উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১৩||

0
363

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৩||

১৯।
তাজওয়ার হতাশ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর আহি মনোযোগ দিয়ে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির উপর বিরক্ত। তারা এসেছে শহরের দামি রেস্টুরেন্টে, আর আহি খাচ্ছে আলু ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত। দামি রেস্টুরেন্টে আহির পছন্দের এই খাবার না থাকায় তাজওয়ারের আদেশে ম্যানেজার খাবার তৈরীর জন্য কিছু সময় চেয়ে নেন। এরপর প্রায় এক ঘন্টা পর খাবার আসতেই আহি হাত দিয়েই ভাত মেখে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝখানে সে আঙ্গুলগুলোও চেটেপুটে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির খাওয়া দেখে নিজের খাওয়ায় ভুলে গেছে। আহি তাজওয়ারের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো আর মনে মনে বলল,
“ভালো করে খাও তুমি। আজকের দিনটা যদি মাথায় থাকে, ভুলেও কখনো আমাকে নিয়ে বের হওয়ার কথা চিন্তা করবে না। মিস্টার খান, এভাবেই আমি তোমার রেপুটেশন ধুলোয় মিশিয়ে দেবো।”

আহি আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এবার সে খুব যত্ন নিয়েই খাচ্ছে। একদম আফিফের মতো করে। আফিফের প্রিয় খাবার গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা। এক্সিডেন্টের পর আহি একবার তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সেদিনই সে জেনেছিল আফিফ আলু ভর্তা খুব পছন্দ করে। এরপর আহি বাসায় এসে মুনিয়া খালাকে বলে ভর্তা আর ভাত নিয়ে হাসপাতালে গেল। কিন্তু সেদিনই আফিফ রিলিজ পেয়ে যায়। আর তাই আফিফের সাথে তার দেখা হয় নি। আর সেদিনের পর থেকেই আহির যখন খুব রাগ উঠতো সে নিজেই আলু ভর্তা বানিয়ে খেতো। কারণ আফিফের প্রিয় কাজগুলোর মাঝেই সে আফিফকে খুঁজে পায়। আর যখন সে আফিফকে অনুভব করে, তখন তার রাগ, কষ্ট সবকিছুই প্রশমিত হয়ে যায়।

(***)

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই রাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজওয়ার আর আহি দু’জনই অবাক হলো। রাদ আহিকে দেখে বলল,
“এতোক্ষণ লাগে তোর খেতে?”

তাজওয়ার আহিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রাদের মুখোমুখি এসে বলল,
“এক্সিকিউজ মি, তুমি এখনো এখানে কি করছো?”

“আমি আহির সাথে যাবো।”

“আমি ওকে নিয়ে এসেছি, আমি-ই ওকে নিয়ে যাবো।”

আহি রাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার রাদের সাথে একটা কাজ আছে। আজই আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তোমার জন্য এখানে আসতে হলো।”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি কাজ?”

রাদ উত্তর দিলো,
“ভর্তির ব্যাপার নিয়ে। আমরা মাস্টার্সে ভর্তি হচ্ছি।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ একটা রিকশা থামিয়ে আহিকে উঠতে বলতেই তাজওয়ার বলল,
“আহি, তুমি রিকশা করে যাবে?”

আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে বলল,
“আমার রিকশায় চড়তে ভীষণ ভালো লাগে।”

তারপর রাদের হাত ধরে তাকেও রিকশায় উঠতে বললো। তাজওয়ার আহি আর রাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি তাজওয়ারের দৃষ্টি অনুসরণ করে একনজর তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? রাদ আমার বন্ধু। অন্তত মিস ফার্জিয়া আর তোমার বন্ধুত্বের চেয়ে আমাদের বন্ধুত্বটা অনেকটা শালীন।”

আহির কথায় তাজওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে ভাবছে, আহি ফার্জিয়ার কথা কীভাবে জানলো? ফার্জিয়া তার বর্তমান প্রেমিকা। এই মেয়েটাই তার টাকার পেছনে পড়ে আছে।
রিকশা চলে যেতেই তাজওয়ার ফোন হাতে নিয়ে ফার্জিয়াকে কল করলো। আজই এই মেয়ের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করবে সে। সে সব ছাড়তে পারবে, কিন্তু আহিকে ছাড়া তার চলবে না।

(***)

রাদ আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। রাদ হঠাৎ রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লো। আহি রাদকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাদ রাস্তার ওপাড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে দু’টো ঝালমুড়ির প্যাকেট নিয়ে ফিরলো। আহি ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে বলল,
“তোর এখনো মনে আছে?”

