নিশীভাতি #৩য়_পর্ব

0
422

#নিশীভাতি
#৩য়_পর্ব

কলেজ শেষে বান্ধবীদের না বলেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো হুমায়রা। নসীবন পেলো না, তাই ইজি বাইকে করেই রওনা দিলো। বাজার পর্যন্ত যেতে পারলেই ভাইয়ের দোকান। কিন্তু রাস্তায় বাধলো বিশাল ঝামেলা। বিশাল একটি গাড়ী নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দিয়ে বসলো ইজি বাইকটিকে। অমনি বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে পড়লো পিচঢালা রাস্তায়। আকস্মিক আঘাতে ইজিবাইকটির এক পাশ একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গেলো।

ভয় এবং সন্ত্রাশের প্রবণতায় জ্ঞান হারিয়েছিলো হুমায়রা। যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে একটি সফেদ বিছানায় আবিষ্কার করলো। সরু বিছানা, পাশে স্যালাইনের দন্ড। তার হাতে ক্যানোলা লাগানো হচ্ছে। ক্ষীণ গতিতে চলছে সেলাইন। আশপাশ লক্ষ করে বুঝলো এটা একটি জেনারেল ওয়ার্ড। তার মতো আরো দুজন মহিলাকে আশেপাশের সফেদ বিছানাগুলোতে দেখতে পেলো সে। সে উঠতে গেলে মোটা একজন সাদা শাড়ি পরিহিত নারী বেশ ধমকের সুরে বললো,
“এই উঠবে না, স্যালাইন চলছে”

হুমায়রা লক্ষ করলো তার গায়ে অস্বাভাবিক ব্যাথা। উরুতে ব্যান্ডেজ। হাতের তালু এবং কনুই এর উপরের অংশ ছিলে গিয়েছে। গায়ে জ্বর জ্বর অনুভূত হচ্ছে। গলাটা যেনো শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক কণ্ঠেই মহিলাটিকে বললো,
“আমার কি হয়েছে?”
“এক্সিডেন্ট। উরুতে রডের চাপ খাইছেন। হাত ছিলে গেছে। মাথার একপাশে ব্যাথা পাইছেন। ভাগ্য ভালা যে ভাঙে নাই বা রডে ঢুকে নাই। বুঝলাম না, কারোর কিছু হইলো না আপনেই কাইত হয়ে গেলেন। কেমনে বসে ছিলেন?”

হুমায়রা উত্তর দিলো না। যতটুকু মনে হচ্ছে মহিলাটি একজন নার্স। আর এটি একটি সরকারী হাসপাতাল। হয়তো উপজেলার হাসপাতালটি। হাসপাতালের নার্সের ব্যবহারই তার প্রমাণ। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সাথে সাথে মানুষগুলোর ব্যাবহার ও থাকে বাজে। ভাইজানের ভাষ্যমতে, এখানে বেতন থাকে কম, তাই অনীহা বেশি। বেসরকারী হাসপাতালে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে হয়, তাই তাদের ব্যবহার থাকে চিনির মতো মিষ্টি। তারা পারলে তোমার জামাও বদলে দিবে অথচ এখানে খালি সেলাইন লাগিয়ে রাখলেও তাদের গুরুত্ব থাকবে না। কথাটা মনে পড়তেই হাসি পেলো হুমায়রার। সাথে সাথে মনে পড়লো এখন ভাইজানের বাসায় যাবার সময়। নার্সের দিকে তাকিয়ে শুষ্ক স্বরে বললো,
“এখন কয়টা বাজে?”
“এশা আযান দিয়ে দিছে”

হুমায়রা কিছু বলার পূর্বেই একজন ভদ্র মহিলার আগমণ ঘটলো। মহিলার পরণে দামী শাড়ি। অন্তত হাজার তিনেক তো হবেক। ক্রিম কালারের উপর ক্রিম কালারের মিহি কাজ করা সুতি শাড়ি। মহিলা এসে দাঁড়ালো ঠিক হুমায়রার সামনে। মৃদু হাসি ঠোঁটের কোনায় এঁটে শুধালো,
“তোমার শরীরটা এখন কেমন আছে?”
“জি ভালো”

হুমায়রার কণ্ঠে জড়তা এবং সন্দিহান দেখে মহিলার হাসি বিস্তৃত হলো। মহিলার কন্ঠে খুব নরম। আগের মতোই নরম স্বরে বললেন,
“আমাকে তুমি চিনবে না। আমি খুব একটা গ্রামে আসি না। চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন আমার ভাই। বিয়ের পর খুব কম আসা হয়েছে। আজ তের বছর পর এসেছি। আমি ঢাকায় থাকি। আসলে আমার ড্রাইভারটা নতুন। ও একটা গা/ধা। ড্রাইভার মানুষ অথচ ব্রেক চাপতে পারে না। ওকে আজকেই বাতিল করে দিবো। আহাম্মক একটা। বলে ওর পা পৌছায় না। অবশ্য ঢাকা শহরে যে ড্রাইভারের আকাল। এই নিয়ে মোট সাতটি ড্রাইভার বদলেছি। এটা হলে আটটা হবে। দুই হালি। অথচ আটমাস ও হয় নি গাড়িটি। এর আগের ড্রাইভারটি……”

