ফুলকৌড়ি (৩০) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
714

#ফুলকৌড়ি
(৩০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো দীবার ফর্সা সুন্দর মুখাবয়ব।যতোটা রূঢ়ভাষায় তার কথার উত্তর নিভান দিলো, ততোটা রূঢ়ভাবে প্রশ্ন সে কৌড়িকে করেনি।তবে নিভানের উত্তরের ভাষা বলে দিচ্ছে কৌড়ির প্রতি নিভানের অনুভূতিরর জোর।প্রথম দেখায় নিভানের পাশাপাশি কৌড়িকে দেখায় যে শঙ্কা মনে সৃষ্টি হয়েছিলো দীবার। তা একটু একটু করে বাস্তবিত রূপ নিচ্ছে।আর নিভান সেই বাস্তবতায় কৌড়ির মাঝে ডুবে যাচ্ছে।আর তাকে দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত সরল চোখে তা দেখে যেতে হচ্ছে।এটা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক যদি বিয়ের আগে একটাবার অনুভব করতে পারতো।তবে কখনো নিভানকে ছাড়ার কথা ভাবতোনা।ভুলে-ও ভাবতো না।এখন একজনের স্ত্রী হয়ে নিছকই এই ভাবনা অবৈধ,হারাম।তবুও মন কেনো মানে না!কেনো মানতে চায় না!নিভানকে যে আর তারদিকে ফেরানো আর কখনো সম্ভব নয়।এটাও বেশ বুঝতে পারছে দীবা।আরও নিভান যে ধরনের ছেলে,দীবা যতোই ছলাকলা করুক আর যতোই তন্ত্রমন্ত্র পড়াক।নিভানকে সে তারদিকে কখনোই ফেরাতে পারবেনা।তবে কৌড়ির পাশাপাশি নিভানকে দেখলেই তার কি যেনো হয়ে যায়।যতোই নিজের মন আর যবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেনা কেনো, তারা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যায়।চায়না সে, নিজের বয়স আর স্বভাবের বাহিরে গিয়ে অস্বাভাবিক আচারন করতে তবু্ও করে ফেলে।দীবার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কৌড়ির মন খারাপ হলো।তারজন্য দীবাকে কথা শুনতে হলো!বিষয়টা মোটেই ভালো লাগলোনা তার।যদি-ও তাকে নিয়ে দীবার ইঙ্গিতসরূপ কথাগুলো তার মোটেও ভালো লাগেনি।তাই বলে তারজন্য কাউকে ছোটোবড় কথা শুনতে হবে!লজ্জিত হতে হবে!এটা কখনোই চায়না সে। শুধু দীবার জন্য নয়,কারও জন্য চায়না সে।মনেমনে ভাবলো নিভানকে কিছু বলবে।ভাবনা মতোই নিভানের দিকে তাকাতেই দেখলো,চোখমুখ শক্ত করে তারদিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা।মানুষটার চোখমুখের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে–এখানে আমার কথার উপরে একটা শব্দ-ও তুমি উচ্চারণ করে দেখো।তোমার খবর আছে।

যে কথাগুলো বলবে বলে মনেমনে সাজিয়েছিলো।ঠোঁট কেনো গলা অব্দি আসার আগেই কথাগুলো যেখান থেকেই গুছিয়ে নিয়ে আসছিলো সেখানেই মাটি চাপা দিয়ে ফেললো সে।সামনের মানুষটা মানেই আতঙ্ক,ভয়!সেই আতঙ্ক,ভয়,মানুষটার আচারনে কিছুটা কাটলে-ও পুরোটা কাটেনি।অদ্ভুত মানুষটার সাথে দুঃসাহসিক আচারন করার সাধ্যি তার কখনো হবে কি-না,সে জানে না।তবে যেটুকু কথার তর্ক সে মানুষটার কথার পরিবর্তে করে,তা মনে সাংঘাতিক ভয় রেখে।

‘এই তোরা এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?চল।ইভানদের ফোন দিয়েছি,আসছে ওরা।আরেহ নিভান তুই কখন এলি?কৌড়ি, তুমি-ও এসেছো?

অমায়িক হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,কৌড়ি দীবার দিকে একপলক তাকিয়ে উত্তর দিলো–ইভান ভাইয়া, জোর করে নিয়ে এসেছেন আমাকে।আমার মানা তিনি একটুও শোনেন নি।

‘ঠিক করেছে।বিয়ে বাড়ির আনন্দ বলে কথা।ভালো লাগবে-না আবার কেনো?যতোই শরীর খারাপ থাক,বিয়ের আনন্দ কেউ মিস করে?ইভান একদম ঠিক করেছে।আমার পক্ষ থেকে বিয়েতে ওর একটা এক্সট্রা গিফট পাওনা রইলো।

