#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২২
দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুন্ধরা। কেবিন জুড়ে বিরাজ করছে অদ্ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। এক নারীর বক্ষস্থলে লেপ্টে হৃদি। পেলব দু হাতে আলিঙ্গন করে নীরব ক্রন্দনে লিপ্ত। তার জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে মামীর আজ এ কি দুরবস্থা! স্বামী প্রদত্ত আঘাতের চিহ্ন সর্বত্র। মুখশ্রীতে এক আকাশসম আঁধারের হাতছানি। প্রিয় মানুষটির দেয়া আঘাত যে বড্ড যন্ত্রণাদায়ক! বুকের ভেতরটা ফালাফালা করে দেয়। কষ্টকর হয়ে পড়ে শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। জীবনের সমস্ত সুখ, খুশি হারিয়ে যায় অতল গহ্বরে। মামী কি করে সহ্য করছেন এই মনোবেদনা! কি করে! এ ভেবেই আরো আবেগী হয়ে পড়লো মেয়েটা। পল্লবী মমতাময়ী রূপে ওকে আগলে নিলেন। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ইরহাম পত্নী সুস্থ আছে। ভালো আছে। সমস্ত প্রশংসা মহান রবের। আজ যদি মেয়েটার কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতো উনি কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন? পারতেন ভাগ্নে বধূর দুর্দশা সহ্য করতে? নাহ্। পারতেন না। ওনার স্বামীর নোংরা হাতটিও যে জড়িত ওই অপরাধীদের সঙ্গে। জীবনভর কম অপরাধ করেনি মানুষটা। কখনো সে অপরাধের আঁচ উনি টের পেয়েছেন, কখনোবা ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তবুও স্বামীর থেকে দূরে থাকতে পারেননি। পারেননি তাকে অন্তর হতে ঘৃণা করতে। বড় বেশিই ভালোবাসেন কিনা। ভালোবাসা যেমন একজন মানুষকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়, তেমনিভাবে কাউকে গড়ে তোলে শক্তিশালী। উনি ভালোবেসে দুর্বল হয়েছেন। বারংবার মুখ থুবড়ে পড়েছেন। তাই তো অন্ধের মতো ভালোবেসে তার ভালোবাসার মানুষ, তার অর্ধাঙ্গকে বারবার সুযোগ দিয়েছেন শুধরে যাওয়ার। যা ছিল ওনার জীবনের মস্ত বড় ভুল। কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয় না, তেমনিভাবে জহির আহসান শুধরে যাওয়ার লোক নয়। তার শিরায় উপশিরায় বিরাজমান লো ভ। লা:লসা। ক্ষমতাশীল গদির প্রতি কুদৃষ্টি। এই লোভ-লালসা ই আজ ওনায় ধ্বং-স করে দিলো। সবটুকু হারিয়ে তার স্থান এখন জেলের অন্ধকার ঘর। মানুষটির কথা স্মরণ করে বেদনা মিশ্রিত শ্বাস ফেললেন পল্লবী। এতটা বোকা-আবেগী না হলেও পারতেন। হয়তো আরেকটু সুন্দর হতো জীবন।
হৃদি বিগত দু’দিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অজ্ঞাত ছিল মামীর দুরবস্থা সম্পর্কে। আজ ঘটনাক্রমে রাহিদ ও ইনায়ার কথোপকথন অনিচ্ছাকৃতভাবে শুনে ফেলে। তাতেই অন্তরে জেঁকে বসে অনুতাপ। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে ইনুর সহায়তায় ছুটে এলো এই কেবিনে। মামী শাশুড়ির কাছে। কি অবস্থা হয়েছে ওনার! প্রথম দিনে দেখা সে-ই নারীটি ইনি! অবিশ্বাস্য! প্রথম দর্শনে মামী শাশুড়ির কথাবার্তায় কেমন রূঢ় ভাব ছিল। ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় উপলব্ধি করতে পারলো পল্লবী মামী মোটেও খারাপ নন। ওনার অন্তরে লুকিয়ে এক কোমল সত্তা। কোনো কারণবশত উনি নিজেকে আড়ালে রাখেন। আজ স্বচক্ষে অবলোকন করলো ওনার অপ্রত্যাশিত এক রূপ। প্রতিবাদী রূপ। যে প্রতিবাদ ওনার শরীর হতে র ক্ত ঝড়িয়েছে। ওনায় চুরমার করে দিয়েছে। আজীবনের জন্য ডেকে এনেছে স্বামী হতে বিচ্ছেদ। সে-ই রূপ। বরাবরই আবেগপ্রবণ স্বভাবের হৃদি। আজও মামীর দুর্দশা সহ্য করতে পারলো না। নীরব রোদনে লিপ্ত হয়ে পড়লো। কেবিনে উপস্থিত তখন মালিহা এবং নাজরিন। ওনারা আবেগপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে। দেখছেন তাদের আদুরে মেয়েটির আবেগী রূপ। আকস্মিক সমস্ত নিস্তব্ধতা হটিয়ে কর্ণপাত হলো গমগমে এক কণ্ঠস্বর,