মহিলাটি খুব মিশুক, নয়তো খুব বেশি বাঁচাল। নয়তো কে তার ড্রাইভার সমাচার এতোটা নিপুনভাবে একটি অপরিচিত মেয়েকে বর্ণনা করে। মহিলার কথাগুলো বিনাবাক্যে শুনতে লাগলো হুমায়রা। একটি মানুষকে হুট করে বলা যায় না আপনি থামুন, আপনার কথায় আমার আগ্রহ নেই। ব্যাপারটি বেয়াদবি হয়। ভাবলো, যখন মহিলার কথা থামাবে তখন বলবে, “আপনার কাছে ফোন আছে? একটা ফোন করবো”

******
রাশাদ যথা সময়ে বাসায় আসলো। সে এখন খাবে, আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার দোকানে যাবে। এখন দোকানে মিঠুকে বসিয়ে এসেছে। ছেলেটা একটু কামচোর কিন্তু মাঠার লোভ দিলে কাজ ফাকি দেয় না। রাশাদ সকাল, দুপুর এবং রাতের খাবারটা বোন আর দাদার সাথে খায়। এটা তার অভ্যাস। খেতে খেতে বোনের কাছে খুটিনাটি সব শুনবে। বোনও এক এক করে ভাইকে সব বলবে। দিন কেমন গেলো, কি কি ঘটলো। বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলো। প্রতিদিন তার হাতমুখ ধোঁয়ার পানি হুমায়রাই এনে রাখে ঘরের কাছে। ভাই কাজ করে কল চাপবে সেটা তার অপছন্দ। কিন্তু আজ বোনকে দেখলো না। আতিয়া খাতুনকে শুধালো,
“হুমায়রা কই?”
“বুবু ফেরে নাই”

কথাটা শুনতেই চমকে তাকালো সে। সময় এখন সাতটা ত্রিশ, অগ্রহায়ণের শেষের দিক। তাই এশা আযান তাড়াতাড়ি দেয়। কলেজ থেকে বাসা আসতে আধা ঘন্টা লাগে। তাহলে এখনো কেনো ফিরে নি হুমায়রা। রাশাদ মুহূর্তেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। চিন্তিত স্বরে শুধালো,
“হুমায়রা বাড়ি ফিরে নি অথচ তোমরা আমারে জানাও নাই কেন?”
“চিন্তা করিস না ভাই, আইসে পড়বে”
“দাদী এখন সাড়ে সাতটা বাজে”

হুমায়রার বয়স ছোট বলে তাকে নিজস্ব মোবাইল দেয় নি রাশাদ। আজকালের মেয়েরা মোবাইল পেলেই বখে যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটা মোবাইল থাকা প্রয়োজন ছিলো। রাশাদ উঠে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বললো,
“আমার খানা উঠায়ে রাখো, আইসে খাবো”

বলেই মোটর সাইকেল স্টার্ট দিলো।

কলেজ গেট শূনশান। দারোয়ান ও নেই বললে চলে। অনেকখুজে দারোয়ানকে পেলো রাশাদ। তাকে শুধাতেই সে বললো,
“সব মাইয়ারা তো গেছে গা”

চিন্তা আরোও গহীন হলো। হুমায়রার বান্ধবীদের বাসায় যাবে কি না সেই দ্বিধা সমাধান ই করছিলো তখন ই একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। সাথে সাথেই রাশাদ ফোন ধরলো। অপাশ থেকে চিকন, নরম মেয়েলী কন্ঠ শুনতে পেলো,
“ভাইজান, আমি হুমায়রা”
“বোন তুই কোথায়? এটা কার নাম্বার?”

