একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় #Part_33(ধামাকা) #ইয়াসমিন_খন্দকার

0
66

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_33(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

রায়ান সমানে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে চলেছে প্রভার সুস্থতার জন্য। সে অপেক্ষায় আছে কোন ভালো খবর শোনার আশায়। রায়ান চায় তার প্রভা আবার তার এবং তার সন্তানদের কোলে ফিরে আসুক। অবশেষে তার চাওয়া বোধহয় আল্লাহ পূরণ করল। ডাক্তার এসে বললো,”আপনার স্ত্রী এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। তবে উনি অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছেন। ওনার খেয়াল রাখবেন।”

রায়ান আল্লাহকে লাখো শুকরিয়া জানায়। এবং বলে,”আমি কি প্রভাকে দেখতে যেতে পারি?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”

রায়ান প্রভাকে দেখতে যায়। প্রভার তখন জ্ঞান ফিরেছিল। সে প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমাকে আবার ফিরে পেয়ে আমি অনেক খুশি। আর তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দেব না। তোমাকে আগলে রাখব। আমাদের সন্তানদের নিয়ে সুন্দরভাবে বাকি জীবন কাটাবো।”

প্রভা উত্তরে হেসে বলে,”আল্লাহ চাইলে তাই হবে। আমিও চাই তোমাদের সবার সাথে সুখে বাকিটা জীবন পার করে নিতে।”

২ মাস পর,
রায়ান ও প্রভার ছেলের নাম রাখা হয়েছে প্রত্যুষ। প্রণালী তার ভাই অন্ত প্রাণ। ভাইকে নিয়েই তার সারাদিন কে’টে যায়। প্রভার অবস্থা এখনো বেশি ভালো নয়। প্রত্যুষ হবার পর থেকেই অনেক বেশি দূর্বল সে। একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রভার ইমিউনিটি সিস্টেম একেবারে কমে গেছে। তার উপর প্রত্যুষের সিজার করে জন্ম হয়েছে এবং সিজারের সাথে ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়েছে। যা প্রথমদিকে বোঝা যায়নি। এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। প্রভা বিছানা থেকে একদম উঠে দাঁড়াতে পারে না। তাই প্রত্যুষের দেখাশোনার জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা করেছে রায়ান। সেও যথাসম্ভব নিজের স্ত্রী-সন্তানের খেয়াল রাখছে।

প্রভার জন্য রায়ানের এখন অনেক চিন্তা হয়। তাই আজ নিজের অনেক জরুরি সভা থাকলেও সে আসে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখার জন্য। আর এসেই দেখল প্রভা গোঙাচ্ছে। রায়ান প্রভার মাথার পাশে বলে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? ডাক্তার ডাকবো?”

প্রভা কষ্টমিশ্রিত গলায় বলে,”আর না রায়ান। আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি আর পারছি না।”

রায়ান অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে প্রভার দিকে। প্রভার চোখেমুখে আজ কোন কষ্ট নেই। সে হাসছে। রায়ানের হাতটা ধরে বলে,”জানো আমি না তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার সন্তানদেরকেও আমি অনেক ভালোবাসি। তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাইনা কিন্তু……আমার হাতে মনে হয় আর বেশি সময় নেই।”

“এসব তুমি কি বলছ প্রভা? কিছু হবে না তোমার।”

প্রভা স্মিত হেসে বলে,”জানো যখন কানাডায় তোমার জীবন সংশয় চলছিল তখন আমি আল্লাহকে বলেছিলাম আমার জীবনের বিনিময়ে যেন তোমায় বাঁচিয়ে দেয়। আল্লাহ বোধহয় আমার সেই কথা শুনেছেন। তাই আমার কোন আফসোস নেই। শুধু তোমার কাছে একটাই আবদার রাখব আমার সন্তানদের তুমি দেখে রেখো। কখনো ওদের মায়ের অভাব হতে দিও না। চাইলে একটা ভালো দেখে মেয়েকে…”

“প্রভা! আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ স্থান পাবে না।”

প্রভার চোখে এবার জল জমে। সে বলে,”আমি বোধহয় তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রায়ান। আমার নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমার কষ্ট হচ্ছে শুধু এটা ভেবে যে আমার মৃত্যুর পর তোমার কি হবে? তুমি কিভাবে সামলাবে নিজেকে? মধ্য রাতে তোমার ঘুম ভেঙে গেলে তুমি কার বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির শ্বাস নেবে? সারাদিন সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করে এসে তুমি কার মুখ দেখে শান্তি পাবে? তোমার অগোছালো জামা-কাপড় কে গুছিয়ে রাখবে? তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কে তোমার সামনে এনে দেবে?”

