নিশীভাতি #৪র্থ_পর্ব

0
361

#নিশীভাতি
#৪র্থ_পর্ব

হুমায়রা ভাবলো, এরা চলে গেলেই ভালো। ভাইজানের সাথে এই বেয়াদব মানুষটির দেখা হলে খুব একটা ভালো হবে না। হলোও ঠিক তাই। ফাইজানের সাথে রাশাদের সাক্ষাতটা খুব একটা ভালো হলো না। ভালো তো দূর, খারাপ শব্দটিও যেনো কম সেটার বিশ্লেষণে। একটুর জন্য মারামারি বাধে নি। হন্তদন্তের মতো হাসপাতালে পৌছালো রাশাদ। যতই বোন বলুক সে ভালো আছে, হৃদয়ের অন্তস্থলের আপনজন হারানোর ভয়টা ঘাপটি মেরেছিলো। আছেই বা কে তার এই বোনটি ছাড়া। হ্যা, দাদা-দাদী আছেন। কিন্তু হুমায়রা তার বেঁচে থাকার প্রেরণা। নয়তো এই জঞ্জালের পৃথিবীর মায়া কবেই ফুরিয়ে গেছে। বাহিরে খোঁজ নিয়ে ওয়ার্ডে এসে বোনকে বিছানায় অর্ধশায়িত দেখে আরোও বিচলিত হয়ে পড়লো সে। ছুটে এসে বোনের সামনে দাঁড়ালো। বোনের কোমল মুখখানায় হাত রেখে বলল,
“কিভাবে হলো এটা?”

ভাইয়ের এমন উদ্বিগ্নতা ফাইজানকে প্রভাবিত না করলেও শরীফাকে করলো। বেশ অপরাধীবোধ হলো নিজেকে। ইতস্ততার সাথে বলল,
“আসলে হয়েছে কি………”

ঘটনার বর্ণনাশেষে রাশাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত হলো বোনের প্রতি। চিন্তা থেকেই বললো,
“আপনারা তো টাকা দিয়েই খালাশ, কিন্তু একটিবার কি ভেবে দেখেছেন আমার বোনের যদি কিছু হয়ে যেত তখন কি হতো! এই সামান্য টাকা আপনার গায়ে লাগছে না, কিন্তু আমার বোনের কিছু হয়ে গেলে আমি তো স্বর্বহারা হতাম”
“বুঝতে পারছি বাবা, কিন্তু আসলে কেউ তো ইচ্ছে করে কিছু করে না। তবে আমাদের সাবধান থাকা উচিত ছিল”

ফাইজান ঘড়ি দেখছে ক্ষণে ক্ষণে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। সেই বিরক্তিভরা স্বরেই বললো,
“আজব তো কিছু তো হয় নি। তাহলে এতো সময় কেনো ব্যয় করছি এখানে। আমি তো উনার চিকিৎসার খরচ দিয়েই দিয়েছি। তাহলে এতো কথার কি আছে! ভাবটা এমন যেনো কেউ মারা গেছে”

ফাইজানের কথা শুনতেই পিলে চমকে গেলো রাশাদের। শরীফা সাথে সাথে ধমকে উঠলো। কিন্তু ফাইজান নির্বিকার। এদিকে রাশাদের চোখ মুখ আপনাআপনি কুঁচকে গেলো। রগ ফুলে উঠলো কপালের। রাগ চেপে দাঁত পিষে বললো,
“ফাজলামি লাগছে আপনার? চিকিৎসার খরচ দিলেই বুঝি দায়িত্ব ঝাড়া হয়। আমার বোনের তো এখানে থাকারই কথা ছিলো। অথচ সে এখানে। তার উরুতে রড চাপা খেয়েছে, রড ঢুকে গেলে সেই দায় কি আপনি নিতেন। আর কি ভেবেছেন আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো। দেশে আইন এখন আছে”
“তাই নাকি? তাহলে আইনের কাছেই যাই নাহয়! আপনার অসীম জ্ঞানের জন্য জানিয়ে দেই, এক্সিডেন্টটা কিন্তু আমার ড্রাইভার ইচ্ছে করে নি। ইজিবাইক চালকটি রং সাইড থেকে এসেছিলো। এখানে ফল্ট তার। এটা তো আমার এবং মার ভালোত্ব যে আমরা ক্ষতি পূরণ দিচ্ছি। তাহলে কাকে আইন দেখাচ্ছেন আপনি। আর আপনার বোন মা/রা যায় নি। তার কিছু তেমন হয়ও নি। হলে সেই খরচটাও আমি দিয়ে দিতাম।“

