#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার
প্রণালীর ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা নরম বিছানায়৷ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সায়মা চৌধুরী তার সামনে বসে আছে। প্রণালী কাচুমাচু হয়ে বলে,”আপনি এখানে?”
সায়মা চৌধুরী আফসোরের সুরে বলেন,”এটা আমাদের বাড়ির গেস্ট রুম। ভাবি তোমাকে এখানেই থাকতে বলেছে। তিনি কিছুতেই এই বিয়েটা মানবেন না।”
“তিনি কি এই বিয়ের ব্যাপারে জানতেন না?”
“না। ভাইয়া ভাবিকে না জানিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। যাইহোক, তুমি এখানে বিশ্রাম নাও। আমিও এখানেই আছি। কাল সকাল সকাল চলে যাব। ভাবির এত অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না জানি তোমাকেও কত অপমান সইতে হবে। ভাইয়ার সবটা বিবেচনা করা দরকার ছিল। ভাইয়া তো জানে ভাবি কেমন। আর ছেলেটাও হয়েছে একদম মায়ের নেওটা। মায়ের কথায় ওঠে আর বসে।”
প্রণালী কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এসব কথার। তার এমনিতেও এসবে কিছুই যায় আসে না। সে কারো স্ত্রীর মর্যাদাও চায়না। কে তাকে অপমান করল সেটাও প্রণালীকে আর ভাবায় না। শান্তর থেকে পাওয়া আঘাত তাকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে কোন কিছুই আর গায়ে লাগছে না। প্রণালীর মনে হয়, কেউ যদি তার গলা টিপে মে*রেও ফেলে তাতেও আর তার কিছু যাবে আসবে না। এতটাই অনুভূতি হীন হয়ে পড়েছে মেয়েটা। এজন্যই তো বোধহয় বলে, ভালোবাসা মানুষকে যেমন গড়তে পারে ঠিক সেই একইভাবে ভেঙে মুচড়ে দিতেও পারে!
হঠাৎ করেই গেস্টরুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে আওয়াজ করে। সায়মা চৌধুরী বিরক্ত সুরে প্রণালীকে বলে,”তুমি এখানে বসো। আমি দেখছি কে এসেছে।”
সায়মা চৌধুরী গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পান সজল চৌধুরীকে৷ সজল চৌধুরী প্রণালীকে গেস্টরুমে দেখে বলে ওঠেন,”ও এখানে কি করছে সায়মা? ওর না আজ বাসর রাত। ওর তো সমুদ্রের সাথে থাকার কথা।”
সায়মা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলেন,”তোমার কি মনে হয় ভাবি ওদের বাসর হতে দেবে? যেখানে উনি এই বিয়েটাই মানতে পারেন নি।”
“এসব বললে তো হবে না সায়মা। ওদের বিয়ে হয়েছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। প্রণালী যেহেতু আইনত ও ধর্মমতে সমুদ্রর স্ত্রী তাই ওদের একসাথেই থাকতে হবে। তুই প্রণালীকে নিয়ে আয়। আমি সবটা ম্যানেজ করছি।”
সায়মা চৌধুরী নিরুপায় হয়ে প্রণালীর কাছে এসে বলেন,”তুমি এসো আমার সাথে। দেখি ভাইয়া কি করতে পারে।”
প্রণালী কোন বাক্যব্যয় না করে উঠে দাঁড়ায়। সায়মা চৌধুরী তাকে নিয়ে যেতে থাকে। সমুদ্রর রুমের সামনে এসে সজল চৌধুরী দরজায় নক করতে থাকেন। সমুদ্র অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। সে শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছিল। দরজায় নক করার শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে,”আবে কে রে!”
সজল চৌধুরী বলে ওঠেন,”আমি তোমার বাবা সমুদ্র।”
“এত রাতে কি চাই তোমার?”
“দরজাটা খোলো তারপর বলছি।”
সমুদ্র বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়৷ সজল চৌধুরী বলেন,”তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? নতুন বউকে গেস্টরুমে রেখে তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ?”
“তো কি করব? মম স্পষ্ট বলে দিয়েছে এই মেয়ের থেকে যেন আমি ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলি। আমি তো মমের অবাধ্য হতে পারবো না।”
সজল চৌধুরী ছেলের কথায় ভীষণ রেগে গিয়ে বলেন,”মেয়েটাকে যখন তুমি বিয়ে করেছ তখন ও তোমার দায়িত্ব। তাই নিজের মায়ের কথায় না নেচে ওর দায়িত্বটা বুঝে নাও। প্রণালী মা, তুমি যাও তোমার স্বামীর রুমে প্রবেশ কর৷ এখন থেকে এই রুমে তোমারও সমান অধিকার।”
সমুদ্র বলে,”নাহ, ও এই রুমে আসবে না। মমের স্পষ্ট নির্দেশ ও যেন আমার ত্রীসীমানায় না থাকে।”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”তুই তোর মায়ের কথা শুনে নিজের স্ত্রীর সাথে অবিচার করতে পারিস না। মেয়েটাকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছিস তুই।”
সমুদ্র একপলক প্রণালীর দিকে তাকায়। এত কিছু হয়ে গেল তবুও মেয়েটার বিশেষ কোন হেলদোল নেই৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো। যেন তার এসবে কিছু যায় আসে না৷ এসব দেখে তো সমুদ্র ভীষণ চটে গেল। মনে মনে বলল,”এ কি মানুষ নাকি রোবট?”