রাদ রিকশায় উঠে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? তোরা চারজন প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলেই ঝালমুড়ি কিনে মাঠে বসে বসে খেতি। আর আমি কতোবার চাইতাম, কিন্তু তোরা ভাগ দিতি না। ভীষণ হারামি ছিলি তোরা।”

আহি হাসলো। রাদ মুগ্ধ হয়ে আহির হাসি দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“আহি, সেদিন থেকেই আমার তোকে ভালো লাগতো। কিন্তু আজও এই কথা তোকে বলতে পারলাম না।”

রাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আনমনে বলল,
“যাকে আমি ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না। আর সে যাকে ভালোবাসে, তার মনে আমার ভালোবাসার মানুষটার জায়গা হয় না। কি অদ্ভুত প্রেম লীলা!”

(***)

আহি বাসায় এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“দরজা খোলা আছে।”

চুনি এক কাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চুনির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির তাকানো দেখে চুনি লাজুক হেসে মেঝেতে বসে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো। আহি পা ভাঁজ করে চুনির দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কেন এসেছো? আমি তো চা খেতে চাই নি।”

চুনি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বেশি খুশি লাগতাছে আফা মণি।”

“কেন?”

“আপনের বিয়া হইবো। আমি নাচমু, শাড়ি পরমু। আমারে একখান শাড়ি কিন্না দিয়েন আফা।”

“আমার বিয়ে হবে এই কথা তুমি কোথায় শুনেছো?”

“মিছামিছি কথা কই না আমি। আজকেই ম্যাডাম আম্মারে কইলো। আপনের তাজওয়ার স্যারের লগে বিয়া।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তা আমার বিয়ে হবে শুনে তুমি খুব খুশি, তাই না? আমাকে আসতে না আসতেই বিদায় করে দিতে চাও?”

চুনি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ছি! আফা। কি কন এসব? আমি আর আম্মা আপনারে খুব ভালোবাসি। জানি আপনে এই বিয়াতে রাজি না। কিন্তু তাজওয়ার স্যাররে দেখছেন? কি সুন্দর একখান মুখ! রাজকুমারের মতো চেহারা।”

“সুন্দর চেহারার মানুষগুলোর মন সুন্দর হয় না। অগোছালো মানুষগুলোই বেশি সুন্দর হয়।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চুনি আহির হাত স্পর্শ করে বলল,
“আফা, আপনে বিয়া না করলে ম্যাডাম হইতো উল্টাপাল্টা কিছু করবো।”

“তুমি ভয় পেও না, চাঁদনি। মিসেস লাবণি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। বেশি হলে কিছু শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। কিন্তু আমার সয়ে গেছে, চাঁদনি। পৃথিবীর সব যন্ত্রণা আমার মনের যন্ত্রণার কাছে তুচ্ছ। আমি ঠিকই এই দিনগুলো কাটিয়ে উঠবো। কিন্তু তাদের কাছে মাথা নত করবো না।”

এরপর আহি চুনির থুতনি ধরে বলল,
“তোমাকে আমি খুব সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দেবো। আমার বিয়ে হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে না।”

চুনি গালে হাত দিয়ে আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আফা, আপনে কাউরে ভালোবাসেন?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“একজন রাজাকে ভালোবেসেছিলাম। তার রানী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রজা বানিয়ে ছেড়েছে। তার রাজ্যে আমি কোথাও নেই।”

চুনি চাপা স্বরে বলল,
“ওই পোলাডা, যার ছবি আঁকছিলেন?”

