ফুলকৌড়ি (৩৮) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
434

#ফুলকৌড়ি
(৩৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কৌড়ির ফোনটা প্রায়শই নাফিমের হাতে দেখা যায়।সেদিন রাতেও ড্রয়িংরুমে বসে কৌড়ির ফোনটা নিয়ে গেম খেলছিলো নাফিম।আশেপাশে কেউ ছিলোনা।শুধু ডাইনিং টেবিলে প্রতিদিনের ন্যায় খাবার সাজাচ্ছিলেন তিন নারী।যাদের খেয়াল ড্রয়িংরুমে ছিলোনা।নিভান গিয়ে বসেছিলো নাফিমের পাশে।বরাবরের মতো নিভানকে দেখে দ্বিধান্বিত হয়ে ভয়ে গেম খেলা ছেড়ে ফোনটা তারদিকে এগিয়ে দিয়েছিলো নাফিম।
প্রথমে ভেবেছিলো,ফোনটা নেবেনা।নাফিম কে খেলতে বলবে কিন্তু তারপর কিছু একটা ভেবে ফোনটা নিয়েছিলো নিভান।নাফিম চলে যেতেই ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে,রেকর্ড অ্যাপসের মধ্যে হাত লেগে ঢুকে গিয়েছিলো।বেশ অনেকগুলো রেকর্ড।বেশিরভাগ বিথী বলে নাম সেভ করা সেই মেয়েটার সাথে কথোপকথনের রেকর্ড।রেকর্ডিং অ্যাপস থেকে চলে আসতে গিয়েই আবারও হাত লেগে রেকর্ড ওপেন হয়ে যায়।ওটাই হয়তো সেদিনের শেষ কথা ছিলো,তারপর আর কারোর সাথে কথা হয়নি। যার কারনে রেকর্ডের তালিকায় প্রথম ওই রেকর্ডটা থাকায়
অনিচ্ছুক সত্ত্বে জানতে পেরেছিলো,বিথীর আর কৌড়ির মধ্যে হওয়া কথাগুলো।বিথীর উপদেশ মুলক বানীগুলো।সেখানে আরও রেকর্ড ছিলো,কৌতুহল জাগলেও শোনেনি নিভান।ওটুকু শুনেই নিভানের মনে হয়েছিলো মেয়েটার স্বাধীনতা হরন করছে।মেয়েটার প্রতি এক্সট্রা লেভেলের পজেসিভ হয়ে পড়েছে সে,তাই বলে এভাবে অন্য গোপনীয়তা হরন করার বিষয়টা অতিরিক্ত।সেরকমই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় নাহিদের ভালো হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সম্পর্কেও জানতে পারেছিলো সে।তবে সেদিন নিজথেকে শোনেনি।নাফিম ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো,আর কিছু একটা শুনছিলো।সে পাশে এসে বসতেই কথাগুলো শুনেছিলো।বাচ্চা মন হয়তো কৌতহলবশত শুনছিলো, কি রেকর্ড আছে বা গানটান কিছু কি-না।আর তাকে পাশে বসতে দেখেই বরাবরের মতো ফোনটা রেখেই দৌড় দিয়েছিলো।তবে নাফিম ফোন রেখে গেলেও রেকর্ড বন্ধ করেনি নিভান।সেদিন ইচ্ছাকৃতভাবেই রেকর্ডটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো।
একবার নয় দু’বার,খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল।আর সেদিন মনে গেঁথে গিয়েছিলো অজনা শঙ্কা।তবে সেদিন রেকর্ড শোনার পর রেকর্ডগুলো ডিলিট দিয়েছিলো নিভান।সাথে রেকর্ড অপশন-ও অফ করে দিয়েছিলো।প্রায়সই নাফিমের হাতে ফোন থাকে।মেয়েটার তারসাথেও মাঝেমধ্যে কথা হয়।বিষয়টা ভালো দেখায় না।

