পূর্ণতা ” #নন্দিনী_নীলা ৫.

0
110

“ #পূর্ণতা ”
#নন্দিনী_নীলা
৫.

রাজশাহী থেকে ট্রেনে করে ঢাকা পৌঁছাবে পূর্ণতা। সকালের ট্রেন না ধরতে পেয়ে বিকেলে ট্রেনে উঠেছে পূর্ণতা। বাবা-মা ইচ্ছে করে ওকে এতো দূরে বিয়ে দিয়েছিল। আচ্ছা এখন ও যে ডিভোর্স নিয়ে ফিরে যাচ্ছি এখন কি হবে? ওকে ঢাকার বাইরে পাঠানোর জন্য এতো কষ্ট করে এতো দূরে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওর খবর যেন কেউ না পায় এজন্য নিজেরাও কখনো এই পাঁচটা বছর ওর সাথে দেখা সাক্ষাত করেনি। না কখনো ফোন দিয়ে ভালো মন্দ খোঁজ নিয়েছে। পূর্ণতা তো তাদের একটা মাত্র সন্তান ওর সাথে তারা এটা কিভাবে করলো? কেমন করে মেয়ের খোঁজ-খবর না নিয়ে তারা থাকতে পারলো? পূর্ণতার ভেতর থেকে তাচ্ছিল্য হাসি বেড়িয়ে আসলো। ও জানালার কাছে বসেছে। ট্রেন এখনো ছাড়ে নি ও স্টেশনের ব্যস্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ বছর আগে লাল শাড়ি পরিয়ে বাবা-মা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল বিয়ের তকমাটা লাগিয়ে। আজ ঠিক পাঁচ বছর পর ও সেলোয়ার কামিজ করে ডিভোর্সী হয়ে ফিরে যাচ্ছে।
বাহ কি সুন্দর একটা জার্নি। ওকে যখন এই অবস্থায় তারা দেখবে একটু ও কি অনুতপ্ত হবে নাকি অহংকার নিয়েই থাকবে।
ট্রেন চলতে শুরু করল কেউ যেন বাতাসের শীতল হাওয়ার সাথে মিশে মিহি কন্ঠে পূর্ণতার কানে কানে বলে উঠল,,” আমায় ছেড়ে তুমি কোথাও ঠাঁই পাবে না পূর্ণতা। যেখানেই যাও ফিরে তোমায় আমার কাছেই আসতে হবে। তোমার ঠিকানা অনেক আগেই আমার কাছে লেখা হয়ে গেছে।”
কেঁপে উঠল পূর্ণতা‌। পরিচিত শহরের ফেরার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ক্ষত জেগে উঠতে শুরু হয়ে গেল। সবকিছু পুরনো, পুরনো জীবন, পুরনো পূর্ণতা আর এই পূর্ণতার মধ্যে তো আকাশ-পাতাল তফাৎ।

অতীতে নিয়ে ভাবতে লাগল পূর্ণতা।
প্রথম নিজের বাবার কথা ভাবলো। পূর্ণতার বাবা শাহিন আলম। যাকে পূর্ণতা জমের মতো ভয় পায়। বাবাকে দেখলে পূর্ণতার হার্টবিট বেড়ে যায়। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো পূর্ণতা একের অধিক কথা বলতে পারে না। বাবাকে ভয় পাওয়ার কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে পূর্ণতা তার গম্ভীর বাবার সাথে পরিচিত। বাবার শাসনে বড়ো হয়েছে । ওকে আদর করে না তা নয় প্রচন্ড আদর করে কিন্তু বাবার ওই যে মুখটা এতোটাই গম্ভীর থাকে যে তিনি আদর করলেও ভীত হয়ে থাকে ওর মন। কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে পুরোই উল্টো। নিজের আসল রুপ একমাত্র মায়ের সামনে প্রকাশ করতে পারে পূর্ণতা। মা যদি সারাদিন ওকে বকে ধমকায় মারে তবুও পূর্ণতা ভয় পায় না হাসে মজা করে। কিন্তু বাবার একটা ডাকে ও একদম ভদ্র হয়ে যায়। বাবাকে বেশি পায়নি পূর্ণতা ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথেই থেকেছে বাবা ছিল আর্মি তে যতটুকু সময় বাড়িতে কাটিয়েছে বাবার ওই গম্ভীর মুখের জন্য বাবার থেকে দূরে থেকেছে। তখন পূর্ণতা ভাবতো আচ্ছা পুলিশ আর্মির এরা কি শুধু রাগতে জানে? হাসতে জানে না?