আহি বলল,
“তুমি এখন যাও। আর শোনো, মিসেস লাবণি আর বাবা কাল বাইরে গেলেই গ্যারেজ থেকে আমার ছবিগুলো নিয়ে এসো।”

চুনি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সে চলে যেতেই আহি বালিশে মাথা ফেলে দিয়ে বলল,
“পাওয়া না পাওয়া হয়তো আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু এআর, তোমাকে ভালোবাসা আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আমি তোমাকে ভালোবেসে বেহায়া হয়েছিলাম। তারপরও ভালোবেসেছিলাম। আমি তোমাকে ভালোবেসে পাগল হয়েছি, তারপরও ভালোবাসতে ভুলি নি। এবার না হয় মৃত্যুও চলে আসুক। তখনো আমি তোমার উন্মাদ প্রেমিকা হয়েই থাকবো। তোমার সেই অজ্ঞাতনামা ভক্ত, যার মনে এখনো দ্বিতীয় কোনো পুরুষ স্থান পায় নি। আমিই সেই যে তোমার স্পর্শ না পেয়েও কলঙ্কিত হয়েছি। তোমাকে ভালোবাসার মতো সুন্দর কলঙ্ক আমার হৃদয়ে লেপ্টে আছে। আর এই কলঙ্ক নিয়েই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করি।অন্ধকার আকাশের গায়ে আলো ছড়িয়ে দেওয়া সেই চাঁদের মতো আমারও ভীষণ অহংকার। কারণ আমার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমার এই অহংকার কখনো কেউ ভাঙতে পারবে না।”

২০।

সকালে আহির আঁকা পুরোনো ছবিগুলো আবার তার রুমে ফিরিয়ে আনা হলো। আহি ঠিক আগের মতো করে তার রুমটা গুছিয়ে নিলো। দুপুরের দিকে রুম গোছানো শেষে আহি তার রুমের একপাশে মৃত পড়ে থাকা কাঠের গোল স্ট্যান্ডের উপর বসলো। তারপর চোখ বন্ধ করে আলতো হাতে স্ট্যান্ডটির উপর হাত বুলালো। এই কাঠের স্ট্যান্ডটির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো তার প্রিয় মানুষটির প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতিটা তো এখন আর নেই। আছে শুধু তার দাঁড়িয়ে থাকার সেই ভিত্তিটি।

……………………..

দুই বসন্ত পেরিয়ে গেছে। আহি এখনো তার মনের কথা আফিফকে জানাতে পারলো না। তবে সেই বেনামী পত্রগুলো আফিফের ঠিকানায় ঠিকই পৌঁছে যায়, যেখানে আহি তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছে। তবে আফিফ তার অজ্ঞাতনামা প্রেয়সীকে না চিনলেও আফিফের প্রিয় জিনিসগুলো আহিকে ভালোভাবেই চিনে ফেলেছে। শুধু তাদের বলার ক্ষমতা নেই। নয়তো তারা আহির উন্মাদনার কথা আফিফকে জানিয়ে দিতো।

আফিফ প্রায়ই সাদা শার্ট পরতো। আহি আফিফের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানার পর ভেবেছিল, তার হয়তো ভালো জামা নেই। কিন্তু পরে বুঝলো সাদা রং আফিফের ভীষণ প্রিয়। আফিফের পিছু নিতে গিয়ে অনেক বার সে খেয়াল করেছিল আফিফ ভ্যানগাড়ির সামনে দাঁড়ালে সাদা রঙের টি-শার্টগুলোই খুঁজে বের করে। আর এটা জানার পর থেকে আহির প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এরপর সে প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যেতে লাগলো, যাতে আফিফের নজরে পড়ে। কিন্তু আফিফ আহির দিকে ভালোভাবে তাকায় না। হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলে আফিফ চোখ সরিয়ে নেয়। তবে সেদিনের পর থেকে আহি সাদা রঙটায় তার হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে আফিফকে বলতো,
“দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”

(***)

একদিন রাস্তার পাশে ফুল গাছের ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আফিফ সেই ভ্যানের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ফেরিওয়ালার সাথে কথা বলে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি সেই ভ্যানের সামনে এসে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আফিফ না-কি অলকানন্দা ফুল খুঁজছিল। আহি ভাবতে লাগলো, যেই ফুল ভ্যানে নেই, সেই ফুল খোঁজার অর্থ নিশ্চয় সেটা আফিফের প্রিয় ফুল। ব্যস, আহি সেদিনই নার্সারীতে গিয়ে অনেকগুলো অলকানন্দা ফুলের চারা এনে তার বারান্দা সাজিয়ে ফেললো। এখনো আহির প্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে অলকানন্দার উপস্থিতি আছে। আগে আহি এই ফুল চিনতোই না। কিন্তু এখন রোজ অলকানন্দাগুলো আহির অনুভূতির সাক্ষী হয়। তারা যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে ফিসফিসিয়ে আফিফকে গিয়ে বলতো,
“দেখো আফিফ, মেয়েটা তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছে যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই সে তার সকালটা শুরু করে। তুমি কি তার সকাল দেখার সঙ্গী হবে না?”

