গোধূলি লগ্ন – পর্ব ২৯+৩০

0
221

#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#Part_29+30

দু’জনের মাথায় হঠাৎ আসলো তারা কি বলছে এসব!!!
তিশার কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে আসে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

–কি বললেন আপনি?

— আপনি এতক্ষণ কি বললেন?? মাঝরাতে।। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, সেটা কি আপনার বাড়ির লোক জানে? রাত বিরাতে এভাবে ফোন দিয়ে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছেন, নিজের মাথা তো নষ্টই।

রূপন্ত কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে কথাগুলো বললো, সে নিজে যে কি বলেছে তার কিছুই মনে নেই। কিন্তু এখন যদি তিশার মনে পড়ে যায় তাহলে তার মান সম্মানের বারোটা বেজে যাবে। তাই সবটা দোষ তিশার উপর দিয়েছে।

তিশা কিছুক্ষণ বসে রইলো,সত্যিই সে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। কিন্তু যেগুলো বলেছে সে গুলো রূপন্তকে ভালোবাসে বলেই বলেছে। কিন্তু রূপন্ত কি করছে? সে অন্য কাউকে নিয়ে মার্কেট করতে যাচ্ছে, ভাবা যায়? না সহ্য করা যায়। নাহ আর দেরি করলে চলবে না, রূপন্তকে মনের কথা জানাতেই হবে।

তিশা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,

— ঐ মেয়েটা কে ছিলো?

— কোন মেয়েটা?

— ঐ যে মার্কেটে..

রূপন্ত বুঝতে পারলো তিশা তৃপ্তির কথা বলছে, কিন্তু হঠাৎ তৃপ্তির কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো?

তিশা রূপন্তর উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— কি হলো,, বলুন ঐ মেয়েটা কে?

— আপনাকে কেনো বলবো?

— কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি, আর আপনি ও আমাকে ভালোবাসেন তাই বলবেন।

তিশা জ্বিভে কামড় দিলো। রূপন্ত চোখ বড় বড় করে একবার তাকালো, তারপর মৃদু হাসলো। রূপন্ত যে কতটুকু খুশি হয়েছে তা সে প্রকাশ করতে পারবে না।
হাসি চেঁপে রেখে বললো,

— আমি কখন বললাম আমি আপনাকে ভালোবাসি! আপনি একটা কাজ করেন আপনি কাল আমার সাথে দেখা করেন আপনার ভুল ধারনা টা মিটে যাবে , আমি জায়গা টা পরে বলে দিবো। আচ্ছা এখন ঘুমান।

রূপন্ত ফোনটা কেটে ধপ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়, এতদিন শুধু শিউর হতে চেয়েছিলো তিশা তাকে ভালোবাসে না ভালোবাসে না! আজ শিউর হয়ে গেলো। এখন শিউর হয়ে গেলো। তবে কাল কি হবে!

তিশার গাল বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তাহলে কি রূপন্ত তাকে ভালোবাসে না! ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসে! আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। ঠিক আছে কাল দেখা করে সরি বললেই হবে রূপন্তকে।

পূন্য ডায়েরির পরের পাতা উল্টালো। তারিখটা দেখলো, ওর বিয়ের পরের দিন লিখা।

১০.০৩.২০১৮

প্রথম দিন খুব কষ্ট হয়েছিলো, নিজে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়েতে যাই নি অসুখের অযুহাতে, রাতে পূন্য আসার পরেও দেখতে যায় নি। কিন্তু সকালে যখন তিয়ানের রুমে গেলাম, পূন্য ভাবিকে দেখে অনেক ভালো লাগলো। মনে হলো তিয়ানের পাশে ওকেই মানায়। আর সব কিছুই ভাগ্যর উপর নির্ভর করে। অনেক মিশুক শান্ত ভদ্র একটা মেয়ে পূন্য ভাবি। একদিনেই কেমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে আমাকে।

পুলকের কাজগুলো আগে ভালো না লাগলেও এখন ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করেছে। আজ সকালে যখন তিয়ান পুলকের সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলো তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই বারান্দায় গিয়ে ওকে দেখা দিলাম। আর ও আমাকে এক নজর দেখেই চলে গেলো। হয়তো ভালোবাসে আমাকে, কিন্তু আমি তো তাকে ভালোবাসতে পারবো না, আমি তো তিয়ানকে ভালোবাসি।

