তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৩৭

0
177

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৩৭
লেখনীতে-আফনান লারা
.
বাপ্পির ক্লান্ত চোখজোড়া দেখে তটিনির সব রাগ মুছে গেলো।হাত বাড়িয়ে ওর পরিশ্রান্ত মুখ ছুঁয়ে দেখছে তটিনি।বাপ্পি অবাক হয়ে শুধু তটিনির কাজ দেখে যাচ্ছে।

‘আপনি প্রতিদিন এমন দেরিতে আসেন?’

‘মাঝে মাঝে’

‘ আমাকে মিস করেছিলেন?’

‘সারাক্ষণ! আর তুমি?’

‘একটুও না’

এই বলে তটিনি বিছানায় এসে বসে বালিশ কোলে নিয়ে।বাপ্পি ও ওর পাশে বসে গালে হাত রেখে তার দিকে চেয়ে থেকে বললো,’বুনি যে বললো তুমি মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছো আমার জন্য?’

তটিনি লজ্জাবতীর মতন মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মন খারাপের কথা বুনি এভাবে বললো?নাকি উনি বানিয়ে বানিয়ে বলছেন?
তটিনিকে চুপ করে থাকতে দেখে বাপ্পি একটু কাছে ঘেঁষে বসে বলে, ‘আমার অফিসের কাছে একটা ১২তলার দালান আছে।কোম্পানির নিজস্ব সেই দালানটি।আজ বস থেকে শুনলাম আমাদের সবাইকে একটি করে ফ্ল্যাট দেয়া হবে।যতদিন কাজ করবো ততদিনের জন্য।ভাবছি বউ নিয়ে সেখানে সেটেল হয়ে যাবো।তখন দিনে একবার নয় চৌদ্দবার দেখা হতে পারে’

তটিনি হা করে তাকিয়ে আছে।বাপ্পি কি তার মন গলাতে এইসব বলছে!
বাপ্পি তটিনিকে অবাক হতে দেখে আবার বললো,’তুমি জানলে অবাক হবে!বাবা নিজেও একটা ফ্ল্যাট পাচ্ছে!’

‘এত খরচ কেন করবে কোম্পানি?’

‘তাদের লাভ আছে।আর সেটা হলো আমাদের বেতন কাটবে’

‘তো যাবেন?’

‘আমি যাবো এটা সিওর।কারণ এতদূর থেকে অফিস যাওয়া আসাতে আমার সমস্যা হয়।আর তোমার তো আরও বেশি সমস্যা হয়!একদিক দিয়ে আমাকে দেখতে পারোনা অপর দিক দিয়ে আমাকে চোখে হারাও!’

তটিনি ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।বাপ্পি ওর পাশেই শুয়ে পড়ে বলে,’বাবা হয়ত যাবেনা!’

‘তো আমাদের আলাদা থাকা কি সবাই মানবে?’

‘আমরা আলাদা হবার কথা বাবাই বলেছে আমায়।সব সুযোগ সুবিধা দেখেই বাবা বলেছেন তটিনিকে নিয়ে থাকতে পারিস!’

‘তো আমি সেখানে গেলে কত টাইম দিতে পারবেন?’

‘ফ্ল্যাট থেকে অফিস দেখা যায়।তুমি বললে গ্লাসে গাল লাগিয়ে সারাদিন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবো!’

তটিনি ফিক করে হেসে ফেললো।ওকে হাসতে দেখে বাপ্পি হঠাৎ ওর হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের পাশে শুইয়ে দেয়।
তটিনি বাপ্পির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে বালিশে মাথা রেখে।বাপ্পি তটিনির মাথার চুলগুলোকে ধরে পিঠের পেছনে নিয়ে বললো,’ভাল লাগে!’

‘কি ভাল লাগে?’