রাশাদ রাগে গজগজ করছে। তার কান থেকে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে এই অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক মানুষটির কথা শুনে। হুমায়রা মুখ শক্ত করে কথাগুলো শুনলো। রাশাদের দিকে একবার তাকালো। ভাইয়ের হাত মুষ্টিবদ্ধ। বুঝলো আবহাওয়া ভালো নয়। তাই চটজলদি ভাইয়ের শার্টের হাতা টেনে ধরলো সে। নরম স্বরে বললো,
“ভাইজান, বাসায় যাবো। আমার স্যালাইন শেষ”

শরীফা লজ্জায় যেনো মাটিতে মিশে যায়। তিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“ফাইজান, তুমি কি বলছো এগুলো”
“আমি লজিক্যাল কথা বলছি মা। তুমি কি যাবে এবার, উনার ভাই তো এসে গেছে”
“তুমি এতো উগ্র হলে কবে থেকে!”

ফাইজান উত্তর না দিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। শেষবারের মতো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি বাহিরে আছি, তুমি আসো”

রাশাদ বোনের দিকে একনজর দেখল। তারপর নার্সকে বলল,
“ডাক্তারের সাথে কথা বলবো, আমার বোনকে আমি নিয়ে যেতে চাই”

নার্স তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। সেই সুযোগে শরীফা হুমায়রার কাছে বসলো। বিব্রত স্বরে বললো,
“আমার ছেলের কথায় কিছু মনে করো না। ও আসলে নারকেলের মত। বাহিরের থেকে খুব কঠিন, কিন্তু ভেতরটা নরম। আসলে ওর কাজটাই এমন, নরম হলেই মানুষ ওরে গিলে খাবে। তুমি যদি ওর সাথে কিছুদিন থাক তাহলেই বুঝতে পারবে ও কেমন”

হুমায়রা চুপ করে শুনলো। মহিলা নেহাৎ ভালোমানুষ নয়তো মুখের উপর ই হুমায়রা বলে দিতো,
“আপনার ছেলে একটা বেয়াদব, দেমাগী, অহংকারী লোক। এমন লোকের সাথে কিছুদিন থাকা তো দূর তার দশ ক্রোশের মধ্যেও থাকতে চাই না”

********

গ্রামের কাঁচা পথ দিয়ে খুব আস্তে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে রাশাদ। তার পেছনে তাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে হুমায়রা। হুমায়রা তাকিয়ে আছে আঁধার চিরে মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলোর দিকে। তন্ময় তার মন। নীরবতা ভেঙ্গে হুট করেই শুধালো,
“ভাইজান মায়ের খবর নিয়েছিলে?”

মায়ের কথা শুনেও না শোনার ভান করলো রাশাদ। উত্তর দিলো না সে। তখন হুমায়রা আবার শুধালো,
“মা বুঝি আমাকে খুব ঘৃণা করতো তাই না?”