বাবা মাকে যতটা ভালোবাসে ততটাই আরেকজন মানুষকে ভালোবাসতো। পূর্ণতার জীবনে বসন্ত এসেছিল। পুরুষ মানুষ বলতে পূর্ণতা একজনকেই ধ্যানে জ্ঞানে চিনতো, জানতো বুঝতো এবং ভালোবাসতো। সে পূর্ণতার জীবনে আগমন করেছিল খুব অদ্ভুত ভাবে। যে পূর্ণতার জীবনে নিয়ে এসেছিল বসন্তের হাওয়া। প্রেমের দোলা লেগেছিল পূর্ণতায় ছোট্ট মনটায়। প্রেম করার বয়স হয়নি কিন্তু ছোটো পূর্ণতা সেই নাবালিকা বয়স থেকেই তার প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল।
বিড়বিড় করে নামটা পূর্ণতা আওড়ালো, প্রভাত।
ওর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। ঠিক পাঁচ বছর পর নামটাও মুখে আনল। নামটা উচ্চারণ করতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট অনুভব হলো। ও হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওর চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে। আগে এই নামটা উচ্চারণ করলে যতটাই ভালোলাগা ভালোবাসা মিশ্রিত এক মিষ্টি অনুভূতি হতো। কিন্তু আজ এই সময় এই নামটা উচ্চারণ করতে ওর এতো কেন যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতরটা কেন ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায় ও শ্বাস নিতে পারছে না?
পূর্ণতার পাশে একজন ছেলে বসেছিল যে হঠাৎ পূর্ণতা কে এমন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে দেখে ভয় পেয়ে যায়।
“হেই আপনি ঠিক আছেন? আপনার কি শ্বাসকষ্ট আছে?”
পূর্ণতা অস্ফুট স্বরে পানি চাইল। ছেলেটা নিজের ব্যাগ থেকেই এটা পানির বোতল বের করে দিল। পানি নিয়ে ডক ডক করে পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে রইল আস্তে আস্তে ওর কষ্টটা নিবারণ হলো। তারপর পাশে তাকিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলে বোতলটা ফিরিয়ে দিল।

বর্ষা কাল চলছে তখন। পূর্ণতার সবচাইতে পছন্দের মাস। ওর পছন্দের ফুল কদম। ও কদম ফুল দেখে ছোটোবেলা থেকে বড় হয়েছে আর তখন থেকেই ফুলটা পছন্দের তালিকায় আছে আর এখন অব্দি সেটাই বিরাজমান। ওদের বাসার সামনে একটা কদম ফুল গাছ আছে। গাছটা ছোটো থেকে ওর সাথে আস্তে আস্তে বড়ো হয়েছে। এখন এতো বড় হয়েছে যে হাত দিয়ে ফুল ছেঁড়া যায় না। পূর্ণতা গাছে উঠতে পারে তাই বড়ো হলেও ওর কোন সমস্যা নেই। নিজের প্রিয় ফুল নিজেই পারে। এই ফুল ছেড়ার ইচ্ছাটা হচ্ছে পূর্ণতা ফুল নিয়ে স্কুলে যাবে আর বান্ধবীদের দিবে। ফুলের লোভ দেখিয়ে বান্ধবীদের থেকে চকলেট খাবে। সেই জন্যেই ও আজকে গাছে ওঠার জন্য এতো লাফালাফি করছে। গতকালের সবাইকে বলে এসেছে ফুল নিয়ে আসবে সবার জন্য। আকাশটা মেঘলাটে হয়ে আছে গাছে ওঠার পরে যদি বৃষ্টি নেমে যায় তাহলে তো বিপদ হবে। পূর্ণতা এখন কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঘাড় পিছন দিকে ঝুকিয়ে দৃষ্টি গাছের ডালে থাকা হলুদ কদম ফুলের দিকে দিয়ে রেখেছে। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভাবল,”ধরছাই উঠে যাই। বৃষ্টির আগেই নেমে যাব এতক্ষণে নেমে যেতে পারতাম শুধু শুধু দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছি।”