‘এই পুরো মানুষটাকেই!’
———
রিনির মায়ের ভীষণ অসুখ।হঠাৎ হয়নি।কয়েকদিন ধরেই তিনি অসুস্থ। কিন্তু আজই অসুখটা বেশি হয়ে গেলো।রিনিকে তাই তার বাবা আর্জেন্ট আসতে বললেন।আসিফ তখন ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিচ্ছে।তাকে ফোন দিয়েও পাওয়া যাবেনা।এদিকে রিনির যাওয়া খুব দরকার।মা নাকি অনেক বেশি অসুস্থ। আসিফের পরীক্ষা শেষ হবে সেই বিকাল পাঁচটায়।আসতে আসতে ওর আরও এক দুই ঘন্টা লেগে যাবে।রিনি আর না ভেবে একাই চলে গেলো।যাবার সময় ঐশীর মাকে বলে গেলো তিনি যেহ আসিফকে সবটা খুলে বলেন।
রিনি চলে যাবার পর পুরো ঘরটা যেন তাদের শূন্য হয়ে গেছে।তটিনি যতগুলো বছর ছিল এ বাড়িতে সেও এতটা মাতিয়ে রাখতে পারেনি যতটা রিনি মাতিয়ে রেখোছিল।ঐশীর সাথে সাথে ওর মায়েরও মনটা খারাপ হলো।রিনি একা যেতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও ভাবছে তারা।এদিকে আসিফ রিনির একা যাওয়াকে কি চোখে দেখবে সেটাও ভাববার বিষয়।ওর স্ত্রীকে তো তাদের ভরসাতেই সে রেখে যায় প্রতিদিন!তটিনির বাবা অতটাও সুস্থ নন যে রিনিকে সাথে করে নোয়াখালী দিয়ে আসবেন।আসিফ সব বুঝলেই মঙ্গল!
———-
আসিফ বাড়ি ফিরে রিনির যাবার কথা শুনে রিনিকে কল দেয় বাড়িতে।সে ধরলোনা,এমন কি বাড়ির কেউই ধরছেনা।
আসিফের চিন্তায় পড়ায় মন বসছেনা।কাল বাদে পরশু তার আরেকটা পরীক্ষা আছে।
শেষে বাধ্য হয়ে তার বাবার নাম্বারেই কল দেয় সে।
বাবা যে সংবাদ জানালো তাতে আসিফের হাত পা সব নিথর হয়ে উঠলো।রিনির মা নাকি আধা ঘন্টা হলো মারা গেছেন।
এ কথা শুনে আসিফ আর দেরি করলোনা।দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

রিনি দুবার জ্ঞান হারিয়েছে।মা হারার শোকে কাতর সে।এটা কখনওই কল্পনাও করতে পারেনি, মা তাকে না বলে এভাবে হারিয়ে যাবে!
কি থেকে কি হয়ে গেলো!পাশে বাবা আর ভাই থাকলেও আসিফের অনুপস্থিতি তাকে আরও ভীষণ একা বোধ করাচ্ছে।বারবার সে আসিফকে খুঁজছে চারপাশে।তার নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে এখন।

মা কাল ও ঠিক ছিল।ওর সাথে কথাও বলেছিলেন!আর সেই মা আজ নেই!বিশ্বাস করতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়।

আসিফ যখন পৌঁছায় তখন রিনির মাকে কবর দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।রিনি মাটিতে বসে কাঁদছিল চিৎকার করে।কাঁদতে কাঁদতে তার গলা ফেটে গেছে।গলার স্বর বদলে গেছে।
আসিফ এসেই রিনির পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিলো।আসিফকে পেয়ে রিনির যেন কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।সে ওকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
আসিফের কথামতন তটিনির বাবা,মা,ঐশী এমন কি তটিনি আর বাপ্পি ও এসেছে এখানে।সবাই দূর থেকে ওদের দেখছিল। রিনি আবারও জ্ঞান হারায়।
সবার সামনো থেকে আসিফ ওকে কোলে তুলে ভেতরের রুমে নিয়ে আসে।

