তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৩২

0
175

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৩২
লেখনীতে-আফনান লারা
.
হাতে হাত রেখে ঘুমালে সম্পর্কটা ঠিক কতটা গভীর হয়?বিশেষত সেই মানুষটার হাত যে মানুষটা আপনার খুব আপন।আপনার বৈধ সম্পর্কের মানুষ।

খুব সকালে তটিনির আর বাপ্পির এক সাথেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।কারণটা ছিল বাপ্পির মায়ের ফোন।আজ বৌভাত, তারা যেন সূর্যের আলো উঠানে পড়ার আগেই বাড়িতে উপস্থিত হয়।
বাপ্পি তটিনির হাতটা তখন ছাড়লো যখন তার বিছানা থেকে নামার উপক্রম হলো।
তটিনির হুশ নেই।সে হেলেদুলে নিজেও নেমে মুখ ধুইতে চলে গেছে।যেতে যেতে আঁচলটা মেঝেতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে।বাপ্পি তার ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করতে ব্যস্ত ছিল।তোয়ালেটা অনেক খোঁজাখুঁজির পর বের করে যেই না সে পিছনে ফিরলো দেখলো তটিনি চোখ ডলতে ডলতে এদিকেই আসছে।আঁচলের ঠিক নেই।বাপ্পি ধপাস করে পিছিয়ে মেঝেতে বসে গেলো এ দৃশ্য দেখে।তটিনি আসতে আসতে খাটের সাথে এক ধাক্কা খেয়ে উহঃ করে নিজের দিকে চোখ ফিরাতেই আঁচল নিচে দেখে তড়িগড়ি করে আঁচলটা তুলে গায়ে জড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে বাপ্পি না দেখার ভান ধরে তোয়ালে গায়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে।

‘এই দাঁড়ান!আপনি কিছু দেখেছেন?’

‘না তো!কি দেখবো?’

তটিনি আর কিছু বলেনা।নিজের আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বিছানার উপর থেকে নিজের চুড়ি আর আংটি নিয়ে পরছে।
বাপ্পি জিভ কামড়ে কোনোমতে ওখান থেকে পালিয়ে ওয়াশরুমে চলে আসে।তটিনি যদি জানে তার আঁচল পড়ে যাবার পর সে ওকে ড্যাবড্যাব করে দেখেছে তাহলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে।
——
তটিনি বাপ্পির অপেক্ষায় ছিল।সে বের হলেই তারা হোটেল থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে রওনা হবে।হোটেলটা থেকে বাড়ি খুব একটা দূরে না।আধা ঘন্টার পথ।
বাপ্পি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তটিনিকে নিয়ে রওনা হয়।তারা যখন বাড়ি পৌঁছে ততক্ষণে সাতটা বেজে গেছে।
ডেকোরেশনের লোকেরা তাদের কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।
তটিনির হাসি আর ধরেনা।আজ তাদের বৌ ভাত।হাসিটা ভেতর থেকে আসছে তার।
হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই তটিনি আটকে যায়।পরের পা আর রাখলোনা।
কিছুক্ষণ আগে এখানে রিনি হাতে ঝুল পরিষ্কার করার ঝাড়ু নিয়ে টুলে উঠে ঝুল পরিষ্কার করছিল।ময়লা দেখলে তার কেমন যেন লাগে,দম ফেলতে অশান্তি লাগে।যেখানেই যাক ময়লা দেখলে উঠে পরিষ্কার করে ফেলে সে।
এখনও তাই করছিল হঠাৎ আসিফ ওখান দিয়ে যাবার সময় টুলের সাথে তার ধাক্কা লাগে আর টুল নড়বড়ে হওয়ায় রিনি তখন পড়ে যাচ্ছিল,আসিফ তাকে সঠিক সময়ে ধরে ফেলে।এই দৃশ্যটাই তটিনি দেখেছে মাত্র।বাপ্পি ব্যাগ কাজের লোকের হাতে দিয়ে গাড়ী পার্ক করে এসে সেও একই দৃশ্য দেখে তটিনির দিকে তাকায়।তটিনির চোখে পানি দেখে তার বুকটা যেন নিমিষেই খালি হয়ে গেলো।মুখটা তার ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মূহুর্তেই।এই মেয়েটিকে সে কখনও কাঁদাতে চায়নি!আর আজ এই মেয়েটিই ওর সামনে কাঁদছে।!
তটিনি শক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে।
আসিফ আর রিনি এখনও ওদের দেখেনি।আসিফ রিনিকে খুব যত্ন করে নিচে নামালো।রিনির খুশি আর ধরেনা।সে আসিফকে তখনই জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা গুজে বললো,’আন্নে আঁর বেজ্ঞিন😘’

