নিশীভাতি #৩৪ম_পর্ব

0
298

#নিশীভাতি
#৩৪ম_পর্ব

ফাইজান কৌতুহলের বশেই খুললো কাগজটি। দু লাইন পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। কারণ এটি যে সে কাগজ নয়৷ রীতিমত প্রেমপত্র, তাও তার বউকে উদ্দেশ্য করে লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে, সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে লেখা;
“Love at first sight– ব্যাপারটি কখনোই আমার কাছে যুক্তিগত ছিলো না। এখনো নয়। তুমি হয়তো আমাকে জানো না, তবে আমি মানুষটি খুব লজিক্যাল। আমার কাছে প্রেম পিরিতির জন্য সময় নেই। আমার একটাই লক্ষ্য জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তার জন্য আমার কোনো বন্ধুও নেই। আমি বানাই নি। কারণ বন্ধুত্ব আমাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। কিন্তু আমার সব পরিকল্পনাগুলো কেমন ভন্ডুল হয়ে গেলো যেদিন আমি প্রথম তোমাকে দেখেছি। আমি কেনো যেনো বেহায়ার মতো তোমাকে দেখছিলাম। তুমি বিশ্বসুন্দরী নও মোটেই৷ কিন্তু কেনো যেনো তোমাকে দেখার লোভ আমার যাচ্ছিলো না। সেদিন আমি স্যারের কোনো কথাই শুনিনি। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিলো, এতোটা বেখেয়ালি আমি মোটেই নই। রাগ আরোও বাড়লো যখন দেখলাম আমি অংক কষতে যেয়েও তোমার মুখ মস্তিষ্কে ছেপে গেছে৷ আমি পড়তে পারছি না। আর ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছি না। বুঝলাম হয়তো এটা আমার ইনফ্যাচুয়েশন। হতেই পারে, সুন্দর জিনিসের প্রতি মানুষ আকর্ষিত হয়৷ আমিও হয়েছি। অবাককর ব্যাপার তোমার থেকেও সুন্দরী মেয়ে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে কিন্তু আমি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটি মোটেই ভালো নয়। ভেবেছি কমে যাবে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ দিনদিন বাড়ছে। আমার মাথানষ্ট হলো যেদিন প্রথম তোমার হাসি দেখলাম। এতো স্বচ্ছভাবে কেউ হাসতে পারে? তোমার মাঝে কেনো কোনো কলুষতা নেই? কেনো তোমাকে দেখলেই আমার মায়া হয়? আমার মনে হচ্ছিলো আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম আটকে আসছে। আমার মস্তিষ্কজুড়ে তোমার বিস্তৃতি আমি টের পাচ্ছিলাম। আমি বুঝলাম এটা সাধারণ আকর্ষণ নয়। আমি এখনো বলবো আমি তোমাকে ভালোবাসি না। প্রেম আমার মনে স্থান পায় নি। কিন্তু এটুকু টের পেয়েছি তোমাকে জানার ইচ্ছে আমার ফুরাবার নয়। আমি তোমাকে জানতে চাই হুমায়রা। হুমায়রা বিলকিসকে আমি চিনতে চাই। তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দিবে? বন্ধু হবে আমার?”

ফাইজানের স্থির দৃষ্টি কাগজটিতে নিবদ্ধ। মস্তিষ্ক সময় নিলো ব্যাপারটির গভীরত্ব অনুধাবণে। কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু। হুট করেই যেনো তার চিন্তাচেতনাগুলো লোপ পেলো।
“দাঁড়িয়ে আছেন যে? ঘুমাবেন না?”