এবাড়িতে আসা একদিনের মধ্যে আমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা বেশ ভাব পাতিয়ে নিয়েছে কৌড়ির সাথে।বিশেষ করে নিভানের সেই আচারনে পর থেকে, ফুফুর কাছ থেকে মেয়েটা সম্পর্কে জেনে আরও নিজ থেকে ভাবটা জমিয়েছে।যদিও কৌড়ি এখনো সেভাবে মিশে উঠতে পারিনি।দুজনের কথায় মূহুর্তেই পরিবেশ আগের ন্যায় হলো।ঈশিতা ভিড় থেকে একটু দূরে গিয়েছিলো, ইভানদের আসতে বলার জন্য।বিধায় বিষয়টা সম্পর্কে সে আবগত নয়।কিন্তু অন্যন্য কাজিনেরা,কৌড়িকে নিয়ে নিভানের ব্যবহারে একটু আশ্চর্য হলো!বাহিরের মেয়েটাকে নিয়ে,দীবার সাথে রূঢ় আচরন!মনেমনে প্রশ্ন তৈরী করলো।তবে যাকে নিয়ে মনে প্রশ্ন তৈরী হলো,তাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা কারও নেই।বিধায় কেউ আর কিছু বললো না।তবে কৌড়ির পানে বাঁকা নজরে তাকাতেও ভুললো না তারা।কৌড়ি খেয়াল করলো বিষয়টা তবে কি করার আছে তার।নিভান-ও খেয়াল করলো,তবে বিশেষ গুরুত্ব দিলো-না।ইভানরা আসতেই,ঈশিতা গহনা আর শাড়ী কেনার জন্য তাড়া দিলো।সবাই গহনার দোকানের দিকে এগোলেও, ঈশিতাকে বলে নিভান অফিসে চলে গেলো।যদিও ঈশিতাসহ ইভান চেপে ধরেছে,কিছুতেই যেতে দেবেনা তাকে।তবে কাজ হলো না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তার।তবে যাবার আগে সবার চোখের আড়ালে কৌড়িকে হুমকিমূলক বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে যেতে ভুললো না।মান্যতার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে মিহিকন্ঠে বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।

‘ভালোমানুষি অপাত্রে দান কখনোই করবে-না।তুমি চাইলে-ও নিভানের,আর না চাইলেও নিভানের।যদি বলো,তোমার হ্যাঁ স্বীকারোক্তি না পাওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে জোর করছি।হ্যা জোর করছি আমি!তুমি হ্যাঁ না যাই বলো না কেনো, তুমি নিভানের।আর নিভান ভালোমানুষি কখনো অপাত্রে দান করা পছন্দ করে না।সো,বি এক্সট্রা কেয়ারফুল।নিজেকে সাবধানে রেখো,ভালো রাখার চেষ্টা করো।অসম্মানিত হওয়ার থেকে রক্ষা করো।না-হলে নিভানের কাছে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া লাগবে তোমাকে।তোমার ভালোর কৈফিয়ত না দেওয়া লাগলেও,অবশ্যই মন্দের কৈফিয়তটা দেওয়া লাগবেই।আর আমার উপরে দেখানো রাগে জেদে ভরা যে শরীরের মধ্যে ভালোমানুষি মনটা নিয়ে ঘুরছো।সে সবকিছু তোমার হলেও,আস্ত তুমিটা তোমার নও।তুমিটা আমার।আর নিভানের জিনিস নিভান কখনো হেলায়ফেলায় নষ্ট করে-না।কষ্ট পেতে দেয় না।অসম্মানিত হতে দেয়ন।সো মাথায় রেখো,কৌড়ি।আস্ত শরীরটা তোমার হলেও,তুমি তোমার নয়।

নিভান শান্ত পায়ে চলে গেলো।সেদিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলো কৌড়ি।নিজের ব্যথা লাগলে,কষ্ট পেলে,সেটাও কাউকে কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে!আশ্চর্য!নিজের সবকিছু অথচ সে নিজের নয়!সেটাই বলে গেলো মানুষটা!ঘোর কাটালো তার।নিভানের কথাগুলো একে একে ফের মন পড়তেই,মনের অদ্ভুত সুক্ষ এক ভালোলাগা সৃষ্টি হলো।পরোমূহর্তে কিছু একটা ভেবে মিলিয়ে গেলো সেই ভালোলাগা।নিভানের যাবার পানে তাকলো সে।জেদ নিয়ে মনেমনে আওড়ালো–কৌড়ি যা ইচ্ছে তাই করবে।আর কৈফিয়ত!বসে আছে সে,আপনাকে দেওয়ার জন্য।

দূরত্ব কদমে কদমে বাড়লেও যেনো কৌড়ির মনে কথা ঠিকই,শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো,এমনভাবে পিছে তাকালো নিভান।সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।সেটা দেখে মৃদু হেসে নিজের গন্তব্যে এগোলো নিভান।মান্যতা দু’জনের বিষয়টা লক্ষ্য করলো।নিভান চোখের আড়াল হতেই মান্যতা মজার ছলে মিহিকন্ঠে বললো।

‘দাদাভাই চুপিচুপি তোমায় কি বলে গেলো?

