লাভ গেম -Part 19+20

0
222

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
১৯+২০
ভালোবাসার রঙিন ডানায় করে কেটে গেছে রঙিন একটা মাস। আজ আদ্রিশ বাড়ির কোনায় কোনায় ক্যামেরা সেট করছে। এমনকি বেডরুমেও। এসব দেখে রুশা ক্ষেপে গেল।
“বেডরুমে! বেডরুমে কেউ ক্যামেরা লাগায়? তুমি এসব কী করছো?”
“রুশা, আমার পক্ষে ব্যবসা বানিজ্য রেখে ঘরে বসে থাকা সম্ভব না আর তোমাকে সব সময় নিজের সাথে রাখাও সম্ভব না। জারিফ কখন কি করে বসে, আমি কোনো রিক্স নিতে চাইনা। আমি যেখানেই থাকি না কেন তোমার উপর আমার দৃষ্টি থাকবে। তোমার বিপদ হলে জানতে পারব।”
“তাই বলে ঘরে ক্যামেরা? কোনো প্রাইভেসি নেই?”
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে কিসের প্রাইভেসি? আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পাবে না।”
“তাহলে এক কাজ করো ওয়াশরুমেও ক্যামেরা লাগিয়ে দেও।”
আদ্রিশ আলতো হেসে বলল,
“প্রয়োজন পড়লে তাও দেব।”
রুশা চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। আদ্রিশ বারান্দার ক্যামেরা লাগানো দেখতে চলে গেল। রুশা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও কি করছে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাগ হচ্ছে প্রচুর।
আদ্রিশ অফিসের কাজ করতে করতে ল্যাপটপের স্কিনে রুশাকে দেখছে। রুশা পুরো দিন ঘর থেকে বের হয়নি। ঘরের কাজ করেছে, শুয়ে শুয়ে বই পড়েছে, গান শুনেছে, ঘুমিয়েছে। খাওয়ার জন্যও নিচে যায়নি। রুশা যে সব ইচ্ছে করে করছে বুঝতে পারছে। প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। রুশা ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। তবে খেতে নয় বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। কিন্তু দরজার সামনে যেতেই একজন সামনে এসে মাথা নিচু করে বলল,
“সরি মেম, আপনার বাইরে যাওয়ার পারমিশন নেই।”
রুশা অবাক হয়ে বলল,
“মানে? আমি বাড়ির বাইরে যাচ্ছি না। বাগানে যাব।”
“সেখানে যাওয়ার অনুমতিও আপনার নেই।”
“অদ্ভুত! সরুন আমি বাইরে যাব।”
“আপনাকে যেতে দিলে স্যার ফিরে এসে আমাদের কঠিন শাস্তি দেবে।”
রুশা রেগেমেগে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে থেকে একজন সার্ভেন্ট ওকে খাওয়ার জন্য অনেকবার ডাকল কিন্তু ও শুনলো না। দরজা বন্ধ করে রাগে গজগজ করতে করতে শুয়ে পড়ল। মুখের উপর বালিশ দিয়ে রাখল যাতে আদ্রিশ ওকে দেখতে না পায়। দু মিনিটের মাথায় ওর মোবাইলে ফোন এলো।
আদ্রিশ কল করেছে। রুশা রিসিভ করে চুপ করে কান পেয়ে রইল।
আদ্রিশ ওপাশে থেকে বলল,
“রুশা, খেয়ে নেও। বিকেল হয়ে গেছে এখনো দুপুরের খাবার খাওনি কেন?”
“আমি খাব না।”
আদ্রিশ আরেকটু কড়া করে বলল,
“রুশা, খেয়ে নেও।”
“খাব না আমি।”
রুশা রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিল।


আধা ঘণ্টা পর আদ্রিশ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। রুশা শুয়ে ছিল। আদ্রিশ খেঁকিয়ে বলল,
“তোমার জন্য কী আমি কাজও করতে পারব না?”
রুশা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে বলল,
“আমি তোমাকে কাজ করতে কখন বারন করলাম?”
“তুমি খাওনি কেন?”
“ইচ্ছে নেই।”
আদ্রিশের রাগ উঠে গেলেও নিজেকে শান্ত করল। তারপর ওর পাশে বসে ওকে কাছে টেনে আদুরে গলায় বলল,
“আমি তো তোমার জন্যই এসব করছি। তোমার কথা ভেবেই। মাত্র কিছুদিন। জারিফজে ধর‍তে পারলে তোমাকে আর এভাবে থাকতে হবে না। নিজের মতো থাকতে পারবে। এই কয়দিন কো-অপারেট করো।”
রুশা তবুও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমার সারাদিন এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না। এভাবে একটা মানুষ বাঁচতে পারে? আমি তো রোবট নই।”
“আচ্ছা, খেয়ে তৈরি হয়ে নেও। আমি তোমাকে আশ্রমে নিয়ে যাব।”
রুশা ওর কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে খেতে চলে গেল।
.
