#গল্পঃ_একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#পর্বঃ_১৬
#লেখাঃ_ইয়াসমিন_খন্দকার
—-
গভীর নিস্তব্ধ রাত। প্রভা তখনো জেগে রয়েছে। তার মনে নানানো চিন্তা ঘুরপাক খাওয়ার বদৌলতে ঘুম তাকে বশ করতে পারছে না। হঠাৎ করেই তার ফোনে টুংটাং শব্দে নিস্তব্ধতা কা’টল। প্রভা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সময় এখন রাত ২ টা। তারমানে কানাডায় এখন সকাল। প্রভার আর বুঝতে বাকি রইল না তাকে ম্যাসেজটা কে দিয়েছে। সে ফোনটা হাতে নিয়েই ম্যাসেজের উত্তর দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে লিখল,”এতক্ষণে তাহলে আমার ম্যাসেজের উত্তর দেওয়ার সময় হলো আপনার।”
কিছুক্ষণ পর ম্যাসেজের উত্তর আসলো,”আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম৷ ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে আপনার ম্যাসেজেরই উত্তর দিলাম। বলুন কি সমস্যা আপনার?”
“আমি কি শুধু সমস্যায় পড়লেই আপনাকে ম্যাসেজ দেই।”
“সেটা তো আমার থেকে ভালো আপনি নিজেই জানেন।”
প্রভা আর বেশি বাড়তি কথা বলতে চাইছিল না। তাই নিজের সমস্যার কথা খুলে বলল,”আমার ফ্যামিলি থেকে বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আমি বিয়েটা করতে চাই না।”
“কেন?”
“আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই।”
“কোন ভ্যালিড রিজন তো আছেই?”
“আমার সাথে যার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে তাকে আমার একদম পছন্দ নয়। তাকে ঘিরে আমার অনেক বাজে অতীত রয়েছে। তাকে আমার কাছে অপরাধী মনে হয় কিন্তু আর সবার চোখে সে আমার জন্য পারফেক্ট৷ তবে আমার তাকে ভরসা করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমি অনেকটা অসহায়।”
“আমি বুঝতে পারছি আপনি খুব কঠিন একটা সমস্যায় পড়েছেন। তবে এই কঠিন সমস্যার একটা অনেক সহজ সমাধান আছে।”
“কি সমাধান?”
“আপনি বিয়েতে রাজি হয়ে যান।”
“এটা কি করে বলতে পারেন আপনি? সবাই কেন আমাকে এই একটা সমাধানের কথাই বলছে? বিয়ে কি সব সমস্যার সমাধান?”
“আমি সেটা কখন বললাম। আমি তো শুধু আপনাকে বিয়েতে রাজি হতে বলেছি, বিয়েটা করতে তো আর বলি নি। বিয়েতে রাজি হওয়া আর বিয়ে করার মধ্যে তফাৎ আছে।”
প্রভা কিছু একটা মনে করে লিখে,”কিন্তু এই বিয়েতে রাজি হয়ে আমার কি লাভ?”
“আপনিই তো বললেন আপনার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে আপনার কাছে তাকে অপরাধী বলে মনে হয়৷ এখন তার কাছাকাছি গিয়েই তো আপনি তার ব্যাপারে আরো ভালো জানতে পারবেন। এভাবে বিয়েটা ভাঙার একটা ভ্যালিড রিজনও দাড় করাতে পারবেন নিজের ফ্যামিলির কাছে ”
প্রভা হেসে ম্যাসেজ করে,”এইজন্যই আমার আপনাকে এত ভালো লাগে। আমার সব সমস্যার কত সুন্দর সমাধান করে দেন আমি।”
অন্যদিক থেকে আর কোন উত্তর আসে না। প্রভা কিছুক্ষণ রিপ্লাইয়ের জবাব অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে তার সমস্যার সমাধানকারী বাকা হেসে বলে,”আমিই যে তোমার জীবনের সব সমস্যার সূত্রপাত।”
~~~~~~~~~~~~~~~~
আবির ও সৌভিক একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আবির নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একসময় বলল,”অনুরাধা কি কাজটা করতে পারবে বলে তোর মনে হয়?”
“পারবে। বেস্ট ফ্রেন্ড তো। প্রভা একটু হলেও ভুলবে ওর কথায়। তুই চিন্তা করিস না।”
“আচ্ছা। তুই বল তোর কি খবর?”
“কি খবর চাস। কোন কুক্ষণে যে ঐ অনুরাধাকে বিয়ে করেছিলাম। আমার জীবনটা একদম তেজপাতা করে দিলো। আমার ছোট ভাই মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করল। শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেক যৌতুক পেল। বাবাও তার উপর খুশি হয়ে নিজের সব সম্পত্তি ওর নামেই লিখে দিয়েছে। এদিকে অনুরাধাকে বিয়ে করে আমি সব দিক থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তুই তো জানিসই ওর বাপের বাড়ি থেকে অন্য যায়গায় বিয়ে ঠিক করেছিল। সেই সময় আমার আবেগের বয়স ছিল তাই পালিয়ে এনে বিয়ে করি। পরে যদিওবা ওর পরিবারে বিয়েটা মেনে নেয় কিন্তু যৌতুক আর পাওয়া হলো না। আর আমার পরিবারে তো ওকে মানেই নি। তাও আগে একটু দেখতে শুনতে ভালো ছিল। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে যা মোটা হয়েছে ওর উপর আমার আর রুচিই আসে না। জানিস আমি কতদিন থেকে ওর সাথে ফিজিক্যালও হই না। ওকে দেখলেই রুচি চলে যায়।”
আবির বাকা হেসে বলে,”আরে এত চিন্তা করিস না। আমার কথা মতো চল দেখবি জীবনে শুধু লাভ আর লাভ। এই মেয়েটাকে দেখ।”
বলেই আবির নিজের ফোন থেকে একটা মেয়ের ছবি বের করে সৌভিককে দেখায়। সৌভিক মেয়েটার ছবির দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”মেয়েটা তো সেই হ*ট।”
“বিছানায় নিতে ইচ্ছা করছে?”
