ফুলকৌড়ি (১২) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
631

#ফুলকৌড়ি
(১২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নীহারিকা বেগম চোখ মোটামোটা করে ছোটো ছেলের দিকে চাইলেন।ইভানের এই একগাল ভুবনভুলানো হাসি মোটেও সুবিধার ঠেকছে না উনার কাছে।মোটামোটা চোখজোড়া হঠাৎই স্বাভাবিক হয়ে এলো উনার।নিটোল কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হলো।ভারী গলায় শুধালেন।

‘তুই ইন্ডাইরেক্টলি বলতে চাইছিস কৌড়িকে তোর পছন্দ হয়েছে।তুই তাকে বিয়ে করতে চাস?

‘ছিঃ মা এসব কি ভাবো,কি বলো।তোমার ঘরে এতবড় একখান সাবালক ছেলে থাকতে,তুমি এই নাবালক ছেলের দিকে নজর দাও কেনো!ইট’স নট ফেয়ার মা।আর কোনো মেয়েকে ভালো লাগলে বা পছন্দ হলে যে, তাকে শুধুই নিজের জন্য পছন্দ করতে হবে এটা তোমাকে কে বললো,আর কোথায় বা লেখা আছে শুনি?এজন্য তোমরা স্ত্রীগন বোঝার ক্ষেত্রে পুরুষের থেকে একধাপ এগিয়ে।এটাকেই বলে মাত্রা-অতিরিক্ত বোঝা।

ইভানের শেষ কথাগুলো শুনে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন নীহারিকা বেগম।তা মোটেও পাত্তা না দিয়ে বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো মুখের ভঙ্গিমা করে ইভান ফের বললো।

‘আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম,তোমার বড়ো ছেলের জন্য পারফেক্ট বউ হলো ফুলকৌড়ি।দেখতে,শুনতে শান্তশিষ্ট,নম্রভদ্র,কথাবার্তা,চালচলন,আদব লেহাজ।
যেসব গুনগুলো একটা মেয়ের মধ্যে থাকলে তোমরা মহিলাগন মনে করো তোমাদের ছেলের জন্য পারফেক্ট।মেয়ে দেখতে গেলেও তোমারা মহিলাগন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেসব গুনগুলো খুঁজে বের করতে থাকো।তার দুই একটা মিসিং হলেও,অধিকাংশ গুনই খুঁজে পাবে ফুলকৌড়ির মধ্যে।একদম বাড়ির পারফেক্ট বড়ো বউ।

নীহারিকা বেগমের মনহলো তিনি মেয়ে দেখতে এসেছেন আর মেয়ের বাপ ভাই,মেয়েকে পার করার জন্য তার গুনগান গেয়ে চলেছে।আশ্চর্য হতে গিয়েও নিরাস হলেন তিনি।এটা উনার ছোটো ছেলে ইভান।যে, কোনো বিষয়ে কখনো সিরিয়াস নয়।হাতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে রান্নায় মনোযোগ দিলেন তিনি।ইভানের অযথা কথায় মনােবেশিত করতে চাইলেন-না।সেটা বুঝতে পেরে ইভান ফের খোঁচালো।

‘ও আম্মু,শুনছো আমার কথা?

‘মেয়েটা অনেকটাই ছোটো।আজেবাজে কথা না বলে এখান থেকে যা।আমার কাজ আছে। তোর অযথা উল্টো পাল্টা কথা আমার এখন শুনতে মোটে-ও ইচ্ছে করছেনা ইভান।

‘আমি সিরিয়াস আম্মু।

‘সিরিয়াস নিজের জন্য হ।ওর জন্য না ভেবে তোরজন্য গিয়ে ভাব,যা।

‘আমার জন্য ভেবে রেখেছি তো।

অদ্ভুত নজরে আবারও ইভানের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।সেটা দেখে অপ্রস্তুত হাসলো ইভান।
নীহারিকা বেগম আবারও রান্নায় মনোবেশিত করলেন।
বুঝলেন ছেলে ফাজলামো করছে।তবুও কাটকাট গলায় বললেন।