সেদিন থেকেই মনটা কৌড়িকে নিয়ে অদ্ভুত এক আশংঙ্কায় কুঁকড়ে আছে।কোনোভাবে কৌড়িকে যদি হারিয়ে ফেলে!এমন শঙ্কা মনের কোণে কোথাও একটা এঁটে খুঁতখুঁত কাজ করছিলো!আর সেই শঙ্কা থেকে আজ হাফিজ ভাইকে না যেতে দিয়ে কৌড়ির সাথে এক্সট্রা সতর্কতাসরূপ ইভানকে পাঠালো।তাতে হোলোটা কি?ইভানকে বারবার বলে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও ইভান তো সেই ব্লান্ডারটাই করলো!যে দৃশ্যাবলী মনেমনে দৃশ্যমান করতেও মনকে কখনো প্রশ্রয় দেইনি।দিতে চাইনি নিভান।সেই দৃশ্যই কি পরিতৃপ্ত করে দিলো না তাকে! মনকে কিভাবে ওই দৃশ্যাবলী দেখার পর ক্রোধে জ্বলে উঠা আগুনের অনল থেকে রক্ষা করবে!কি করে নিজেকে ঠান্ডা করবে সে?উফফ!কৌড়ি!

‘দাদাভাই প্লিজ!ওরা শুধু কথা বলছে।ওরা ভাইবোন ভালোমন্দ কথা বলতেই পারে।প্লিজ উল্টো পাল্টা ভেবে কিচ্ছু করোনা।প্লিজ দাদাভাই,আমার রিকোয়েস্ট। প্লিজ প্লিজ।তুমি অসুস্থ।প্লিজ দাদাভাই।

মৃদু হাসলো নিভান।কি ঠান্ডা ভয়ংকর তাচ্ছিল্যময় হাসি।ইভানের বুক কেঁপে উঠলো।সে নিশ্চিত, সেদিনের মতো আজও দাদাভাই একটা অঘটন ঘটাবে!তন্মধ্যে নিভান শীতল মার্জিত গলায় বললো।—এতো সুন্দর দৃশ্যবালী দেখার জন্য ওরসাথে আমি তোকে পাঠিয়ে ছিলাম ইভান?ওরা দু’জনে নির্জন পুকুরপাড়ে বসে গল্প করবে আর আমি দুনয়ন পরিতৃপ্ত করে দেখবো!

মার্জিত কথাগুলো মোটেই নিভানের ঠান্ডা গলায় ঠিক লাগলোনা ইভানের।কি করবে,কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো-না।কেমন পাগল পাগল লাগলো।সত্যিই তো দাদাভাই তাকে বিশ্বাস করে পাঠিয়ে ছিলো,সেই ভরসা বিশ্বাসের মর্যাদা কি রাখতে পেরেছে সে?পারিনি তো!মূহুর্তেই মুখটা ছোটো হয়ে গেলো তার।দূর্বল নমনীয় গলায় অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বললো।–‘স্যরি দাদাভাই।

‘বাড়িতে আসছিস কখন?

নিভানের ঠান্ডা গলার বার্তা প্রশ্ন নয় উত্তর বলে দিচ্ছে, আর একমুহূর্ত নয়।এক্ষুনি চলে আসবি।অথচ এখন কোনোমতোও যাওয়া সম্ভব নয়।কৌড়ির দাদিআপা রান্নাবান্নার বিশাল আয়োজনে নেমেছে।প্রিয় নাতনীটাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়েছে বলে কথা।সেই মানুষটাকে এখন কি বলে উপেক্ষা করে বাড়িতে যাবার কথা বলবে সে!ভিতরে ভিতরে ভিষণ অসহায় বোধ করলো ইভান।কন্ঠে ফুটে উঠলো সেই অসহায়ত্ব।

‘প্লিজ দাদাভাই,একটু বুঝতে চেষ্টা করো।এখন আসা সম্ভব নয়।কি করে আসবো?

‘এইযে আজ আমি অফিসে এসেছি,মৃদুল ড্রাইভ করে নিয়ে এসেছে।এখন বল,তবে তুই কি চাইছিস?এই অবস্থায় আমি ড্রাইভ করি আবারও উল্টো পাল্টা কিছু ঘটিয়ে হসপিটালে পড়ে থাকি?এবার মনে কর আর বেঁচে ফিরলাম না আমি।

দূর্বল জায়গায় আঘাত!মুখটা আরও অসহায় দেখালো ইভানের।কন্ঠস্বর আগের ন্যায় দূর্বল, নমনীয় রেখে বললো।-কেনো পাগলামি করছো?তুমি এমনটা ছিলেনা দাদাভাই!এমনটা তোমার কাছে কাম্য নয়।