হুমায়রার কন্ঠে স্বম্বিৎ ফিরলো। সাথে সাথে কাগজটি দুমড়ে মুচড়ে মুঠোবন্দি করলো সে। হুমায়রার অগোচরে ট্রাউজারের পকেটে পুরলো। হুমায়রার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললো,
“চলুন”

মুখোমুখি দুজন শুয়ে আছে। ফাইজানের স্থির দৃষ্টি হুমায়রার ঘুমন্ত মুখবিবরে আবদ্ধ। খোলা অবিন্যস্ত চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়েছে। কিশোরীর তাতে খেয়াল নেই। ফাইজান আলতো হাতের স্পর্শে তা গুজে দিলো কানের পাশে। শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো কিশোরী। একটু নড়লো। ফাইজান সেই সুযোগে তাকে আরেকটু কাছে টেনে নিলো। মেয়েটি ঘুমালে কিছু টের পায় না। হয়তো টের পায় কিন্তু আমলে নেয় না। তবে প্রায় রাতে ফাইজান তাকে কাছে টেনে নেয়। নিজের সন্নিকটে রাখে, যেখানে তার নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসে। কোমড়ের অস্থি চেপে ধরে মাঝে মাঝে। মেয়েটি একটু নড়ে চড়ে উঠে, তারপর আবার ঘুমিয়ে যায়। ফাইজানও ঘুমিয়ে পড়ে তখন। কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। চিরকুটটির প্রতিটি শব্দ বিশ্রীভাবে মস্তিষ্কে আঘাত করছে। খুব বিশ্রী ভাবে। বারবার শব্দগুলো তাকে পোড়াচ্ছে যেনো। হুমায়রাকে কেউ পছন্দ করে, কেউ তার সাথে ঘনিষ্টতা বাড়াতে চায় ব্যাপারটি মোটেই ভালো লাগছে না ফাইজানের। বরং খুব ই বাজে লাগছে। রাগ হচ্ছে, মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মস্তিষ্কের কোষগুলো উৎপাত করছে যেন।

বয়স কত হবে ছেলেটির। স্যারের ব্যাচে পড়ে তাহলে আঠারো কিংবা উনিশ। কম করে হলে তার থেকে তেরো বছর ছোট। একটা তের বছর ছোট ছেলের বাচ্চামোতে তার উপর রাগ করাটা হাস্যকর। হাস্যকর তো বটেই, তার থেকে বেশি হাস্যকর এই যে সে নিজের অমূল্য ঘুমকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে নিয়ে ভাবছে, দুশ্চিন্তা করছে। কিসের দুশ্চিন্তা? হুমায়রাকে নিয়ে! সে কি চিঠিটা পড়েছে? সে কি ছেলেটিকে চেনে? যখন ছেলেটি তাকে চিঠিটি দিচ্ছিলো তখন তার কেমন লেগেছিলো? সে কেনো চিঠিটি নিয়েছে? সে কি ছেলেটিকে পছন্দ করে? কথাটাগুলো ভাবতেই উঠে বসলো ফাইজান। তার অশান্ত চিত্ত তাকে অস্থির করে তুলছে। বিশেষ করে শেষ প্রশ্নটি! ভাবতেই যেনো নিঃশ্বাস আটকে আসার যোগাঢ় হলো। উত্তেজনায় মাথা ফেটে যেতে চাইলো। ভ্রু কুঞ্চিত হল তার। প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো। সবকিছু যেনো এলোমেলো লাগতে লাগলো। পাশের ঘুমন্ত কিশোরীকে তখন আকড়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে, যেখানে সে বাদে অন্যকারোর উপস্থিতি থাকবে না। অবান্তর চিন্তা, নিতান্তই অবান্তর। কিন্তু ফাইজানের বুক কাঁপছে। অস্থির লাগছে। বত্রিশ বছরের যুবক এই কনকনে শীতেও ঘামছে তরতর করে। তার মুখবিবরে আতংক, ত্রাশ। ছোট্ট বউটিকে হারিয়ে ফেলার কাতরতা চুয়ে চুয়ে পড়ছে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলালো। সে তো এমন নয়, বিকারহীন, অনুভূতিহীন, কঠিন মানুষ সে। খুব কঠিন পরিস্থিতিতেও সে থাকে স্থির, শান্ত। কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করে না বিন্দুপরিমাণ। কারণ এভাবেই নিজেকে তৈরি করেছে সে। তবে একটা ছোট ছেলের আবেগমিশানো প্রেমপত্রে কি আসে যায়! হুমায়রা সে বয়সে ছোট, কিন্তু খুব বুঝদার। সে কখনোই এমন কিছুকে প্রশ্রয় দিবে না। হয়তো সে ছেলেটিকে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারে নি, হয়তো সে জানতো না চিঠিতে কি লেখা, হয়তো সে পড়েও নি। যদি এমন কিছু হয় তবে ফাইজান কখনো তাকে জানতেও দিবে না চিঠির কথা। কিন্তু যদি এমন কিছু না হয়? যদি ছেলেটির আবেগঘন সস্তা চিঠিতে সে গলে যায়! ছেলেটি তার সমবয়সী। ছেলেটি হয়তো তার সাথে ঘনিষ্টতা বাড়াবে। হয়তো তার প্রতি দূর্বল করার চেষ্টা করবে! কথাটা ভাবতেই গলগলে রক্তের স্রোত বইলো শিরদাঁড়া বেয়ে। নাহ! সে এটা হতে দিবে না। সে হুমায়রার ত্রিসীমানাতে ছেলেটিকে প্রবেশ করতে দিবে না। হয়ত সে ছেলেটিকে চিনে না, কিন্তু চিনতে কতক্ষণ। সে তো ওই ব্যাচেই পড়ে। দরকার হলে সে ব্যাচ পালটে দিবে। পরমুহূর্তেই ফাইজান ধাতস্থ হলো। সে পাগলামি করছে, অপ্রকৃতস্থের মত চিন্তা করছে। তার বয়সের পুরুষের এমন চিন্তাধারা খুবই বেমানান। তার চেয়েও অধিক বেমানান হুমায়রাকে এমন নিজের মাঝে বন্দি করে রাখার চিন্তা! সে কেনো একটা আধবয়সী ছেলের চিঠিতে এতোটা চিন্তিত! সে কি হুমায়রাকে ভালোবাসে! বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টির শব্দ আছড়ে পড়ছে জানালায়। হীম শীতে শীতল ঘর। ফাইজানের নির্ঘুম মস্তিষ্ক শত চিন্তায় জর্জরিত। আজ রাতটা আবার নির্ঘুম কাটবে!