‘কোনো উদ্ভট,উশৃংখল,মেয়েকে বাড়িতে বউ করে আনলে ,আমি কিন্তু কখনোই মানবো না।বলে দিলাম।

‘কেনো মানবেনা।সেই উশৃংখল উদ্ভট মেয়ের সাথে তোমার ছেলে সংসার করতে পারলে,তুমি কেনো মানবে না।তুমি শ্বাশুড়ি হবে,তোমার কাজ হলো সেই উশৃংখল উদ্ভট মেয়েটাকে কিকরে সুশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়।সংসারের কাজকর্ম করিয়ে তাকে কিভাবে নিজের আয়ত্তধীন করা যায়।আর সেখানে তোমার ছেলের কাজ হলো ,সেই উশৃংখল মেয়েটাকে শুধু ভালোবাসা, ভালোরাখা।তবে কেনো মানবে না তুমি?

ছেলের মুখের দিকে বিস্ময় নজর নিয়ে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলের মনেহয়, তিনি এরকম দজ্জাল শ্বাশুড়ি হয়ে,ছেলের বউ পরিচালনা করবেন।যে উনাকেই এরকম ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন,উনার ছেলে।আশ্চর্য!মায়ের বিস্ময় নজর পড়তে,বুঝতে,বিশেষ জ্ঞান অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়লোনা। সময়ও লাগলোনা ইভানের।মায়ের মুখের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে সে,একটু বেশিই বলে ফেলেছে।তাই কথা ঘুরাতে বললো।

‘আচ্ছা আমার প্রসঙ্গ বাদ দাও।তোমার নাবালক ছেলে সাবালক হতে অনেক বাকী।সে সাবালক হবে তারপর তো বিয়ে!সে এখানো হাজার বছর বাকী।যাই হোক যা বলছিলাম,সেটাতে মনোযোগ দাও।তুমি বলো তোমার ফুলকৌড়িকে পছন্দ নয়?

এরকম নজরকাঁড়া মেয়ে নজরে পড়তেই,মেয়ের চৌদ্দ গুষ্ঠির ডিটেইলস নিয়ে বংশবৃত্তান্তের গুনাগুন ভালো হলেই সেই প্রস্তাব নিভানের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি।বরাবরই ছেলেটা নাকচ করে এসেছে।আর কৌড়িকে তার মনে ধরবে,আর-ও মেয়েটার বয়স কম।কখনোই মানবে না নিভান।নিজে বয়সে পরিনত হওয়া সত্ত্বে-ও যখন বিয়ে করতে চাইছেনা,তখন অপরিণত একটা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেবে।জড়াবে নিজের জীবনে।কখনো মনেহয়না নীহারিকা বেগমের।
ছেলে,নিজে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শুধুই সুন্দরীর কাঙালি নয়,এটা তিনি বেশ বুঝেছেন।তবে বিয়ে করতে চাইছে না,এটাই উনার বুঁজে আসছেনা।দীবাকে কি খুব মনে ধরেছিলো ছেলেটার?সেই কারনেই কি বিয়ে করতে নাকচ সে?তাহলে কেনো দীবার বিষয়ে কথা এলেই এতো মহাবিরক্ত হয়।আর যদি দীবার বিষয়ে আপসেট নাই থেকে থাকবে তবে সেবার বিয়ে করতে রাজী হলেও,তারপর আর কেনো বিয়ে করতে রাজী হচ্ছেনা ছেলেটা?

‘কি হলো কথা বলছো না কেনো?

‘ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখেছিস,প্রস্তাব তার কাছ গিয়ে রাখ।আমাকে বলছিস কেনো?ছেলেরা বড়ো হয়ে গেলে কি আর মায়ের কথা শোনে,নাকি মানে?