এবার আর নিজের ভিতরের ক্রোধটাকে চাপিয়ে রাখতে পারলোনা নিভান।এতোসময় বহুত চেষ্টা করেছে তবে আর অনড় থাকতে পারলোনা।টেবিলের উপরের ফুলদানিটা মূহুর্তেই হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো।টেবিলের সরাসরি কাঁচের দরজায় গিয়ে সেটা করাঘাত করলো।মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।সেই চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের টুকরো টুকরো শব্দে অফিসকক্ষ যেনো মৃদু ভূমিকম্প বয়ে গেলো।শব্দ ছড়িয়ে পড়লো,অফিসকক্ষের বাহিরে স্টাফকক্ষেও।সবার নজর প্রশ্নাতীত হলো।তবুও সাহস জুগিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে এলোনা।শুধু ক্ষনে ক্ষনে সেদিকে নজর দিলো।ততোসময়ে নিভানের ক্রোধিত কন্ঠস্বর বজ্র গলা নিলো–এই তোরা কি বাধ্য করছিসনা আমাকে এমনটা করতে?ইভান,ওই ছেলেটার জন্য মেয়েটার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বাবার মৃত্যুর দিনে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তাকে।অন্যের আশ্রিতা হয়ে থাকতে হচ্ছে! বিষয়টা নিশ্চয় তোর অজনা নয়!আর না নেহাৎই ছোটোখাটো কোনো কারণে বাড়িছাড়া হতে হয়েছে তাকে বলে তোর মনেহয়!বিষয়টা কোন পর্যায়ে গেলে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে সেটাও নিশ্চয় তোর আন্দাজ আছে! করতে পারছিস আন্দাজ!তবুও কেনো সব বুঝে ওকে ওখানে নিয়ে গেলি?ও তো আবদার জুড়বে,ওর সবকিছু ওখানে।তুই কেনো বুঝলিনা?ওই ছেলেটাকে বিশ্বাস করে তার কথায় তুই ওকে ওবাড়িতে নিয়ে গেলি!কেনো?আর ওর-ও বিবেকবোধ দেখ,দিব্যি কি সুন্দর প্রকৃতি বিলাশ করছেন ম্যাডাম।তাও আবার সেই ছেলেটার সাথে,যে মাত্রই ওর জীবনের দুঃস্বপ্ন।আশ্চর্য হচ্ছি আমি!শুধু ওর আমাতেই সমস্যা।ওকে কাছে পেলে….

কথা শেষ করলোনা নিভান। দাঁতে দাত চেপে বাকি কথা গিলে ফেললো।ছোটো ভাইয়ের সামনে তা আর প্রকাশ করতে চাইলোনা।ফের কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত গলায় বললো।–ফোন ওর কাছে দে।

বকাগুলো নীরবে হজম করলেও,কৌড়িকে চাইতেই চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেলো ইভানের।কৌড়িকেও বকবে নাকি?বকারই তো কথা।যে কান্ড ঘটিয়েছে মেয়েটা।কি দরকার ছিলো এতো সুন্দর ঘটা করে বসে ওই খাটাশটার সাথে কথা বলার।আচ্ছা কৌড়ি যে মেয়ে, এমন ঘটা করে কথা বলার তো নয়।পরিক্ষার কেন্দ্র ছেলেটাকে দেখেও তো কথা বলিনি সে।এমনকি বাড়িতে আসার পথে ভুলেও ছেলেটার দিকে নজর দেয় নি কথাতো দূর।তবে এখন এতো ঘটা করে কথা বলছে কেনো?যাই হোক দাদাভাইয়ের এখন কৌড়ির সাথে কথা বলতে দেওয়া যাবেনা।নাহলে আরেক কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।আর সেই কেলেঙ্কারির কারণ ধরে যদি কৌড়িকে আর ওবাড়িতে না পাঠাতে রাজী হয়!তবে এদিকে দাদাভাইকে ঠান্ডা করবে কিকরে?অসহায় নজরে আকাশের পানে তাকালো ইভান।ফের অসহায় কন্ঠে মিনমিন করে বললো –ইয়া আল্লাহ মাবুদ রক্ষে করো!