” আহা ম:রণ! ঢং দেইখা আর বাঁচি না। একজন গায়েব হইয়া পুরো গুষ্টিডারে শ্ম শা ন বানাই রাখছে। আরেকজন স্বামীর আহ্লাদ পাইয়া এইহানে ভর্তি। যুগে যুগে আর কত কি যে দেহা লাগবো! ”
জমিলা বানু কেবিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। নিজস্ব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন কড়া স্বরে। হৃদি ও পল্লবী প্রথমে চমকালেও আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। অনেক তো হলো। আর কত? অবশেষে মুখ খুললেন মালিহা। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললেন,
” দেখুন ফুপু। ওরা কেউই শখের বশে এখানে অ্যাডমিট হয়নি। আর যেমনটা আপনি ভেবেছিলেন তা কিন্তু সত্য নয়। রাতের আঁধারে হৃদি কারো সাথে পালিয়ে যায়নি। ওকে কি:ডন্যাপ করা হয়েছিল। আর ওই বডিগার্ড? তার ডে ড বডি পাওয়া গেছে গতকাল। নদীর পাড়ে। শেষে রইলো ভাবীর কথা? স্বামীর বিশ্বাসঘা:তকতার শিকার হয়ে সে এখানে ভর্তি। আপনি তো নিজের চোখে সবটা দেখলেন। এরপরও মনে হয় সবটা ওদের দোষে হয়েছে? নাহ্। এখানে ওরা দোষী নয় বরং ভিকটিম। ”
মেকি আহাজারি করে উঠলেন জমিলা বানু। ভেতরে প্রবেশ করে বড় গলায় বললেন,
” বাহ্ বউ! বাহ্! মুহে বড় বুলি ফুটছে তো? এজাজ জানে এইসব? তুমি কোন সাহসে আমার মুহের ওপর কথা কও? হাঁ? এই মাইয়ার লেইগা প্রতিবাদ? যতসব বাজা.. ”
আর বলতে দিলেন না মালিহা। নাজরিন অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে। পৌঢ়া মহিলা তাদের মেয়ে সম্পর্কে এসব কি বলছেন! মালিহা প্রতিবাদ করলেন,
” ফুপু প্লিজ। যে শব্দটা মুখে এনেছেন তা দয়া করে উচ্চারণ করবেন না। আমার ছেলে এখানে অনুপস্থিত। তাই বলে ওর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আপনি আমার ছেলের বউকে যা খুশি তাই বলবেন এমনটা আমি মোটেও সহ্য করবো না। এ কয়েকদিন অনেক কিছুই তো বললেন। আমরা শুনলাম। মুখ বুজে সবটা শুনলাম। আমি ফাঁকা বুলিতে নয় বরং প্রমাণে বিশ্বাসী।”
পুত্রবধূকে ইশারায় দেখিয়ে কাট কাট স্বরে,
” এই যে জলজ্যা:ন্ত প্রমাণ। আমার হৃদি মা। ও কোনো বাজে মেয়ে ছেলে না। আমার ছেলের জান। কোনো ঠ:গিনী নয়। আশা করি বুঝতে পেরেছেন? ”
একমাত্র জমিলা বানু ব্যতীত প্রত্যেকের মুখে তখন প্রসন্ন আভা। মালিহা কি দারুণ রূপে পুত্রবধূর হয়ে জ্বলে উঠলেন! প্রশংসনীয়! অভাবনীয় জবাবে জমিলা বানু তখন বাকরুদ্ধ। ক্ষিপ্ত নয়নে সকলের মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। অতঃপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গটগট করে পা ফেলে কেবিন হতে প্রস্থান করলেন। বেয়াদব মেয়েছেলের সাথে উনি মোটেও কথা বলতে ইচ্ছুক নন। হৃদি কৃতজ্ঞ চাহনিতে তাকালো শাশুড়ি মায়ের পানে। টলমলে আঁখি যুগল। মা ওকে অসম্মানিত হতে দেয়নি। প্রতিবাদ করেছে! মালিহা যেন চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলেন।
‘ আমার পা:গল ছেলেটার অনুপস্থিতিতে ওর অর্ধাঙ্গিনীর সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব এই মায়ের। ‘
.