পূর্ণতা তরতর করে গাছের আগায় উঠে গেল। তারপর ডালে থেকে হলুদ কদম ফুলের ডাল ছিড়ে ছিড়ে নিচে ফেলছে। বান্ধবীদের জন্য একটা একটা করে আর নিজের জন্য একটা। সবগুলো ছেঁড়া হতেই ও কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,,”এইযে মেঘ আমাকে তো খুব ভয় দেখাচ্ছিলে উঠতে পারবো না। এই যে উঠেছি বৃষ্টি এখনো আসেনি এবার আমি নেমে যাব। হি হি।”
বলে পূর্ণতা নিচের ঢালে পা দিয়ে নিচে নামতেছিল। তখনই ঝরঝর করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে স্তব্ধ হয়ে পূর্ণতা গাছে আগাই বসে পড়ে।
এটা কি হলো শেষ মুহূর্তে বৃষ্টি আমাকে বিপদে ফেলে দিল এখন আমি নামবো কিভাবে? এতো জোরে বৃষ্টি নেমেছে যে দুই মিনিটে গাছ পিচ্ছিল হয়ে গেল। এবার পূর্ণতা গাছের ডাল ধরে রাখতে পারছে না। ওর হাত পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে পা পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। ও সাবধানে নিচের ডালে এসে বসে র‌ইল। এখানে থেকে পড়লে হাত পা ভাঙবে না কিন্তু ব্যথা পাবে প্রচুর।
কাঁদো কাঁদো মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পূর্ণতা। গাছের ডাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে ওই শরীরও ভিজিয়ে দিয়েছে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। বৃষ্টির বেগ এতোটাই ভেতর থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে আসছে। ওর নাম ধরে ডাকছে যদি মা ওকে আজকে এখানে দেখে ওর পিঠে বেতের বারি পড়বে। সাহায্যের জন্যে মাকে ও এখন ডাকা যাবে না নামার পরে মাইর খেতে হবে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে পূর্ণতা বসে আছে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তখনি ও দেখতে পায় ওর গাছের নিচে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে হাবাগোবা টাইপের। ছেলেটা মুখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা ঢোলাঢালার শার্ট আর একটা প্যান্ট কাঁধে একটা ব্যাগ ছেলেটা নিচ থেকে ওর ছেঁড়া কদমগুলো হাতে নিচ্ছে তুলে।
এতো বড় সাহস কে এই ছেলেটা কোথা থেকে আসলো? আমার এতো কষ্টের কদম ফুল নিচ্ছে কেন?
রাগে চেঁচিয়ে উঠল পূর্ণতা।
“এ্যাই এ্যাই কে আপনি আমার ফুল নিচ্ছেন কেন? তাড়াতাড়ি আমার ফুল রেখে দিন। আমি এতো রিস্ক নিয়ে এতো কষ্ট করে ফুলগুলো ছিঁড়লাম। আর উনি কোথা থেকে উড়ে এসে আমার ফুল গুলো নিয়ে নিচ্ছে। কত বড় সাহস।”
ছেলেটা ফুল হাতে নিয়ে পূর্ণতা কোথা থেকে কথা বলছে ওকে খুঁজছে আশেপাশে। পূর্ণতা রেগে বলল,,”আমি কি আপনার আশেপাশে ঘুরছি? আমি উপরে আছি উপরে তাকান আশেপাশে না খুঁজে বুদ্ধু।”
ছেলেটা মাথা তুলে উপরে তাকাতেই পূর্ণতা দেখতে পায় একটা শ্যাম বর্ণের ছেলেকে।
প্রভাত পূর্ণতার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,,”তুমি গাছের ডালে বসে কি করছো এই বৃষ্টির মধ্যে পড়ে যাবে তো!”