হঠাৎ কথায় পরাণ চমকিয়ে উঠলো কৌড়ির।পাশে ফিরে মান্যতার দুষ্ট হাসির মিষ্টি মুখটা দেখতেই নজর অসহায় করে ফেললো সে।অর্থাৎ এসব কথা তোমায় বলি কিকরে আপু?কৌড়ির মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেললো মান্যতা।ফের মজার বললো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, বড়ভাই আর বড়ভাবীর গোপনীয় কথা আমি শুনছি-না।তবুও মুখটা ওরকম করে রেখো-না।আমার দাদাভাই আবার কিন্তু প্রিয়জনদের বেচারা মুখ সহ্য করতে পারেনা।আরও তুমি তার.…

‘আপু।

এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলো মান্যতা। সেই হাসিতে কৌড়ির হৃদস্পন্দন দুরুদুরু হলো।সতর্ক নজর আশেপাশে ফেলতেই দেখলো,সবাই সামনে এগিয়ে গেছে।শুধু তারা দু’জনে পিছনে।হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো,এমনভাবে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।কৌড়ির হাল বুঝে হাসি থামিয়ে ফেললো মান্যতা।হাত বাড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় কৌড়ির হাতটা নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো।—জানো কৌড়ি,আমার গোটা লাইফে দাদাভাইকে আমি গম্ভীর স্বভাবের জেনে এসেছি।অবশ্যই দেখে এসেছিও তেমন।আমাদের সব ভাইবোন থেকে ভিন্ন,একদম আলাদা।তাকে হাসতে কম দেখেছি,সবার সাথে প্রাণখোলা মিশতে খুব কম দেখেছি।যেকোনো সম্পর্কে অনুভূতি খোলাখুলি প্রকাশ করতেও খুবই ক্ষীন দেখেছি।অথচ সবটাই কিন্তু দাদাভাইয়ের মধ্যে ভরপুর।কিন্তু সে দেখাতে পছন্দ করে-না আর দেখায়ও-না।তবে তোমার বেলায়,সেই দাদাভাইটা কেমন ভিন্ন।হয়তো এতোদিনে জেনে গিয়েছো এমনকি বুঝে গিয়েছো,দাদাভাই তোমাকে পছন্দ করে।তবে একটু আধটু পছন্দ নয়,একবারে নিজের বলে পছন্দ করে।আমিও বুঝেছি এবং দেখেছিও, তোমার প্রতি তার অনুভূতির প্রকাশভঙ্গী।খুবই কঠিন!দৃঢ় মনোবল স্বভাবের মানুষ হয়েও,যা সেও ভিতরে চেপে রাখতে পারেনা।দাদাভাইকে যেমনভাবে ছোটো থেকে এই-অব্দি দেখে এসেছি,বিশ্বাস করো কৌড়ি। আমার কাছেও এই দাদাভাইকে কেমন অবিশ্বাস্য এলোমেলো লেগেছে।কিছুতেই আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না,এ-কি আমার সেই দাদাভাই!গম্ভীর, কথা কম বলা,হাসতে কম পরা,মিশতে না পারা,অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম দাদাভাই!কতোখানি তীব্র সেই অনুভূতি বুঝতে পারছো।তোমাকে ভেঙে বলতে পারছি না হয়তো সেকারণেই আমার মতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছো না।তবে তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া।প্লিজ কৌড়ি,ওই মানুষটাকে কখনো বিমুখ করো-না।তোমাকে যদি সে নিজের একান্ত স্ত্রী রূপে চায়,তুমি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ভুল করো-না।তুমি চোখবুঁজে ওই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারো,ভরসা করতে পারো।তুমি কখনোই ঠকবে-না।আমার ভাই বলে বলছি না,তুমি ওই মানুষটাকে জানো না।জানলে,তুমিও ওই মানুষটাকে কখনোই তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে-ও না।

থামলো মান্যতা।কৌড়ির হতবিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো–তোমার সাথে আরও অনেক কথা আছে।বাড়িতে অনেক মানুষ।রাতে শোয়ার প্রবলেম হতে পারে।তুমি আমার কাছে ঘুমাবে।রাতে আমরা অনেক গল্প করবো।শুনবে না?