‘ছেলে বড় হয়ে গেছে তো কি হয়েছে, কান চেপে ধরে কথা শোনাবে,মানবে না আবার।আর তোমার যা ছেলে আমার কথা শোনার জন্য বসে আছে।আমি প্রস্তাব রাখবো,আর সে নির্দ্বিধায় মেনে নেবে!তাহলেই হয়েছে।ঠিকই বলেছো,তোমার বড় ছেলেটা একটু অবাধ্য বেশিই।

চালন বলছে সুইয়ের।তোর পিছে কেনো একটি ছিদ্র! যেখানে তার নিজের পিছনে হাজার ছিদ্র, তার কোনো খোঁজনামা নেই।তেমনটা হয়েছে উনার ছোটো ছেলের।তবে কথা বাড়ালে,ইভানের অযথা বকবকানিতে মাথা ধরে যাবে উনার।তাই ইভানকে রান্নাঘর থেকে তাড়াতে বললেন।

‘আয় আগে তোর কান চেপে ধরি।

কথাটা বলে ইভানের দিকে এগোতেই সরে বসলো সে।থেমে গেলেন নীহারিকা বেগম। এমনিতেই ছেলে লম্বা। তারউপর বসে আছে উঁচুতে,ধরতে তো এমনিতেই পারবেন না।সহসা শুধু তেড়ে এলেন।ফের সরে রান্নায় মনোযোগ দিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বকতে থাকলেন।

‘সারাদিন কাজকর্ম নেই,শুধু আবোলতাবোল ভাবনা।আর এরওর পিছে লেগে থাকা।সকালবেলা কতো করে বললাম, ওদের সাথে একটু যা,গেলিনা।মেয়েটা বাড়ি থেকে অসুস্থ অথচ আমাকে জানালো না,তা হলে কি কখনোই আমি যেতে দিতাম।সেই অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে নিয়ে ,রাস্তায় গিয়ে বমি-টমি করে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে।না পেরে তাকে অফিসে রেখে ওরা জিনিসপত্র কিনেছে।দেখলি মেয়েটা অসুস্থ, তাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসবি।নাহ,মার্কেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে যখন সেই অসুস্থ মেয়েটাকে ফেলে রেখে চলে গেলো ওরা।অফিসে গিয়েও নাকি বমি করেছে মেয়েটা।তখন বাড়িতে ফিরলো চোখমুখের কি নাজেহাল অবস্থা।সারাদিন এরকম আজুড়ে কথাকাজ না ভেবে,একটু তো বাড়ির বিভিন্ন কাজকামের দিকে খেয়াল দেওয়া যায়।নাহ…তা না করে সারাদিন মাথায় আজুড়ে চিন্তা নিয়ে ঘুরা।

‘অফিসে বমিটমি করে দিলো অথচ তোমার সাংঘাতিক ছেলে কিছু বললো না?

আশ্চর্য হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ইভান।নীহারিকা বেগম এবার অতিষ্ট হয়ে গেলেন।এতো কথা শোনালেন তবুও এই ছেলের কানে ঢুকলোই না।এ কেমন ইতুড়ে ছেলে হয়েছে উনার।দিনদিন ইতুড়েপনা বাড়ছে বৈ কমছেইনা।এবার কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন।

‘ইভান,এখান থেকে যা।আর একটা উল্টোপাল্টা বকলে কিন্তু সত্যিই ভালো হবেনা বল দিলাম।

মায়ের শান্ত মেজাজ বেশ কায়দা মতো বিগড়ে দিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারলো ইভান।আর রাগানোটা ঠিক হবেনা ভেবে,কেবিনেট থেকে নেমে দাঁড়ালো সে।বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ফের দাড়িয়ে পড়লো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।

‘আমি ফাজলামো করে বলছিনা মা।আমি সিরিয়াসলি বলছি,দাদা-ভাইয়ের জন্য ফুলকৌড়িকে আমার ভিষণ পছন্দনীয়।মেয়েটার গুনাগুন তোমার মতো।তাই বলছিলাম।আমার কথা ফাজলামো মনে হলে-ও, তুমি মেয়েটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নাহয় একটু ভেবে দেখো।