পূর্ণতা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,”আমার ফুল তাড়াতাড়ি ওখানে রাখুন। রাখুন বলছি না হলে ভালো হবে না।”
“এতো উত্তেজিত হবে না পড়ে যাবে তো। আল্লাহ তুমি ওখানে কিভাবে উঠলে? তোমার কি একটু ভয় ডর নেই!”
পূর্ণতা খুব অহংকারী গলায় বলল,,”আমি কি আপনার মত হাবাগোবা ভীত টাইপের নাকি? আমি যথেষ্ট সাহসী বুঝচ্ছেন আমি এখান থেকে পরব না।”
অহংকার বেশিক্ষণ টিকলো না পূর্ণতা বলতে বলতে হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়েছিল আর তাই নিজের ভারসাম্য রাখতে না পেরে পরে যায় সব পিচ্ছিল খেয়ে। পূর্ণতা কে পরে যেতে দেখে প্রভাত স্তব্ধ হয়ে যায়। কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের দুহাত নায়কই স্টাইলে বাড়িয়ে দেয় পূর্ণতাকে ধরার জন্য। কিন্তু এখানে তো পূর্ণতা আর প্রভাত নায়ক নায়িকা নয় আর না এটা কোন সিনেমা। এর জন্যেই প্রভাত নায়কদের মতো পূর্ণতাকে ধরে ভারসাম্য রাখতে পারে না। অন্য দিকে পূর্ণতা ওর হাতের উপরেই পড়ে কিন্তু দুজনেই মাটিতে বসে পড়ে। পূর্ণতার শরীরের ভার গিয়ে পড়ে প্রভাতের হাতে ও হাটুতে। প্রভাত খুবই ব্যথা পায়। ব্যথায় ও মুখশ্রী নীল হয়ে ওঠে। গাছটা খুব বেশি উঁচু ছিল না। নাহলে আজকে দুজনেরই হাড়গোড় ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু মোটামুটি পরিমাণ ব্যথা পেয়েছে দুজনে কোমর ধরে ওঠে হাত পা ঝাড়তে লাগে। ফুলের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় পূর্ণতা এতো কষ্ট করে ফুলগুলো পারল আর ওদের দুজনের চাপায় পড়ে ফুল নষ্ট হয়ে গেছে।
পূর্ণতা আঙ্গুল তুলে প্রভাত কে বলল,,”আপনি যদি ফুলগুলো না কুড়িয়ে নিতেন। তাহলে আপনার হাতে ফুলগুলো থাকত না। আর এভাবে আমাদের দুজনের চিপায় পরে নষ্ট হতো না।”
প্রভাত বলল,,”কেঁদো না আমার জন্য কোন মেয়ে কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তোমাকে ফুল আবার পেরে দেব।”
পূর্ণতা কপাল কুচকে বলল,,”মেয়ে কাঁদলে আপনার কষ্ট হয় ছেলেরা কাঁদলে বুঝি মজা লাগে?”
প্রভাত ওর কথায় হেসে বলল,,”মেয়েদের মতো ছেলেরা কথায় কথায় কেঁদে ভাসায় না। মেয়েদের মতো ছেলেরা ছিদকাঁদুনে না। এজন্যই শুধু মেয়েদের উল্লেখ করে বললাম।”
প্রভাতের কথার মানে বুঝতে পেরে পূর্ণতার চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো।
“তার মানে আপনি বুঝালেন মেয়েরা কথায় কথায় কাঁদে আপনি মেয়েদের ছিদকাঁদুনে বললেন?”
“দেখো যেটা সত্যি সেটা মানতে শিখো। আমি কি মিথ্যা বলেছি?”
রাগে পূর্ণতার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হবে। ও রাগে অগ্নি মুর্তি হয়ে তাকিয়ে আছে প্রভাতের দিকে। ছেলেটাকে যতটা হাবাগোবা ভেবেছিলাম ততটা না প্রচন্ড বেয়াদব একটা ছেলে। কিভাবে আমাকে অপমান করল? ঠান্ডা মাথায় অপমান যাকে বলে।
প্রভাত তখনও হাসি হাসি মুখ করে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে‌।
পূর্ণতা এই বেয়াদব ছেলের সাথে আর একটা কথাও বলতে চায় না তাই রাগে গজগজ করে বড়ো বড়ো পা ফেলে বাসার দিকে হাঁটা ধরল।
#চলবে….