বড় গাছের নিচে বসে থাকা ছেলেটার নাম পুলক, সে অনন্যাকে ভালোবাসতো! অনন্যাকে একনজর দেখার জন্য এই খানে বসে থাকতো,, পূন্যর মাথা কাজ করছে না। আচ্ছা পুলক কি জানে, যে অনন্যা আর নেই!
পূন্য পরের পৃষ্ঠায় গেলো,

অনেকদিন পরে আবার লিখেছে, প্রায় পনেরো দিন পর হবে,

২৫.০৩.২০১৮

পূন্য ভাবির গলায় দাগগুলো দেখে মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। এরকম দাগ তো একদিন আমার শরীরেও পড়েছিলো, আজ পূন্য ভাবির শরীরে যে দাগ গুলো করেছে সেই ঐদিন আমার শরীরেও সেই দাগগুলো করেছে।
যাইহোক বেলাশেষে আমি সুখেই আছি।

০১.০৩.২০১৮

“আস্তে আস্তে পুলককে ভালো লেগে যাচ্ছে। পুলক আমার পিছু না নিলে একদম ভালো লাগে না। হয়তো ওর প্রেমেই পড়ে গেছি। কিন্তু ইদানিং পুলক হয় সকালে দেরি করে আসে, নয়তো আসেই না। যা আমি একদমই মেনে নিতে পারি না। কিন্তু আমি কি পুলকের যোগ্য!!!”

কয়েকটা পাতায় শুধু পুলককে নিয়েই লেখা আছে। অনন্যা যে পুলকে ভালোবেসে ফেলেছিলো তা পর লেখাগুলো পরেই বুঝা যাচ্ছে।

১২.০৩.২০১৮

নতুন করে বাঁচার আশা দেখেছিলাম, নতুন করে জীবন সাজানোর আশা ও করেছিলাম। কিন্তু কি হলো! মাঝখানে আসার কি তোর খুব দরকার ছিলো? কেনো আসলি? রিপোর্টে ভেবেছিলাম হয়তো হয়তো বড় সরো কোনো রোগ হবে, কিন্তু তখন কি জানতাম হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বলবে, “কনগ্রাচুলেশন, আপনি মা হতে চলেছেন।” সব মেয়ে কথাটা শুনার পর খুশি হয়, কিন্তু আমি হতে পারলাম না, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পরলো। আটকাতে পারলাম না, মনে হলো খরস্রোতা নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে, জল আটকানো যাবে না।
যখন তিয়ান কে বললাম তখন তার রিয়েক্ট দেখে বাঁচার ইচ্ছে টায় মরে গেছে।সে খুব সহজেই বলে দিলো,” I’m sorry,, দেখো, সেদিন তুমিই আমাকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলে, বারবার তোমার দরজায় কড়া নেড়েছিলাম আর তুমি বারবার আমাকে ভালোবাসো না বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আজ আমি কিছুই করতে পারবো না। ”

তিয়ান নিজের আসল রূপটা দেখিয়ে দিলো। আমি এতোদিন পুলক, পূন্য ভাবি, ফুপি ওদেরকে আমার মা বাবা সবাইকে ঠকিয়ে এসেছি। আর আজ আমি নিজেই ঠকে গেলাম। নাহ্, আমি কারো সংসার ভাঙতে চাই না। আর পুলক ও আমাকে মেনে নিবে না, হয়তো সব কথা জানার পর আমাকে ঘৃণা করবে, সে কেনোই বা আমার পাপের বোঝা টানবে! তাই একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। এতে আমি আর আমার সন্তান দুজনেই বেঁচে যাবো। আমাকে যে মরতেই হবে। পূন্য ভাবিকে সরি বলার খুব দরকার ছিলো,বলতে পারবো কি না জানি না, আম্মু আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে”

পূন্য ডায়েরি টা বন্ধ বিছানার নিচে রাখলো। লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়লো। কান্না আর আঁটকে রাখতে পারছে না। চোখের জল যে আজ কোনোভাবেই বাঁধা মানতে পারছে না।

তৃপ্তির ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে বসলো, আবছা আলোয় দেখতে পেলো পূন্য হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। বুবুন কেনো কাঁদছে তৃপ্তি জানে না। হয়তো নিবিড় ভাইয়ার কথা মনে পড়ে গেছে। তৃপ্তি পূন্যর মাথায় হাত রেখে বললো,
–বুবুন,