রাশাদের চিন্তিত ত্রস্ত কন্ঠ শুনে বুঝতে বাকি নেই, ভাইজান তাকে খুজতে বেরিয়েছে। অনেক রয়ে সয়ে বললো,
“আমি উপজেলার হাসপাতালে”
“কেন, কি হইছে? আমি আসতেছি এখন ই”

ভাইয়ের কন্ঠের উৎকুন্ঠা যেনো বাড়লো। হুমায়রা সাথে সাথেই বললো,
“ভাইজান আমি ভালো আছি। তুমি সাবধানে আসো। তাড়াহুড়ো করো না। আমি ঠিক আছি। মোটরসাইকেল আস্তে চালিও”

হুমায়রার কথায় একটু হলেও শান্ত হলো রাশাদ। বুকের ভেতরে উঠা ঝড় একটু হলেও ক্ষান্ত হলো। ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি”

বলেই ফোন রেখে দিলো। হুমায়রা মিনিট দুয়েক মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সামনে বসা ভদ্রমহিলাকে ফিরিয়ে দিলো মোবাইলটি। উনার নাম শরীফা। এই কিছু সময়ে সেটাও জানা হয়ে গেছে। মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ, চাচী”
“তোমরা কয় ভাই বোন?”
“আমি আর ভাইজান”
“বাবা কি করে তোমার?”

বাবার কথাটা শুনতেই চুপ হয়ে যায় হুমায়রা। তার জীবনে এই অধ্যায়টি খুব কুৎসিত। কি বলবে? বাবা নেশা করে, আর ভাইজানের ঘামের পয়সা জুয়ায় উড়ায়? হুমায়রাকে চুপ থাকতে দেখে শরীফা ভাবলেন হয়তো মেয়েটির বাবা নেই। তাই প্রশ্ন পালটে বললেন,
“আমার একটি ছেলে আছে। একমাত্র ছেলে। ওর পড়ে বাচ্চা নিতে চেয়েছি, কিন্তু হয় নি। হয়তো আল্লাহপাকের এটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার অবশ্য আফসোস নেই। আমার এক ছেলেই একশত সমান। খুব ভালোবাসে আমাকে। আমাকে সহ্য ও করে। এই যে আমি ফোন করেছি। ওর সব কাজ ফেলেই ছুটে আসবে।“

সত্যি তাই হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে একটি শ্যাম বর্ণের পুরুষকে প্রবেশ করতে দেখলো হুমায়রা। পরণে সাদা পাঞ্জাবী, মুজিব কোট। হাতা কনুই অবধি গোটানো। চুলগুলো অবিন্যস্ত, এলোমেলো। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কপালের ধার দিয়ে। চোখে মোটা কালো চশমা। গালে বেশ দাড়ি আছে কিন্তু বেশ গোছানো। উদ্বিগ্ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আশপাশট ঘুরিয়ে ঠিক শরীফার সামনে এসে দাঁড়ালো. মোটা স্বরে বললো,
“মা তুমি ঠিক আছো?”

শরীফার মসৃণ হাসি বিস্তৃত হলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“হ্যা, আমি ঠিক আছি। তুই মেলা দিন বাঁচবি। তোর কথাই বলছিলাম হুমায়রার কাছে”

লোকটি এবার তাকালো হুমায়রার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যেনো তাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে সে। চোখ ঘুরিয়ে হুমায়রাকে পর্যবেক্ষণ করে অবিলম্বে বলল,
“চলো, মামা অপেক্ষা করছেন। আমি বাকিদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছি। আর উনার খরচটাও দিয়ে দিবো”
“সে কি? একবার জিজ্ঞেস করবি না ও কেমন আছে? ফাইজান এটা অভদ্রতা”
“তুমি জিজ্ঞেস করেছো তো, সেটাই যথেষ্ট”

হুমায়রার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো। মানুষটিকে অতিশয় দাম্ভীক লাগলো। দেখেই খুব একটা ভালো লাগে নি। মানুষের স্বভাব তার চেহারাতেই ছলকায়। এই মানুষটিকে দেখেই রুক্ষ্ণ, বদমেজাজী, দাম্ভিক লেগেছিলো। এতো কোমল মার এমন ছেলে ব্যাপারটা হজম হলো না। ফাইজান নামক লোকের মা খুব বিব্রত স্বরে বললো,
“কিছু মনে করো না, ও একটু বেরসিক, খাইশটা। ওর বাপের মত। তোমার ভাই কি চলে আসছে?”
“হ্যা, বিশ মিনিট লাগবে”
“তুমি উনার ভাইয়ের অপেক্ষা করবে নাকি?”

ফাইজান হতবাক স্বরে শুধালো। শরীফা ধমকের স্বরে বললো,
“এত ছোট মেয়েটাকে একা ফেলে যাবো নাকি? আক্কেল কি বেঁচে আসছো? গা/ধা কোথাকার”

হুমায়রা ভাবলো, এরা চলে গেলেই ভালো। ভাইজানের সাথে এই বেয়াদব মানুষটির দেখা হলে খুব একটা ভালো হবে না। হলোও ঠিক তাই। ফাইজানের সাথে রাশাদের সাক্ষাতটা খুব একটা ভালো হলো না। ভালো তো দূর, খারাপ শব্দটিও যেনো কম সেটার বিশ্লেষণে। একটুর জন্য মারামারি বাধে নি…………………

চলবে

[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?

ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)

পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here