#গল্পঃ_একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#পর্বঃ_২০ (বোনাস)
#লেখাঃ_ইয়াসমিন_খন্দকার
—-
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা বিমান ভ্রমণ করার পর অবশেষে কানাডার মাটিতে পা রাখল প্রভা। এই প্রথমবার উত্তর আমেরিকা মহাদেশের এই দেশটিতে এলো সে। মনে অনেক সংশয় প্রশ্ন নিয়েই দেশটিতে এলো সে। প্রভা প্লেন থেকে নেমেই তাকালো চারিদিকে। যেদিকে চোখ যায় সাদা চামড়ার মানুষদের ভীড়। প্রভা মূলত এসেছে কানাডার রাজধানী অটোয়াতে। অটোয়ার ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে ল্যান্ড করেছে সে। অটোয়া শহরটি কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কুইবেক প্রদেশের সাথে সীমানাতে, গাতিনো নদী, রিদো নদী ও অটোয়া নদী তিনটির সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। অটোয়া নদী অন্টারিও ও কেবেক প্রদেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমান্ত গঠন করেছে। শহর থেকে অটোয়া নদীর অপর পাড়ে কেবেক প্রদেশ অবস্থিত। জনসংখ্যার বিচারে অটোয়া দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম মহানগর এবং অন্টারিও প্রদেশের ২য় বৃহত্তম শহর। মহানগর এলাকাসহ এর লোকসংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ।
বিমানবন্দর থেকে নেমেই প্রভা সৌভিকের দেওয়া চিঠিটা খোলে। এখানেই তাকে কোথায় যেতে হবে সেই ঠিকানা দেওয়া আছে। সৌভিক আসার সময় প্রভাকে এদেশের মূদ্রাও দিয়ে দিয়েছে যাতে এখানে চলতে ফিরতে কোন অসুবিধাও না হয়। এসবের কারণেই প্রভার ধারণা তার এখানে আসা নিয়ে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছে সৌভিক। কিন্তু সে তো একা এসব করেনি। নিশ্চয়ই কেউ সৌভিককে সহায়তা করেছে এবং সে কানাডারই কেউ। কিন্তু লোকটা কে? প্রভাকে এখন তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
প্রভা বিমানবন্দরের বাইরে এসে ট্রাক্সির জন্য ওয়েট করে। কানাডায় মূলর ট্যাক্সিই প্রধান যান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিওবা এখানকার রাস্তায় প্রাইভেট কারই বেশি দেখা যায় তবে বাংলাদেশের মতো রিক্সার চল সেখানে নেই।
প্রভা একজন ট্রাক্সি চালকের সাথে কথা বলতে যায়। কিন্তু তার পূর্বেই অন্য একজন ট্রাক্সিচালক তার সামনে এসে বলে,”Bonjour”
এরপর আরো কিছু বলে যা প্রভার বোধগম্য নয়। প্রভা বুঝতে পারে লোকটি ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলছে। কিরগিজস্তানে থাকাকালীন একজন ফ্রেঞ্চ ফ্রেন্ড ছিল প্রভার। তার কাছ থেকে টুকটাক ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখেছে তাই সে জানে Bonjour মানে হলো হ্যালো। তবে সবসময় তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলায় ফ্রেঞ্চ ভাষা তেমন বোঝে না প্রভা। এদিকে অটোয়া কানাডার বৃহত্তম ফরাসি ভাষাভাষী শহরগুলির একটি; এখানকার অর্ধেকেরও বেশি অধিবাসী ফরাসি ভাষাতে কথা বলেন। অটোয়া শহরে বেশ কিছু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। এদের মধ্যে জাতীয় শিল্পকলা কেন্দ্র ও কানাডার জাতীয় চিত্রশালা উল্লেখযোগ্য।
প্রভা লোকটিকে বলে যে সে ফ্রেঞ্চ বুঝতে পারে না৷ তখন লোকটি প্রভাকে ইংরেজিতে বলে তার সাথে যেতে। হাসপাতাল থেকেই নাকি তাকে পাঠানো হয়েছে। প্রভা হতবাক হয়ে যায়। সে যে আজ এখানে আসবে সেটা হাসপাতালের লোক কিভাবে জানল? তাহলে কি প্রভার আড়ালে অনেক কিছুই ঘটেছে?