পূন্য মাথা ভাসিয়ে তৃপ্তিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। পূন্যর মনে হচ্ছে সে কেনো বেঁচে আছে? তার মরে যাওয়া উচিত ছিলো, অনন্যা বেঁচে থাকতো।

তৃপ্তি বললো,
— এখনো কেনো নিবিড় ভাইয়ার মধ্যেই ডুবে আছো? মাথা ভাসাও,,দেখো তিয়ান ভাইয়া দাড়িয়ে আছে। সে তোমাকে নিবিড় ভাইয়ার থেকেও বেশি ভালোবাসে।

পূন্য চোখ মুছে ফেললো।সকাল হওয়ার আর বেশি দেরি নেই। পূন্য বললো,

— তুই শুয়ে পড়। আমি একটু আসছি।

তৃপ্তি শুয়ে পড়লো। সবাই ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে আছে, শুধু আমি বাদে। কথাটা ভেবে তৃপ্তি হাসলো। এসব থেকে দূরে থাকায় ভালো, না হলে সেই বুবুনের মতো কষ্ট পেতে হবে।

পূন্য অনন্যার মোবাইল টা বের করে নিলো। মেসেজ করেছে অনেকগুলো।

“আমি চলে এসেছি,, তুমি বারান্দায় একবার আসো অনেকদিন ধরে তোমায় দেখি না। শুধু তোমাকে দেখার জন্য এসে পড়েছি।”

“তুমি বের না হলে কিন্তু সারারাত এখানেই দাড়িয়ে থাকবো।”

এমন আরো দুই টা মেসেজ করেছে। পুলকের মেসেজ গুলো পড়ে পূন্যর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। বেচারা সে তো জানেই না যে অনন্যা মারা গেছে। অনন্যার মোবাইল টা নিয়ে বারান্দার দরজা টা খুলে ধীর পায়ে বাইরে আসলো, এখনো কি বসে আছে পুলক!!

বড় গাছটার দিকে তাকালো। হালকা আলো ফুটে উঠেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই ছেলেটা দাড়িয়ে আছে, এই পুলক। অনন্যা তুই কার জন্য আত্মহত্যা করলি! কেনো করলি! পুলককে এখন কি বলবো?

নকল ভালোবাসা গুলোর জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো আড়ালেই থেকে যায়। সত্যি বলতে সমাজ এখন নকল জিনিসেই বেশি আগ্রহ দেয়। আসল জিনিসগুলোর প্রতি তাদের নজর পরেই না। আর যখন পরে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

পুলক অনন্যার রুমের দরজা টা খুলতেই খুশিতে দাড়িয়ে গেলো, অনন্যাকে দেখবে এই খুশিতে সে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অনন্যা নয়, বেরিয়ে আসলো অন্য কেউ। অনেকক্ষণ ধরে তাকেই দেখেছে। কিন্তু কেনো? মেয়েটা রুমে ঢুকে গেলো। পুলক আবার বসে পড়লো পাকা বেঞ্চটাতে। অনন্যা কেনো আসছে না। কিছুক্ষণ পর চোখটা হঠাৎ অনন্যাদের বাড়ির গেইটটার দিকে চলে গেলো,, গেইট খুলে একজন বেরিয়ে আসলো। তার দিকেই এগিয়ে আসছে মন্থর গতিতে। ২১-২২বছর হবে হয়তো,অনেক সুন্দরী। মেয়েটা অনেকটা এগিয়ে এসেছে, পুলক উঠে দাড়ালো, তাকে কি অনন্যা পাঠিয়েছে?

পূন্য পুলকের সামনে এসে দাড়ালো, চুপ করে রইলো একটু সময়, বুঝতে পারছে না পুলককে কিভাবে বলবে। অবশেষে বলেই দিলো,

— পুলক! দেখো আমি তোমাকে চিনি না, শুধু তোমার নাম শুনেছি তাও আজ। আগে দেখতাম তুৃমি এইখানে বসে থাকতে, কেনো বসে থাকতে তাও জানতাম না, এটাও আজকেই জেনেছি।
তোমার ভালোবাসার রং টায় আলাদা। অন্যরকমভাবে নিজের ভালোবাসাটাকে সাজিয়েছো। কিন্তু আমি এখন যা বলবো তাতে হয়তো তোমার ভালোবাসাটা রংহীন হয়ে যাবে। এর পরে আর কোনোদিন তোমার ভালোবাসা রং রেঙে উঠবে কি না জানি না।