এই দুই বসন্তেই আহি আফিফের কাছে না এসে তাকে যতোটুকু চিনেছে, ততোটুকু কেউ আদৌ তাকে চিনতে পেরেছে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

(***)

চারুশিল্পে ক্লাস করতে এসেই আফিফকে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন দেখাটা আহির কাছে খুব কম মনে হচ্ছে, তাই সে আফিফকে আরো জানতে শুরু করলো। যাতে তাকে আহি আরো বেশি সময় ধরে দেখার সুযোগ পায়। মোটামুটি স্কুলের বিষয়গুলোর বাইরে আহির ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো আফিফের ইতিহাস।
এরপর ধীরে ধীরে আহি জানতে পারলো আফিফ বয়সে তার চেয়ে বড়জোর তিন বছরের বড়। ক্লাস হিসেবেই তা আহি আন্দাজ করেছে। কারণ আহি এখন দশম শ্রেণিতে, আর আফিফ ইন্টার পরীক্ষার্থী। আহি চেয়েছে, সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে আফিফের কলেজের সামনে গিয়ে তাকে দেখে আসবে। কিন্তু আফিফ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়েই সে জানলো, আফিফ গ্রামের কলেজে পড়ে। আর তারা গ্রামেই থাকতো। কিন্তু কয়েক বছর আগেই আফিফের বড় বোন চয়ন কাজের সূত্রে শহরে এসেছিল। চয়নের বিয়ে হয় নি। সে কলেজ পর্যন্ত পড়েছিল। তার বয়স ছিল মাত্র বাইশ। গ্রামের এক চাচার সাহায্যে সে একটা মার্কেটে কাজ নিয়েছিল। আর সেখানেই সে মেয়েদের শাড়ি-পোশাক বিক্রির দায়িত্ব পেয়েছিল। এরপর হঠাৎ চয়ন কাজ ছেড়ে দেয়। মেয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর পরই আফিফা বেগম সেলাই কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি আফিফ টিউশন করাতো। কিন্তু গ্রামের কলেজে পড়ে শহরে ভালো টিউশন পাওয়া দুষ্কর ছিল। শহরের অভিভাবকরা ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করতে চান। তাই আফিফের জীবিকার উপায় হয়ে দাঁড়ালো তার শখ। আফিফ ছবি আঁকতে ভালোবাসে। রং-তুলি তার স্বপ্ন। আফিফের খুশির জন্যই চয়ন তাকে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বলেছিল, জীবনে সে কিছু হোক না হোক, অন্তত একজন ভালো চিত্রশিল্পী হয়ে যাতে বের হয়। আফিফ বর্তমানে ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়। এতেই সে ভালো আয় করতে পারছে। এই প্রতিযোগিতার শহরে আফিফের ছবি আঁকতে পারার দক্ষতা তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এরপর কয়েক মাস আগেই চয়নের মৃত্যু হয়। মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। চয়ন আত্মহত্যা করেছিল। আফিফ সম্পর্কে এতোটুকু তথ্যই আহি নিতে পেরেছে। কিন্তু চয়নের আত্মহত্যাটা আহির কাছে রহস্য হয়ে গেলো। তবে আহি এতোটুকু বুঝে গেছে আফিফ তার জীবনে প্রচুর কষ্ট করছে। এই মুহূর্তে সে যদি আফিফকে তার ভালোবাসার কথা বলে, তাহলে হয়তো আফিফ তাকে দূরে সরিয়ে দেবে। কোথায় আহির বাবা দেশের প্রভাবশালী মানুষ, আর কোথায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শান্ত ছেলে আফিফ। আহি তো সত্যটা মেনে নিয়েই আফিফকে ভালোবেসে যাচ্ছে। কিন্তু আফিফ যদি সত্যটা মানতে না চায়। তাই আহি সিদ্ধান্ত নিলো, এখন সে তার ভালোবাসার কথা জানাবে না। আরেকটু সময় নেবে। চয়নের মৃত্যুর ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে আফিফের হয়তো আরো কিছু মাস সময় লাগবে। কিন্তু এতোদিন আহি আফিফকে নিজের কাছ থেকে কীভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে? এখন তো তার ভালোবাসা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। তার এই বাড়াবাড়ি প্রেম প্রশমিত করার একমাত্র ওষুধ আফিফকে কাছে পাওয়া। আফিফকে তার চোখের সামনে বসিয়ে রাখা। কিন্তু কীভাবে সে আফিফকে তার সামনে বসিয়ে রাখবে। দ্বিমাত্রিক ছবিগুলো আহিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। একের পর এক ছবি এঁকেও যেন আহি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবার তার সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করছে। সম্রাট তার প্রেমের সাক্ষী রূপে বানিয়েছিলেন তাজমহল। আর আহি ভালো কারিগর দিয়ে বানিয়েছে আফিফের ভাস্কর্য। হুবহু আফিফের প্রতিরূপ নিয়ে এসেছে সে। ভাস্কর্যটি দাঁড় করানোর জন্য দামী কাঠ দিয়ে একটা গোল স্ট্যান্ড বানিয়েছে আহি। ভাগ্যিস আহি নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতো। ভাগ্যিস তার ঘরে তার অনুমতি ব্যতীত কেউ আসতে পারতো না। নয়তো সালমা ফাওজিয়া অনেক আগেই আহির এই অতিমাত্রার পাগলামো কমানোর একটা ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতেন।

