তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৩১

0
182

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৩১
লেখনীতে-আফনান লারা
.
বাপ্পির অফিস অনেকদিনের ছুটি নেয়া হয়েছে,আর মিস দেয়া যাবেনা।তাই পরেরদিন ভোর হতেই তারা হোটেল থেকে বিদায় নিলো।তটিনি গাড়ীর পেছনের সিটে ঘুমাচ্ছিল আজ।কাল সারা রাত ঘুমিয়েছে তাও তার অনেক ঘুম যেন এখনও বাকি আছে।অবশ্য এখন খুব একটা সকাল না।সাড়ে ছয়টা বাজে।বাপ্পি হাই তুলতে তুলতে ড্রাইভ করছে।কাল রাতে যেটা ঘটেছে সেটা খুব একটা স্মরণীয় নাহলেও বাপ্পির বার বার দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়।তটিনি আসিফকে না চেয়ে তাকে চাইছে এর চেয়ে বড় কিছু আর কি হতে পারে।

অনেকটা পথ আসার পর বাপ্পি গাড়ী থামায়।একটা কফি খেতে মন চাইছে।দোকানটা মেইন রোড থেকে কাঁচা পথ দিয়ে মাঝ বরাবর।অর্থাৎ গাড়ী রেখে হেঁটে যেতে হবে কফির জন্য।
তটিনিও ঘুমায়।তাই বাধ্য হয়ে বাপ্পি দরজা লক করে ঐ দোকানের দিকে চলে গেলো।
সে যাবার কিছু সময় পরেই তটিনির ঘুম ভেঙ্গে যায়।চোখ ডলে সামনে তাকিয়ে বাপ্পিকে কোথাও না দেখে সে কিছুটা ভয় পেলো।এরপর গাড়ীর দরজা খোলার চেষ্টা করে দেখে সেটা লক।এবার তার ভয়টা আরও গাঢ় হয়ে আসে।
জানালায় হাত রেখে কিছু বলবে তখনই বাপ্পিকে দূর থেকে আসতে দেখে মূর্হুতেই তটিনির মুখে হাসি ফোটে।সে মুচকি হেসে এক দৃষ্টিতে বাপ্পির দিকে তাকিয়ে আছে।বাপ্পি দরজা আনলক করে তটিনির দিকে চা ধরে বললো,’জানতাম তুমি জেগে যাবে।তাই তোমার জন্য ও নিয়ে এসেছি।চা খেয়ে নিজেকে ফ্রেশ করে নাও তো দেখি’

তটিনি কাপটা দেখে মনে করছে বিয়ের দিন রাতে হাসপাতালে বাপ্পি ওকে কফি দিতে চেয়েছিল।সে ধমক দেয়ায় এরপর থেকে ও আর কখনও ভুলেও তটিনিকে কফি সাধেনি!
এই ছোট বিষয়টা নিয়েই তটিনির ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেলো।

বাপ্পি তার এই হাসিটা দেখেনি।সে কফিতে চুমুক দিয়ে মাথার উপরের আমড়া গাছটা দেখছে।সবগুলো পাতা হলুদ রঙ হয়ে আছে।
অনেকক্ষণ সেটা দেখে তটিনিকে সে গাড়ীর বাইরে নিয়ে এসে বলে চোখ বন্ধ করো।
তটিনি চায়ের কাপটা কারের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে।বাপ্পি গাছটাকে ধরে খুব জোরে ঝাঁকায়।ওমনি সে বলে তটিনিকে চোখ খুলতে।তটিনিও চোখ খুলে।খুলতেই চোখের সামনে শতশত আমড়া গাছের হলুদ পাতা ঝরতে দেখে সে।তার হাসিটা এমন ছিল যে এইসব বুঝি ফুলের পাপড়ি!
সে চিৎকার করছিল খুশিতে।বাপ্পি অবাক চোখে ওর খুশিটা দেখে গেছে।ফুলের পাপড়ির বদলে বিবর্ণ পাতাতেও কেউ এত খুশি হয়!
গাছের পাতাগুলো সব ঝরে যাবার পর তটিনির হাসি বন্ধ হলো।বাপ্পি কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে।গাছটা যেমন বড় ছিল তেমনই তার ঢালপালা গুলো বেশি ছিল তার সাথে পাতাও বেশি তাই ওর গায়ের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে গেলো।
তটিনি দেখে নিচে পাতাতে পাতাতে ভরে অনেক সুন্দর বসার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। তাই চায়ের কাপটা নিয়ে সে পাতার উপরে বসে যায়।
বাপ্পি বসতে গিয়েও বসেনা।অভ্যাস নেই,কেমন একটা আনইজি লাগছিল।তখনই তটিনি তাকে খোঁচা দিয়ে বললো,’এইসব কি আর বড়লোকেরা পারবে!’