****

ফাইজানের অফিস ঘরে হুল্লোড়। পার্টির ছেলেপুলেরা হিসেব করছে টাকার। ওয়ার্ড কমিশনাররা এসেছিলো। তাদের ভোটারদের জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করতে বলা হয়েছে। টাকা ফাইজান দিচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটি গোপনীয়। এদিকে ঘরে ঘরে তার প্রচার কমিটি ভোট চাইতে যাচ্ছে। গতবার বন্যায় ফাইজানের কাজগুলো বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সেকারণে গরীবদের কাছে সে বেশ প্রিয়। কম্বল প্রদানের কর্মসূচিও শেষ। ভোটের আর বেশি বাকি নেই। প্রচারের গান সবখানে শোনা যাচ্ছে। এর মাঝে দুটো ছেলের মাঝে একটু ঝামেলা হয়েছে। তাদের রেষারেষি এই সময়ে মোটেই উপকারি নয়। ফরিদ ব্যাপারটি নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো, কিন্তু ফাইজান বিকারহীন। সে শুধু পেপারওয়েটটির দিকেই চেয়ে আছে।
“ফাইজান তুমি কি ওদের সাথে কথা বলবে? নাদিম আর আফসান ছেলে দুটো কিন্তু আমাদের জন্য খুব কাজের। ফাইজান তুমি কি কথা বলবে? ফাইজান? ফাইজান?”
“কিছু বললে?”

অন্যমনস্ক স্বরে উত্তর দিলো ফাইজান। ফলে ফরিদ কিছুটা অবাক হলো। বিরক্ত স্বরে শুধালো,
“তুমি কি কিছুই শুনোনি?”

ফাইজান সত্যি ই কিছু শুনে নি। ফলে ফরিদের চিন্তা হলো,
“সকাল থেকে দেখছি তুমি অন্যমনস্ক! হয়েছে কি?”
“কিছু না”
“আমাকে বিশ্বাস করতে হবে সেটা? তুমি তো এমন উদাসীন নও। কিছু নিয়ে চিন্তিত কি?”

ফরিদের কন্ঠে চিন্তার রেশ। ফাইজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“রাতে ঘুম হয় নি, তাই ক্লান্ত?”
“বিয়ের পর এই প্রথম এই কথাটা শুনলাম। ঝগড়া হয়েছে নাকি?”