তটিনি পিছিয়ে যাওয়া ধরতেই বাপ্পি ওকে হাত দিয়ে ধরে ফেলে।এরপর চুপচাপ ওদের নজর এড়িয়ে রুমে নিয়ে আসে তটিনিকে।

রুমে এনে দরজা লক করে বাপ্পি।তটিনি চোখ মুছে বিছানার উপর রাখা তার বৌ ভাতের শাড়ীর প্যাকেটটা হাতে তুলে নেয়।দ্রুত প্যাকেট থেকে সেটা বের করে পরতেও চলে যায়।বাপ্পিকে সে বোঝাতে চাইছে সে ঠিক আছে।আসলে যে ও ঠিক নেই এটা বাপ্পি জানে।
তটিনি ওয়াশরুমে এসে নিচে বসে ঝর্ণা ছেড়ে কাঁদছিল মাথা ধরে।বাপ্পি দরজার কাছে এসে প্রায় দশ মিনিট মতন দাঁড়িয়ে ছিল এরপর দরজায় হাত রেখে সে বলে,’তটিনি!এত ভিজলে জ্বর আসবে।সকালে এত ভিজতে হয়না!চলে এসো’

তটিনি শোনেনা।সে কাঁদছে!আসিফকে ভোলার হাজার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ!
বাপ্পি দরজায় কয়েকবার নক করার পরেও তটিনির কোনো সাড়া না পেয়ে ড্রয়ারের উপর থেকে ওয়াশরুমের চাবি বের করে লক খুলে বলে,’তটিনি আমি আসছি!’

দরজাটা খুলতেই তটিনিকে নিচে বসে থাকতে দেখে বাপ্পি দরজা ছেড়ে দেয়।তটিনি মাথা তুলে বাপ্পিকে দেখে হাত উঠিয়ে ঝর্ণা অফ করে।এরপর চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।তারপর আর কিছু করেনা।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বাপ্পির দিকে তাকিয়ে থাকে।বাপ্পি শাড়ীর প্যাকেটটা বাহিরে রেখে তোয়ালে ওর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলে,’আমি ওদের বলছি চলে যাবার জন্য।তাও তোমায় কষ্ট পেতে হবেনা’

‘না।তার দরকার নেইই’

‘তোমায় এভাবে দেখতে পারবোনা আমি’

”আমি ঠিক আছি’

তটিনি তোয়ালেটা ধরে বের হয়ে আসে।বাপ্পি কিছু না বলে দরজা খুলে চলে যায় রুমের বাহিরে। আসিফ রিনিকে ছাড়িয়ে বাগানের দিকে গেছে।বাপ্পি ও সেদিকেই গেলো।ওকে দেখে আসিফ খুশি হয়ে জানতে চাইলো তারা কখন এসেছে।তটিনি বা কোথায়।
বাপ্পি ওর সাথে আলাপ করতে করতে চেয়ার নিয়ে বসে।আসিফ তার ভার্সিটি নিয়ে কথা শুরু করে তখনই বকুল আপা সেখানে এসে বাপ্পিকে ধমকে বললেন গিয়ে তটিনির কথা শুনতে।তটিনি নাকি ওর খোঁজ করছে শুধু।আসিফ ও অবাক হলো।বাপ্পি তো নিজেই অবাক।
তাও মনে মনে আন্দাজ করে তটিনি হয়ত আসিফকে জেলাস ফিল করাতে বকুল আপুকে দিয়ে ওকে ডেকেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই রুমে এসে দেখে তটিনি পিঠে হাত দিয়ে রুমের শেষ কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।বাপ্পি ওর কাছে এসে বললো,’আসিফকে জেলাস ফিল করাতে আমায় মনে করা হচ্ছে?’