পুলকের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে শুধু হা করে শুনেই যাচ্ছে। মেয়েটা মাথা নিচু করে কথা বলছে, পুলক ও মাথা নিচু করেই শুনছে।

পূন্য বলেই চলছে,
— আমি বুঝতে পারছি না আমি কিভাবে বলবো,
পুলক,,অনন, অনন্যা মারা গেছে।

পূন্য কথাটা বলে পুলকের দিকে তাকালো। পূন্যর চোখ ছলছল করে উঠলো।

পুলক পাহাড় সমান বিস্ময় নিয়ে বললো,
— কিক,,, কি?

— হুুম,, আজ চারদিন হয়ে গেছে। অনন্যা মারা গেছে। ছাঁদ থেকে লাফ দিয়েছিলো। আচ্ছা তুমি এখন চলে যাও। আর বসে থেকো না, যার জন্য বসে থাকতে সেই তো নেই, কেনও বসে থাকবে বলো?চলে যাও

পুলক বেঞ্চটায় বসে পড়লো। অনন্যা কেনো এমন করলো? কি হয়েছিল? আচ্ছা একবারও কি তার কথা মনে হয় নি!

পূন্য কিছুক্ষণ পুলকের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো,

— আচ্ছা,, অনন্যা কেনো আত্মহত্যা করেছিলো?

পূন্য বলবে না, কারন বললে পুলক অনন্যাকে ঘৃণা করবে, হয়তো ভুল বুঝবে। অনন্যা তো মারা গিয়েছে, সে কেনো আর কারো ঘৃণার পাত্রি হবে। পূন্য বললো,

— জানি না। হয়তো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিলো, হয়তো সমাজের প্রতি ঘৃণা জন্মে গিয়েছিলো, তাই আত্মহত্যা করেছে।

— কেনো এতো বিতৃষ্ণা এসেছিলো?
পূন্য পুলকের প্রতি ঘুরলো, চোখ ছলছল, ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি, পুলক বেশ অবাক হলো।
পূন্য বললো,

–তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তার এই কেনোর উত্তর পেয়ে যাবে। যদি অনন্যাকে সত্যিকারের ভালোবেসে থাকো।

পুলক কিছুক্ষণ ঐ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বললো ওনি? পুলক বুঝতে পারলো না। শুধু মনে হচ্ছে তার বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, মনে হচ্ছে অনন্যাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। অনন্যাকে ছাড়া সে মরে যাবে।

পূন্যর দিকে তাকালো,, গেইটটার আড়ালে চলে গেলো সে।

চলবে,,,
#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#part_30

পুলক কিছুক্ষণ ঐ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বললো ওনি? পুলক বুঝতে পারলো না। শুধু মনে হচ্ছে তার বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, মনে হচ্ছে অনন্যাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। অনন্যাকে ছাড়া সে মরে যাবে।

পূন্যর দিকে তাকালো,, গেইটটার আড়ালে চলে গেলো সে।

পূন্য গেইট টা পাড় হয়ে পিছনে ঘুরলো, পুলককে দেখতে পেলো না, গেইটটা আড়াল করে রেখেছে পুলককে, অনেক কষ্ট পেয়েছে পুলক। পুলকের করা প্রশ্নটা পূন্যর মাথায় ঘুরছে,
“কেনো এতো বিতৃষ্ণা এসেছিলো??”

পূন্য হাসলো, বিতৃষ্ণা এসেছিলো, কারন সে ঠকে গিয়েছিলো, কেউ তাকে ঠকিয়েছিলো, বিতৃষ্ণা এসেছিলো কারন সে তার ভালোবাসার মূল্য পায় নি,সে তার বিশ্বাসের মর্যাদা পায় নি।

ধীর পায়ে সদর দরজার সামনে এসে দাড়ালো, হালকা হাতে বন্ধ দরজা টা ধাক্কা দিয়ে খুললো। তার জীবনটাও বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে। এতো বিতৃষ্ণা কেনো?