ঘোর কাটলো কৌড়ির।কিছু বলার আগেই, দূর থেকে মৌনতার কন্ঠ ভেসে এলো–এই আপু,তোরা আবার দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো।দেরী হয়ে যাচ্ছে তো, আয়।

মান্যতাও এবার তাড়া লাগিয়ে বললো–এই চলো,চলো।আমাদের রেখে ওরা না আবার শপিং সেরে ফেলে।

শপিংমল থেকে বের হয়ে গাড়িতেই বসতেই,কিছু একটা ভেবে ফোন হাতে নিলো নিভান।ফোন ওপেন করে ডায়ালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন লাগালো।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই নিভান শুধালো–তুই কোথায়?শপিংয়ে আসলি না যে?তন্ময়ীর সাথে তো তোরও আসার কথা ছিলো,তবে আসলি না কেনো?

‘আরেহ মেয়েদের শপিংয়ে আমি গিয়ে কি করবো।তাই যায়নি।আর এদিকে একটু কাজ ছিলো,বিধায় যেতে পারিনি।

তৃনয়ের স্বাভাবিক গলার কথাগুলো,কিছুতেই স্বাভাবিক লাগলোনা নিভানের।সে জানে তৃনয় কেনো আসিনি শপিংয়ে।নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।প্রসঙ্গ পাল্টে ফের শুধালো–আন্টির খবর কি?শরীর এখন কেমন? ভালো আছে কি?

‘শরীর তো ভালো আছে।তবে তনুর প্রতি মনেহয় একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।আম্মু বলতে চাইছেন,কিছু না ঘটলে কিছু রটে না।নিশ্চয় তন্ময়ী কিছু করেছে না-হলে হঠাৎ এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেলো কোথায়?অনকে বুঝিয়েছি তবুও মুখ থমথমে ভাব উনার।কথাও সেভাবে বলছেন না।এই আর কি।

নিভান কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো-না।ইভানের প্রতি রাগ উঠতে গিয়েই মন দূর্বল হয়ে পড়লো।ভেবে দেখলো,আজ যদি ইভানের সিচুয়েশনে সে পড়তো।তবে কি করতো?যাই করতো না কেনো,ইভানের মতো বোকামি সে করতোনা।ভাবনা ছেড়ে নিভান ফের শুধালো।

‘আন্টি কি ওই ছেলের জায়গায় ইভানকে মানতে পারছেন না?

আরেহ মা মানবে কি, সে নিজেই তো মানতে পারছেনা।কথাটা ঠোঁটের চৌধারে এনেও বলতে পারলোনা তৃনয়।ইভানের জন্য মান্যতাকে পাওয়া তার আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সে ভেবে রেখেছিলো,তন্ময়ীর বিয়ের পর একটা চান্স নেবে।তাতে যা হয়ে যায় হবে।তবে বিষয়টা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।বোনের ননদকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টা কি কেউ ভালো চোখে দেখবে?নাকি ভালো মনে মেনে নেবে?ওবাড়ির কেউ মানবে?নিভান মানবে?বোনটার কি তার কাজে শ্বশুরবাড়িতে অসম্মানিত হতে হবে না?এসব ভেবে ভেবে সে দিন পার করছে।এগুলো সে নিভানকে কি করে বলে!কিকরে বোঝায়।তবে নিভানের কথার উত্তর সরূপ বললো।

‘আরেহ না।মা কেনো মানতে পারবেনা।ইভান সবদিক থেকে পারফেক্ট ছেলে।আর তাকে মেয়ের জামাই হিসাবে চাইবেনা,এটা কিকরে হয়!এমনিতেই তন্ময়ীর উপর একটু মনখারাপ আছে বলে ওরকমটা করছে।

নিভান কিছু ভাবলো।ফের বললো–আমি অফিস শেষ করে তোর বাসায় আসছি।আন্টির সাথে আমার কথা আছে।রাখছি।

ফোন কাটতে গিয়েও তৃনয়ের প্রশ্ন থেমে গেলো নিভান–
‘আম্মুর সাথে কি কথা তোর?

‘তোর মতো গাধাকে বলবো কেনো?যে নিজের কাজটা সাহস নিয়ে ঠিকঠাক করে উঠতে পারেনা।তাকে বলে লাভ আছে?

‘এই আমি কি ঠিকঠাক করতে পারিনি?আমি পড়াশোনা থেকে শুরু করে যে কাজটায় উদ্যোগ নিয়েছি,সেটা পুরোপুরি সাহসের সহিত সাকসেসফুল করে এসেছি। তুই আমাকে নতুন চিনছিস?নাকি নতুন করে আমাকে চিনাতে হচ্ছে?