রায়ানের চোখেও জল জমেছে। প্রভা রায়ানের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,”তুমি প্লিজ কেঁদো না। আমি তোমায় এভাবে দেখতে পারব না। আমি তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই।”

“প্রভা…”

“অনেক কষ্ট করেছি আমি। আর পারছি না। এবার আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”

“তুমি ঘুমাও প্রভা। আমি এখানেই আছি।”

“রায়ান…”

“হুম বলো।”

“তোমার ইনোসেন্ট গার্ল তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”

“আমিও আমার ইনোসেন্ট গার্লকে অনেক ভালোবাসি।”

“তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম দেখার কথা? কিভাবে ধাক্কা খেয়েছিলাম আমরা। আমি পরপারেও আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আবার তোমার সাথে ধাক্কা খেতে চাই। তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই।”

রায়ান অনবরত কেঁদেই চলেছে। প্রভা৷ বলে,”এবার একটু হাসো। আমি তোমায় হাসিমুখে বিদায় দিতে চাই। ধরে নাও এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”

রায়ান নিজের চোখের জল মুছে অল্প হাসে। হাসিতে ছিলে মলিনত্বের ছোয়া। প্রভাও হাসে রায়ানের দিকে তাকিয়ে। এরমধ্যে প্রণালী প্রত্যুষকে কোলে নিয়ে চলে আসে। প্রভা প্রণালীকে নিজের কাছে ডেকে বলে,”তোমার ভাই আর বাবাকে দেখে রাখার দায়িত্ব কিন্তু তোমার।”

প্রণালী কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। প্রভা আবারো রায়ানের দিকে তাকায়। অত:পর তার হাতটা ধরে বলে,”তাহলে আমি এবার ঘুমিয়ে পড়ি?”

রায়ান কিছু বলে না। সে বুঝতে পারছে প্রভা এবার চোখ বন্ধ করলে আর কখনো চোখ খুলবে না। রায়ান প্রভার সামনে আর কাঁদতে চায়না। নিজের প্রিয়তমাকে এভাবে বিদায়ও দিতে চায়না। প্রভা নিজের দুচোখ বন্ধ করে। রায়ান নিজ স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”
~~~~~~~~~~~
পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের মাতম চলছে। অনুরাধা, সৌভিক সহ রায়ানের সকল শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজন এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা সকলেই প্রভার জন্য মর্মাহত। অনুরাধা তো কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার জ্ঞানও হারিয়েছে। প্রভার সাথে তার সেই ছোট বেলাকার বন্ধুত্ব। প্রভার এই মৃত্যু সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রণালীও হাউমাউ করে কাঁদছে নিজের মায়ের জন্য। প্রত্যুষ, সে তো জানেই না সে কি অমূল্য সম্পদ হারিয়েছে। তবে বাচ্চাটাও আজ কাঁদছে। হয়তো সবাইকে কাঁদতে দেখে সে কাঁদছে। তবে এত সবকিছুর মধ্যেও রায়ান স্বাভাবিক আছে। সে আর কাঁদছে না। কারণ তার প্রভা যে তাকে কাঁদতে বারণ করেছে।

শেষবারের মতো প্রভাকে দেখে নিলো সে। কিছুক্ষণ পরই প্রভাকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রভার নিথর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সে বলে,”ভালোবাসি, তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি। আজীবন এভাবেই ভালোবেসে যাব।”

প্রভার জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। এরপর রায়ান প্রভার কফিন বহন করে তাকে নিয়ে কবরস্থানে রেখে আসল। যেই মেয়েটাকে সবসময় আগলে রেখেছে তাকে কিনা আজ নিজের থেকে এত দূরে রেখে আসতে হয়েছে। প্রভাকে সমাধিস্থ করে এসে আকরাম খানের মুখোমুখি হয় রায়ান। নিচু কণ্ঠে বলে,”আমি আপনাকে দেয়া কথা রাখতে পারলাম না বাবা। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিয়েন। আমি আপনার মেয়েকে আগলে রাখতে পারলাম না।”

আকরাম খান রায়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। রায়ানও এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”প্রভা আমায় একা করে কিভাবে চলে গেল? ওর কি একবারো আমার কথা মনে পড়ল না?”

রায়ানের জীবন যেন নিঃসঙ্গতায় ডুবে গেল। প্রভার সাথে ৬ বছরের সংসার যাত্রার ইতি ঘটল। রায়ান জানে বাকি জীবন তাকে এই নিঃসঙ্গতা নিয়েই কাটাতে হবে। কারণ প্রভার স্থান সে আর কাউকে দেবে না।

রায়ান বিমর্ষ মন নিয়ে বসে রইলো ঘরে। ভাবতে লাগল প্রভার কথা। তার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্ত গুলো। পাশের ঘরের রেডিও থেকে বাজছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান,
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না…
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা, মিটিয়ে দেব গো
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে”

to be continue….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here