তৃপ্তি উঠে পূন্যকে দেখতে পেলো না। এতো সকালে বুবুন আবার কোথায় চলে গেলো? বিছানা থেকে উঠে সোজা হাটতে লাগলো, কোথায় খুজবে এখন। আম্মু বলে গেছে বুবুন কে চোখে চোখে রাখতে। ভাবতে ভাবতেই হলরুমে চলে এলো। রান্না ঘরে হাড়ি পাতিল নাড়াচাড়ার শব্দ হচ্ছে। তৃপ্তি অনুমান করলো পূন্য ঐ খানেই আছে। রান্না ঘরের দরজাটায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বললো,

— শশুড়বাড়িতে এতো সকাল সকাল উঠতে হয়!!তারপর কাজ করতে হয়??

পূন্য চায়ের পানি বসিয়ে ফুটন্ত পানিটার দিকে তাকিয়েছিলো। তৃপ্তির গলার আওয়াজ শুনে তৃপ্তির দিকে ঘুরে বললো,

— হুমম,, কিছু বলেছিস?

— এতো সকাল সকাল রান্নাঘরে কি করছিস??

— চা খাবো। চা বানাতেই এসেছি।

— তুই সর,, আমি বানাই।

— না,, আমি বানাচ্ছি, তুই বরং ফ্রেশ হয়ে নে।

তৃপ্তি পূন্যকে সরিয়ে দিলো। তারপর বললো,,

— আমার বিয়ে হলে কাজ করতে হবে না। তাই আগে থেকেই অভ্যাস করি।

পূন্য হাসলো, মাঝে মাঝে দুঃখের সময়ও হাসি আসে। এখানে থেকে আর কাজ নেই তৃপ্তিই চা বানাবে যখন বলেছে তখন ওই বানাবে, পূন্য রুমে চলে আসলো। চোখে মুখে পানি দিয়ে পূন্য বারান্দায় এসে দাড়ালো। পুলক এখনো বসে আছে! ইসস,, কেনো বসে আছে? এখন তো আর সে নেই, তাহলে কেনো বসে আছে?

পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখটা চেঁপে রাখলো। পূন্য বেলকুনির গ্রিলটা শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করলো। একটু পর তিয়ানের হাতগুলো সরিয়ে দিলো। তিয়ানকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,

—ফ্রেশ হয়ে নাও, কফি নিয়ে আসছি। অফিস যাবে তো?

তিয়ান বেশ অবাক হলো। এতদিন বিয়ে হলো ওদের পূন্য একদিনও জিজ্ঞেস করে নি, সে অফিস যাবে না যাবে না। আজ জিজ্ঞেস করলো! তিয়ান মাথা নেড়ে হ্যা বললো।

পূন্য চলে গেলো। তিয়ান পূন্যকে দেখলো, কি জানি পূন্য কে কোনোদিন ও বুঝতে পারবে কিনা?
পত্রিকাটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো।

মিতু জানালাটা খুলে দিতেই একটা ঠান্ডা বাতাস এসে রুমে ডুকলো। সূর্যের আলো এসে পড়লো রুমে। সকালের মৃদু সূর্যের আলো গায়ে মাখতে অনেক ভালোবাসে মিতু, শীত গরম সব সময়েই। দু হাতে সূর্যের আলো মুঠোয় নিয়ে মুখের উপর মাখলো।

চোখে আলো পড়তেই নিবিড় বালিশটা মাথার উপর দিয়ে চেঁপে ধরলো। তারপর বললো,

— মিতু,, জানালাটা বন্ধ করো। আলো আসছে,, ঘুমুতে পারছি না।

কোনো সাড়া না পেয়ে নিবিড় আবার বললো,

— কোথায় তুমি??

— এখানেই,, আলো মাখছি।

মিতু কথা শুনে নিবিড় চোখ খুললো, বালিশটা মাথার উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসলো।মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি মাখছো??