বোনকে সেধে অন্যের ঘাড়ে তো কখনো চাপাতে চায় না নিভান।তবে বন্ধুর মনের দোনোমোনোতাও বুঝতে অসুবিধা হলোনা।মনেমনে ভুগছে ছেলেটা, সেটাও বেশ কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো।তাই বললো।

‘নতুন করে চেনাতে,জানাতে হবেনা।তোকে চিনি, জানি বলেই বলছি।তবে ভেবে দেখ।সব ঠিকঠাক থাকলেও, জীবনে যে জিনসটা আঁকড়ে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত বাঁচতে হবে।সেই জিনিসটা তুই সাহসের সহিত নিজের করে নিতে পেরেছিস কি-না?আমার কনফিউশান সত্যিই তুই সেটা চাস কি-না?মনেপ্রানে চাইলে কি কেউ নিজের হৃদয়ে বসানো মানুষটা থেকে দূরে থাকতে পারে নাকি নিজেকে তার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারে?তবে আমি পারছি কৈ?আমার যে কৌড়িকে চাই।আমি

শব্দ করেই শ্বাস ফেললো নিভান।সেটা হতবাক হয়ে থাকা ওপাশের ছেলেটা-ও শুনতে পেলো।নিভান ফের বললো–রাখছি।রাতে দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।

উত্তর এলোনা।কল কেটে দিলো নিভান।অথচ ওপাশের ছেলেটা তখনো স্তব্ধ।নিভান তার কথাদ্বারা কি বোঝাতে চাইলো,নিজেও বুঝতে চাইলো?বিশেষ করে কৌড়িকে দিয়ে উদাহরণ দেওয়া শেষের কথাটা!তবে কি নিভান জানতে পেরেছে তার মনের কথা?কবে, কিভাবে, কখন?সে তো তার আচারন দ্বার কখনো বুঝতে দেয়নি তাকে।শুধু তাদের খুব ভালো বন্ধত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে।তবে কিভাবে জানলো?মান্যতাকে দেখা মূহুর্তেই চোখমুখের এক্সপ্রেশন বদলে যায় তার।সেখানে ভীড় করে বিশেষ মুগ্ধতা।ভিতরে ভিতরে সে দূর্বল হয়ে পড়ে।সেসব আচারনই কি তবে বুঝে নিয়ে তার বুদ্ধিমান চতুর বন্ধুটি!

কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর একটা সকাল।হেমন্তঋতু গিয়ে শীতের ঘনঘটায় প্রকৃতি আচ্ছন্ন হয়েছে গোটা কয়েকদিন হলো।সামনে কৌড়ির পরিক্ষা।অথচ বিয়ের হইহট্টগোলের আমেজে পড়াশোনা হচ্ছে না।কৌড়ি মুখে কিছু না বললেও নীহারিকা বেগম বেশ বুঝতে পারলেন তার অসুবিধার।তাই বিয়ের কয়েকদিন মান্যতার রুমে থাকতে বলেছেন তিনি, কৌড়িকে।যেখানে বিশেষভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছে নীহারিকা বেগমের আম্মাকে।বয়সের খাতিরে বিভিন্ন ব্যথা-বেদনায় আক্রান্ত মানুষটাকে একটু স্বত্বি শান্তিতে থাকতে দেওয়ার জন্য মান্যতার রুমটা আলাদা করে উনাকে স্পেস দেওয়ার জন্য বাছাই করে থাকতে দেওয়া হয়েছে।আপতত কৌড়িরও একটু পড়াশোনার জন্য স্পেস দরকার।তাই ভেবেচিন্তে সেখানে কৌড়িকেও জায়গা করে দিলেন।বৃদ্ধা মানুষটা তা নিয়ে দ্বিরুক্তি করলেন না।বরং খুশিই হলেন।বিয়ে বাড়িতে রাতের বেলায় রুমটায় অনেক মানুষের থাকার জায়গা হলেও,দিনের বেলায় রুমটায় শুধু কৌড়ি আর বৃদ্ধ মানুষটার আনাগোনা।তবে মান্যতা মৌনতার আশা যাওয়া অঢেল চলছেই।