হুমায়রার তন্ময় স্বর বুকে ছ্যাত করে উঠলো রাশাদের। জোর গলায় বললো,
“না তো”
“আমি জানি, মা তো আমাকে পেটেই ধরতে চায় নি”

কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। সাথে সাথেই মোটরসাইকেলে ব্রেক কষলো রাশাদ। পেছনে ফিরে বোনের দিকে তাকালো। গোল গোল নয়নে পানি চকচক করছে। মুখখানা আগলে শুধালো,
“কে বলেছে তোকে এগুলা?”
“দাদী বলছে। আমি পেটে আসার পর মা আমারে মেরে ফেলতে চাইছিলো”

হুমায়রার কন্ঠে ভার। কথাটা অসত্য নয়। রাশাদ হবার পর থেকেই জুবাইদা সংসারের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। ভালোবাসার বদলে মার, অসম্মান আর কত সহ্য হয়। এজন্য যখন হুমায়রা পেটে আসে সে ভারসাম্যহীনের মতো আচারণ করে। অবশ্য হুমায়রার ভুমিষ্টের পর সব অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আঠারো বছর পর আবারও সব এলোমেলো হয়ে গেলো। রাশাদ অনেক শান্ত গলায় বললো,
“একটা কথা মাথায় রাখবি। তোকে কেউ ভালবাসুক আর নাই বাসুক। তোর ভাইজান তোকে অনেক ভালোবাসে। মাঝে মাঝে একজনের ভালোবাসা যথেষ্ট হয় বাঁচার জন্য”

হুমায়রা হুহু করে কেঁদে উঠে। সে জানে তার ভাইজান তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। তবুও লোভী মনটা যে আরও চায়। মা-বাবার ভালোবাসা কেনো পেলো না অষ্টাদশী! এই আফসোসটি বুঝি কখনোই মিটবে না

********

গহীন রাত। ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের সাথে মিশে আছে নিগূঢ় নীরবতা। বাতাসে পতপত করে নড়ছে উঠানের বা পাশের আমড়া গাছের পাতা। সেই পাতার ফাঁকে উঁকি দেওয়া চাঁদের রুপালী আলো এসে পড়ছে উঠানে। শামসু মিঞা তাহাজ্জুদের নামায পড়তে উঠেছে। কলপাড়ে ওযু করবেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, উঠানে একটা প্রগাঢ় কালো ছায়া। কৌহুতল জন্মালো বুড়ো মস্তিষ্কে। চোর নাকি! কিন্তু চোরের কি এতো সাহস হবে? তবুও শাবলটা ঘরের কোন থেকে হাতে নিলেন। চুপি চুপি এগিয়ে গেলেন তিনি ছায়ার কাছে। মানুষটি খুব সংগোপনে প্রবেশ করছে তার বাড়িতে। খুব কাছাকাছি যেতেই কপালে ভাঁজ পড়লো শামসু মিঞার। রাগে শরীর গরম হয়ে গেলো। বুড়ো জীর্ণ শরীর নিয়ে ছুটে যেয়েই এলোপাথাড়ি মার শুরু করলেন তিনি। ফলে মানুষটি ব্যাথায় চিৎকার শুরু করলো।
“আব্বা, লাগতেছে।
“কু/ত্তার বাচ্চা, সাহস কেমনে হইলো মোর বাড়িতে পা রাখার। শয়তান, জানোয়ার। সাহস কেমনে হইলো মোর নাতীনের ঘরে শফিরে ঢুহানোর। তোরে আজকে মাই/রে ফেলাবো”
“আব্বা, ছাড়েন।“

কাওছারের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলো বাকি মানুষের। ছুটে এলো তারাও উঠানে। রাশাদ থামাতে চাইলো দাদাকে। কিন্তু থামলো না শামসু মিঞা। একপর্যায়ে মার সহ্য না করতে পেরে নিজের পিতাকে সজোরে ধাক্কা দিল কাওছার। ছিটকে পড়লো শামসু মিঞা। তাড়াতাড়ি রাশাদ তাকে ধরলো। বৃদ্ধ শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। বুকে ব্যাথা করছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলেন,
“এই শয়তানডারে বের কর। এক্ষন বের কর”

বলতে বলতেই নিস্তেজ হয়ে পড়লেন তিনি………………

চলবে

[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?

ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)

পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here