চলে গেলো ইভান।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।একটা মানুষের বলাচলা একদিন দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা কেমন।সেই হিসাবে তিনি কৌড়ি দেখছেন,প্রায় মাসের কাছাকাছি সময়। নিঃসন্দেহে মেয়েটা খুবই ভালো।মনে ধরার মতোন।তবে উনার মনে ধরলে তো আর হবেনা।ছেলের ও মনে ধরতে হবে।আর এরকম দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ মেয়ের প্রস্তাব তো এ-র আগেও ছেলের সামনে উপস্থাপন করেছেন তিনি।মনে ধরেছে কই ছেলের। সেখানে কি কৌড়িকে মন ধরবে তার?মন হয়না নীহারিকা বেগমের।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি।ইভান সিরিয়াসলি বললেও এবার তিনিই সিরিয়াসলি নিলেন না।

সকালবেলা খাবার খাচ্ছিলো কৌড়ি।আজ থেকে তার কলেজে যাওয়ার কথা থাকলেও বড়মা তাকে যেতে দিলেন না।কাল অসুস্থ হয়ে পড়ায়,আজও শরীরটা দূর্বল।অতিরিক্ত ঘুমে চোখমুখ ফুলেফেঁপে মুখটা ঢোল হয়ে আছে।মায়ের নজর,সেটা দেখে বড়মা তাকে আর কলেজে যেতে দিলেন না।বললেন,আরও একটা দিন কলেজে না গেলে কিছুই হবেনা।কিন্তু শরীর খারাপ হলে সবকিছুই বৃথা।তাই আর যাওয়া হয়নি।সত্যিই শরীর ভালো না থাকলে কিছুই ভালো লাগেনা। তার-ও যেতে ইচ্ছে করেনি।

‘কি ফুলকৌড়ি,কাল থেকে তোমার দেখা-সেখা নেই?ব্যাপার স্যাপার কি বলোতো একটু শুনি।শুনালাম,বমি-টমি করে দাদাভাইয়ের অফিস ভাসিয়ে দিয়ে এসেছো। ভালোই করেছো,তাকে জ্বালানোর লোক নেই।তুমি একটু জ্বালিয়ে এসে ভালোই করেছো।তবে ইচ্ছে করে ভাসিয়েছো নাকি দাদাভাইয়ের ভয়ে?কোনটা?

ডায়নিং টেবিলে বসতে বসতে কথাগুলো বললো ইভান।শেষের কথাগুলো গালে হাত চেপে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।এতোসময় মাথা নিচু করে খেলেও এবার মাথা উঁচু করলো কৌড়ি।এতোদিন এই লোকটাকে সে ভালোভাবে চিনে ফেলেছে,এবাড়ির সবার পিছু লেগে থাকা হচ্ছে এই লোকটার কাজ।আর তার পিছনে এক্সট্রা গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে এই লোকটার আরও বড় মহাকাজ।বরাবরের মতো কণ্ঠের কোমলতা বজায় রেখে কৌড়ি বললো।

‘কেউ ইচ্ছে করে বমি করতে পারে?আমি ইচ্ছে করে করেছি বলে আপনার মনে হয়?

‘দারুন যুক্তি।তবে কি বরাবরই মতো দাদাভাইয়ের ভয়ে করে ফেলেছো?