‘নাহ।আসলে আমার পিঠের উপর যে রশিটা আছে সেটা জায়গা থেকে ছুটে গেছে।সেফটিপিন দিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে।অনেক টাইট বলে পরতে আমার কষ্ট হয়েছে।আবার খুলে সেফটিপিন লাগালে আবারও ছুটে যাবে’

বাপ্পি কোমড়ে হাত রেখে বলে,’এটা তো বকুল আপুকে দিয়েও করাতে পারতে’

‘বলেছিলাম।উনি আমায় ধমকে বলেছেন কাজটা আপনার করা উচিত’

বাপ্পি ঢোক গিলে তটিনির কাছে এসে দাঁড়ায়।তটিনি মাথা নিচু করে ওর দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো।বাপ্পি সেফটিপিন নিয়ে রশিটাকে আটকে দিচ্ছে।হাত কাঁপছে তার অনবরত।
তটিনি মুচকি হেসে বলল,’বিয়ের পরেরদিন আমি মলম মালিশ করেছিলাম।আমার এতটাও হাত কাঁপেনি’

‘ওসব তুমি বুঝবেনা।তোমাদের তো আমাদের পিঠ, গলা দেখে অনুভূতির বৃদ্ধি ঘটেনা।কিন্তু আমাদের ঘটে।’

‘তো কি করা উচিত তাহলে?’

‘যেটা করা উচিত সেটা করলে তুমি খুব মারবে আমায়।বৌভাতের দিন মার খেয়ে গাল লাল করে হাঁটতে চাইনা’

তটিনি জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালো।সেখানে আসিফ বসে বসে কফি খেতে খেতে ফোনে লার সাথে যেন কথা বলছে।রিনি সেখানে লাফালাফি করছে ওর পাশেই।
তটিনি মাথা উঁচু করে বলে উঠলো,’মারবোনা’

‘তাও করছিনা।আমার সাহস নেই’

তটিনি নিজেকে ছাড়িয়ে বাপ্পির দিকে ফিরে বললো,’কেন নেই?আমি অনুমতি দিলাম না?’

‘দিলে তবে বাগনে আসিফকে দেখে।বিয়েটা জেদ করে করেছো,ভালবাসাটা জেদ করে করোনা,হবেওনা,গড়বেওনা’

এই বলে বাপ্পি চলে গেলো।তটিনি বাপ্পির কথায় আশ্চর্য হয়ে আছে।বাপ্পি খুব কঠিন একটা সত্যি বলে চলে গেলো!
আসিফকে জেলাস ফিল করাতে সে বাপ্পিকে বিয়ে করেছে হাজারও অপছন্দের ভীড়েও।আর আজ!আবারও একই সিদ্ধান্ত! ‘
——
রিনি ফুলের মালা মাথায় লাগিয়ে বাপ্পিদের বাগানের সবকয়টা ফুল ধরে ধরে দেখছে।আসিফ হাতে কফির মগটা নিয়ে ওর চঞ্চলতা দেখছে।
বহু সময় আগে তটিনিকে এভাবে দুষ্টুমি করতে দেখতো সে।
মনটা আনন্দে ভরে উঠতো কিন্তু সে বুঝতে দিতোনা।আর আজ ও!!!
রিনি চুল কানের পেছনে গুজে আসিফের দিকে ফিরে বলে,’আঁরে ভালা লাগে?’

‘একটুও না’

‘বেশ জানি!!’

আসিফ অন্যদিকে মুখ করে বসে এবার।তটিনি জানালায় হাত রেখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।দিনশেষে সে একা!
তার কেউ নেই।কিছু নেই!তাকে বোঝার মতন একটি মানুষ নেইই!
শাড়ীর আঁচল গায়ে চাদরের মতন টেনে রুম থেকে বের হয় সে।সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাপ্পি তার বাবার সাথে ডেকোরেশনের জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।দূর থেকে ওর গায়ের কমলা রঙের পাঞ্জাবিটা চোখে লাগে!
তটিনি অনেকক্ষণ ওকে দেখছিল।বকুল আপু হাতে পিঠার ঢালা নিয়ে ওখান দিয়ে যাবার সময় বললেন,’কথা বলতে ভয় কিসের?যাও ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াও’
চলবে ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here