তার কথায় বাপ্পি দ্রুত বসে যায় ওর পাশে।কথাটা ভালমতন গায়ে লাগছে ওর।
চা কফি শেষে বাপ্পি কাপ গুলো রেখে আসতে চলে যায় ঐ দিকে আর তটিনি বসে বসে শূন্য পাতার গাছটি দেখছে।ঢালপালাগুলো কেমন যেন খাঁপছাড়া।
পাতাতেই যেন সব সৌন্দর্য্য ছিল।পাতা নেই বলে গাছটাকে কেমন যেন একটূ লাগছে।গাছের আসল রুপটাই যেন ফিকে হয়ে গেছে।তটিনি পাতাগুলো ধরে বারবার গাছটা দেখছিল।
তখনউ বাপ্পি এসে ওকে তাড়া দিয়ে বলে গাড়ীতে উঠতে।তটিনি এবার পেছনে না বসে বাপ্পির পাশের সিটটাতেই বসেছে।
বাপ্পি ফ্রেশ মাইন্ডে ড্রাইভ করছিল।কয়েকবার করে ওর মায়ের ফোন এসেছিল।তিনি জানিয়েছেন আজ নাকি ওরা ফিরবে বলে বাড়িতে মহা আয়োজন লেগেছে।তাছাড়া আজ তটিনির পরিবারের লোকদেরও বাপ্পিদের বাসায় দাওয়াত।বৌভাত তো হয়নি।সেটা কাল হবে বলে আজ সবাই একটু আলাপ করতে আসবে কত মানুষ আসবে সেটা নিয়ে।।

তটিনি শুনলো আসিফ ও আসবে।হঠাৎ সে বাপ্পিকে গাড়ী থামাতে বলে।বাপ্পি ভয় পেয়ে গাড়ীটা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে নেয়।

‘কি হলো হঠাৎ?’

‘আমরা বাসায় যাব না’

‘কোথায় যাবো?’

‘ঢাকায় হোটেল নাই?’

‘বাসা থাকতে হোটেলে কেন?’

‘আমি বলছি তাই।আমাকে নিয়ে সোজা হোটেলে যাবেন আর নয়ত আপনি বাসায় ফিরুন আমি নিজের ব্যবস্থা করতেছি’

‘বলবে তো কি হয়েছে!’

‘না বলবোনা।আমি আজ ফিরবোনা বাসায়।কাল সকালে ফিরবো’

বাপ্পি আর কিছু বলেনা। পুনরায় গাড়ী স্টার্ট করে।ঢাকায় পৌঁছে তটিনির কথামতন সে একটা হোটেলে আসে।মাকে ফোন করে জানায় আজ এখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টি বলে রাতটা তারা এখানেই থাকবে।ওদিকে আসিফ,রিনি,ঐশী,তটিনির বাবা মা সকলে এসে গেছে।আর তাই ওরা দুজন আসবেনা বলে সকলেই আশাহত হলেন।
বাপ্পি কাউকে বলে নাই তটিনির কারণে তার আসা ক্যানসেল হয়েছে।তটিনি হোটেলের রুমে এসে এক কোণায় বসে আছে সোফায়।কোনো কথা বলছেনা।বাপ্পি এতটা পথ ড্রাইভ করে এসেছে বলে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানায়।গা টা এলিয়ে দিতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিলো ওর।তটিনি ফ্রি হয়ে ফোন নিয়ে ঐশীকে কল দেয়।ঐশী কলটা রিসিভ করেই চেঁচামেচি শুরু করে। তারা কেন আজ আসেনি।কত অপেক্ষা করছে সবাই।পার্টিটা কি বেশি জরুরি হয়ে গেলো!’