এবার মুখটা ছোটো করে ফেললো কৌড়ি।এখন তাকে কালকের ঘটে যাওয়া বিব্রতকর পরিস্থিতির বর্ননা দিতে হবে!যদিও মানুষটাকে সে ভয় পায়।তাই বলে ভয়ে তো সে করেনি,পরিস্থিতিতে পড়ে করতে বাধ্য হয়েছে।তবে ইভানকে সে বর্ননা দিতে চাইলোনা।নাহলে লোকটা আরও ক্ষেপাবে।কৌড়ির মনে কথা তো আর ইভান বুঝলো না,সে তার স্বভাবমতো অমায়িক হেসে বললো।

‘তোমার ভয় কাটানোর একটা দারুণ আইডিয়া পেয়েছি ফুলকৌড়ি।তবে খাওয়া শেষ করে নাও,না-হলে দাদাভাই তোমার সামনে না থাকস সত্ত্বেও তুমি বিষম খাবে।এবং সেই বিষম না ছাড়ার সম্ভাবনায় বেশি।

একটা মানুষের দূর্বল বিষয় পেলে হয়।এই ছেলে সেটা নিয়ে তার পিছনে ইতুড়ের মতো লেগে থাকে।এখন আবার,তার ওই ইতুড়ে মাথা থেকে কি আইডিয়া বের করলো, কে জানে?

‘কি হলো,তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।নাকি বলবো?

‘বলুন।

তাহলে গালে ভাত, পানি কিছুই দিওনা।না-হলে আমার ভাবা আইডিয়া শুনে সত্যিই তোমার বিষম লাগতে পারে।

এবার অসন্তুষ্ট মুখে ইভানের দিকে তাকালো কৌড়ি।তা দেখে হেসে ফেললো ইভান।বললোে–আচ্ছা তুমি যখন শুনতে আগ্রহী তবে বলি।তবে বিষম-ফিষম খেলে কিন্তু আমার দোষনা।দোষ না তো?

না চাইতেও মাথা নাড়িয়ে না সম্মতি জানাতে হলো কৌড়িকে।কৌড়ির মাথা নাড়ানো দেখেই ইভান বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ন্যায় বলতে শুরু করলো—আমি ভেবে দেখালাম,যে জিনিসটাতে আমাদের ভয় বেশি। সেই জিনিসটার কাছাকাছি থাকলে আমাদের ভয় ততোটাও করেনা।যেমন মনেকরো,কাল তোমাকে বাধ্য হয়ে দাদাভাইয়ের কাছে থাকতে হয়েছে।যতোটা ভয় তুমি দাদাভাইকে দূর থেকে পাও,কাছাকাছি গিয়ে ততোটা অনুভব করেছিলে?

কৌড়ি কি বলবে বুঝে পেলোনা।কি বলতে চাইছে সামনে বসা ছেলেটা সেটাও বুঁজে আসলোনা তার।তবে সত্যি বলতে দূর থেকে মানুষটাকে যতোটা ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়েছিলো, মানুষটা ততোটাও না।আর ভয়টাও সেভাবে অনুভব করেনি।বরং মানুষটা সবদিক দিয়ে ভিষন কেয়ারিং বলেও মনেহলো তার।তাই ইভানের ভিতরে কি চলছে,সেটা না বুঝে নিজে যা বুঝলো সেই ভিত্তিতে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্থাৎ সে ততোটাও ভয় অনুভব করেনি। সেটা দেখে ইভান জেনো যুদ্ধ জয়লাভ করলো,এমনভাবে খুশি হলো।তা দেখে প্রশ্নে কপাল কুঁচকে গেলেও কিছু বললোনা কৌড়ি।

‘পাওনি তাইতো।তাই তোমার ভয় কাটানোর উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে দাদাভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে যাওয়া।অর্থাৎ দাদাভাইকে বিয়ে করে দাদাভাইয়ের বউ হয়ে থেকে যাওয়া।তোমার ভয় কাটানোর দারূন আইডিয়া না বলো?