‘কি হলো ফোন ওর কাছে দে।

ইভান পড়লো বিপাকে। তবুও আরেকবার রোধ করার চেষ্টা করে বললো–‘পরে কথা বললে হবে না?পরে কথা বলে নিও?

‘ইভান…

কলিজা মোচড় দেওয়ার মতো শীতল ডাকটা শুনেই তড়িঘড়ি করে ইভান ফের বললো—প্লিজ দাদাভাই,মেয়েটাকে বকো-না।আমার দোষ,আমার যা বলার বলো।ও বাড়িতে এসে ভিষণ খুশী।আমি এতোটা উচ্ছল ওকে ওবাড়িতে কখনো দেখিনি।

আগুনে ঘি ঢাকার মতো কাজ করলো ইভানের বলা বাক্যগুলো।ইভান তখনও বুঝতে পারিনি সে আরও একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে।নিভানের তাচ্ছিল্যেময় ঠান্ডা গলায় উত্তর পেতেই নিজের গালে কোষে দু’চারটা চড় অনায়সে মারতে ইচ্ছে করলো তার।–‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি তিনি বাড়িতে গিয়ে আপন মানুষদের পেয়ে কতো আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।

প্রায় তিন মাসের মতো নিজ বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন কৌড়ি অথচ এবাড়িতে আসার পর মনেহচ্ছে তিনমাস নয় কত যুগ সে এবাড়ি থেকে দূরে।পরিচিত একই ঘরবাড়ি,আগানবাগান,পুকুরঘাট অথচ সবটাই যেনো কৌড়ির চোখে নতুন লাগছে।পরিক্ষার কেন্দ্রে বিথীর সাথে দেখা হলেও,পরিক্ষা দিয়ে কোনোমতে বাড়িতে গিয়েই মেয়েটা আবার চলে এসেছে তার এখানে।কতো কথা, কতো গল্প,কতো মনখারাপ হলো এই কয়েক ঘন্টার মধ্য।কৌড়ির মনেহলো,মেয়েটা কতো কথা জমে রেখেছে তারজন্য।একসাথে নিজের ঘরে বসে গল্প করছিলো কৌড়ি আর বিথী।দুপুর গড়িয়ে বিকালের আভা ছড়াতেই দুজনে,কৌড়িদের মুখামুখি শান বাঁধানো ঘাটটায় গিয়ে বসেছিলো।কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বিথী উঠে গিয়েছে ওয়াশরুমে।আর বিথীর ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো কৌড়ি।হঠাৎ অনুভব করলো তার মুখোমুখি শান বাঁধানো বসার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে কেউ।মুখ উচু করে তাকাতেই আগের সেই উগ্র লাল চোখের চাহুনী,নেশাখোর টাইপের ছন্নছাড়া চেহারা কিছুই নজরে এলো-না কৌড়িট।সেখানে শান্ত নজর আর সুদর্শন মুখটা নজরে পড়লো কৌড়ির।যে উগ্র ছেলেটার জন্য তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিলো, সেই ছেলেটা কি এই?হঠাৎ মেলাতে পারলোনা কৌড়ি।তবুও মনেমনে শঙ্কিত হলো।ছেলেটা এখানে এসেছে কেনো?

‘কেমন আছিস?