সকাল হতেই পুনরায় বিয়ে বাড়ির হৈচৈ শুরু হলো।যে যার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজেকর্মে লিপ্ত হলো।গল্পগুজব, রান্নাবান্না,আলাপ আলোচনা,যে যার কর্ম অনুযায়ী লিপ্ত।সকাল হওয়ার পর কৌড়ি এখানো বাহিরে বের হয়নি।গভীর মনোযোগ বইয়ের পাতায় তার।একটু আগে এসে রানীসাহেবা তাকে আর নানুমাকে চা নাস্তা দিয়ে গেছে।আপতত ওই খাবারেই চলে যাবে তার দুপুর অব্দি।তবে বড়মা কি তা হতে দেবে?তবুও বাহিরে হৈচৈ নিজেকে সামিল করার নিয়ত তার নেই।রুমের বাহিরেই কেনো জানি যেতে ইচ্ছে করছেনা।এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকেই কেমন পরপর মনেহচ্ছে।অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা।তবুও সেই চিন্তাভাবনা থেকে কিছুতেই নিজেকে সহজ করতে পারছেনা।বিধায় গভীর মনোযোগটা পড়াশোনায় দিয়েছে।এমনিতেই এতো অচেনা মানুষের মধ্যে নিজেকে কেমন মনেহচ্ছে, তার উপর পড়াশোনায় ভিষন চাপ।অথচ সেই চাপ অনুযায়ী পড়তেও পারছে-না সে।আপতত পড়ায় মনোবেশিত করেছে।নানুমাও তাকে ডিসটার্ব করছেন-না।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেলকনিতে গিয়ে বসেছেন।সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদ্দুর এসে পড়েছে সেখানে।সেই সোনালী রোদ্দুরে তিনি গা ভাসাচ্ছেন আর চা খাচ্ছেন।পড়ার একফাঁকে নজর যেতেই কৌড়িরও ইচ্ছে হলো উনাকে সঙ্গ দেওয়ার।দ্বিধাদন্ড ছাড়াই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সে-ও উঠে উনার কাছে চলে গেলো।বৃদ্ধা মানুষটার সাথে দিলখোলা সম্পর্ক তৈরী নাহলেও একটুআধটু মিশুকে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।একদম বড়মায়ের কপি মনে হয়েছে।বৃদ্ধ মানুষটার মুচকি হেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা মবে ধরেছে কৌড়ির।প্রায় দু-মাসের অধিক সময় বাদে মনে হয়েছে,দাদিআপার সঙ্গ পেয়েছে সে।কৌড়িকে বেলকনিতে দেখতেই বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললেন।

‘পড়াশোনা ছেড়ে এসেছিস তবে?

বিনিময়ে কৌড়ি মৃদু হেসে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়লো।বৃদ্ধা আবার শুধালেন।–তোর সাথে তুই করে কথা বলছি।কিছু মনে নিচ্ছিস না-তো?

কৌড়ি চঞ্চল গলায় উত্তর দিলো–একদম না।আপনি আমার সাথে তুই করে বলতেই পারেন।

বিনিময়ে ফের মৃদু হাসলেন বৃদ্ধা।বয়সের ভারে কুঁচকে আসা মুখাবয়বে সেই হাসিটা দারুন মুগ্ধতা ছাড়লো। কৌড়িও সেটা মুগ্ধ নজরে দেখলো।অথচ বৃদ্ধার নজর বেলকেনির গ্রীল ভেদ করে লন এরিয়ায় চেয়ার পেতে গোল টেবিলের মধ্যমনি হয়ে বসা যুবকের পানে অটল।কিছুসময় বাদে সেটা বুঝে,নানুমার নজর লক্ষ্য করে কৌড়িও সেদিকপানে তাকালো।নজর স্থির হয়ে গেলো তারও।জাহিদ আঙ্কেল শাহেদ আঙ্কেল দিয়ে ইভান ভাইয়ার মামারাসহ বেশ কিছু মুরুব্বি মানুষের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে, তাকে সবসময় হুমকির মুখে রাখা মানুষটা।হালকা শীতের প্রতাপে গায়ে জড়ানো তার কালোরঙা হুডি।হুডিটা মাথায় জড়ানো নেই।পরিপাটি করে রাখা ঘনোকালো চুলগুলো সোনালী রোদ্দুরে চকচক করছে।শ্যামবর্ণ মুখের আদল আরও উজ্জ্বল উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।গায়ের লম্বা হাতার হুডিটার কনুই পর্যন্ত সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।ডানহাতে চায়ের কাপ।সময় নিয়ে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।সবার মধ্যেমনি হয়ে বসে থাকা মানুষটাকে বেশ আকর্ষণীয় আর হ্যান্ডসাম লাগছে।ওই শ্যামসৌন্দর্য পুরুষ যেকোনো নারীর স্বপ্নের কাম্য পুরুষ।আর ওই মানুষটাকে তাকে পছন্দ করে?মনে উঠতেই,অদ্ভুত শিহরনে তোলপাড় বয়ে চললো ছোট্টো বুকের ভিতরটায়।মনটা কোনো কারনে সুখ অনুভূত অনুভব হতে গিয়ে-ও নিরাসিত হলো।এ কেমন দোটানায় মধ্যে পড়ে গিয়েছে তার মন মস্তিষ্ক?কোনপথে যাবে সে?এ কেমন জ্বালা!মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখলো নানুমা এখনো নিষ্পলক ওই মানুষটার পানে তাকিয়ে রয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগলো কৌড়ির।নাতীকে নানুমা এতো স্নেহময় মুগ্ধ নজর কি দেখছে?তবে চেয়েও প্রশ্ন করতে পারলোনা।দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে ফেলে দিলো মন।পাশে দাঁড়ানো বয়োবৃদ্ধ মানুষটা সেটা বুঝতে পারলো কি-না জানা নেই কৌড়ির।তবে নিজের মতো করে নলে উঠলো।