অতীত বর্তমান মিলিয়ে আছে সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বেন আর বুঝার ট্রাই করবেন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

“ #পূর্ণতা ”
#নন্দিনী_নীলা
৬.

পূর্ণতাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে পাশে বসা ছেলেটা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা পাগল নাকি ভাবছে ছেলেটা! এই হাসছে এই কাঁদছে মেয়েটার হাবভাব ও কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটার ফোনের রিংটোন জোরে বাজতে পূর্ণতার ধ্যান চূর্ণ হয়। ও সোজা হয়ে এক পলক ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে।
ছেলেটি ওকে ডেকে উঠে,,” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
পূর্ণতা জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। তারপর গম্ভীর মুখ করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ছেলেটি জবাব না পেয়ে বলল,,” আই এ্যাম তুষার। আপনি?”
পূর্ণতা কটমট করে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,,” আমি কি আপনার নাম জানতে চেয়েছি?”
তুষার থতমত খেয়ে বলল,,” জি না কিন্তু আমিই বললাম। পাঁচ ছয় ঘন্টা একসাথে জার্নি করব পাশাপাশি বসে থাকব কিন্তু পরিচিত হবো না ব্যাপারটা কেমন না? ধরেন হঠাৎ একদিন আমাদের দেখা হয়ে গেল। তখন কি বলে সম্বোধন করব?”
পূর্ণতা বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,,” আমাদের কখনোই দেখা হবে না আর হলেও আমি আপনাকে চিনব না। আপনার আমাকে চেনার প্রয়োজন নেই।”
“আপনি মনে হয় অনেক বেশি ডিপ্রেশনে আছেন তাই না?”
পূর্ণতা আর কোন জবাব দিল না রাগী দৃষ্টিতে একবার তুষারের দিকে চেয়ে অন্য দিকে তাকালো। এমনটা বাচাল মানুষের সাথে ওকে বসতে হলো।

পূর্ণতা ফের অতীতে চলে গেল।

ভিজে ভিজে বাসায় যেতেই পূর্ণতা মায়ের কাছে এক গাদা বকুনি খেল। পূর্ণতার তখন মেজাজ গরম হয়ে আছে প্রভাতের সাথে ঝগড়া করে। আর ফুলগুলো সব নষ্ট হয়ে গেল। কে ওই লোকটা? তখন আর এটা মাথায় আসেনি। ছেলেটা ওদের বাসায় কি করছে! পূর্ণতা মায়ের বকা তোয়াক্কা না করে রুমে চলে গিয়েছে। বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশটা শীতল ও গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। এখন এক কাপ চা খাওয়া দরকার‌। এজন্য ও নিচে আসে এসে দেখে ভেজা পোশাকে প্রভাত সোফায় বসে আছে। ওর চোখ কপালে উঠে যায় প্রভাতকে নিজেদের ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে। ও তেরে আসে প্রভাতের দিকে।
“আপনি আমার বাসায় কি করছেন? কোন সাহসে আমার বাসায় ঢুকেছেন আম্মু কোথায়?”
বলেই চিৎকার করে আম্মু বলে ডেকে উঠল।
এদিকে প্রভাত পূর্ণতার চিৎকার শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। প্রভাত পূর্ণতার চিৎকার শব্দে কানে হাত দিয়ে রেখেছে। পূর্ণতা চিৎকার করে একটানা আম্মু বলে ডাকছে। ভেতর থেকে ওর আম্মু ধমক দিল ওকে।
পূর্ণতা চিৎকার থামিয়ে অপমানিত বোধ করে তাকাল প্রভাতের দিকে। দেখল প্রভাত কানে হাত দিয়ে রেখেছে ও চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,,,”আপনি কানে হাত দিয়েছেন কেন?”
প্রভাত কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে বলল,,”যে ভাবে চিৎকার করছিলে। কানে তালা ফেটে বয়রা হয়ে যেতাম। সেই ভয়ে এই পন্থা অবলম্বন করতে হলো।”
“আপনার এতো বড় সাহস আপনি আমাকে আমার বাসায় দাঁড়িয়ে অপমান করছেন!”