প্রভা আর ভাবল না কিছু। চুপচাপ ট্যক্সির মধ্যে উঠে পড়লো সে৷ এরপর অপেক্ষা করতে লাগল গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য সেখানে গিয়েই হয়তো সে এই ব্যাপারে জানতে পারবে।
রাস্তায় যেতে যেতে প্রভার চোখে পড়ে অসংখ্য ম্যাপল ট্রি। অবশ্য কানাডায় ম্যাপল ট্রি থাকা অস্বাভাবিক নয়। কানাডাকে তো ম্যাপল পাতার দেশই বলে।
প্রভা কিছু সময় জার্নি করল। অতঃপর পৌঁছে গেল অটোয়া ম্যানিয়ালিন হসপিটালের সামনে। এই হসপিটাল শহরের অন্যতম প্রসিদ্ধ হসপিটাল। এখানেই কাজের সুযোগ পেয়েছে সে।
প্রভা গাড়ি থেকে নামলো। এমন সময় একজন লোক এগিয়ে এসে প্রভাকে স্বাগতম জানালো। প্রভাকে যেই বিষয়টা অবাক করল সেটা হলো লোকটা বাঙালি এবং তিনি বাংলাতেই কথা বলছেন। প্রভাকে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন,”হ্যালো আমি অভিষেক চক্রবর্তী। আমি মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে এখানে এসেছি। আমিও এই হসপিটালের একজন ডাক্তার। শুনলান আজ এখানে নতুন একজন বাঙালি ডাক্তার আসছেন। তাই আমি স্বাগত জানানোর জন্য চলে এলাম।”
প্রভা ভদ্রতা সূচক হাসল। অতঃপর অভিষেক চক্রবর্তীকে বলল,”আপনাকে ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই। বিদেশে বাঙালিই তো বাঙালিকে দেখবে তাইনা? আপনি আসুন আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।”
লোকটি প্রভাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে অনেক গল্পও করে এখানকার সম্পর্কে। তিনি কানাডার আবহাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন,”বর্তমানে কিন্তু কানাডায় monsoon মানে বর্ষাকাল চলছে। যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তাই নিজের সাথে ছাতা রাখবে সবসময়।”
প্রভা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। একটু সামনে এগোতেই হঠাৎ করে অভিষেক চক্রবর্তী কাউকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। প্রভাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,”প্রভা ইনি হলেন সানা প্রিস্ট, এই হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।”
প্রভা সানার সাথে পরিচয় করে নেয়। সানা মূলত বছর ৪০ এর একজন স্বপ্নবাজ মহিলা। যিনি খুব কম বয়সেই অনেক সফলতা অর্জন করেছেন। প্রভাকে দেখে তিনি অভিবাদন জানান।প্রভাকে এখানে আসার জন্য ওয়েলকামও করেন। সবার এমন ব্যবহারে প্রভা আপ্লুত হয় খুব। সানা প্রভার সাথে কথা বলা শেষ করে সামনে এগোয়। তারপর কাউকে একটা ম্যাসেজ করে বলে,”ব্রো, সে এসে গেছে কানাডায়। তুমি তাকে দেখতে আসবে না?”
বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসে,”সে যখন এসে গেছে তখন তার টানে তো আমায় যেতেই হবে।”
এদিকে ডাক্তার অভিষেক চক্রবর্তী প্রভাকে হাসপাতালের আশেপাশটা ঘুরিয়ে দেখায়। অত:পর বলেন,”আপনার তো কাল থেকে ডিউটি। তাই আজ আমি আপনাকে হাসপাতালটা ভালো ভাবে দেখিয়ে দিলাম যাতে কোন সমস্যা না হয়। এছাড়া যদি কোন সমস্যায় পড়েন তাহলে আমায় জানাবেন।”
প্রভা তখন বলে,”আসলে আমি তো এখানে আজই প্রথম এলাম তাই এখানে কোথায় থাকব সেটা এখনো ঠিক করিনি।”
অভিষেক চক্রবর্তী হেসে বলেন,”এটা নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না। এই হসপিটালের সকল বিদেশী কর্মীদের জন্য এখান থেকেই রুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। পাশের একটি ফ্ল্যাটেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর শুধু তাই নয়, তিন বেলার খাবারও হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হয়। আপনি আমার সাথে আসুন আমি আপনাকে আপনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।”
প্রভা অভিষেক চক্রবর্তীর সাথে যেতে থাকে। লোকটাকে তার কাছে অনেক ভালো মনে হয়। বিদেশের মাটিতে এমন নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করার মতো লোকের খুব অভাব। প্রভা তো ভেবেছিল এখানে এসে না জানি কোন অকূল পাথারে পড়বে। কিন্তু এখন তো সে দেখছে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাচ্ছে।
~~~~
তখন বিকেল বেলা। কানাডার আবহাওয়া বর্তমানে বেশ উষ্ণ। প্রভা এসেছে থেকে ফ্ল্যাটের মধ্যেই অবস্থান করছে। বর্তমানে তার কেমন জানি দমবন্ধ লাগছে সবকিছু। তাই সে একটু বাইরে ঘোরার জন্য বের হলো। এখানে আসার পর অভিষেক চক্রবর্তী তাকে এখানকার সিম কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাই প্রভা নিজের ফোনটাও সাথে নিয়ে নিল যাতে করে কোন সমস্যায় পড়লে অভিষেক চক্রবর্তীকে কল করতে পারে। লোকটা প্রভাকে নিজের নাম্বারও দিয়েছে। প্রভার এখন কেমন জানি মনে হচ্ছে সত্যিই কি মানুষ এমন নিঃস্বার্থ হয়? নাকি তিনি কারো কথা মেনে এসব করছেন? এই প্রসঙ্গে সৌভিকের বলা কথাগুলো প্রভার মনে পড়ে যায়। সৌভিক তো বলেই ছিল কানাডায় সব ব্যবস্থা করাই আছে। কিন্তু কে করল এসব?
এই ভাবনা নিয়েই প্রভা বাড়ি থেকে বের হলো। অত:পর রাস্তায় বেরিয়ে উদ্দ্যেশহীন ভাবে হাটতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে প্রভা অবলোকন করল আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। হয়তো একটু পরই বৃষ্টি শুরু হবে। প্রভার ভাবনার মাঝেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। প্রভা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বেশ অনেকটা দূরই সে চলে এসেছে। এখানে কোন ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না। প্রভার আফসোস হলো খুব। অভিষেক চক্রবর্তী তো তাকে সতর্ক করেই ছিল বৃষ্টির ব্যাপারে। সেই আমলে নেয়নি। এখন হয়তো এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে।
প্রভা একটা ল্যাম্পপোস্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টির গতি বাড়ছে। প্রভা ভিজে যাচ্ছিল এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে কেউ তার মাথায় ছাতা ধরে। প্রভা হতবাক হয়ে যায়। আজ থেকে ১২ বছর আগে রায়ান তার মাথায় যেভাবে ছাতা ধরেছিল ঠিকই একই ভাবে! এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু কে এই ব্যক্তি যে তার মাথায় ছাতা ধরল। কেন জানি প্রভার নাকে অনেকদিন পর চেনা একটা ঘ্রাণ ভেসে এলো। অতীতের কথা মনে করে সে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,”রায়ান! তুমি ফিরে এসেছ!”
(চলবে)…
#গল্পঃএকই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
(বোনাস পর্ব দিয়ে দিলাম। সবাই সুন্দর সুন্দর কয়েকটা মন্তব্য করে দেন, ধন্যবাদ) 💞