হতবাক,আশ্চর্য,বিস্ময়,অবাক কোনটা হলো না কৌড়ি। সব অনুভূতি মিলিয়ে ইভানের দিকে মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো।বিষম লাগার থেকে-ও বাজে অবস্থা হয়ে গেছে তার।সে, বাঘ ভাল্লুক সিংহ,এরকম হাজারও প্রানী বাদে কতশত মানুষকেও ভয় পায়।তাই বলে তাকে ভয় কাটানোর জন্য,সেসকল প্রানিদের সাথে-ও বিয়ে করতে হবে!এটা কোনো কথা হলো।আর মানুষও খুঁজে পেলোনা।শিরশিরানি দিয়ে উঠলো সমস্ত শরীর।আজ একটুখানি মানুষটার আশেপাশে থেকেছে,তাই দম লেগে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।সংকোচে অশান্তি অশান্তি অনুভব হয়েছে তার।শুধু মনে হয়েছিলো,কখন মানুষটার থেকে ছুটকারা মিলবে তার।সেখানে এই ছেলে,ওই মানুষটার সাথে একেবারে থাকার বুদ্ধি দিয়ে বলছে,ভয় কাটানোর জন্য একটা গুড আইডিয়া বের করেছে!ইভানকে তার এবার পাগল মনেহলো।আর পাগলের আইডিয়া কোনোমতেও গ্রহনযোগ্য নয়।

‘বললে না-তো,কেমন আইডিয়া দিলাম তোমাকে?একেবারে ফাস্টক্লাস আইডিয়া না!

অসন্তুষ্ট গলায় কৌড়ি বললো–সবচেয়ে বাজে আইডিয়া।

ইভানের উচ্ছাস মুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো।বললো —কোন এঙ্গেলে তোমার মনেহলো আইডিয়া বাজে?দাদাভাই একটু গম্ভীর টাইপের মানুষ। কম কথা বলে। কিন্তু দাদাভাই কতো ভালো ছেলে তুমি জানো?আমার দেখা সেরা ছেলে আমার দাদাভাই।

‘আপনার দাদাভাই ভালো ছেলে হলেও আপনি মোটেই ভালো নন।

‘আরেহ দেবর হিসাবে আমি খারাপ হলে-ও তোমার চলবে।কিন্তু বর হিসাবে আমার দাদাভাইতো খারাপ নয় খুব গুড বয়।তবে তাকে কেনো রিজেক্ট করছো?দেবর হিসাবে ভালো না হওয়ায় আমাকে রিজেক্ট করো।সমস্যা নেই।কিন্তু তুমিতো বলছো দাদাভাই ভালো ছেলে তবে তাকে কেনো বর হিসাবে মানতে চাইছোনা?

কৌড়ির মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে নাজেহাল অবস্থা।নজর অসহায় হয়ে পড়লো।কি বলবে খুঁজে পেলোনা।আশেপাশে নজর দিলো,নীহারিকা বেগমকে এদিকে আসতে দেখে,আশা নিয়ে উনার দিকেই চেয়ে রইলো সে।কাছে আসতেই কৌড়ির চাহুনি দেখে ডায়নিং টেবিলের পাশে থেমে গেলেন তিনি।ইভানকে ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকতে দেখে খটকা বাড়লো।বললেন।

‘তুই নিশ্চয় আবোলতাবোল বলে ওর খাওয়া বন্ধ করে রেখেছিস?আল্লাহ,ইভান তোর সারাদিন এগুলো করতে ভালো লাগে?বড় হয়েছিস অথচ অবুঝপনা বাড়লো বৈ কমলোই না।আর তুই?ভাত না খেয়ে ওর আলতুফালতু কথা গিলছিস কেনো?ও যেখানে থাকবে সেখানে একটাও থাকবিনা।বলেছিনা আমি।

কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে শেষের কথাগুলো বলতেই ইভান প্রতিবাদ জানালো—মা এটা কিন্তু মোটেই ঠিক না।আমি মোটেই আলতু ফালতু কথা বলছিলাম না।আমি ওকে ভালো আইডিয়া দিচ্ছিলাম।আমি সবসময় ফালতু কথা বলিনা।

‘কি আইডিয়া দিচ্ছিলি?