ফরিদের রসিকতার উত্তর হিসেবে ফাইজান বললো,
“উহু”

পরক্ষণেই শুধালো,
“আঠারো উনিশ বছরের আবেগ কি খুব সিরিয়াস কিছু হয়?”

ফাইজানের কথাটা শুনতেই চক্ষু ছানাবড়া হলো ফরিদের। তার বিস্ফারিত নয়নে কৌতুহল। ফাইজান সাথে সাথেই কথা ঘোরালো,
“নাদিমকে আমার সাথে দেখা করতে বলো”

বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। ফরিদ অবাক কণ্ঠে শুধালো,
“কোথায় যাও?”
“আজ শরীরটা ভালো নেই! বাসায় যাচ্ছি। এদিকটা সামলে নিও”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে। ফরিদের কৌতুহল কাটছে না। ফাইজানের আজ হলো কি!

******

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হানা দিচ্ছে ধরনীতে। শীতের প্রকোপ দ্বিগুণ বেড়েছে। হুমায়রা হাতা আনে নি। ফলে বৃষ্টির ছটায় সোয়েটারটা ভিজে গেছে। ঠান্ডা লাগছে। এর মাঝেই গম্ভীর স্বর কানে এনো,
“উত্তরটা এনেছো?”

পাশ ফিরতেই মৃণালের দেখা পেলো। কালো ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখ ফ্যাকাশে লাগছে। নেত্রমনি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঘুমায় নি হয়তো। হুমায়রা ব্যাগ খুললো। একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“যতটা কঠিন ভেবেছি, ততটা কঠিন নয়”

মৃণালের মুখভাব পালটে গেলো। চোখে মুখে বিভ্রান্তি। বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“এটা কি?”
“৭৮ নাম্বার পৃষ্ঠার প্রশ্নের উত্তর”
“তুমি আমার চিরকুট পাওনি?”

এবার হুমায়রা অবাক হলো৷ ভ্রান্ত স্বরে শুধালো,
“কোন চিরকুট?”

মৃণালের অস্থিরতা বাড়লো। এদিক ওদিক চেয়ে গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুখ থেকে চ সূচক শব্দ নিঃসৃত হলো। বিরক্তি দমিয়ে বললো,
“তুমি সত্যি পাও নি?”
“না”

কিছুসময় চুপ রইলো মৃণাল। তারপর কণ্ঠস্বরের রুক্ষতা কমালো। জড়তাহীন স্বরে বললো,
“আমার তোমাকে ভালো লাগে হুমায়রা। আমি তোমাকে….”
“হুমায়রা”

কথাটা শেষ করার পূর্বেই রাশভারী কন্ঠস্বর কানে এলো মৃণালের। পেছন ফিরতেই ছাতি হাতে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত হৃষ্টপুষ্ট যুবকের দেখা পেলো সে। যুবকটির মুখশ্রী থেকে তার দৃষ্টি বেশি ধারালো। মৃণাল কিছু বলতে পারলো না। যুবকটি এসেই হুমায়রার মাথায় ছাতা ধরলো। মৃদু স্বরে বললো,
“দেরি করে ফেললাম নাকি?”

হুমায়রা মাথা নাড়ালো। না সে দেরি করে নি। ফাইজানের দৃষ্টি এবার মৃণালের দিকে গেলো। হুমায়রার কাধে হাত দিয়ে শুধালো,
“আপনার বন্ধু?”
“বন্ধু না, একই ক্লাসে পড়ি আমরা”

হুমায়রার উত্তরের সাপেক্ষে ঠোঁটের কোনায় অদ্ভুত হাসি উন্মোচিত হলো ফাইজানের। ভারী স্বরে শুধালো,
“নাম কি তোমার?”
“মৃণাল”
“আমি ফাইজান ইকবাল, হুমায়রার হাসবেন্ড”…..

চলবে

(সাফওয়ান এবং আয়াতের প্রেমকাহিনী এখন সাতশত অধিক পাঠকের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। পড়েছেন তো! না পড়ে থাকলে বইটই এ মাত্র ৬০ টাকায় পেয়ে যাবেন “চাঁদ বলে হাতটি ধরো”)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here