দুদিন পর। আদ্রিশ মোবাইলে কারো সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। রুশা ওকে চিৎকার করতে দেখে দৌড়ে ঘরে আসে। পেছনে থেকে শুনতে পায়।
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলছে,
“পঞ্চাশ লাখ টাকা কি তোর বাপ দিবে? এক পয়সা কম নেব না। আমার পুরো ১০কোটি চাই। এক টাকা কম হলে তোকে গুলি মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেব।”
“বস, লোকটা দিতে চাইছে না।”
“ওকে আমার কথা বল। বলবি এক টাকা কম দিলে ওর খবর আছে। যদি বাড়াবাড়ি করে
ওখানেই শেষ করে দিবি। টাকা দিতে না পারলে বাঁচার দরকার নেই। মেরে দে।”
ওর কথা শুনে রুশা অবাক না হয়ে পারল না। আদ্রিশ এত টাকার মালিক সেখানে পঞ্চাশ লাখ টাকার জন্য এভাবে কথা বলছে। আবার মেরে ফেলার কথা বলছে। লোকটার হয়তো আর্থিক সমস্যা আছে তাই দিতে পারছে না।
আদ্রিশ কল কেটে গালাগাল করতে করতে ঘুরে রুশাকে দেখল। রুশা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে।
“লোকটার হয়তো আর্থিক সমস্যা আছে। কথা বলে আর কিছুদিন সময় দেও।”
“অনেক সময় দিয়েছি। ওর আর্থিক সমস্যা থাকলে সেটা ওর ব্যাপার আমার দেখার দরকার আছে? আমি আমারটা চাই এট এনি কস্ট।”
“পঞ্চাশ লাখ টাকার জন্য মেরে ফেলবে? টাকার দাম বেশি মানুষের চেয়ে?”
“আমার কাছে মানুষের চেয়ে টাকার দাম বেশি। টাকা না থাকলে এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচা যায় না। সম্মান পাওয়া যায় না। টাকা না থাকলে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। আজ টাকা আছে লাইফে সব আছে। টাকা না থাকলে তুমি থাকবে নাকি আমার সাথে? টাকা না থাকলে তুমিও ছেড়ে চলে যাবে।”
রুশা ওর কথা শুনে বড়সড় ধাক্কা খেল। আদ্রিশ ওকে লোভী ভাবছে?
“আমি তোমার টাকার জন্য তোমার সাথে আছি?”
“উহু, টাকার জন্য হয়তো নেই কিন্তু টাকা না থাকলে আমাকে ছেড়ে অন্যের হাত ধরতে দু’বার ভাববে না। মেয়েরা টাকার জন্য সব করতে পারে।”
“আদ্রিশ! সবাই এক নয়। সবাইকে এক রকম ভাবে জাজ করো না। আর প্লিজ আমাকে এত লোভী ভেবো না।”
“আচ্ছা ধর, আমি হঠাৎ করে গরিব হয়ে গেলাম, আমার ব্যবসা-বাণিজ্য যাবতীয় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেল তখন তুমি কি করবে?”
“কি করব? তোমার সাথে থাকব। তোমার জন্য সব পরিস্থিতিতে ফাইট করব। আমি তোমার স্ত্রী।”
আদ্রিশ হাসল। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য দেখতে পেল রুশা।
“স্বার্থ ছাড়া কেউ কারো সাথে থাকে না। আমি তুমি দুজনেই দুজনের স্বার্থের জন্য একে অপরের সাথে আছি। ভালোবাসাও এক ধরনের স্বার্থপরতা। নিজের ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কি করে। আমি নিজেই কত কি করেছি। তোমার ভালোবাসা আদায় করতেও আমাকে অনেক কিছু করতে হয়েছে। কেন করেছি? নিজের স্বার্থে। তুমি ব্যথা পেলে আমি ব্যথা পাই কেন? অস্থির অস্থির করি কেন?নিজের স্বার্থে।”
রুশা অবাক হয়ে আদ্রিশকে দেখছে। কি সব উল্টো পালটা কথা বলছে। সব উল্টো ভাবে দেখছে। উলটো ভাবে ভাবছে। আদ্রিশ আসলেই অসুস্থ মানুষ। এই মানুষটার সাথে কি করে আজীবন থাকবে জানা নেই। কখন কি বলে, কি করে কোনো দিকে হুশ নেই।
রুশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি নিজেও নিজের দিকটা আগে ভাবি কিন্তু তাই বলে অন্যের ক্ষতি চাইনি কখনো। অন্যের কষ্ট, সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছি। সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এদিক দিয়ে তোমার চেয়ে কিঞ্চিৎ হলেও কম স্বার্থপর। লোকটাকে মেরো না। একটা মৃত্যু অনেক গুলো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। একা মরে না অনেকগুলো মানুষকে জীবন্ত লাশ করে দিয়ে যায়। আর হ্যা, তোমার সৎ মায়ের মতো সবাইকে বিবেচনা না করে আপন মায়ের মতোও বিবেচনা করতে পারো। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।”
রুশা ঘর থেকে চলে গেল।
দিন দিন আদ্রিশ আর রুশার সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। রোজ রোজ নতুন তিক্ততা ঘিরে ধরছে মিষ্টি সম্পর্কের মধ্যে। আদ্রিশ রুশাকে পুরো দিনে তিনবার মোবাইলে কথা বলতে দেখেছে। কার কাউকে অনেকটা সময় নিয়ে মেসেজ কর‍তে দেখেছে। আদ্রিশ রুশাকে ওর বিপক্ষে কিছু করতে দিতে চাইছে না। আর না চাইছে প্রতারক হিসেবে কঠিন শাস্তি দিতে। আদ্রিশ চাইছে রুশা ওর সাথে ওর হয়ে থাকুক। ওকে হারাতে পারবে না। আজকাল মাথায় বিভিন্ন চিন্তা চাড়া দিয়ে উঠে। নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারছে না। উল্টো পালটা কাজ আর কথা দুটোই করছে। রুশা আদ্রিশের ব্যবহারে বারবার ঘাবড়ে যায়। রুশাকে এতবার কারো সাথে কথা বলতে দেখে মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরেই ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। রুশা শুয়ে ছিল। আদ্রিশকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। এভাবে মোবাইল কেড়ে নেওয়ায় বুক কেঁপে উঠে।
“আমার মোবাইল এভাবে নিলে কেন?”