‘তোমার বড় ছেলের বউ হওয়ার।কিন্তু ও তোমার মতো রাজী হচ্ছে না।

মানেটা কি?এটা বড়মাকেও বলেছে।অসহায় নজরটা এবার ইভানের মুখের দিকে ফেললো কৌড়ি।সেটা দেখে ইভান ফিচাল হেসে বললো—তোমাকে আইডিয়া দেওয়ার আগে মায়ের সাথে তোমাকে তার বড় বউমা হওয়ার পরামর্শ করে নিয়েছি।তবে সবাই ওই একজায়গায় আঁটকে আছি,আমার গম্ভীর দাদাভাই।

মূহুর্তেই চোখ ঘুরিয়ে নীহারিকা বেগমের দিকে তাকালো কৌড়ি।এসব কি হচ্ছে, বলছে এই ছেলে।নিশ্চিত এই ছেলের মাথায় সমস্যা হয়েছে।নীহারিকা বেগমের দিকে তাকাতেই দেখলো,তিনি-ও নিরাশ ভঙ্গিমায় তারদিকে চেয়ে আছেন।হয়তো ছোটো ছেলের কান্ডতে তিনিও নিরাশিত।তেমনটা মুখেও বললেন।

ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে কৌড়ি।ও কথা বললে কানে তুলবিনা।চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে যা।

কথাগুলো বলে নীহারিকা বেগম চলে গেলেন।কৌড়ি মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।সেটা দেখে অসন্তুষ্ট গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে ইভান চেঁচিয়ে বললো।

‘এটা ঠিক নয় মা।এজন্য কারও ভালো করতে নেই।

কৌড়ির খিলখিলিয়ে হাসি পেলো।তবে পরিস্থিতি যা হাসলে সামনে বসা মানুষটাকে অসম্মান করা হবে তাই হাসি চেপে রেখে খাবারে মনোযোগ দিলো।

গোটা দেড় কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে এসে,বাড়ির গেটের সম্মুখীন হয়েই দাড়িয়ে পড়লো নিভান।গায়ের সাদা টিশার্টটা ঘামে ভিজে প্রায় জুবুথুবু।পেশিবহুল হাতদুটো দুহাটুতে ভরক দিয়ে মাথা নিচু করে নিয়ে শ্বাস ছেড়ে নিলো কয়েকবার।ফের মাথা উঁচু করে বাড়ির ভিতরের দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ একটা মায়াবী মুখের দেখা মিললো,বাড়ির গার্ডেন এরিয়ার বেঞ্চতে।হালকা গোালপী আর সাদা রঙের মিশ্রনে সাদামাটা একটা থ্রিপিস পরা।মাথায় ওড়না নেই।লম্বা বেনুনিটা,বসে থাকায় পিঠ বেয়ে জমিনে গিয়ে ঠিকেছে।মাথা নিচু করে একমনে কি জানো করে চলেছে মেয়েটা।আনমনে কদম বাড়ালো নিভান।যতো সামনে এগোলো ততো সেই স্নিগ্ধ মুখটা আর-ও স্নিগ্ধ দেখালো।