গলার সেই একগুঁয়ে উচ্চ স্বরটাও বিলিন।কি নম্রভাব সেখানে।তার আলাপনের উত্তর দেওয়া উচিত কি?উচিত অনুচিত খুব একটা ভাবা প্রয়োজন মনে করলো-না কৌড়ি।শুধু গাঁট হয়ে বসে রইলো।সেদিন যখন সবসীমা পার করে তারসাথে নরপিশাচের মতো আচারণ করেছিলো।তাকে বাজে উদ্দেশ্য ছুঁতে চেয়েছিলো ছেলেটা। তারপর থেকে,এই ছেলেটার সাথে কথা বলা তো দূর ঘৃনার মুখটাও দর্শন করার ইচ্ছেও করে-না কৌড়ির।আর যারজন্য বাবার মৃত্যুর শোকটাও ঠিকঠাক পালন করতে পরিনি,বাড়ি ছাড়া হতে হলো তাকে।সেই ছেলেটার কথার উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনা কৌড়ি।কথাই বলতে চায়না সে।সামনের ছেলেটা বুঝি সেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলো,অপরাধবোধটা যেনো ধিকেধিকে জ্বললো বুকের ভিতর।কৌড়িকে পাওয়ার ইচ্ছে সেই ছেলেবেলা থেকে।সেখানে কৌড়ির সাথে ওই বাজে নোংরা আচারণটা সে করতে চায়নি।আগেও করতে চায়নি,সেদিনও করতে চায়নি।কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়েছে।বলাবাহুল্য তখন বন্ধুদের পরামর্শটা তার কাছে যথাযথ মনে হয়েছিলো।শুধু তখন নয়,তখনকার সব পরামর্শ তারকাছে যথাযথ মনে হতো।যা এখন আফসোস হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাকে অপরাধবোধে ভোগায়।আর সবচেয়ে বড় আফসোস এটাই,সেই বুঝলো সে।তবে কৌড়িকে হাতছাড়া করার পর।এটা যদি কয়েক বছর আগে বুঝতো,তবে কৌড়িকে মনেহয় হারাতে হতোনা তাকে।জোর করে, গুন্ডামী করে ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে, যে আর যাই হোক মনের মানুষের ভালোবাসা হোক বা তাকে,আদায় করা সম্ভব নয়।তা এখন হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।সত্যিই কি কৌড়ি শুধু তার আফসোস হয়ে থাকবে?মূহুর্তেই
পিছনের করা অপরাধমূলক উগ্র আচারনগুলো দুনয়নে ভেসে উঠলো।তাচ্ছিল্যের মৃদু হেসে অপরাধবোধে মাথা নিচু করে নিলো সে।মন বললো।হয়তো আফসোস হয়েই থাকবে কৌড়ি তার !তবে স্বীকারোক্তি তো তাকেই জানাতেই হবে।

‘বড়চাচা আর তোরসাথে এযাবৎকালের আমার করা সকল অন্যায় আচারণের অপরাধী আমি।জানি ক্ষমার যোগ্য নয়।তবুও ক্ষমা করিস আমায়।আমি আমার করা আচরনের জন্য অন্যকে দায়ী করতে চাইনা,তবুও বলছি আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোরসাথে বা বড়চাচার সাথে ওই অন্যায়মুলক উগ্র আচরনগুলো করিনি। করতে চায়ওনি।আর না সেদিন তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চেয়েছিলাম।আমার সবকিছু খারাপ আমি জানি।কিন্তু তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চাওয়ার মানসিকতা আমি কখনো পোষণ করিনি।বিশ্বাস কর,শুধু বন্ধদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।ওরা বলেছিলো,আমার দ্বারা তুই কলঙ্কিনী হলে,তুইও বাধ্য হবি আমার হতে আর চচাও বাধ্য হবে তোকে আমার সাথে বিয়ে দিতে।আমি তোকে পাওয়ার লোভে,ওদের পরামর্শ নিয়েছিলাম।আর সেই পরামর্শে যে তোকে একেবারে হারিয়ে ফেলবো,তা তখন বুঝিনি।দোষ আমার নয় বলছিনা।দোষ পুরো আমার।আমি অন্যায় করেছি,বাজে আচারণ করেছি।কিন্তু তোকে পাওয়ার আগ্রহটা আমার কোনোকালেও মিথ্যা ছিলো-না,ফুল।শুধু পন্থা অনুসরণ করাগুলো ভুল ছিলো।যদিও সেই ভুলের মাশুল মনে হয়,তোর বোঝা বোঝা ঘৃনার অনল নিয়ে আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়ে যেতে হবে।আমি রাজি বইতে।তবুও বলবো ক্ষমা করিস আমায়।তোর জীবনের সকল খারাপ পরিস্থিতিগুলো ক্রিয়েট করার জন্য দ্বায়ী আমি।পাারলে সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিস।