রুশা হাত বাড়ায় মোবাইল নেওয়ার জন্য। আদ্রিশ দেয়ালে ছুড়ে মারে। মোবাইল, ব্যাটারি, কভার সব আলাদা হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। রুশা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে। আবার ভাবছে আদ্রিশ এমন কেন করছে। রুশা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলল,
“আজ থেকে মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ।”
“কারণ?”
রুশা কারণ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আদ্রিশের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। চোয়াল শক্ত করে চোখে মুখে কাঠিন্য এনে বলল,
“জানিস না তুই? সারাদিন এত কার সাথে কথা বলিস? আজ ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছিস মোবাইলে। তুই আর মোবাইল ব্যবহার করতে পারবি না।”
“আমি আশ্রমে কথা বলি। কথার সাথে, বন্ধুদের সাথে কথা বলি।”
“আজকের পর যার যার সাথে কথা বলার আমার মোবাইল দিয়ে বলবে।”
“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“অসম্ভব কিছু?”
রুশা ওর কথা শুনে হতবাক। আদ্রিশ ওকে সন্দেহ করে।
আদ্রিশ আবারও বলল,
“যেভাবে বললে আজকাল যেন কেউ পরকিয়া করে না। স্বামী থাকতে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যায় না? স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে অন্যের সাথে দিনের পর দিন হোটেলে, এখানে সেখানে অবৈধ সম্পর্কে যায় না?”
রুশার কান জ্বলে যাচ্ছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আদ্রিশ আজকাল এমন ব্যবহার কেন করে? কেন ওকে এভাবে ছোট করে? কেন সব সময় কষ্ট দিয়ে কথা বলে? আজ যা বলল তাতে রুশার মন তিক্ত হয়ে গেছে। আদ্রিশের সাথে কথা বলতেও ঘৃণা লাগছে। কিন্তু জবাব না দেওয়া মানে সব স্বীকার করে নেওয়া।
“আদ্রিশ তোমার মনে হয় না তুমি বেশিই বলছো? এসব পরকিয়া যেমন মেয়েরা করে তেমনি ছেলেরাও করে। তুমি সারাদিন বাইরে থাকো। কোথায় কি করো তা কি আমি জানি, না দেখতে যাই? এমনও তো হতে পারে তুমি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে ধোঁকা দিচ্ছো?”
রুশার কথা শুনে আদ্রিশ ওর নাম ধরে চিৎকার করে হাত উঁচু করে মারার জন্য। রুশা হাতের দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ হাত নামিয়ে নিল। রুশা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“নিজের বেলায় ষোলো আনা। সব ভালো চরিত্র যেন একা তোমার। জ্বালা অন্যেরও হয়। উপলব্ধি করতে শিখো।”
আদ্রিশ রাগে ফোঁসফোঁস করছে।
.