ব্যস্ত নগরী। যানজটমুক্ত সড়কে ছুটে চলেছে একটি গাড়ি। পিছু ফেলে যাচ্ছে অসংখ্য দালান, যানবাহন, পথচারীদের আনাগোনা। শুভ্র রঙা গাড়ির পেছনের সিটে বসে গম্ভীরমুখো মানুষটি। কর্ণে ঠেকে মোবাইল। ওপাশ হতে শোনা যাচ্ছে অপরিচিত কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ,
” চৌধুরী সাহেব। বেশি লাফালাফি করবেন না। জানেন তো ডাঙ্গায় বসে কুমিরের সঙ্গে পাঙ্গা নেয়া নিতান্তই বোকামি। এখনো সময় আছে। কেস উইদ্রো করে নেন। ভুলে যাবেন না ওরা একেকজন রাঘব বোয়াল। ওদের ছোট্ট এক ইশারা। আপনার অস্তিত্ব ধূলোয় মিশে যাবে।”
কথাগুলো কেমন বিনোদনমূলক ছিল। অধরকোলে ফুটে উঠলো বক্র রেখা। জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ইরহাম। চলন্ত পথঘাটে চোখ স্থির রেখে হালকা রসিকতার স্বরে বললো,
” ভুল জায়গায় কল করে ফেলেছেন জনাব। চৌধুরীর কাছে রাঘব বোয়াল, চুনোপুঁটি বলে কিছু হয় না। সব মাছ একই। জলজ প্রাণী। জলের গভীরে হয়তো তারাই রাজা। কিন্তু একটুখানি ডাঙ্গায় এলে সমস্ত শক্তি ফুরুৎ। কাতরাতে কাতরাতে ম রে যায়। ”
” চৌধুরী! ” গম্ভীর অসন্তুষ্ট স্বরে নামটি উচ্চারণ করলো ওপাশে থাকা অজ্ঞাত ব্যক্তি।
” জ্বি। কেস উইদ্রো করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইনশাআল্লাহ্ শীঘ্রই দেখা হচ্ছে কোর্টে। যত চেষ্টা করার করতে থাকুন। ডাঙ্গায় এবার রাঘব বোয়ালের ম র ণ আসন্ন। রাখছি তবে। আসসালামু আলাইকুম। ”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো ইরহাম। ওপাশে থাকা লোকটির প্রতিক্রিয়া অজ্ঞাত ই রইলো। বোঝাই যাচ্ছে গ্ৰেফতারকৃত ছয়জনের মধ্যে কারোর শুভাকাঙ্ক্ষী এই ব্যক্তি। আইনি মা:রপ্যাঁচ হতে মুক্ত করার বহু চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। চৌধুরী যে এবার পুরোদমে মাঠে নেমেছে। খেলায় জয়লাভ ব্যতীত ক্ষ্যা”ন্ত হবে না সে। নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়বে প্রতিপক্ষকে। দেশের মাটিতে বসে অনেক তো দেশদ্রো:হী কর্মকাণ্ড হলো। এবার সময় হয়েছে পাপের বিনাশ করার। আস্তে ধীরে সমূলে উৎপাটিত হবে এই অপরাধী চক্র। ইনশাআল্লাহ্।
সম্মুখে ড্রাইভারের পাশে বসে সাহিল। পিছু ঘুরে ‘ভাই’ এর দিকে তাকালো। চিন্তা মিশ্রিত স্বরে শুধালো,
” ভাই সবটা ঠিকঠাকমতো হবে তো? ”
ভাবনায় ছেদ পড়লো। ওর পানে একঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ইরহাম। বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নীরস বদনে জবাব দিলো,
” সময় তার সঠিক উত্তর দেবে। ”
•