মাথা উঁচু করলো নাহিদ।কৌড়ির অবিশ্বাস্য নজরে নজর রাখলো সে।ওই নজরে তারজন্য দ্বিধা, সংশয় অবিশ্বাস, ঘৃনা সব যেনো স্পষ্ট।হয়তো তার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছেনা বা চাইছে না মেয়েটা।অবিশ্বাস্য
শুভ্র মুখখানা কি মায়াময়।এই মায়াই-তো ডুবেছিলো সে।আর তারজন্য কতো পাগলামি,কতো উগ্রতামী করলোই না জীবনে সে!অথচ ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু হলো না!ভুলটা তো অবশ্যই তারই ছিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে ভিতরে পুড়তে থাকা সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধের স্বীকারক্তি জানিয়ে পুনরায় আওড়ালো।

‘আমাকে অবিশ্বাস কর!পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলে ভাব!তবুও এটুকু অন্তত বিশ্বাস কর,আমি সেদিন তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চায়নি ফুল।শুধু আমার করে পাওয়ার জন্য ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।

আবারও একই বিষয়ে সাফাই।কৌড়ির অবিশ্বাস্য পলকহীন নজর এবার এলোমেলো হলো।দৃঢ়কণ্ঠে শক্ত গলায় একটাই বাক্য ছুড়লো—আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না,জানতেও চাইনা।আপনি চলে যান।আর দ্বিতীয়ত আপনি কখনো আমাকে ফুল নামে ডাকবেন না।ওটা শুধু বাবার মুখেই মানাতো আর কারও মুখে নয়।আপনার মুখে তো নয়ই।

এলোমেলো হাসলো নাহিদ।তবুও মেয়েটা কথা বলেছে, এই শান্তি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।তন্মধ্যে সেখানে হাজির হলো ইভান।তাকে দেখে তড়িঘড়ি করে কৌড়িও উঠে দাঁড়ালো।কিছু প্রয়োজন পড়লো কি-না?
সেটা খেয়াল করেও নিজের কথা শেষ করতে নাহিদ বললো–যদি-ও তোর কাছে আমি বিশ্বাসযোগ্য মানুষ নই।তবুও বিশ্বাস করতে বলছি আমাকে।আমার দ্বারা আর কখনো তোর ক্ষতি হবে-না,আল্লাহ প্রমিজ।তাই বলছি এতো কষ্ট করে শহর থেকে এখানে এসে পরিক্ষা না দিয়ে বাড়িতে থেকে পরিক্ষা দে।ঝামেলা,কষ্ট দু’টোই রক্ষে হবে।তারপরে নাহয় আবার শহরে চলে যাস।

আবার শহরে চলে যাস কথাটা মুখ আওড়াতে চাইলো না।তবুও বুকের ভিতরের ব্যথা দমিয়ে কথাটা বলতে হলো নাদিহকে।ফের ইভানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যে হেসে চলে গেলো সে।ইভানের অসহায় নজর আরও অসহায় হয়ে ধরা দিলো।ফোনে তখন অডিও কলে নিভান।নিশ্চয় সব শুনেছে।এবার কি হবে?নাহিদ চলে যেতেই কৌড়ির খেয়ালী নজর ইভানের মুখে মনোবেশিত হলো।ইভানকে তারদিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে গেলো তার।সহসা প্রশ্ন করলো।

‘কিছু লাগবে ভাইয়া আপনার?

সহসা ফোন এগিয়ে দিলো ইভান।অসহায় মুখ,কাচুমাচু নজর।দূর্বল গলায় বললো —ফোন ধরো।কথা বলো।

কে প্রশ্ন করে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো কৌড়ি।ইভান তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে শান বাঁধানো বসার জায়গায় বসে পড়লো।এবার কৌড়ির পালা!ইভানকে উত্তর না দিতে দেখে ফোনটা কানে নিলো কৌড়ি।সকাল থেকে ফোন দিয়ে তন্ময়ী আপু,মৌনতা, মান্যতা আপু,ছোটোমা,বড়মা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।এখানে যেনো না থাকা হয়।তাড়াতাড়ি চলে আসি যেনো।সেরকম তাদেরই কারও কল হবে মনেকরে ফোনটা কানে তুললো সে।সময় যেতেই ওপাশ থেকে শুধু ঘনো নিঃশ্বাসের আওয়াজ আসতেই চমকে ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ইভান যেনো অপেক্ষায় ছিলো।সে তাকাতেই চোখ দিয়ে ইশারা করলো,তুমি যাকে ভাবছো সেইই।সহসা হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেলো তার।চোখের আকার ছাড়ালো দ্বিগুন।
মূহুর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর আর অতি শীতল কন্ঠের কঠিন বার্তা।

‘কার অনুমতি নিয়ে তুমি ও-বাড়িতে গেছো?আবার থাকার চিন্তাভাবনাও করে ফেলেছো!