সকালের বাগানে ফোঁটা শতশত স্নিগ্ধ ফুলের মাঝে বসা মেয়েটার সকালের মায়বী রূপের স্নিগ্ধতা আজ শতশত ফুলের স্নিগ্ধতাকেও হার মানাচ্ছে।জীবন্ত একটা মায়াবী স্নিগ্ধ সাদা গোলাপ।একমনে মেয়েটা ফুল গেথে চলেছে।হাঁটা থেমে গেলো নিভানের।নজর স্থির রাখলো সেই জীবন্ত সাদা গোলাপের পানে।হঠাৎ কৌড়ির মনেহলো কেউ তাঁকে খুব খেয়ালি নজরে দেখছে।আশেপাশে নজর দিতেই দেখলো,কোথাও কেই নেই।তবে এরকম কেনো মনেহলো?বিশেষ ভাবলোনা কৌড়ি।আবারও মনোযোগ দিলো ফুল গাঁথুনিতে।আনমনে হেসে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো নিভান।দ্রতপায়ে ছাঁদে চলে গেলো, যাবার আগে রানি সাহেবাকে রান্নাঘরে দেখে কফির অর্ডারও দিয়ে গেলো।ছাঁদে এসে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো নিভান।নজর স্থির রাখলো সেই জীবন্ত সাদা গোলাপের পানে।কি হলো নিজের মন মস্তিষ্কের,ভেবে পেলো-না নিভান।তবে সকালের ওই বাগানভর্তি ফুলের মধ্যে বসা জীবন্ত গোলাপটা তার মন মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিয়েছে।তাকে দেখার নজরের তৃষ্ণা জেগেছে প্রবল।একই দৃশ্য_____মেয়েটা নিজের কোমল হাতদ্বারা একমনে ফুল গেঁথে চলেছে।

প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে।
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।

সকাল সকাল গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে কফির মগটা এনে রেলিঙের উপর রাখলো নিভান।কপাল একটু নয় অনেকখানি কুঁচকে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে চাইলো নিভান।ইভানের এরকম একটা গান গাওয়ার মানেটা কি?আর আজ ব্যাপার কি?বাহিরে দিগন্তে সূর্য উঠার আগেই তাদের বাড়ির সূর্যটা উঠে গেছে।যার সকাল হয় মধ্যেদুপুরে।সেই তিনি সূর্য উঠার আগেই দেখা দিলেন!

‘কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।মগটা ঠোঁটে ছুঁতেই সেই দূরপ্রান্তে বাগানে বসা মেয়েটার পানে নজর গেলো।অদ্ভুতভাবে নজরজোড়াকে টানছে মেয়েটা।এই মেয়ে চাইছেটা কি?হঠাৎই মন বলে উঠলো,মেয়েটা চাইছে কোথায়?চাইছে তো সে!হঠাৎ মস্তিষ্ক বলে উঠলো,সে কখন চাইলো!তবে কেনো মেয়েটা তাকে এতো অদ্ভুতভাবে টানছে?

‘এই ফুলকৌড়ি…

হঠাৎ ইভানের এমন ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো নিভান।মানেটা কি,মেয়েটাকে এভাবে ডাকার কি প্রয়োজন?কতোবড় ফাজিল ছেলে।তাকে যে অপ্রস্তুত ফেলার জন্য ফাযিলটা কাজটা করেছে বেশ বুঝলো নিভান।তবে অপ্রস্তুত তাকে দেখালো না।বরং নির্বিকার চাহুনিতে চেয়ে রইলো সেই দূরপ্রান্তের নারীটির দিকে।ইভানের ডাকে কৌড় উপরের দিকে চাইতেই নজর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তার।নজর ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই ইভান ফের বললো।

‘আজকে যা তোমাকে লাগছে-না!কুয়াশাচ্ছন্ন স্নিগ্ধময় সকালের স্নিগ্ধতম জীবন্ত ফুলকৌড়ি।বাগানের শত ফুল-ও আজ তোমার স্নিগ্ধতায় হার মেনে যাচ্ছে….

পছন্দের কফিটা হঠাৎই স্বাদহীন মনেহলো নিভানের।কেনো?কোনো উপকরণ তো কফিতে কম নেই,সবকিছু তো পরিমাপ মতোই।খুব মনোযোগ দিয়েও তো খাচ্ছিলো এতোসময়।তবে হঠাৎ কেনো বিস্বাদে পরিনত হলো?ভালো লাগছে না কেনো কফিটা আর খেতে!কফির মগটা ঠোঁটে চেপে থাকলেও,মগের ভিতরের অসমাপ্ত তরল পদার্থটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে আর কেনো গলাতে নামতে চাইছে-না?এতো বিস্বাদ!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here