পূর্ণতার মা রোজিনা বেগম এগিয়ে এসে বললেন প্রভাতকে,,”হ্যাঁ ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তুমি তাহলে ভাড়া থাকবে।”
প্রভাত বলল,,” জি আন্টি।”
“পূর্ণ যা তো প্রভাত কে ওর রুম টা দেখিয়ে দিয়ে আয়। গতকাল যে রুমটা পরিষ্কার করালাম ওই রুমে থাকবে। চাবিটা নিয়ে যা আমার ড্রেসিং টেবিলের সামনেই রাখা আছে।”
পূর্ণতা আকাশ থেকে পরে বলল,,”হোয়াট? উনি আমাদের বাসায় থাকবে কেন আম্মু? জানো উনি কত বেয়াদব? আমি কত কষ্ট করে গাছে ওঠে এতগুলো ফুল পারলাম। আর ওনার জন্য সবগুলো ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের বাসায় এসে আমাকে অপমান করছে। তুমি উনাকে আমাদের বাসায় থাকতে দিচ্ছ! অসম্ভব আমি উনাকে কিছুতেই আমাদের বাসায় থাকতে দেবো না। এই যে বের হোন আমাদের বাসা থেকে এক্ষুনি বের হোন বলছি।”
উত্তেজনায় পূর্ণতা গাছে ওঠার কথাটা বলে দিয়েছে। রোজিনা বেগম মেয়ের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললেন,,”তুই আবার গাছে উঠেছিলি?”
পূর্ণতা নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে বুঝতে পেরে আমতা আমতা করতে লাগল।
রোজিনা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,,”বড়দের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তাড়াতাড়ি সরি বল আর আমি যা বলছি তাই কর বেয়াদব মেয়ে।”
মা রেগে আছে বুঝতে পেরে পূর্ণতা আর মায়ের ধমকের উপরে কথা বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে। পূর্ণতা ওর মায়ের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে আগুন দৃষ্টিতে তাকালো প্রভাতে দিকে তারপর গজ গজ করে চলে যাওয়া ধরল।
রোজিনা বেগম প্রভাতের দিকে তাকিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললেন,,”ওর কথায় কিছু মনে করো না প্রভাত। ছোট তো বোঝে না কোথায় কি বলতে হয়। এক বাপের এক মেয়ে তো এজন্য মাথায় ১০০ ডিগ্রী রাগ। দেখো না কেমন চাটাং চাটাং করে কথা বলল। বাবাকে দেখে একটু ভয় পায় কিন্তু তাকে তো কাছেই পায় না। সে তো তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত।আমি যতই রাগ ধমক দেই না কেন এই মেয়েকে শোধরাতে পারি না। চল আমি তোমাকে এরকম দেখিয়ে দিচ্ছি।”
“প্রবলেম নেই আন্টি।” রোজিনা বেগম রুমে চলে গেল চাবি আনতে।
“অল্প বয়সী মেয়েদের রাগটা একটু বেশিই থাকে। এরা বুঝে কম চিল্লায় বেশি।” প্রভাত সিঁড়ির কাছে পূর্ণতা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে পূর্ণতা প্রভাতের কথা শুনে রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। পূর্ণতা রুমে এসে ঠাস করে দরজা আটকে দিল।
রুমে এসে রাগে চিৎকার করে উঠল। আম্মু কীভাবে ওর নামে বদনাম করল‌ একটা বাইরের বেয়াদব ছেলের কাছে। নিজের মেয়ের প্রতি কোন ভালোবাসা নেই কীভাবে ওকে অপমান করল ছেলেটা। ওদের বাসায় এসেছে আর ওকেই সমানে অপমান অপদস্থ করে যাচ্ছে আর ও কিচ্ছুটি করতে পারছে না।