অনেকদিন পরে কথা এসেছে রুশার সাথে দেখা করতে। রুশার ওকে দেখে একটু ভালো লাগছে। সারাদিন একা একা বাসায় বসে থাকতে কার ভালো লাগে? রুশা আজকাল আদ্রিশের সাথে তেমন কথা বলে না। সব সময় গাল ফুলিয়ে থাকে। আদ্রিশের অভ্যাস হয়ে গেছে রুশার এমন মুখ দেখতে দেখতে। কথার সাথে গল্প করে ওর ভালোই লাগছে। সুযোগে আছে ওর মোবাইলটা ব্যবহার করার জন্য। রুশা বই পড়ছিল। বই রেখে রুশা হাসি মুখে গানের সুরে সুরে আস্তে আস্তে বলল ওর মোবাইলটা যেন ওয়াশরুমে রেখে আসে। কথাকে আগেই বলে দিয়েছে আদ্রিশ ওর মোবাইল নিয়ে নিয়েছে। বাইরে যেতে দেয় না। সারাক্ষণ ঘরবন্দী করে রাখে। কথা রুশার ফিসফিসানি কথা শুনে নার্ভাস হয়ে গেল। যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে তো খবর আছে। আদ্রিশ ওকে না মেরে দেয়। কথা অসহায় মুখ করে রুশার দিকে তাকাল। রুশা ইশারায় অনুনয় করছে। কথা ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানায় মোবাইল রেখে এল। তারপর ওরা কিছুক্ষণ গল্প করে রুশা শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে মেসেজ করল শানকে। এখানকার সব অবস্থা জানাল রুশা।
🥀🥀
রাতের বেলা খাবার টেবিলে রুশা আদ্রিশের অনেকটা দূরে বসে খাচ্ছে। দুজনের মধ্যেই দূরত্ব বিরাজ করছে, পাশাপাশি নীরবতা। কেউ কারো সাথে আদুরে গলায় কথা বলে না, কারো হাতে খাওয়ার জন্য বায়না করে না, এক সাথে বসে গল্প করে না।
আদ্রিশ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,
“কথার সাথে ফিসফিস করে কি কথা বলছিলে?”
রুশা চমকে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশের এত সময় কী করে হয়? সবকিছুই কি করে দেখে? কোনো কিছুই কি চোখ এড়ায় না? মোবাইলের ব্যাপারটা জেনে গেল না তো?
“কত কথাই তো বলেছি। তুমি কোনটা শুনতে চাইছো?”
“বেশি ড্রামা করো না। তুমি নিশ্চয়ই গোপন কিছু বলছিলে। তোমার বলার ধরণ, কথার দৃষ্টি তাই বলছিল।”
রুশা খাওয়া থামিয়ে বলল,
“অদ্ভুৎ! এখন আমি কথার সাথে বসেও একটু শান্তিতে কথা বলতে পারব না? তার জন্যও কৈফিয়ত দিতে হবে? হাসি, আনন্দ, সুখ, শান্তি সবকিছু তো কেড়ে নিয়েছে। এখন এই জীবনটাই পড়ে আছে আর কী চাইছো? এখন আমি ওর সাথে কী কথা বলেছি তারও হিসেব দিতে হবে?”
রুশা প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে গেল। আদ্রিশ ওর পেছনে পেছনে গেল। ঘরে গিয়ে রুশাকে চেপে ধরে বলল,
“আজকাল বড্ড মেজাজ দেখাচ্ছো তুমি। রুশা নয় অন্য কোনো চরিত্রে ঢুকে পড়েছো। আমাকে হিসেব দিবে না তো কাকে দিবে? ”
“আজকাল তুমি আমার সাথে কুকুর, বিড়ালের মতো ব্যবহার করছো। মানুষ মানুষের সাথে এমন করে না। এই বাড়ি নামক খাঁচায় বন্দী করে রেখেছো। মানসিক টর্চার করছো। প্রতিনিয়ত আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কী করেছি আমি? কিসের জন্য এমন ব্যবহার?”
“কি করেছিস তুই জানিস না? তোকে বলতে হবে? মুখ বন্ধ করে থাক। নয়তো জিভ কেটে দেব।”
আদ্রিশ রুশাকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিল। রুশার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। মন চাইছে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে।
রুশা এক পাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। আদ্রিশ অন্য পাশে। রুশার চোখে ঘুম নেই। ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে।
“অনেক হয়েছে আদ্রিশ। এতদিন তোমাকে ভালোবেসে সব সহ্য করেছি। আমাকে এই বাড়িতে আঁটকে রাখবে আর আমি পড়ে থাকব? তেমন মেয়ে আমি না। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে সব টর্চার মেনে নিয়েছি। তোমার ভালোবাসার জন্য নিজেকে বদলে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সব ভুলে তোমাকে ভালোবেসে তোমার সাথে থাকব কিন্তু তুমি নিজেকে বদলাতে পারলে না। আমি আমার সমস্ত প্লানে পানি ঢেলে দিয়েছিলাম। যে কারণে নিজেকে এভাবে তৈরি করেছি সে কারণটাই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম। লাইফের এত বড় রিক্স নিয়েছিলাম, লক্ষ্য থেকে সরে এসেছিলাম, সব মাটি চাপা দিয়ে তোমার সাথে বাঁচতে চাইছিলাম কিন্তু বিনিময়ে তোমার কাছ থেকে কিছুই পাইনি। তুমি আমাকে ভালোই বাসো না। তুমি ভালোবাসার নামে অভিনয় করে গেছো। তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছো। অনেক বড় গেম খেলছো আমার আড়ালে আর আমি এত বোকা যে তোমার এই প্লান ধরতে পারিনি। সব ভালোই ভেবে এসেছি। তুমি কি করতে চাইছো আদ্রিশ? তোমার মাথায় কি চলছে? আমাকে নিয়ে কোন গেম খেলছো? আজ থেকে তোমার আর আমার পথ আলাদা আদ্রিশ। আমাকে আর বোকা বানাতে পারবে না। আমি জানি তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছো। এতদিন ধরে অভিনয় করেছো। মেইন প্লান এক্সিকিউট করার সময় চলে এসেছে।”
.
