতুকে যেনো আরো সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে মিতুর চেহারা থেকেই বেরুচ্ছে এক স্নিগ্ন আলো। মিতুর চেহারার আলোতেই আলোকিত হয়েছে সব কিছু। নিবিড় হাসলো, হঠাৎ কেনো ওর এমন হচ্ছে! হঠাৎ কেনোই বা মিতুকে এতো রূপবতী মনে হচ্ছে।

ভালোবাসাটায় বড়ো, যদি কাউকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায়, মন থেকে মেনে নিতে পারে, তাহলে সে যতোই কুৎসিত থাকুক না কেনো তাকে ভালো লাগবেই, সে সামনে আসলে মনে হবে সেই তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানব বা মানবী। তার রূপের কাছে হার মেনে যাবে পৃথিবীখ্যাত সব সুন্দরী। তাই নিবিড়ের মিতুকে রূপবতী ভাবাটা ভূল কিছু নয়, বরং না ভাবলে ভূল হতো।

নিবিড় বললো,,

— মিতু তোমার মন ভালো হয়েছে তো?

—হুম,, আমার মন তো ভালোই ছিলো। খারাপ ছিলো কখন?

মিতুর নিবিড়ের দিকে ঘুরে বললো, নিবিড় মিতুকে শক্ত করে ধরে বললো,

–পরে যাবে তো, ভয় করে না রেলিং বসে এভাবে নড়াচড়া করছো যে

— না, ভয় করবে কেনো? আমার সাথে আপনি আছেন তো আমার কিছুই হবে না। আপনি তো
আমাকে সব সময় আগলে রাখেন।

— কই আমি তো তোমাকে আগলে রাখি না!

নিবিড়ের কথায় মিতু একটু দমে গেলো, কিছু একটা ভেবে হাসলো, একটু আগের নিশ্চুপ থাকা মুখের সৌন্দর্য্য টা কেও ছাড়িয়ে গেলো এই হাসির কলকলানি ধ্বনিতে। নিবিড় মুগ্ধ হয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে।

মিতু হাসি থামিয়ে বললো,

— আগলে না রাখলেও চলবে, তবে এই আপনি আমার মন ভালো করার জন্য সারাদিন নিয়ে ঘুরলেন, আমার পাগলামো গুলো নিরবে সহ্য করে গেলেন, অন্যায় আবদার গুলো মুচকি হেসে অকপটে মেনে নিলেন, আমি এখান থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে শক্ত করে ধরে রাখলেন, এই গুলোই যথেষ্ট আমার জন্য। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।

নিবিড় মিতুর কথাগুলো শুনে হাসলো, মেয়েটা কথার মারপ্যাঁচ খুব ভালোই পারে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে তার কথাতেই অটুট থাকে।

নিবিড় মিতুর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না কেনো জানি, যতোই দিন যাচ্ছে মায়া ততোই বাড়ছে। নিবিড় মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,

— আচ্ছা আমার মায়ের কথায় তুমি কষ্ট পাও নি?

মিতু হাসলো,,
— ওনি কষ্ট পাওয়ার মতো কোনো কথায় বলে নি। তাহলে আমি কষ্ট পাবো কিভাবে?

— তখন যে,,

— তখন শাসন করেছে। আমরা খুব বেশিই দেরি করে ফেলেছিলাম, ভুল তো আমারই হয়েছে। আমাদের সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসার দরকার ছিলো। আর যখন দেরি করলাম তখন ফোন দিয়ে বলা উচিত ছিলো, তিনি তো টেনশন করছিলেন আমাদের জন্য।

সত্যিই তো নিবিড়ের এসব কথা মাথায় আসে নি। সে সব সময় তার মাকে ভুলভাবেই জেনেছে, ভুল ভেবেছে। মিতুর মতো চিন্তা তো একবারও করে নি। আসলে নিবিড়ের মায়ের প্রতি ভালোবাসাটা একেবারেই উঠে গেছে, এই জন্যেই মা সমন্ধে তার ধারণা টা সব সময় উল্টোই হয়। নাহ্, মা সমন্ধে তার ধারণাটা পাল্টাতে হবে, তিনি যা করছিলেন, তা তো আর পাল্টানো যাবে না। তাই তার সাথে এমন আচরণ করা ঠিক হবে না। আর এখন তো সব ঠিকই আছে। সে নিজেও এখন মিতুকে মেনে নিয়েছে। তবে এর পুরো ক্রেডিটটাই রূপন্তর প্রাপ্য। নিবিড় মিতুকে রেলিং থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো,

— চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে।

— নাহ, আরেকটু থাকি না।

— আরেকটু থাকলে সকাল হয়ে যাবে।

— হোক না সকাল, তাতে কি!