তটিনী রিনির মায়ের কবরটা দেখছিল।কবরে একটি গাছ লাগিয়ে দেয়া হলো।এরপর সবাই চলে গেছে।তটিনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে,দেখলো বাপ্পি পুকুর ঘাট থেকে।তাই উঠে এসে ওর হাত ধরে ওখান থেকে নিয়ে এসে বললো,’ওখানে সব পুরুষ মানুষ!তোমার থাকা ঠিক না’

তটিনি বাপ্পির দিকে তাকিয়ে থেকে ওর পিছু পিছু রিনিদের বাড়িতে ফিরে আসো।রিনির নাকি এখনও জ্ঞান ফেরেনি।আসিফ ডাক্তার আনতে ছুটেছে।
বাপ্পি, তটিনিকে আশেপাশের সব মানুষ দেখছিল আর গল্প গুজব করছিল। বাপ্পির গায়ে সাদা পাঞ্জাবি আর তটিনির গায়ে সাদা থ্রি পিস।দুজনকে এখানে থাকা সকলের চাইতে আলাদা দেখাচ্ছিল বলে সবার নজর ওদের উপরই ছিল

তটিনি রিনির পাশে এসে বসে।ওর মাথায় হাত বুলাতে যেতেই আসিফ একজন ডাক্তার নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়।সেটা দেখে তটিনি সরে দাঁড়ালো।
ডাক্তার দেখে জানালেন ভয়ের কিছু নেই।সব ঠিক হয়ে যাবে এই বলে কিছু ঔষুধ লিখে দিয়ে চলে গেছেন।আসিফ চিন্তিত হয়ে রিনির বাবার কাছে যাওয়া ধরতেই তটিনি ওকে আটকালো।ওর সামনে এসে বলল,’আপনি রিনির কাছে থাকুন!রিনির আপনাকে প্রয়োজন!আমি আঙ্কেলের কাছে যাচ্ছি’

এই বলে তটিনি বেরিয়ে আসলো রুম থেকে।তখন সে রিনির বাবাকে খুঁজতে গিয়ে বাপ্পির সাথে ধাক্কা খেলো আচমকা।বাপ্পি ওকে খুঁজতেই এদিকটায় আসছিল।

‘কি ব্যাপার!কই যাচ্ছিলে এত দ্রুত!’

‘রিনির বাবার খবর নেয়ার জন্য’

‘আমি দেখে আসলাম।শুয়ে আছেন।তার ও শরীর ও ভাল না’

তটিনি মাথা নাড়িয়ে চলে যাওয়া ধরতেই বাপ্পি ওর হাতটা আবার ধরে বলে,’একটা জায়গায় যাবে??

‘কোথায়?’

বাপ্পি কিছু না বলে তটিনিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে।মাটির কাঁচা পথ টা ধরে অনেকদূর চলে আসে দুজনে।এদিকে আসার পথে এই সুন্দর পথটা বাপ্পি দেখেছিল।মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল তটিনিকে নিয়ে একবার হলেও সে এখানে আসবে।তাই হলো। তটিনি তার চোখে দূর দূরান্ত অবধি সব সরষে ক্ষেত দেখছে।মুগ্ধতায় আরকে ক্ষেতের কিণারায় পা দুলিয়ে বসলো, তারপর বাপ্পির দিকে চেয়ে বললো,’আপনিও বসুন।গ্রামে আসলে এমন মাটি লাগেই গায়ে।এটা ব্যাপার না’

তটিনির আশ্বাসে বাপ্পি বসে ওর পাশে।হঠাৎ তটিনি বাপ্পির কাঁধে মাথা রেখে বলে,’জীবনসঙ্গী যেমনটাই হোক,দুঃসময়ে সবার আগে সেই মানুষটাই পাশে দাঁড়ায় তাই না?এই যে আসিফ ভাইয়ার রিনির প্রতি কেয়ারের কথা বাদ দিলাম।সে বাড়িতে আমার মন খারাপ ছিল বলেই তো আমায় এখানে নিয়ে আসলেন আপনি!

‘চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here