রৌদ্রময় এক মধ্যাহ্ন। নিজ ঘরে ব্যস্ত সময় পাড় করছে ইনায়া। ছোট্ট ব্যাগে গুছিয়ে রাখছে লাঞ্চ বক্স। শুধু আজ রাতটুকু। ইনশাআল্লাহ্ আগামীকাল বিকাল নাগাদ হাসপাতালের বন্দী জীবন হতে মুক্তি লাভ করবে ভাবী। তার মামী। দুঃখিত! শাশুড়ি মা। সম্পর্কের সমীকরণ এখন বদলে গেছে যে। মামাতো ভাই যখন বর। মামী তখন শাশু’মা। ফিক করে হেসে উঠলো মেয়েটা। কোনোমতে হাসি চেপে ব্যাগ গুছানোর ফাঁকে হাঁক ছাড়ল,
” অ্যাই তোমার হলো? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। ”
” আসছি। ”
ওয়াশরুম হতে সাড়া দিলো স্বামী। ইনায়া মুখ বাঁকালো।
” ওয়াশরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। একটু আগে নিজেই তাড়া দিচ্ছিল। আর এখন? এই হলো পুরুষ মানুষের খাসালত। নিজের দোষ, দোষ না। যত দোষ নন্দ ঘোষ। হুহ্! ”
সহসা বকবকানি থমকে গেল। পুরুষালি দু’টো হাতে আবদ্ধ হলো মেয়েটি। শিহরিত তনুমন। বৃদ্ধি পেল শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। কর্ণপাতায় ছুঁয়ে উষ্ণ শ্বাসের শিরশিরানি। ফিসফিসিয়ে শুধালো অর্ধাঙ্গ,
” রাগ হয়েছে সোনা? হুঁ? ঠিক আছে। আদরে আদরে রাগের প্রলেপ মুছে দিচ্ছি। ”
ইনায়া তখন একটু একটু করে গলে যাচ্ছে স্বামীর আর্দ্র ছোঁয়ায়। অপ্রত্যাশিত মুহুর্তে এমনতর হৃদয় নিংড়ানো পরশ! বহুল প্রতীক্ষিত এই মুহুর্ত। তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি আজ বাস্তব। হালাল পরিণতি পেয়েছে তার মনকাননে চুপিসারে গড়ে ওঠা প্রণয়। অজান্তেই ভিজে উঠলো অক্ষিকোল। বাহিরে যাওয়ার তাড়া ভুলে দু’জনে মগ্ন একে অপরেতে। শক্তপোক্ত দু হাত স্থাপিত পেলব উদরে। বেসামাল অধর ছুঁয়ে যাচ্ছে কাঁধ ও গলদেশের কোমল ত্বক। নিমীলিত ইনায়ার আঁখি পল্লব। নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে স্বামীর বাহুডোরে। অনুভব করতে লাগলো হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তটি। রাহিদ আপনমনে অর্ধাঙ্গীতে বিভোর। চকিতে কর্কশ ধ্বনিতে বিরক্ত করে বসলো মোবাইল নামক যান্ত্রিক ডিভাইসটি। ছিটকে দূরে সরে গেল দু’জন। আকস্মিক বিভ্রাটে বিরক্তের ছাপ চোখেমুখে। ঘন শ্বাস পড়ছে ছেলেটির। শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত। ইনায়া স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে। লালিমা লেপ্টে চোখেমুখে। অধরকোলে লাজুক রেখা। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের স্পর্শটুকু এখনো শিহরিত করে চলেছে তারে। বিরক্তিসূচক শব্দ করে বেডের কাছে গেল রাহিদ। হাতে নিলো মোবাইল। স্ক্রিনে প্রদর্শিত হচ্ছে রায়না কলিং। বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো সে,
” মনে হচ্ছে এদের চক্করে আমাকে নিরামিষ হয়েই ম;রতে হবে। ”
.