নিবিড় কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে মিতু হাত ধরে হাটা শুরু করলো।

মিতু নিবিড়ের সাথে দু পা হেটেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো নিবিড়ের কাছে,,

— আচ্ছা আমি তো আপনাকে ভালোবাসি, আপনি কি আমায় ভালোবাসেন??

মিতুর হাতের বাধন টা নরম হলো। নিবিড় মিতুর দিকে তাকালো, মিতুর মুখটা কেমন যেনো মলিন হয়ে আছে। নিবিড় কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মিতু নিবিড় কে থামিয়ে দিয়ে বললো,

–আবার বলবেন না আমি পাগলের প্রলাপ বকছি। এটা পাগলের প্রলাপ নয়, আমার প্রশ্নের উত্তর দিবেন, কারন আপনার এই প্রশ্নর উত্তর দেওয়া দরকার, আর আমার এই প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার । শুধু হ্যা বা না তেই উত্তর দিন। আপনি কি আমায় ভালোবাসেন??

মিতু কথাগুলো একদমে বললো। তারপর দম নিলো। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিবিড় মিতুর দিকে তাকিয়ে ছিলো, মিতুর একদমে কতোগুলো কথা বললো! মিতু তাকাতেই নিবিড় অন্যদিকে তাকালো, কতো সুন্দর একটা সময় কে মিতু জটিল বানিয়ে দিলো। মেয়েরা রকমই হয়, সহজ সরল সুন্দর জিনিস তাদের ভালো লাগে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই জিনিসটাই রাখে, শুধু শুধু জটিল করে। নিবিড় একটা মৃদু হাসি দিয়ে জটিল টাকে সহজ করলো। মিতুর দু বাহু ধরে কাছে টেনে নিতে চাইলো, কিন্তু মিতুর শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তাই একটু জোরেই মিতুকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ মিতুকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখার পর বললো,

— হ্যা।

মিতু হাসলো, সব বাধা, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘুচে গেলো। এতক্ষণ শুধু নিবিড় মিতুকে জড়িয়ে রাখলেও এখন মিতুও নিবিড়কে দু হাতে আকড়ে ধরলো।

নিকষ কালো অন্ধকার যতো গাঢ় হয়, কিছু কিছু ভালোবাসাও গাঢ় ততো হতে থাকে। চাঁদ তারাভর্তি খোলা আকাশের নিচে প্রেমিকার সামনে দাড়িয়ে প্রেমিকা কে বুকে জড়িয়ে প্রেম স্বীকার করতে পারার মধ্যে একটা সার্থকতা লুকিয়ে থাকে। যেটা সকল প্রেমিক প্রেমিকারা পায় না। নিবিড় পেয়েছে সেই সার্থকতা।

রূপন্ত তিন চারবার ফোনটা কেটে দেওয়ার পর আবার কল আসলে রিসিভ করলো, নাম্বার টা একবারও দেখে নি। রিসিভ করে কানের উপরে রাখতেই, ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসলো। রূপন্তর চোখ থেকে ঘুম গ্যাসের মতো উড়ে গেলো। এতো রাতে কে ফোন দিয়ে কান্না করছে!!

রূপন্ত কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— কে বলছেন?

— কতোবার কল দিয়েছি, আর তুমি ফোন কেটে দিয়ে, এখন বলছো কে বলছেন??

কন্ঠস্বর টা রূপন্তর পরিচিত মনে হলো, কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দেখলো স্ক্রিনে অপরিচিতা লিখা আছে, এত রাতে তিশা কল দিয়েছে, আর কল দিয়ে কাঁদতেছে কেনো? তিশার কান্না শুনেই রূপন্তর মাথা নষ্ট হয়ে গেলো।

ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কাঁদছো কেনো তুমি??

— আগে বলো তুমি ফোন কেনো কেটে দিয়েছো? আমাকে ইগনোর করছো?

— আরে না,, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমের ঘোরে কেটে দিয়েছিলাম।

— আমার থেকে তোমার কাছে ঘুমটায় বেশি!

–না,, না,, ঘুমের আগে তুমি!!

দু’জনের মাথায় হঠাৎ আসলো তারা কি বলছে এসব!!!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here