বেনেবউ #পর্ব_৫

0
370

#বেনেবউ
#পর্ব_৫
#তানজিলা_খাতুন_তানু

ইপ্সিতা নিরস মুখে বাড়ি ফিরে আসে, সামনের লড়াই গুলো আরো কঠিন হতে চলেছে সেটা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে।

বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া না করেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল, মা অনেকবার ডেকে যাবার পরেও দরজা খোলো নি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইপ্সিতার মা ইরা একা খেয়েই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওনার ব্ল্যাড প্রেসার, বেশিক্ষন না খেয়ে থাকতে পারেন না।

সন্ধ্যাবেলা,
– ‘মা আমি ছাদে যাচ্ছি, একটু ওইখানেই থাকব প্লিজ আমাকে ডাকাডাকি করবে না।’

ইপ্সিতা একটা মাদুর নিয়ে ছাদে চলে যায়। ইপ্সিতার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ভালো করেই বুঝতে পারলেন মেয়েটা কোনো কারনে প্রচন্ড রকমের ডিপ্রেশড আছে তাই কথা বাড়ালেন না।

ইপ্সিতা ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়ল। খোলা আকাশের নীচে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিলো, বন্ধঘরে দমব’ন্ধ হয়ে আসছিল। ছাদে এসে সময় কাটানো নিভ্রের রোজকার নেশা, প্রতিদিনের মতো আজকেও ছাদে আসলো। ছাদের মাঝখানে কাউকে বসে থাকতে দেখে প্রথমে একটু ভয় পেয়ে যায়, বলা তো যায় না জ্বিন,ভূত এসে বসে আছে। বুকে সাহস নিয়ে আর একটু এগিয়ে এসে বুঝল একটা মেয়ে বসে আছে, এটা আবার পেত্মী নয় তো?

কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে ইপ্সিতা পেছনে ফিরে তাকালো, চাঁদের আলোয় নিভ্রকে চিনতে একটু অসুবিধা হয়ে গেল।

– ‘কে?’
– ‘আমি নিভ্র। আপনি কি বেন, (কথাটা শেষ না করে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল) বাড়ি ওয়ালার মেয়ে?’
– ‘হুমম।’
– ‘তা এখন ছাদে কি করছেন?’
– ‘আপনি যা করতে এসেছেন আমিও তাই করতে এসেছি।’
– ‘আমি তো স্মোক করতে এসেছি তারমানে আপনিও কি?’

ইপ্সিতার ভ্রু কুঁচকে গেল‌‌। নেশা জিনিসটা ওর অপছন্দের বিষয়বস্তু। হালকা চাঁদের আলোয় ইপ্সিতার মুখের রিয়াকশন স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করে বলল,
– ‘মজা করলাম, আপনি আবার সিরিয়াস নিলেন নাকি।’
– ‘না।’
– ‘আচ্ছা আমি কি আপনার সাথে বসতে পারি?’
– ‘মানে?’
– ‘না মানে আপনিও একা আর আমিও তাই দুজনে যদি একটু আড্ডা দিতাম তো‌।’

কারোর মুখের উপরে না বলাটা একটু দৃষ্টিকটু দেখায়, ইপ্সিতা নিভ্রকে না বলতে পারল না অনুমতি দিয়ে দিলো।

নিভ্র টুকটাক প্রশ্ন করছে, ইপ্সিতা উত্তর দিচ্ছে। এইভাবেই বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়, ইপ্সিতা ফোন করার বাহানায় উঠে চলে রায়, বিষয়টি নিভ্র বুঝতে পারলেও তেমন কোনো পাত্তা দিলো না। ওহ খুব হ্যাপি ইপ্সিতার সাথে বেশ কিছুটা সময় পার করতে পেরে।

কেটে যায় কয়েকটা দিন। ইপ্সিতা আর নিভ্রের মাঝের সম্পর্কটা আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, যদিও সবটাই নিভ্রের কাজকর্ম। ইপ্সিতা এখনো পর্যন্ত নিভ্রের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। তবে দুজনকে প্রায় সময়েই একসাথে দেখা যায়, ছাদে একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলে, রাস্তায় গাড়ি ধরার জন্য আসার পর দুজনে একসাথে আসে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও ইপ্সিতা বের হচ্ছে তখনি পেছন থেকে নিভ্র ডেকে বলল,
– ‘এই ইপ্সিতা।’
– ‘জ্বি বলুন।’
– ‘আমার সাথে আসো, আমি স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিচ্ছি।’
– ‘থাক প্রয়োজন নেই আমি যেতে পারবো।’
– ‘আরে আসো না।’

নিভ্রের জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইপ্সিতা ওর সাথে বাইকে যায়। ওদের দুজনকে একসাথে যেতে দেখে পাড়ার এক কাকিমা বলে,
– ‘বাবাহ এদের দেখি এতদূর গড়িয়ে গেছে। ভাবিকে বিষয়টা জানাতে হচ্ছে।’

আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ থাকে যারা ওদের সমালোচনা করতে ব্যস্ত থাকে। অন্য জনের বাঁশ দেবার জন্য রেডি হয়ে থাকে, অসহ্য মানুষজন।

নিভ্রের মা রান্না শেষ করে ঘর গোছাচ্ছিলেন তখনি কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখলেন এক প্রতিবেশী এসেছে।