— আলো মাখছি।

নিবিড় কপালে হাত দিলো। সকাল সকাল এই মেয়ের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। পাগল নিয়ে সংসার করছে সে। উফফফ,, নিবিড় উঠে গিয়ে জানালাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর বললো,,

— আর আলো মাখতে হবে না। সারারাত বাসার ছাঁদে বসে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো। অন্তত এখন ঘুমুতে দাও। প্লিজ,

নিবিড় গিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। মিতু নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিতুর এখন কি যে করতে ইচ্ছা করছে, সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

নিবিড় চোখ বন্ধ করে আছে। কিন্তু বুঝতে পারছে মিতু ওর দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। কারন মিতুকে এখন ওর প্রিয় কাজটা করতে দেওয়া হয় নি।

নিবিড় চোখ বন্ধ করেই বললো,

— এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হয়।

মিতু কিছুটা এগিয়ে এলো,বিছানার সাথে মিশে দাড়িয়ে বললো,

— আমার আপনাকে দেখার কোনো ইচ্ছাই নেই।

কথাটা শেষ করে মিতু হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিবিড় হেসে উঠে বসলো। মিতুকে রাগাতে ভালোই লাগে।

রাগে বিড়বিড় করতে করতে হাঁটছিলো মিতুর। হঠাৎ আয়েশা আক্তারের সামনে পড়ে গেলো। আয়েশা আক্তারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিতু ঘাবড়ে গেলো। ওনি এমনভাবে কেনো দেখছে??

আয়েশা আক্তার মিতুকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর বললো,

— পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি? একা একা কার সাথে কথা বলছো?

— না, মানে, কারো সাথে বলছিলাম না।

— না বললেই ভালো। তা যাও চা টা খাওয়াবে নাকি খাওয়াবে না? এতোদিন তো অনেক ঘুরাঘুরি করেছো, এবার সংসারের কাজে মন দাও। নাকি সারাজীবন আমাকেই রান্না করে যেতে হবে? সংসার সামলাতে হবে?

— আমি যাচ্ছি।

মিতু কথটা বলে রান্নাঘরে গেলো। কিন্তু রান্নার র ও সে জানে না। আসলে কোনোদিন তাকে রান্না করতে দেওয়া হয় নি। তো সে কিভাবে রান্না করা শিখবে।

আয়েশা আক্তার রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন মিতু দাড়িয়ে আছে। তিনি খুব ভালো করেই জানে মিতু রান্না করতে জানে না।
আয়েশা আক্তার বললেন,,

— কি হলো দাড়িয়ে আছো কেনো? রান্না বসিয়ে দাও। ওরা খেয়ে বেরুবে তো।

মিতু আয়েশা আক্তারের কথা শুনে চমকে উঠলো, আমতা আমতা করে বললো,

— আমি তো,,

— জানি তুমি তো রান্না করতে পারো না। তা সারাজীবন কি এই কথা বললে চলবে,রান্না শিখতে হবে তো।

এই প্রথম আয়েশা আক্তার মিতুর সাথে নরম গলায় কথা বলছে, মিতু বেশ অবাক হয়েছে, আবার অনেক খুশিও হয়েছে। আয়েশা আক্তার মিতুকে রান্না শিখাতে লেগে পড়লো। এটা এভাবে করতে হবে, ওটা এভাবে না। মিতু আয়েশা আক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর আবার কাছে মনোযোগ দিলো। কিন্তু তিনি হঠাৎ কেনো তাকে এতো আদর করছে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। কারন যাই হোক মিতু আপাতত খুশিই আছে। আস্তে আস্তে তার চাওয়া পাওয়া গুলো পূরণ হচ্ছে। নিবিড়ের ভালোবাসাটাই তার জীবনে সব থেকে বেশি।

৫.৩০ বাজে,, হাতে থাকা কালো চিকন বেল্টের ঘড়িটাতে দেখলো তিশা। বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পড়ে আছে, সাথে হালকা সাজ। পুরোটাই রূপন্তর কথা মতো সেজেছে। কিন্তু এই রূপন্তটা শুধু শুধু এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অবশ্য আশে পাশের পরিবেশটা এতো সুন্দর,এখানে দাড়িয়ে থাকলেও সমস্যা নেই। আজব কিছুই বলছে না, না বললে না বলুক,, সে সরি বলে দিয়ে চলে যাবে, এটাই ঠিক করলো। আচ্ছা রূপন্ত কি বলার জন্য ডেকেছে?

— I Love You

রূপন্তর কথা শুনে তিশা আকাশ থেকে পড়লো, না মাটি থেকে আকাশে উঠে গেলো, সে নিজেই বুঝতে পারলো না। হা করে রূপন্তর হাতে থাকা গোলাপ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।রূপন্ত গোলাপ গুলো তার দিকেই বাড়িয়ে দিয়েছে।

রূপন্ত কিছুক্ষণ তিশাকে দেখলো। তার রিয়েক্ট বুঝার চেষ্টা করলো। তারপর বললো,

— I love you. Really love you.