আর সবার সামনে বলল,”আমি এত কিছু জানি না। মম যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে আমি এই রুমে থাকতে দিতে পারব না। আমাকে আর ডিস্টার্ব না করে যাও এখান থেকে।”
সজল চৌধুরী বলেন,”আমি তোমার বাবা, আমার কথাও তোমাকে শুনতে হবে। প্রণালী এই রুমেই থাকবে।”
এরমাঝেই পুষ্পা চৌধুরী সেখানে চলে আসেন। এসেই সমুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার বাবা তো ঠিক বলছে বাবাই। ঐ মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করেছ, তোমার রুমে তো ওর অধিকার আছে। ওকে তোমার রুমে থাকতে দাও।”
সমুদ্র চৌধুরী নিজের মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”মম, তুমি এই কথা বলছ! অথচ তুমিই তো এই মেয়ের থেকে আমায় দূরে থাকতে বলেছিলে। আমি তো তোমার কথামতোই কাজ করছিলাম।”
সজল চৌধুরী বলেন,”যাক! তাহলে তোমার সুমতি হলো।”
তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে পুষ্পা চৌধুরী বলে ওঠেন,”ঐ মেয়েটাকে নিজের রুমে থাকতে দিয়ে তুমি আমার রুমে চলে এসো বাবাই। আজ সারা রাত মা-ছেলে গল্প করে কা’টিয়ে দেই।”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা তুমি কি বলছ ভাবি? আজ তোমার ছেলের বাসর রাত আর তুমি ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছ!”
পুষ্পা চৌধুরী রাগী গলায় বলেন,”তোমাকে না বলেছি আমার সংসারে নাক না গলাতে। নিজের নাক সামলে রাখো নাহলে সেটা কে’টে দিতে আমার একটুও হাত কাপবে না।”
এমন অপমানে সায়মা চৌধুরী চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হন। সজল চৌধুরী অনেক সাহস করে স্ত্রীর মুখের উপর বলেন,”তুমি কিন্তু কাজগুলো একদম ঠিক করছ না পুষ্পা। ছেলেটার বিয়ে হয়েছে আর এখনো ওকে আঁচলের তলে রাখতে চাইছ।”
পু্ষ্পা চৌধুরী স্পষ্ট স্বরে বলেন,”এই বিয়ে আমি মানি না। কারণ এই মেয়েকে আমার পছন্দ নয়। আমি আমার ছেলেকে আঁচলের তলেই রাখবো। যেদিন নিজের পছন্দের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনব, সেদিন আমি ওর ভার সেই মেয়ের উপর ছেড়ে দেব। তার আগে নয়।”
এই বলে পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে বলেন,”বাবাই, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো আমার রুমে।”
সমুদ্র মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো বলে,”তুমি যাও মম, আমি এখনই যাচ্ছি।”
“তাড়াতাড়ি এসো।”
বলেই পু্ষ্পা চৌধুরী তার রুমের দিকে পা বাড়ান। তিনি চলে যাবার পর সমুদ্র নিজের বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”শুনলে তো মম কি বলল? এখন আমাকে যেতে দাও।”
বলেই সে প্রণালীর দিকে একপলক তাকিয়েই চলে যায়। এত কিছুর পরেও প্রণালীর কোন হেলদোল নেই। সজল চৌধুরী প্রণালীর কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কিছু মনে করো না মা।”
প্রণালী তো আদতে এসব কিছু গায়েই মাখে নি। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়াও দেখায় না। সায়মা চৌধুরী বলেন,”এভাবে চুপ থাকলে চলবে না৷ নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে।”
প্রণালী তবুও নিশ্চুপ। একটু পর বলে,”আমি কোথায় থাকব?”
সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা যেহেতু তোমার স্বামীর রুম তাই এখানেই থাক।”
“ওকে।”
বলেই প্রণালী সমুদ্রের রুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। এসব লড়াই-টড়াইয়ে তার ইন্টারেস্ট নেই। জীবনে এমনিতেও আর কোন কিছুর পরোয়া করে না। এদিকে সায়মা চৌধুরী সজলকে বলেন,”তুমি কোন ভুল করলে না তো ভাইয়া? এই মেয়ে কিভাবে ভাবিকে জব্দ করবে?”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। মেয়েটা তো অনেক প্রতিবাদী ছিল। হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেল কিভাবে?”
এদিকে প্রণালী ভীষণ ক্লান্ত। শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
to be continue…