‘জানিস নানুমা!ওই ছেলেটার গায়ের রঙ শ্যামকালো হলে কি হবে,আমার নজরে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।আমার সকল নাতিনাতনিদের মধ্যে সবচেয়ে স্নেহময় আর নিস্পাপ আদূরে একখানা মুখ।আমার এতিম বাচ্চাটা,আমার নিভান।ছোটো বেলা থেকে কতোকিছু সহ্য করেছে আমার বাচ্চাটা।অথচ কখনো উফ-তাক শব্দ ওর মুখ দিয়ে বের হয়নি।বাবাকে হারালো,মায়ের অবহেলা পেলো।অথচ ছেলেটা চুপচাপ।জানিস,আমি ওর ওই ছোট্টো নিস্পাপ আদূরে মুখখানা দেখতাম আর ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম।ভাবতাম,আমার এই এতিম বাচ্চাটার কি হবে।একসময় চিন্তায় চিন্তায় অসুখ বাঁধিয়ে ফেললাম।আমার ছেলে ছেলে বউরা সান্ত্বনা দিলো।ওরা থাকতে কখনো নিভানকে কখনো কষ্ট পেতে দেবে।নিজেদের সন্তানের মতোই মানুষ করবে।ঈশিতা।আমার নাতনী।ও পর্যন্ত কি বলতো জানিস?বলতো,ওমন আদূরে মায়ামায়া একটা মুখ।দাদুমা তুমি কিকরে দুশ্চিন্তা বাড়াও,আমরা ওকে অযত্নে অবহেলায় বড় হতে দেবো।ও ছেলেটা, সবার প্রিয় জানিস!প্রিয় হয়ে উঠেছে তার স্বভাবে ব্যবহারে।

থামলেন বৃদ্ধা।জেনে জিরিয়ে নিলেন।ফের বলতে শুরু করলেন–নীহিরিকার যখন জাহিদের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হলো।আমি ওকে দিতে চায়নি।আমার এমিত বাচ্চাটা পরের বাড়ি কষ্ট পাবে।আমি চায়নি।আমার ছেলেরাও দিতে চায়নি।তবে জাহিদ সেটা মানেনি।নিজ সন্তানের দাবী করে এবাড়িতে নিয়ে আসলো ওকে।
সত্যি বলতে,ও নিভানকে মেনে নিয়েছিলো সেভাবেই।একদম নিজ সন্তানের মতোন।অথচ আমার এতিম বাচ্চাটাকে কেউ ভালো চোখে দেখলোনা।তবুও আমার বাচ্চাটা কখনো কাওকে অভিযোগ জানাইনি।ছোট্ট বাচ্চাটা কি বুঝতো জানিনা।তবে কখনো কারও নামে ভালোমন্দ বিচার দেওয়া,দোষারোপ করা এসব গুণ ও কখনো আয়ত্ত করেনি।ওর প্রতি আলাদা একটা মায়ামমতা আমার।অদ্ভুত টান।যা অন্য নাতিনাতনীদের প্রতি অনুভব করিনা আমি।সেই আলাদা টানটা আসে না আমার ওদের প্রতি, যা একমাত্র ওরপ্রতি কাজ করে।এবাড়ি থেকে আমার কাছে বেড়াতে গেলে,আমি যখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এটাওটা জিজ্ঞেস করতাম ওকে।ওর বাচ্চা কন্ঠে একটাই উত্তর ছিলো, আমি মায়ের কাছে ভালো আছি নানুমা।অথচ ওর আর ওর মায়ের মুখ দেখলেতো আমি বুঝতে পারতাম।ও কতোটা ভালো আছে।মাঝেমধ্যে অনেকদিন করে রেখে দিতাম আমার কাছে। জাহিদ আবার সেটা বেশিদিন দীর্ঘ হতে দিতোনা।নিয়ে আসতো ওকে।সত্যি বলতে জাহিদ কখনো ওকে পরের ছেলের নজরে দেখিনি।তবে ওর বাড়ির লোক কেউ নিভানকে পছন্দ করতোনা।জাহিদের চাপে পড়ে সবাই নিভানকে মেনে নিলেও,মন থেকে কেউ মেনে নেয়নি।এরপর ইভান নানুভাই জন্মালো।আমার যেমন ওর উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ওর-ও ইভান নানুভাইয়ের উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ইভান নানুভাই জন্মানোর পর আর ওকে আমার কাছে রাখতে পারিনি।ইভানকে ছাড়া ওবাড়িতে যেতোনা ও।আর কোনোসময় গেলেও থাকতোও-না।এরপর সকাল প্রতিকূল অনুকূলের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে বেড়ে উঠলো।সেই ইভানের সাথে ওর দূরত্ব তৈরী হলো,এবাড়ির কিছু মানুষের কুমন্ত্রণায়।যদিও সেটা সামসময়িকতার জন্য ছিলো।তবুও দু ভাইয়ের মধ্যে আগের যে অটুট বন্ধন ছিলো, সেটা এখন আর দেখা যায়না।তারপর এবাড়ির মানুষগুলো পরিস্থিতির অনুকূলে পড়ে এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো।আপন ভাইরা স্বার্থপরের মতো দূরে সরে গেলো। সেখানে সেই ওকেই নিজের সপ্নটা বিসর্জন দিতে হলো।
দিলেও।তখন আর আমি চুপ থাকতে চাইলাম না।ওকে স্বার্থপরের মতো বারবার বললাম–কেনো নিজের ইচ্ছে, স্বপ্ন বিসর্জন দিবি তুই নানুভাই?ওই মানুষগুলো তোর এই বিসর্জন,ত্যাগটা বুঝবেনা।তোকে বুঝবেনা!