সকাল থেকে ঘনঘন বমি আর মাথা ঘুরে যাওয়ার কারণে রুশার মনে কু ডাকছে। এখন তিক্ত সম্পর্ক হলেও মাসখানেক আগেও মধুর সম্পর্ক ছিল ওদের। রুশার মাথা আরো যন্ত্রণা করছে। কেমন ভনভন করছে। চারদিকে সব কিছু উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে রুশা মেঝেতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পরে একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখল। তিনি মিষ্টি হেসে উঠে বাইরে গেল। রুশাও বিছানা থেকে নেমে গেল। বাইরে কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“মিস্টার আদ্রিশ আফসান, আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। উনার বিশেষ খেয়াল রাখবেন।”
এসব শুনে রুশার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। জীবন ওর সাথে কি খেলা খেলছে বুঝতে পারছে না। যেখানে ওর জীবনের সিকিউরিটি নেই সেখানে একটা বাচ্চাকে কি করে জন্ম দিবে? আদ্রিশের মতো একটা ক্রিমিনাল, খুনি, সাইকো আর রুশার মতো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধ উন্মাদ মানুষ কি করে ওর বাবা-মা হতে পারে? যারা একে অপরের শত্রু? একে অপরের বিরুদ্ধে ছক কষে যাচ্ছে তারা ওকে কি সুন্দর জীবন দিতে পারবে? কী করে দেবে? রুশা নিজেই আগুনে ঝাপ দিয়ে বসে আছে। আস্তে-আস্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সেখানে বাচ্চা? আর আদ্রিশ কি নিজের সন্তানকে বাঁচতে দেবে?
আদ্রিশ বাচ্চা আসার কথা শুনে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ও বাবা হবে, একটা পরিবার হবে, ওকে বাবা বাবা বলে ডাকবে এসব ভাবতেই ভেতরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত ঘরে এলো। রুশাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ওর মুখ ফ্যাকাসে। রুশার ফ্যাকাসে মুখ দেখে আদ্রিশ প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
চলবে….
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
২০.
“আমার বাচ্চা চাই না।” রুশা খুব সহজ আর স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বলল। কিন্তু ওর এই কথা আদ্রিশ ঠিক হজম করতে পারল না। রুশা ঠান্ডা মাথায় এই ছোট কথা দ্বারা বড় একটা খুন করে ফেলল। আদ্রিশের চোখ মুখে যে খুশির আভা ফুটে উঠেছিল নিমিষেই
তা মুছে গেল। ওর চোখ মুখ শক্ত আকার ধারণ করল।
দু পা এগিয়ে ওর কাছে গিয়ে বলল,
“বাচ্চা চাই না মানে কী?”
“মানেটা খুব সহজ। আমি বাচ্চা চাই না।”
“কেন চাও না হাহ?”
“কেন চাইব? আমি এই বাচ্চা জন্ম দিতে পারব?”
“কেন পারবে না? সমস্যাটা কোথায়?”
“বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য আমি বেঁচে থাকব তো? তোমার শত্রুরা আমাকে বাঁচতে দেবে? বিশেষ করে জারিফ?”
আদ্রিশ সাথে সাথে বলল,
“জারিফকে আমি মেরে ফেলেছি। তুমি এখন সেফ।”
রুশা মৃদু হাসল। আদ্রিশ তাহলে ওকে এতদিন জারিফের ব্যাপারে মিথ্যে বলেছে।
“জারিফ নাহয় মরে গেছে। তোমার কি শত্রুর অভাব? আমার জীবনের গ্যারান্টি আছে?”
আদ্রিশ রুশার দুহাত ধরে নরম কন্ঠে বলল,
“রুশা, কেউ তোমার ছায়াও ছুতে পারবে না। আমি আমার সমস্ত এফোর্ট লাগিয়ে দেব। তুমি সুস্থ ভাবেই ওকে পৃথিবীতে আনতে পারবে। বাচ্চাটা আমাদের প্রথম সন্তান। ওর আসাটা খুব জরুরি। আমাদের দুজনের জন্যই জরুরি।”
রুশা আদ্রিশের হাত ছাড়িয়ে নিল। আদ্রিশ ওর দিকে চেয়ে আছে। রুশা আদ্রিশের চোখে চোখ রেখে বলল,
“জন্ম দিতে পারলেও সুস্থ একটা জীবন দিতে পারব? কোন পরিচয়ে বাঁঁচবে? কার পরিচয়ে বাঁঁচবে?”
“আমার সন্তান অবশ্যই আমার পরিচয়ে বাঁঁচবে।”
রুশা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“তোমার আবার পরিচয় আছে? ওহ হ্যা, আছে তো। একজন মাফিয়া, ক্রিমিনাল, খুনি, সাইকো। খুবই সম্মানের পরিচয়। এই পরিচয়ে বড় হবে?”
আদ্রিশ চিৎকার করে বলল,
“রুশা! একদম বাজে কথা বলবে না। আমি সাইকো নই। আমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। এই শব্দটা তোমার মুখে আরেকবার শুনলে….