তটিনি শুধু জানতে চায় আসিফ রিনি এসেছে কিনা।ঐশী জানায় তারাও এসেছে।এটা শুনেই তটিনি ফোন রেখে দিলো।
মূলত ওদের সামনে যেতে চায়না বলেই সে আজ বাসায় ফেরেনি।ওদের একসাথে দেখলে ওর মনটা আবার খারাপ হয়ে যাবে আর তার রিয়েকশান দেখাবে বাপ্পিকে।যেটা সে চায়না।
—-
বাপ্পি যখন চোখ খুললো তখন বাজে রাতের বারোটা পঞ্চাশ।একটার কাছাকাছি। পেটের খুধায় জেগে গেছে সে।লাফ দিয়ে উঠে বসে সবার আগে তটিনির কথা মাথায় আসলো।কারণ তটিনিও না খেয়ে আছে।হন্তদন্ত করে রুমের আলো জ্বালালো সে।আলোতে স্পষ্ট হয় তটিনি।সে বাপ্পির পাশে গুটিশুটি দিয়ে চোখ বন্ধ রেখে শুয়ে ছিল।বাপ্পি ওকে না জাগিয়ে ফোন নেয় খাবার অর্ডার দেয়ার জন্য তখন তটিনি চোখ মেলে বলে,’ওখানের মিনি ফ্রিজটা থেকে চকলেট আইসক্রিম নিয়ে খেয়েছি।খিধে নেই আমার।আপনি শুধু নিজের জন্য অর্ডার দিন।’
——-
ঐশী, আসিফ আর রিনিকে জোর করে বাপ্পির মা রেখে দিয়েছেন বাসায়।এটা নাকি নিয়ম।বউয়ের বাড়ির কেউ ১মবার আসলে তাদের রেখে দিতে হয়।তটিনির বাবা মা চলে গেছিলেন।বকুল আপুর রুমে রিনি আর আসিফকে থাকতে দেয়া হলো।আর ঐশী থেকে গেলো বুশরার সাথে।
রিনি সবগুলো জিনিস ধরে ধরে দেখছে।এত বড়লোকের ছেলের সাথে তটিনির বিয়ে হইছে তাও সে মানিয়ে নিতে পারছেনা!!কি ভালবাসাটাই ছিল ওদের!
রিনি ইয়া বড় হা করে সব দেখছিল দেখে আসিফ টিটকারি করে বলে,’এই বাড়ির আর ছেলে নাই।নাহলে তোরে বিয়ে করাই দিতাম’

‘আঁর জামাই আছে।আরঁ আর বিয়া লাগদোনো।অজ্ঞার বালুপাসা হাইতেই আঁর জীবন যায় যায়…..’

আসিফ হেসে দিয়ে আবার পরক্ষণেই মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেলে।সে জানে আজ তটিনি কেন আসেনি।এতদূর জার্ণি করে কেউ অন্তত পার্টিতে যাবেনা।সে নিশ্চয় ইচ্ছে করে বাড়ি ফেরেনি,ওর সামনে পড়তে হবে বলে।
——-
তটিনি হাঁটু ভাঁজ করে খাটে হেলান দিয়ে বসে বসে বাপ্পির খাওয়া দেখছে।বাপ্পি অনেকবার ওকে খেতে ডেকেছে কিন্তু সে বলেছে সে খাবেনা।তটিনি খায়নি বলে বাপ্পি খাবার খুব কম খেয়ে হাত মুছে তটিনির সামনে এসে বসে।এরপর পা দুলাতে দুলাতে ওর হাতটা টেনে ধরে ওর দিকে ফিরে বলে,’জানিনা কেন!কি কারণে এতটা মন খারাপ করে রেখেছো!যদি বলতে তাহলে আমি সমাধান করে দিতে পারতাম’

‘আসিফ ভাইয়া…..’

‘বুঝেছি!ওরা হয়ত এতক্ষণে চলেও গেছে।কাল সকালে আমরা বাড়ি ফিরে যাবো কেমন?কাল কিন্তু অনুষ্ঠান আছে।এখন শুয়ে পড়ো।আমার কোনো অভিযোগ নেই।যদি আরও আগে বলতে তবে এত প্রশ্ন করতাম না’

বাপ্পি আলো নিভিয়ে আবারও শুয়ে পড়েছে।তটিনির চোখে ঘুম নেই।কাল যদি বৌভাত হয় ও!!তাহলে আসিফ রিনি আবার আসবে!
তার ভাল লাগছেনা এই একটা টপিক!কেন শেষ হয়না!সবসময় ওর সাথেই জড়িয়ে যায়!
হাতটা সরাতেই বাপ্পির হাতের স্পর্শ পেয়ে তটিনির চিন্তাটা বদলে গেলো।ওর হাতের সাথে হাত লাগায় সে আসিফ রিনির অধ্যায়টাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায়।অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। বাপ্পির কি দোষ!বারবার এক কথাই মাথায় আসে।আসলেই ওর কি দোষ!সে তো বিয়েতে শুরুর দিকে জোরাজুরি করলেও পরে সে ঠিকই সব সিদ্ধান্ত তটিনির উপর ছেড়ে দিয়েছিল।বিয়েটা তটিনি নিজের মতেই করেছে!
হয়ত মত না,জেদের বশে!

ভাবতে ভাবতেই তটিনি বাপ্পির আঙ্গুলটাকে ফোনের আলো দিয়ে দেখছিল।বাপ্পিকে নিয়ে ভাবলে আসিফের কথা একবারও মনে আসেনা তার।বাপ্পি বেশ ভাল বুঝতে পারছিল তটিনি এবার তার আঙুল নিয়ে গবেষণায় মেতেছে।তাই সে এক পলকেই তটিনির হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো।এমন ভাবে ধরলো, আগামীকাল ছাড়া আর ছাড়বেনা। চোখটাও বন্ধ!
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here