আজ থেকে বহু বছর পূর্বের কথা। সময়কাল ১৯৯৫। প্রথম প্রেমে দিওয়ানা হৃদয়। জহির ও পল্লবী নামের তরুণ তরুণী একে অপরের জন্য পা গ ল। ভালোবেসে করতে পারে জান কু:রবান। দু’জনার বয়সের পার্থক্য মাত্র তিনবছর। পল্লবী অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। সে জায়গায় জহির মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। স্বাভাবিক ভাবেই পল্লবীর পরিবার ওদের সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ। বাড়িতে এ নিয়ে বহু অশান্তি হলো। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন অন্যত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। তবে যদি প্রেম নামক ভূতটা মাথা থেকে বেরিয়ে আসে। দুর্ভাগ্যবশত তা হলো না। হিতে বিপরীত হলো। বিয়ের দিন পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে গৃহত্যাগী হলো পল্লবী। বাবা নামক মানুষটি সেদিন প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে চরম অপমানিত হলেন। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রইলেন এক সপ্তাহ। ভেতরকার অভিমান-রাগ তাকে বাধ্য করলো মেয়েকে ত্যাজ্য করতে। যে সম্পর্কের আরম্ভ পিতা-মাতাকে কষ্ট দিয়ে, সে সম্পর্ক খুব কম ক্ষেত্রেই সফলকাম হয়। আকাঙ্ক্ষিত সুখ লাভ করতে ব্যর্থ হয় সে-ই দম্পতি।
পালিয়ে ঢাকা এলো জহির, পল্লবী। পিছে ফেলে এলো সিলেটের মায়া-ভালোবাসা-মমতা। হাজির হলো তারা এজাজ মালিহার সংসারে। এজাজ সাহেব স্বাভাবিকভাবেই এমন আচরণে বিরোধিতা করলেন। তবে ধূর্ত বুদ্ধিসম্পন্ন জহির মিষ্টিমধুর কথায় তাকে ঠিক মানিয়ে নিলো। বোন, বোন জামাইয়ের উপস্থিতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো জহির, পল্লবী। ছোট্ট সংসার সাজালো স্বপ্নের শহরে। বছর কয়েক বাদে পৃথিবীর আলো দেখলো প্রথম সন্তান রাহিদ। সংসারে তখন সুখ আর সুখ। সুখে ম:রণ পল্লবীর। ধীরে ধীরে জহিরের আসল রূপ প্রকাশিত হতে লাগলো। লো:ভ, লা’লসা, এজাজ সাহেবের প্রতি বিশ্রী হিংসা আরো কত কি লুকিয়ে অন্তরে। ভদ্রলোকের বেশে সে এক অভদ্র। নোংরা পুরুষ। জহির বোন জামাইয়ের সহায়তায় ব্যবসা আরম্ভ করলেন। একটু একটু করে এগোচ্ছিল ব্যবসা। আর ধৈর্য হলো না। দ্রুত সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চাইলেন জহির। তাই তো সুযোগ বুঝে অবৈধ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। ফলস্বরূপ মুনাফা আর মুনাফা। সরল মনের এজাজ সাহেব টেরও পেলেন না শ্যালকের ভেতরকার কুৎসিত রূপ ঠিক কতটা জঘন্য। সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠেই চলেছেন জহির। হাতে এখন শোভা পায় হার্ড ড্রিঙ্কের স্বচ্ছ গ্লাস। একটু একটু করে পরনারীতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন উনি। ঘরের নারীকে আর মনে ধরে না। নিত্যনতুন নারীসঙ্গে চনমনে অন্তর। এভাবেই চলছিল দিন। স্বামীকে অন্ধবিশ্বাস করা পল্লবী যখন স্বামীর স্বরূপ টের পেলেন তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সংসার জীবনে পেরিয়েছে বহু বসন্ত। দুই সন্তানের জননী সে। বাবা তাকে ত্যাজ্য করেছে। একদিন বাবা-মাকে কাঁদিয়ে যে সংসার সাজিয়েছিল আজ সে সংসার তাঁকে কাঁদায়।
কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী পল্লবী পারলেন না স্বামীকে ত্যাগ করে দুই সন্তান নিয়ে চলে যেতে। পারলেন না সিঙ্গেল মাদার হয়ে বাকি জীবন কাটানোর মধ্যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে। তার ফলাফল আজ এই বিচ্ছেদ। জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত। এক ধাক্কা। যথাসময়ে যদি একটুখানি সাহসিকতার পরিচয় দিতেন আজ এই করুণ পরিণতি হতো না। ওনার সন্তানদের এতখানি দুঃখ সইতে হতো না।
একদিকে জীবন ও সংসার জীবন নিয়ে বেদনাবিধুর পল্লবী। অন্যদিকে জহির আহসান। লোহার শিকের ওপারে কাটছে দিন। যাচ্ছে রাত। কেমন তার প্রতিক্রিয়া? অনুভূতি? একটুও কি অনুতপ্ত সে?
চলবে.
[ ধীরে ধীরে সমস্ত অজানা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আজ হৃ’হামের মুহুর্ত ছিল না। আগামী পর্বে থাকছে তারা। পাঠকবৃন্দ আপনাদের আগেই জানিয়েছি, আমার অ্যাসাইনমেন্ট চলছে। এজন্য অনিয়মিত পর্ব আসছে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার সময়সীমা দশ তারিখ। ফলস্বরূপ শেষ মুহূর্তে লেখালেখিতে ব্যস্ত রয়েছি। এজন্য আগামী দু’দিন নতুন পর্ব আসবে না। ইনশাআল্লাহ্ দশ তারিখের পর হতে পূর্বের ন্যায় নিয়মিত পর্ব পাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে ধৈর্য ধরে পাশে থাকার জন্য। আসসালামু আলাইকুম। ]