” কী করবে? কী করবে তুমি?”
“তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
“তুমি এমনই একজন মানুষ নিজের সন্তানকেও হত্যা করতে দু’বার ভাববে না। দেখা গেল জন্ম দেওয়ার আগে তুমিই খুন করে ফেললে অথবা জন্ম দেওয়ার পরে।”
আদ্রিশ নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। নিজের সন্তানকে খুন করবে এটা রুশা ভাবলো কী করে?
আদ্রিশ ঠাটিয়ে এক চড় মারল রুশাকে। রুশা ছিটকে খাটের কোনায় পড়ে গেল। রুশা ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হাসল। তারপর বলল,
“সাথে সাথে প্রমাণ করে দিলে তো? যদি পেটে আঘাত পেতাম? তাহলে কী বাচ্চাটা বাঁচত? তুমি ওর খুনি হতে না?”
রুশার কথা শুনে আদ্রিশের হুশ এলো। রুশা তো ঠিকই বলেছে। বেকায়দায় আঘাত পেলে বাচ্চাটার কী হতো?
রুশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি আমাকে যে পরিমাণ টর্চার করো তাতে আমার জীবনের গ্যারান্টি নেই। একদিন আমিই মরে যাব। সেখানে বাচ্চা কী করে জন্ম দেব? তুমি নিজের উপর কন্ট্রোল করতে পারো না। রাগের বশে আমাকে বারবার আঘাত করবে। আর এই আঘাতে কোনো একদিন আমি বাচ্চাটাকে হারিয়ে ফেলব। আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। আর হ্যা তোমার মতো মানুষের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই। একটা খুনি, ক্রিমিনাল নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। সন্তান, সংসার তাদের জন্য নয়। তাই আমি ওকে পৃথিবীতে আনব না। তোমার মতো মানুষ ওকে মানুষ হওয়ার না অমানুষ হওয়ার শিক্ষা দিবে।”
আদ্রিশ রাগে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু রুশাকে কিছু বলতে পারছে না। আর না আঘাত করতে পারছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই বাচ্চাটা আমার চাই। যেকোনো মূল্যে চাই। ওর সাথে কিছু করলে তোকে আমি ছাড়ব না। মনে রাখিস।”
আদ্রিশ হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রুশা ধপ করে বসে পড়ল। বসে বসে কাঁদতে লাগল।
.
আদ্রিশ যথারীতি চেষ্টা করছে রুশাকে মানাতে। রুশার প্রয়োজনের কমতি রাখছে না। নিজে ওর টেক কেয়ার করছে। ও মনে প্রাণে চাইছে বাচ্চাটা আসুক। একটা বাচ্চা ওদের দূরত্ব ঘোচাতে পারে। সম্পর্ক আরো গভীর করবে। রুশা তাহলে সব সময় আদ্রিশের সাথে থাকবে। ওকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারবে না। উলটা পালটা কিছু করার কথাও ভাববে না। বাচ্চার জন্য হয়তো নিজেকে বদলে নিবে। ওদের জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে। হাসিখুশি একটা জীবন হবে।
আদ্রিশ রুশার সামনে ওর মোবাইলটা রাখল। রুশা একবার মোবাইলের দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।
আদ্রিশ ধীরে ধীরে বলল,
“তোমার মোবাইল ফেরত দিলাম। অন করে নিও।”
রুশা কিছু বলল না। মোবাইলটা হাতে নিল না। আদ্রিশকে যথারীতি ইগ্নোর করছে। আদ্রিশ চাইছে না রুশার উপর রাগ করতে। নিজেকে যথেষ্ট ঠান্ডা রাখছে।
দুদিন পর। রুশা ওয়াশরুমে গিয়ে শানকে কল করল। শান কল রিসিভ করে চুপ করে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে আদ্রিশ না রুশা।
“ভাইয়া!”
“পিউ, বোন আমার কেমন আছিস? তুই ঠিক আছিস তো? আমি কত টেনশন করছি তোর জন্য।”
“আমি ঠিক নেই ভাইয়া। অনেক সমস্যায় আছি। কি করব বুঝতে পারছি না।”
“কী হয়েছে? আদ্রিশ কিছু করেছে?”
“না।”
“তাহলে?”
রুশা চুপ করে আছে। শানের টেনশন বাড়ছে। রুশা নতুন করে কি গণ্ডগোল বাঁধাল তাই ভাবছে।
“পিউ! কথা বল। আমার টেনশন হচ্ছে।”
রুশা নিচুস্বরে বলল,
“ভাইয়া, আমি প্রেগন্যান্ট।”
শানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল বোনের কথা শুনে। স্তব্ধ হয়ে আছে। ওর বোন প্রেগন্যান্ট! যে কিনা শত্রু নিধন করতে গেছে সে এখন শত্রুর বংশধর নিজের পেটে বহন করছে?
শান তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“কী বলছিস পিউ?”