“অবশ্যই। ইশ, আমি কতদিন ধরে এমন কাউকেই খুঁজছিলাম।”
“পেয়ে যাবি শুধু আমার কথা শুনে চল।”
“বল কি করতে হবে?”
“তুই এতদিন নিজের কাজ খুব ভালো ভাবেই করেছিলাম। রুহুল আমিন আঙ্কেলকে তোর জন্যই তো এই বিয়েতে আমি কনভিন্স করতে পেরেছি। এখন তোকে আর বেশি কিছু করতে হবে না। এই ওষুধটা নে এটা রুহুল আমিন আঙ্কেলের খাবারে মিশিয়ে দিবি।”
“এটা কিসের ওষুধ?”
“এটা এমন একটা ওষুধ যেটা খেলে উনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর তখন প্রভাকে এই বিয়েতে মত দিতেই হবে।”
“যদি কেউ টের পেয়ে যায় তখন? না, না আমি এসব কিছু করতে পারবো না।”
“তুই এত ভয় পাস না। আমি আছি তো আমি সব ম্যানেজ করব। তাছাড়া রুহুল আমিন আঙ্কেল তোকে অনেক ভরসা করে। তাই তোকে উনি সন্দেহ করবে না। আর এখন ওনার বাড়ির সবাইকে তো আমিই নিয়ন্ত্রণ করি। তাই তুই বাড়তি চিন্তা করা বন্ধ কর। শুধু নিজের লাভের কথা ভাব। জীবনে ভালো মানুষ হয়ে কোন লাভ পাওয়া যায়না।”
সৌভিক বলে উঠল,”একদম ঠিক বলেছিস তুই। ভালো মানুষ হয়ে আসলেই কোন লাভ নেই। আমি ভালো মানুষ হয়ে কোন লাভ পেয়েছি জীবনে? কত বছর বেকার বসে ছিলাম। তারপর একটা চাকরি পেলাম তো সেখানেও আমায় মিথ্যা চুরির দায়ে বের করে দিল। তখন থেকেই আমি বুঝেছি এ পৃথিবীতে সুখে থাকতে হলে খারাপ পথই বেছে নিতে হবে।”
“একদম ঠিক বুঝেছিস তুই। নিজের সুখের কথা সবার আগে চিন্তা করতে হয়। আমি তো সবসময় তাই ভেবেছি।”
এসব বলেই অতীতে ডুব দেয় আবির। মনে করে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ছোটবেলায় তার মা-বাবা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর তাকে মামার বাড়িতে থাকতে হয়েছে। মামা-মামীর কত খোটা শুনতে হয়েছে। জীবনে সুখ সে পায়নি, না পেয়েছে কারো ভালোবাসা৷ অন্যদিকে তারই প্রিয় বন্ধু রায়ান কত বড়লোকের ছেলে ছিল। কত সুখী ছিল তার জীবন। এটা নিয়ে আগে থেকেই আবিরের মনে রায়ানের জন্য হিংসা ছিল। পরে যখন জানতে পারে যেই প্রভাকে সে ভালোবাসে তাকে রায়ানও ভালোবাসে তখন নিজের কথা ভেবেই সে সরে গিয়েছিল। কারণ রায়ানের সাথে থাকার জন্য সে অনেক সুবিধা পেত৷ রায়ান প্রায়ই তাকে ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতো, ভালো শপিং মলে নিয়ে গিয়ে নিজের টাকায় শপিং করাত। রায়ানের মামা বাড়ি থেকে তাকে পড়াশোনার জন্যও তেমন টাকা দিত না৷ রায়ানই আবিরের পড়াশোনার খরচের অনেকাংশ বহন করত। এসবের জন্যই তো সে প্রভার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একসময় ঠিকই তার মনে চাপা হিংসা ভেসে ওঠে। তাই তো সেদিন সে গিয়েছিল প্রভার কাছে। আবির আরো একটা ঘটনার কথা মনে করে। সেদিন সে ঠিকই দেখেছিল ট্রাকটা তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। এইজন্য সে তো নিজেই সরে আসত সেদিন। তবে রায়ানই তাকে ঠেলে ফেলে দেয়। আবির চাইলেই আরো আগে রায়ানকে সতর্ক করতে পারত। কিন্তু সে সেটা করে নি। আবিরের মনে সেইসময় একটাই চিন্তা ঘুরছিল রায়ান ম**রলেই সে প্রভাকে পাবে। কারণ সেও জানত প্রভা তাকে নয় রায়ানকে ভালোবাসে৷ এইজন্যই তো সেদিন সে রায়ানের মৃত্যু কামনা করেছিল। পরবর্তীতে তার চাওয়াই পূরণ হয়৷ এরপর সে যা করেছিল সবই নাটক। রায়ানের মৃত্যুতে সে বিন্দুমাত্র কষ্ট পায়নি। বরং খুশি হয়েছিল। তবুও নিজের স্বার্থের জন্যই নাটক করে। যার দরুণ এই নাটক দিয়েই সে রুহুল আমিনের মন জয় করে রায়ানের যায়গা নিতে পেরেছে। এসবের জন্য সে নিজের উপর গর্বিত।
(চলবে)…
#গল্পঃএকই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
(সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, ধন্যবাদ)