যেদিন ভাস্কর্যটি বাসায় আনা হয়েছিল, সেদিন রিজওয়ান কবির আর সালমা ফাওজিয়া বাসায় ছিলেন না। আহি তার ঘরে ভাস্কর্যটি নিয়ে আসে। এরপর তার বিছানার মুখোমুখি সেটা দাঁড় করিয়ে রাখলো। তারপর সে তার কৃত্রিম আফিফের জন্য সাদা শার্ট আর প্যান্ট কিনে এনে সেটিকে পরিয়ে দিলো। আর বুক পকেটে গুঁজে দিলো তার বাগানের সেই অলকানন্দা ফুল। এরপর ভাস্কর্যটির হাত ছুঁয়ে দিয়ে আহি বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ ছিল। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”

………………………….

অতীত স্মৃতি হাতড়ে ভালোই নয়ন ভেজালো আহি। চোখ খুলতেই তার অশ্রুসিক্ত লাল চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। সে কাঠের স্ট্যান্ড থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অলকানন্দা ফুলগুলো এখন আর নেই। গত চার বছর সে এখানে ছিল না। তাই ফুল গাছগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আহি ছাড়া এ বাসায় আর কারো ফুল গাছের শখ নেই। এই বাড়ির মানুষগুলো টাকার গাছ খুঁজতে এদিক-ওদিক ছুটে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এআর, চার বছর ধরে তোমাকে দেখি না। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। দূর থেকে দেখলেই আমার চলবে। এমনিতেই তোমার কাছে যাওয়ার সাহস নেই আমার। এই মুখ নিয়ে তোমার সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? তুমি নিশ্চিত ঠাট্টা করবে! হাসবে আমার উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার কাছে আমি বেহায়া হলেও, আমার কাছে এটাই বেঁচে থাকার সম্বল। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো এখনো আমি বেঁচে আছি। নয়তো এই হিংস্র মানুষগুলো অনেক আগেই আমার প্রাণ নিয়ে নিতো।”

(***)

বিকেলে তাজওয়ার আহিদের বাসায় এলো। মিসেস লাবণি আর রিজওয়ান কবির এখনো বাসায় ফেরেন নি। আহি এই মুহূর্তে তাজওয়ারকে দেখে ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। কিন্তু এই অসভ্য লোকটাকে সহ্য করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।
এদিকে তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“ইউ আর লুকিং ভেরি বিউটিফুল!”