“হ্যা ভাইয়া।”
শান গর্জে উঠে চিৎকার করে বলল,
“তুই এইজন্য গিয়েছিস? আদ্রিশের সন্তানের মা? ছিহ! তোকে আমি বারবার সাবধান করেছি। শুনিস নি আমার কথা। ওই খুনিটার সন্তানের মা হয়ে ওই বাড়িতে থাকবি? ওর সাথে সংসার কর, ওর সন্তান লালন পালন কর। আমাকে ভাই বলে পরিচয় দিবি না। আমি মরে গেছি তোর জন্য। এটাই মনে করবি। আমার তোর মতো বোনের দরকার নেই।”
রুশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
“ভাইয়া, এভাবে বলো না। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি কাকে বলব নিজের কষ্টের কথা, সমস্যার কথা?”
রুশা লজ্জায়, অনুতাপে, কষ্টে কাঁদতে লাগল।
শান নিজেকে শান্ত করে বলল,
“তোকে চলে আসতেও বলতে পারছি না। কারণ তুই তোর লক্ষ্যের পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিস, এতদিন এত কষ্ট করেছিস। আমার পরামর্শ বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেল। তারপর নিজের কাজ শেষ করে চলে আয়। আমি সব ম্যানেজ করে নেব।”
রুশার নিজেকে অসহায় লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
“বাচ্চা নষ্ট করে ফেলব? আমার বাচ্চা।”
শান আবারও চিৎকার করে উঠল।
“ভুলে গেছিস তুই সব? ভুলে গেছিস ও আমাদের সাথে কি করেছে? আমাদের পরিবারটা ধ্বংস করে দিয়েছে। সেসব দিন ভুলে গেছিস? কতটা ছটফট করেছি আমরা। কত কেঁদেছি, চিৎকার করে কেঁদেছি, আর্তনাদ করেছি। কত অসহায় ছিলাম। এখনো আমি কিছুই ভুলিনি অথচ তুই সব ভুলে বসে আছিস। তোর ভাইয়ের সাথে, ভাবীর সাথে তার অনাগত সন্তানের সাথে কি করেছে সব ভুলে গেছিস? একটা বাচ্চা আমাদের বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা ছিল। কিন্তু সে এখন তার মায়ের সঙ্গে কবর বাসী হয়ে গেছে। ভাই-ভাবীকে তো বাবা-মায়ের মতো মানতিস, তাদের কথা ভুলে গেলি? কত তপস্যার পরে একটা বাচ্চা দিয়েছিল আল্লাহ সেটাও কেড়ে নিয়েছে ওই আদ্রিশ। মৃত মানুষের মতো বেঁচে আছি। হাসতে ভুলে গেছি পিউ। কতটা অসহায় হয়ে গেছি। তুই সেদিন চিৎকার করে কী বলেছিলি? কী প্রতিজ্ঞা করেছিলি? সব ভুলে গেছিস পিউ? এত তাড়াতাড়ি?”
শান কাঁদছে। রুশাও ওর সাথে কাঁদছে। সেসব দিনের কথা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না রুশা। মেঝেতে বসে পড়ল। ভয়ানক, লোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এতগুলো দিন পাড় করে গেছে।
“না ভাইয়া, কিছুই ভুলিনি। আমি প্রতিশোধ নেব। সবকিছুর প্রতিশোধ নেব। আমি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ করব। আমার ভাই-ভাবী, তাদের অনাগত সন্তানের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেব।”
” ও যেদিন ওর বাচ্চার জন্য ছটফট করবে সেদিন আমি শান্তি পাব। এখন কি করবি তা তুই ভালো জানিস।”
“আদ্রিশ বলেছে যেকোনো মূল্যে ওর বাচ্চা চাই। বাচ্চার কিছু হলে আমাকে ছাড়বে না। আমি কী করব?”