আজ প্রায় পাঁচদিনের মতো মানুষটা তারসাথে ইচ্ছে করে কথা বলে-না।আজ তার পরিক্ষা এটা জেনে-ও একবারও তাকে দোয়া জানানোর প্রয়োজন মনে করল না।আর না কথা বলার।এখন আসছে কৈফিয়ত নিতে!
সুক্ষ এক অভিমান জমে ছিলো কৌড়ির মনে।সেই অভিমান থেকেই সহসা উত্তর দিলো।

‘এটা আমার বাড়ি। এখানে আসতে অনুমতি কেনো লাগবে?আর এখানে থাকার চিন্তাভাবনা কি! এখানেই থাকার কথা ছিলো,আর এখানেই থাকার অধিকার আমার।

‘ওটা তোমার বাড়ি নয়,ওটা তোমার বাবার বাড়ি।

‘সমান কথা।বাবার মানে আমার।আর দ্বিতীয়ত বাবার আর কোনো সন্তান নেই।তারমানে এটা এখন আমারই বাড়ি।তাই এখানে থাকার সম্পূর্ণ অগ্রঅধিকার আমারই।

‘বাহ।কৌড়িতো দেখি উড়ে বেড়াচ্ছে।তা ইন্ধন যোগাচ্ছে কে?তোমার ওই সো কলড উগ্র বাজে স্বভাবের ভাই।তা থেকে যাও তবে তার কথায়।থাকবে?

এতো শান্ত আর স্বাভাবিক কন্ঠ।কৌড়ি উত্তর দিতে ভুলে গেলো।মুলত সাহস যুগিয়ে উত্তর গুছিয়ে বলতে পারলো না একটা শব্দও।কেমন ওপাশের মানুষটার গলা অতি স্বাভাবিকের মধ্যে-ও অস্বাভাবিক ঠিকলো তার কাছে।একটু নয় অনেকখানী অদ্ভুত অস্বাভাবিক ঠিকলো।

‘বলছো না যে, থাকবে?

প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব যেনো সহসা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কৌড়ির।—‘থাকলে অসুবিধা কোথায়?

আগুনের ফুলকির ন্যায় দরদরিয়ে ঝলসানো মেজাজে ঘি ঢিলে দিলো যেনে কৌড়ি।মূহুর্তেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো নিভান।কি ভাঙলো বুঝতে পারলো-না কৌড়ি।তবে তীব্র ঝনঝন শব্দে কানের তালা ছুটে যাওয়ার উপক্রম হলো তার।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।ভয়ে মাথা থেকে পা অব্দি শিহরে উঠলো তার।কথা বলতে বলতে ইভানের থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে সে।তবু-ও তার চোখমুখ খিঁচে নেওয়া দেখে ইভান বেশ বুঝতে পারলো,ফোনের ওপাশের মানুষটা ক্ষেপেছে ভিষণ।আর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চলছে।খারাপ লাগলো ভিষণ।তবে করার কিচ্ছু নেই।ফোনের ওপাশের মানুষটা তখন তীব্র রাগে অন্ধ।রাগে বজ্র কন্ঠে বার্তা ছুড়লো।

‘থাকলে অসুবিধা কোথায়?এই অসুবিধা কোথায় তুমি জানো-না?জেনে-বুঝেও কি করে জিজ্ঞেস করতে পারো,থাকলে অসুবিধা কোথায়?আর ওই উগ্র বাজে ছেলেটার সাথে বসে খোশগল্পে কি করে মেতে আছো তুমি? তাকে বিশ্বাস করে তুমি ওবাড়িতে গেছো!আবার তার পরামর্শ অনুযায়ী থাকতেও চাইছো!আবার বলছো থাকলে অসুবিধা কোথায়?আমার কথা একবারও কি মনে হয়না তোমার?