রোজিনা বেগম প্রভাত কে দুপুরের খাবার ওদের সাথেই খেতে বললেন। কারণ যে বৃষ্টি এই অবস্থা বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় আর প্রভাত সাথে করে একটা ব্যাগ এনেছে যাতে শুধু নিজের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ও ব‌ইখাতা নিয়ে এসেছে। প্রভাত রুমে এসেই ফোনটা অন করে চার্জে বসালো। আর নিজের ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে নিল। শীতে চামড়া সাদা হয়ে গেছে অনেক সময় ধরে ভিজে ছিল। দুইটা হাঁচি ও দিল। প্রভাত ল্যাপটপ বের করে ভালো করে মুছে নিল‌। যদি পানি যায় সর্বনাশ হবে। ব্যাগে কয়েকটা বিস্কুট ছিল একটা ছিঁড়ে কামড় দিতে লাগল কারণ সকাল থেকে না খাওয়া। এক কাপ চা‌ ব্যতিত কর কিছুই খাওয়া হয়নি।
প্রভাত পড়ালেখার জন্য ঢাকায় এসেছে। স্টুডেন্ট ভালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেয়েছে‌। কিন্তু লোক না থাকায় হোস্টেলে সিট পায়নি। এজন্য এই বিলম্ব পদ্ধতি। ভাড়া ছাড়া প্রভাত থাকবে না। ঢাকা শহরে নিজের আপন কেউ না থাকলেও নিজেদের এলাকার মোটামুটি ভালো পরিবারের ছেলে ও। প্রভাত ল্যাপটপ এ কিছু করছে আর বিস্কুট খাচ্ছে। তখন দরজায় নক না করেই রুমে প্রবেশ করল পূর্ণতা।
পূর্ণতা কে জোর করেই ধমক দিয়ে পাঠিয়েছে এখানে। প্রভাত কে খেতে ডাকতে পাঠিয়েছে রোজিনা পূর্ণতা কে। পূর্ণতা সোজা রুমের ভেতরে গিয়ে কোমরে হাত গিয়ে বলল,,” আপনি তখন কি বলছিলেন যেন?”
প্রভাত ল্যাপটপ অফ করে সোজা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি‌ বলছিলাম?”
” সাধু সাজবেন না। আমি কিন্তু সব শুনেছি।”
” শুনলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?”
নাকের পাটা ফুলিয়ে পূর্ণতা বলল,,” আমার বাসায় এসে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করছেন? দয়া করে থাকতে দিয়েছি তাই মাথায় উঠে বসবেন তাই না?”
” আমি তো তোমার কাছে দয়া চাই নি। আমি ভাড়া দিয়েই থাকব।”
” আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছেন?”
” ক‌ই না তো!”
” এতোই যেহেতু টাকা তাহলে এখানে থাকছেন কেন? চলে যান আমাদের বাসায় আপনার মতো বেয়াদব ছেলের কোন জায়গা না।”
রাগে পূর্ণতার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। রীতিমতো এই ছেলেটা ওকে অপমান করছে। মা এই বেয়াদব ছেলেকে খেতেও অফার করেছে আবার ওকে ডাকতে পাঠিয়েছে। ও তাকে খেতে নয় আজ বাসা থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে।
প্রভাত বিস্কুটের প্যাকেট থেকে আরেকটা বিস্কুট বের করে কামড় দিয়ে বলল,,” বিস্কুট খাবে?”
পূর্ণতা মুখটা হা করে বলল,,” এতো অপমান করছি তাও আপনার লজ্জা লাগছে না এখানে থাকতে? আমাকে আবার বিস্কুট সাধছেন?”
” অল্পবয়সী মেয়েরা দেখতেও যেমন সুন্দরী হয় তেমনি রাগটাও মাথায় উঠে থাকে। এরা বুঝে কম লাফায় বেশি। তুমি এখনো বাচ্চা। তোমার কথা ধরে বাসা থেকে চলে যাওয়ার মতো বোকা আমি নয়। বাচ্চাদের সব শুনতে হয় না।”
বলেই প্রভাত ওকে রেখেই নিচে নেমে এলো। পূর্ণতা কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারছে না। এই ছেলেকে বাসা থেকে এতো সহজে তাড়ানো যাবে না। ভারি নির্লজ্জ ছেলে এতো অপমান করছে তাও যাচ্ছে না।
পূর্ণতা বিছানা থেকে অর্ধেক বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে সেটা দুহাতে মুচড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি করে বিছানায় ফেলে চলে আসলো।
#চলবে…

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here