– ‘আরে দিদি আপনি। ভেতরে আসুন।’
– ‘হ্যাঁ দিদি একটা কথা বলতে এলাম।’
– ‘কি কথা?’
– ‘বলি দিদি নিজের ছেলেকে সামলে রাখুন নাহলে কিন্তু আপনার সর্বনা’শ হবে।’
– ‘কেন?’
– ‘আরে দিদি আপনার ছেলেকে তো কয়েকদিন ধরে দেখছি ওই ইপ্সিতার সাথে মেলামেশা শুরু করেছে।’
– ‘তাতে ক্ষতি কি?’
– ‘দিদি আপনার কি বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আপনি কি ভুলে গেছেন ওই ইপ্সিতা তো ধ’র্ষি’তা। নিজের ছেলেকে ওই মুখপু’ড়ির কাছ থেকে দূরে রাখুন।’

নিভ্রের মায়ের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। কয়েকটা দিনে ইপ্সিতার সাথে উনিও অনেকটাই ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলেন ভুলেই গিয়েছিলেন বাড়িওয়ালার মেয়ে ধ’র্ষি’তা আর ওনার একটাই মেয়ে। ইপ্সিতা যে সেই মেয়ে হতে পারে এই কথাটা মাথাতেই আসেনি ওনার, এখন উনি কি করবেন? উনি তো নিজেও চেয়েছিলেন নিভ্রের সাথে ইপ্সিতার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়, মেয়ে যে ধ’র্ষি’তা। আর যাইহোক একটা ধ’র্ষি’তা মেয়েকে তো নিজের ছেলের বউ করতে পারেন না উনি।

***

নিভ্র ইপ্সিতাকে স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে বলল,
– ‘রাতে ছাদে দেখা হচ্ছে।’

ইপ্সিতা মুচকি হাসলো। ছেলেটার সাথে সময় কাটাতে ওর নিজেরও ভালো লাগে, তবে সেটা কখনোই নিভ্রের সমানে প্রকাশ করেনি। নিভ্র চলে যাবার পরেই ইপ্সিতার ফোনে ফোন আসে।

– ‘হ্যালো ম্যাম বলুন।’
– ‘ইপ্সিতা তোমাকে আজকে আসতে হবে না, আমি একটা কাজে বেড়িয়েছি বাড়িতে নেই।’
– ‘ওকে ম্যাম।’

ইপ্সিতা উল্টো পথে বাড়ি ফিরে আসে।

– ‘কিরে ফিরে আসলি যে?’
– ‘কাজ নেই। সরো আজকে আমি রান্না করবো।’
– ‘আচ্ছা কর।’

ইপ্সিতা রান্না করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইপ্সিতার মা মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করছেন, কত আশা বুনেছিলেন মেয়েটার একদিন সংসার হবে, ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন কিন্তু সেইগুলো কি আদৌও সম্ভব হবে! কে জানে।

ইপ্সিতা রান্না গুলো শেষ করে কিছুটা খাবার তুলে বলল,
– ‘মা এইটা আন্টিকে দিয়ে আসবে।’
– ‘তুই যা না, আমার পায়ে ব্যথা করছে।’
– ‘আচ্ছা।’

ইপ্সিতা নিজের হাতে রান্না করে নিভ্রের মায়ের দরজায় কড়া নাড়ল। ইপ্সিতা কে দেখে নিভ্রের মায়ের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, ইপ্সিতা একটু অবাক হয়ে বলল,
– ‘আন্টি তোমার শরীর কি ঠিক আছে, মুখটা এইরকম লাগছে কেন?’
– ‘তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’
– ‘কি বলো।’
– ‘তুমি আর এই বাড়িতে এসো না।’

ইপ্সিতা চমকে উঠল। পরক্ষনেই নিজের অতীত মনে পড়তেই মুখের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।

– ‘কেন, আমি ধ’র্ষি’তা বলে?’

নয়না বেগম ইপ্সিতার দিকে তাকাল, চোখে একরাশ অস্বস্তি বোধ। ওনার দৃষ্টি ইপ্সিতার ব্যথাকে আরো দ্বিগুন করে তুলল।

– ‘আমরা মানুষরা কি অদ্ভুত তাই না। মানূষকে আপন করে নিতেও দুইবার ভাবিনা আর দূরে ঠেলে দিতেও দূইবার ভাবি না। ঠিক আছে আপনি যখন চাননা তখন আমি আর আসবো না তবে একটা রিকুয়েস্ট।’

নয়না বেগম ইপ্সিতার মুখে আপনি ডাকটা শুনে চমকে উঠলেন। মেয়েটা তো ওকে তুমি বলতে হঠাৎ করেই আপনি ডাকছে কেন?

– ‘আপনার পছন্দের রান্না করেছিলাম, এটা কি নেবেন নাকি ধ’র্ষি’তার হাতে কিছু খাবেন না।’
– ‘খাবারট দিয়ে যাও।’
– ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

খাবারের জায়গাটা নেবার সময়ে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। নয়না বেগম খেয়াল করলেন ইপ্সিতার চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে, যেকোনো সময়েই পানি গড়িয়ে পড়বে। জায়গাটা ওনার হাতে দিয়েই ইপ্সিতা দৌড়ে নীচে চলে গেল। নয়না বেগমের মনে অনুশোচনা হলো, আচ্ছা মেয়েটাকে কি বেশিই আঘাত দিয়ে দেওয়া হলো? কিন্তু উনি কি করবেন, যাই হোক ওইরকম একটা মেয়েকে তো নিজের পরিবারের সাথে জুড়তে পারেন না।

ইপ্সিতা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করল। এতদিন এত মানুষের হাজারটা কটু কথা শুনেও যে কষ্টটা হয়নি আজকে নয়না বেগমের একটা কথাতে তার থেকে তিনগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কেন?

কয়েকদিনে মানুষটিকে বড্ড বেশি আপন করে নিয়েছিল, নিজের মায়ের চোখেই দেখত আর সেই মায়ের কাছ থেকেই এইরকম কথা শুনে ইপ্সিতার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কেন বারবার ওর সাথেই এইরকম হয়!

#চলবে…

গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here