তীব্র ক্রোধ।সেদিনের মতো কি ভয়ংকর রাগ,কান্ড।তাকে ঘিরেই।এই লোকটা কি পাগল হলো!উফফ!কন্ঠ নমনীয় হলো এবার কৌড়ির।কোমল গলায় বললো।

‘প্লিজ আপনি অসুস্থ।পাগলামো করবেন না।

‘আমি অসুস্থ, এটা তোমার খেয়ালে আছে!খেয়ালে আছে বলছি কেনো,আমি মানুষ এটা তোমার মনেহয় বলে তো আমার মনেহয় না!তার ভালোমন্দ খেয়াল ধ্যান তোমার থাকবে,এটা আশা করাও অনুচিত।

‘প্লিজ।

‘তুমি আমাকে না জানিয়ে কেনো গেলে ওবাড়িতে কৌড়ি।তাও আবার ওই ছেলেটার কথায়!

‘আমি কারও কথায় এবাড়িতে আসিনি।এটা আমার জন্মস্থল।এখানে আমার টান,মায়া, ভালোবাসা সবকিছু। আমি সেই টানেই এসেছি।আর দাদিআপার কথা কিকরে ফেলতে পারতাম?আর আমি কারও সাথে খোশগল্প মেতে থাকিনি,উনিই এসেছিলেন কথা বলতে।বলেছেন আমি শুনেছি,উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।ব্যাস চলে গিয়েছেন।

কৌড়ির কথার ধরন বুঝে নিভান বুঝি এবার একটু শান্ত হলো।তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়া কন্ঠ এবার দূর্বল হলো।এক্সডিন্টে মাথার ছেঁড়াকাটাযুক্ত জায়গা ঝিমঝিম করে উঠলো।চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে দূর্বল গলায় বললো–‘চলে এসো কৌড়ি।

এই ডাক,এই আহ্বান!ফিরিয়ে দেওয়া যায়।নাকি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব!কি করবে সে এখন?এদিকে দাদিআপাকে-ও কি বলবে!আবার এই মানুষটাকে কি করে না বলবে!তবুও অবুঝের মতো বললো–এখন!কিভাবে সম্ভব।

‘কৌড়ি।

কি অদ্ভুত ডাক।পৃথিবীর সমস্ত মোহমায়া যেনো এই ডাকে কেটে গিয়ে শুধু ওই মানুষটার সম্মোহনী ডাকে মন তলিয়ে যায়।এই ডাকের অর্থ, তার কাছে সহজ সরল আবদারের প্রার্থনা,চলে এসো কৌড়ি। অসহায় হলো স্বর।বললো–‘আমি দাদুআপাকে কি বলবো?

‘জানিনা।শুধু যতো দ্রুত সম্ভব চলে এসো।বিকজ,আই ফিল ইনসিকিউর অ্যাবাউট ইউ।প্লিজ কৌড়ি,চলে এসো।

মধুময় আহ্বানে পিষ্ট হলো কৌড়ির মন।তবুও কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললো–‘পাগল হয়েছেন!

অদ্ভুত ক্লান্ত হাসলো নিভান।এখনো চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে আছে সে।মাথার ঝিমঝিম ব্যথাটা যেনো ধীরধীরে বাড়ছে।মাথায় বামহাতটা চেপে ধরলো সে।ফের খুব স্বাভাবিক, সহজ গলায় বললো।–তুমি আমার কাছে আসতে যতো দেরি করবে পাগলামোর মাত্রা ততো সীমা ছাড়াবে।আল্লাহ হাফেজ কৌড়ি।

ফোন কেটে দিলো নিভান।বুঝতে পেরেও কানে ফোন নিয়ে হতভম্ব হয়ে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলো কৌড়ি।ফের বিথী এসে ডাকতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো সে।ধীর পায়ে এগোলো ইভানের দিকে।গভীর ভাবনায় ডুবে আছে,এমনভাবে পুকুরের দিকে নিটোল চোখে তাকিয়ে আছে ইভান।কাছে গিয়েও সাড়া পাওয়া গেলোনা।তাই কৌড়িকে ডাকতে হলো তাকে।সে ফিরতেই তারপানে কেমন অসহায়া হয়ে তাকালো কৌড়ি।ইভান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কৌড়ির চেয়েও অসহায় চাহুনি ফেললো তারদিকে। দু’জনের একটাই ভাবনা,কি করবে এখন!কোনদিকে যাবে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here