“ওর যন্ত্রণা তাহলে শুরু হয়ে গেছে? তুই এমন কিছু কর যাতে দায়ভার তোর উপর না পড়ে।”
“ঠিক আছে। আমি কিছু ভাবছি।”
রুশা কল কেটে থম মেরে বসে রইল। ওর মাথা কাজ করছে না। গ্যালারি থেকে ভাই ভাবীর একটা পিক বের করল। দুইজনকে এক সাথে কত সুন্দর লাগছে। কত সুখী ছিল ওরা। ওদের কত ভালোবাসা, স্বপ্ন ছিল। বিয়ের পর পর ওর ভাইয়া ওর ভাবীর কাছে বাচ্চা নেওয়ার কথা বলে। বাচ্চা হচ্ছিলো না দেখে ওর ভাবীর মনমরা হয়ে থাকত। মনে মনে অনেক কষ্ট পেত। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করত, কত কি মানত করেছে। রুশাকে কল করেও অনেক কান্নাকাটি করত। ওর ভাই অনেক বুঝাতো কিন্তু তার মনে হতো সে হয়তো কোন দিন মা হতে পারবে না। তারপর তিন বছরের মাথায় আল্লাহ মুখ তুলে তাকায়। সেদিন ওদের বাড়িতে যেন ঈদ উৎসব। রুশাকে ভিডিও কল করে যখন ভাই-ভাবী এক সাথে খবর দিয়েছিল তখন রুশা ওদের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। কত খুশি ছিল তারা। কল কেটে নিজেও কেঁদেছিল খুশিতে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ভাইয়ের বাচ্চার জন্য সুন্দর একটা নাম খুঁজতো।
“ভাইয়া, আমি এত স্বার্থপর কিভাবে হয়ে গেলাম? কী করে সব ভুলে গেলাম? তুমি আমার বাবা, আমার মা ছিলে। তুমি ছোট থেকে আগলে রেখেছো। এতটা ভালোবেসেছো। বিয়ে পর্যন্ত করতে চাওনি। তোমার সাথে কী হয়েছিল কী করে ভুলে গেলাম। আমার ভাবীর সাথে কী হয়েছিল কী করে ভুলে গেলাম? তোমাদের বাচ্চার সাথে যা হয়েছে তা কী করে ভুলে গেলাম? আমাদের সাজানো সংসারের সাথে কী হয়েছিল তাও ভুলে গেলাম? এত স্বার্থপর কিভাবে হতে পারলি পিউ? নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলি? আমি আদ্রিশকে ছাড়ব না। সবকিছুর বরাবর হিসাব নেব। ও আমাদের কাছ থেকে যা যা কেড়ে নিয়েছে তা সব কেড়ে নেব। ওর বাচ্চাকেও কেড়ে নেব। আমি ওকে ছাড়ব না ভাইয়া। আমি ওকে ছাড়ব না ভাবী। প্রতিটি মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব। ভয়ানক প্রতিশোধ।”
রুশা পাগলের মতো আচরণ করছে। চিৎকার করে কাঁদছে। হাত দুটো দিয়ে মেঝেতে আঘাত করছে। হাতে রক্ত জমে গেছে৷
.
.
.
রুশা আদ্রিশের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। আদ্রিশ এতে বেশ খুশি। ওরা দুজন এক সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। বেবির কন্ডিশন নিয়ে কথা বলেছে। কীভাবে চলতে হবে সব পরামর্শ নিয়েছে। বেবির বয়স দুই মাসের অধিক। আর আট মাস পরে বেবিকে ছুতে পারবে। আদ্রিশ সেই সময়টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ওরা দু’জন মিলে বেবির জন্য খেলনা, জামাকাপড় কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছে। আদ্রিশ ওকে কেনাকাটার বাহানায় বাইরে নিয়ে যায় যাতে ওর মন ভালো থাকে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়, রাতে লং ড্রাইভে যায়। ওর মন সব সময় ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করে কারণ ডাক্তার স্ট্রেস ফ্রি থাকতে বলেছে৷
রুশার মাথায় একেক সময় একেক প্লান ঘুরতে থাকে কিন্তু কোন প্লান কাজে দিচ্ছে না। সব প্লান ফ্লপ হয়। আদ্রিশ শাওয়ার নিয়ে এসে রেডি হচ্ছে। জামাকাপড় এটা সেটা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছে। রুশা শুয়ে শুয়ে দেখছে এসব।
“আদ্রিশ তোমাকে না কতদিন বলেছি এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে না? এগুলো আমার পছন্দ না। আর নিচে এসব কি রেখেছো? যদি আমি পড়ে যাই? তোমাকে আর কতবার বলব?”
আদ্রিশ সরি বলে টুল, কাউচ জায়গা মতো রাখল। কার্পেটের উপর থেকে হ্যান্ডার তুলল।
রুশা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। আদ্রিশ শ্যাম্পুর বোতল ফেলে রেখেছে। মেঝেটা পুরো ভেজা। রুশা বেশ বিরক্ত হলো। শ্যাম্পুর বোতলটা তুলে ছিপি লাগাতে গিয়ে থেমে গেল। কিছু একটা ভাবল। তারপর কিছু শ্যাম্পু মেঝেতে ফেলে দিল। পা দিয়ে সেই শ্যাম্পু ছড়াচ্ছে।
আদ্রিশ টাই বাঁধার জন্য টাইটা হাতে নিতেই রুশার চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসে। আদ্রিশের হাত থেকে টাই পড়ে গেল। বুকটা ধুক করে উঠল৷ আদ্রিশ দৌড়ে দরজার সামনে গেল। দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ। রুশার আর্তনাদ কানে আসছে। আদ্রিশ দরজা ভেঙে ফেলে। রুশা মেঝেতে পেটে হাত দিয়ে কাঁদছে। পায়ের কাছে রক্তের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। আদ্রিশ দ্রুত ওকে ধরতেই রুশা জ্ঞান হারালো।
.
হাসপাতালের বেডে রুশা ঘুমিয়ে আছে। আদ্রিশ ওর সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ওর ঘুমন্ত মুখটা যেন বলছে,
“তুমি খুনি। আমার নিষ্পাপ বাচ্চার খুনি।”
আদ্রিশের চোখ ফেটে যেন কান্না হয়ে রক্ত ঝড়ছে। এর আগে শেষ কবে এত কষ্ট পেয়েছে, চোখে পানি এসেছে মনে নেই। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগেই বলেছে ওর মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here