ও সেদিন উত্তর দিয়েছিলো—আমি নিজেকে মহান বোঝানোর জন্য বা কারও জন্য কিছু করছিনা নানুমা।আমি আমার বিবেকবোধ থেকে নিজের স্বপ্নটা ত্যাগ করতে চাইছি।যেখানে যে ব্যাক্তিটা আমাকে নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।বাবার বঞ্চিত আদর ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে।তাকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে স্বপ্নের পথে উড়াল দেই কিকরে?এতোটা স্বার্থপর হতে তো শেখাওনি তোমারা, আমাকে।তবে শুধু নিজেরটা ভাবি কিকরে?আর আমার মা।তিনি যেখানে ভালো থাকবেন না সেটা জেনেও সেখানে আমি আমার স্বপ্নের পথে পা বাড়াবো কিকরে?আমার ইচ্ছেগুলোর ডানা মেলে দেই কিকরে? আমার মা ভালো থাকার কাছে,আমার স্বপ্ন যে নিতান্তই নগন্য।

‘স্কলারশিপ পেয়েও ছেলেটা বাহিরে পড়ার স্বপ্নটা ছেড়ে দিল।জাহিদের ধসে পড়া ব্যবসার হাল ধরলো।তারপর একটু একটু করে নিজের ভালো থাকাটাও ছেড়ে দিলো।ভুলে গেলো, ও নিজে ভালো থাকা।নিজে কিসে ভালো থাকবে,কিসে মন্দ থাকবে।সেটা না ভেবে নিজের ভাইবোন,আপনজনদের নিয়ে ভাবনা বাড়লো।ভাবতে থাকলো।আজ ও সফল।তবে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা, ভালোলাগা, মন্দলাগা সবটা ত্যাগের বিনময়ে সে সফল।অথচ ওকে দেখ,কি নির্জীব।মনেহয় ও ওর ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,ভালোলাগা মন্দলাগা নয়,নিজেকেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে।

কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ মানুষটার দূর্বল গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো।সেই কম্পনে কৌড়ি অনুভব করতে পারলো,ওই মানুষটার প্রতি এই বৃদ্ধার আলাদা স্নেহ।বিমূঢ়, স্তব্দ কৌড়ি।সে ভুলেও আশা করেনি।ও মানুষটার অতীত এমন হতে পারে।সেজন্য কি সেদিন মানুষটা বলেছিলো,সে এবাড়ির কেউ নয়।ভাবনা কেমন অস্থির এলোমেলো হয়ে উঠলো কৌড়ির।অদ্ভুত কারনে ব্যথার তোলপাড় শুরু হলো বুকের ভিতর।চঞ্চল নজর গিয়ে পড়লো,লন এরিয়ার সেই নির্দিষ্ট স্থানে।নজর গিয়ে থামলো,সেই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে।হঠাৎই নানুনার মতো তারও মনে হলো,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যুবকটা বুঝি ওই বসে আছে।তার শ্যাম সৌন্দর্যের কাছে যেনো পৃথিবীর অন্যন্য সুদর্শন সুপুরুষেরা সব ফিকে।কৌড়ির এলোমেলো অনুভূতি অনুভবের মধ্যে, পাশে বৃদ্ধা নারীটা শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফের বললেন

–ওর জন্য আমার সবসময়ের প্রার্থনা।ও একটু অভিযোগী হোক,একটু অভমানী হোক।মনের মধ্যে চেপে রাখা বিয়োগ ব্যথার ক্লেশগুলো সেই অভিমানে অভিযোগে মুক্ত হয়ে যাক।তারপর নিজের ইচ্ছেমতো ভালো থাকুক।পৃথিবীর সবসুখ প্রভু তার রহমতের হাতদ্বারা ওর উপর ঢেলে দিক।ও এমন একজন জীবনসঙ্গিনী পাক।সে যেনো ওর সমস্ত অপূর্ণতা, পূর্নতায় ছেয়ে দেয়।ওর সকল অপূর্ণতার পুর্নাঙ্গীনি হয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here