রূপন্ত তিশার মুখ থেকে দ্বিতীয় বারের মতো I love you কথাটা শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু তিশা তো কোনো কথায় বলছে না।

তিশা বিশ্বাসেই করতে পারছে না রূপন্ত থাকে প্রপোজ করছে। না, হয়তো সে কল্পনা দেখছে।

রূপন্ত তিশার দিকে হাসলো, তারপর বললো,

— রাত ২.০০ টার সময় মোবাইলে I love you বলে দিয়েছো, আর এখন যখন আমি বলছি, তখন I love you too টাও বলতে পারছো না!! লজ্জা পাচ্ছো? নাকি…

— তুমি, সত্যি সত্যিই আমাকে I Love you বলেছো?

রূপন্ত তিশার দিক থেকে চোখটা সরিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। তারপর হেসে আবার তিশার দিকে তাকালো,

— হুম,, নাও গোলাপ গুলো ধরো তো

তিশা হাত বাড়িয়ে গোলাপ গুলো নিলো। তারপর বললো,

— তাহলে ঐ মেয়েটা তোমার গার্লফ্রেন্ড না??

— কোন মেয়েটা?

— ঐ যে মার্কেটে…

— আরেহ্, না। ও আমার কাজিন হয়। পূন্য আপুর বোন। তো এখনও কিন্তু বললে না??

— কি??

— I love you too

তিশার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। সে কি করে বলবে, রূপন্তর দিকে তো তাকাতেই পারছে না,, লজ্জা করছে। লজ্জায় লাল, নীল, গোলাপি, বেগুনী
হয়ে যাচ্ছে।

রূপন্ত তিশার হাত থেকে একটা গোলাপ নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছিলো, তারপাশেই তিশা হাঁটছে, হঠাৎ রূপন্ত গোলাপ টা দিয়ে তিশার খোলা চুলে হালকা ছোঁয়ালো। কিছু চুল সামনে এসে পড়লো। তিশা চুল গুলোকে আবার কানের পাশে নিয়ে রূপন্তর দিকে তাকালো, রূপন্ত ভ্রু নাচিয়ে বললো,

— বলো!!!

— আমি পারবো না!!!

— বাহ্,, তাহলে কে পারবে শুনি?? নাকি I love you বলার জন্য আরেকজনকে রাখতে হবে! তুমি আমার সাথে প্রেম করবে, আর সে তোমার হয়ে আমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে দিবে।

রূপন্তর কথা শুনে তিশা হাসলো। তারপর বললো,

— I Love you too,

রূপন্ত মাথা নেড়ে হাসলো, সামনের দিকে তাকিয়ে তিশার হাত ধরলো, তিশা রূপন্তকে দেখছে, চোখে মুখে অন্যরকম একটা আমেজ।

সন্ধ্যা হবে হবে করছে, চারদিকটা রঙিন হয়ে এসেছে, শুকনো পাতার উপর এসে পড়েছে রোদের শেষ কিরণ। চারদিকে গাছ, মাঝ দিয়ে একটা ছোট রাস্তা। রাস্তা টা শুকনো পাতা দিয়ে ডেকে গেছে। শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাটছে রূপন্ত তার তিশা। পাতার উপর পা ফেলার সাথে সাথে মচমচ শব্দ হচ্ছে।

তিশার ঠোঁটে হাসি, গালে টোল পড়েছে হালকা বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ছে, রূপন্তর হাতটা শক্ত করেই ধরে রেখেছে। যেনো কোনোদিনও না হারাতে পারে।

তৃপ্তি বিকেল বেলাটা পূন্যর রুমে বসেই কাটিয়ে দিলো, তিয়ান ভাইয়া না থাকাই সে বুবুনের সাথে গল্প করলো, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করেছে বুবুন বারবার অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছিলো, কিছু নিয়ে ভাবছে বুবুন। কিন্তু কি নিয়ে?

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বারান্দায় এসে দাড়ালো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। সে অবশ্য প্রকৃতিপ্রমী না। তাই এইসব ভালো লাগলো না, হঠাৎ চোখ টা গাছের নিচে গেলো। সেখানে কেউ বসে আছে? কে এই ছেলেটা???

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here