আহি দাঁত কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তোমার এই অসভ্য কমেন্ট নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখো।”

“তুমি তো দেখছি আমার সাথে অসভ্য শব্দটা ব্যবহার না করে কথায় বলতে পারো না।”

“কারণ এই শব্দটাই তোমার সাথে মানানসই।”

“আর তোমার পাশে আমার মতো এই অসভ্য মানুষটাকেই বেশি মানায়।”

আহি চোখ-মুখ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির মুখশ্রী দেখে বাঁকা হেসে তাকে টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি?”

তাজওয়ার হেসে বলল, “অনলি ফর ইউ।”

তাজওয়ার পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে বাগানের বেঞ্চে বসে পড়লো। আহি বিরক্ত মুখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে যেতে নেবে, তাজওয়ার তার হাত ধরে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন আমাকে জোর করে সিগারেট খাওয়াবে?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“খাওয়াবো না। কিন্তু অভ্যাস করতে হবে। তোমার পাশে বসে আমি রোজ রাতে সিগারেট ধরাবো, আর তুমি এই ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখবে। ভীষণ চমৎকার একটা দৃশ্য! তুমি নিশ্চিত উপভোগ করবে।”

তাজওয়ার আহির দিকে ফিরে ধোঁয়া ছাড়তেই আহি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। তাজওয়ার হাসলো। আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার এই স্বভাবটাই আমি ঘৃণা করি। আর মনে রেখো, রোজ রাত কেন? তুমি কোনো রাতেই তোমার এই কুৎসিত স্বপ্ন পূরণ হতে দেখবে না।”

আহি কথাটি বলেই হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। এরপর ঘরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে সে বার কয়েক মুখে পানির ঝাপটা দিলো। তারপর ভেজা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে তাকাতেই তার মনে পড়লো সেই দিনটির কথা।

………………………

সেদিন বাসের জন্য আফিফ রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। আর ওমনি আফিফ কাশতে শুরু করলো। ধোঁয়াটা একদম আফিফের কাছেই ছেড়েছিলো লোকটা। আহির ইচ্ছে করছিলো, সেই মুহূর্তেই লোকটাকে গণপিটুনি খাওয়াতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। তাই সে তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আফিফের দিকে এগিয়ে দিলো। আফিফ পানি খেয়েই আহিকে ধন্যবাদ দিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে ছিল আফিফ। সে হয়তো ভাবছে, এই মেয়েটা এখানে কি করছে? তাহলে কি এ-ই সেই মেয়ে যে তার পিছু নেয়? আহি আফিফের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সরাতে স্বাভাবিক মুখে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আফিফের আগেই একটা বাসে উঠে পড়লো। বাসে উঠেই আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আফিফকে একনজর দেখে নিলো। আফিফ হয়তো এখন ভাববে এটা ইচ্ছেকৃত সাক্ষাৎ নয়। এটা হঠাৎ দেখা হওয়া।
এরপর বাস একটু সামনে যেতেই আহি বাস থেকে নেমে আনমনে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। আর মনে মনে সেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিলো। সিগারেটের ছলে সে জানতে পারলো, সিগারেটের ধোঁয়ায় আফিফের সমস্যা হয়। উলটো তার বোতলটিও আফিফের স্পর্শ পেলো। উপরন্তু আফিফের ধন্যবাদও পেলো। তার ইচ্ছে করছে এই দিনটা ফ্রেমে তুলে সাজিয়ে রাখতে।

………………………

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফোনে টুংটুং শব্দ তুলে একটা মেসেজ এলো। ফোন হাতে নিলো আহি। দেখলো রাদের মেসেজ এসেছে। মাস্টার্সে ভর্তির জন্য একটা ভালো ভার্সিটি খুঁজে পেয়েছে সে। কালই ফর্ম ছাড়বে। আহিকে কাল দেখা করতে বলেছে। ভার্সিটির নামটা দেখেই আহির অস্থিরতা বেড়ে গেলো। এটা তো সেই ভার্সিটি! এই ভার্সিটিতেই আফিফ পড়তো। ফোনটা রেখে আহি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমিও না, কি ভাবছি! এআর তো অনেক আগেই গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে গেছে।”

চলবে-

(পাঠক-পাঠিকাদের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে শীগ্রই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here