#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে #পর্ব_৪৫ #লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
110

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪৫
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ঈদের দিন সন্ধ্যেবেলা।

নবকুঠিরে তখন মেহমানের আনাগোনা। অভিকের মামার বাড়ি খালার বাড়ির সবাই ঈদ উপলক্ষে বেড়াতে এসেছে। কোনো বছর ঈদে সবাই আসে না। এই বছরের ঈদটা বিয়ে বিয়ে আমেজ নিয়ে এসেছে। বেড়াতে আসার ফাঁকে নতুন বউটা একটু দেখে যাবে এই নিয়ে আসা।
তাছাড়া অভিকের মামার বাড়ির দিক থেকে সেই একমাত্র যে বিয়ে উপযুক্ত। তার বিয়ে নিয়ে হৈচৈ এর শেষ হওয়ার কথা নয়।

অভিক সিজান আর মামার ছেলে রিছানকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরেছে। অনেকগুলো বছর পর দেশে তার ঈদ উদযাপন।
তাকে বাড়ি ফিরতে দেখে সবাই আরও মেতে উঠলো। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে তরী আর খড়িকে দেখলো। তারা দুবোন ছোট একটা ভাই আছে। তারা এসে সালাম বিনিময় করে বলল

ঈদ মোবারক। আমাদের বখশিশ।

অভিক মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল

ঈদ মোবারক। বখশিশ আপাতত পকেটে নেই। ঘরে যাই। ফ্রেশ হই । তারপর।

ওকে ওকে। সিজান ভাই রিছান ভাই বখশিশ রেডি করো।

ওরা দুজনেই হাসলো। রিছান তরীর মা সাঈদা বেগমকে বলল

ছোট ফুপী বখশিশের বদলে ওদের জন্য জামাই ঠিক করে দিলে ভালো হয় না? দুটো লাল টুকটুকে বর।

খড়ি বলল

অ্যাহ বর আবার লাল টুকটুকে হয় কেমনে? বউ হয় লাল টুকটুকে।

সবাই তার কথায় হেসে উঠলো।

সাঈদা বেগম অভিককে বললেন

হ্যা রে অভি বখশিশ সব শেষ করলে হবে? আসল মানুষকে তো বখশিশ দেয়া বাকি।

অভিক টি টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে গিয়ে বলল

আসল মানুষ কে?

জিনিয়া বলে উঠলো।

সু—জা—না।

অভিক কেশে উঠলো। সাঈদা বেগম বললেন

হায় হায় একটু আস্তে খা।

খড়ি খিক করে হেসে উঠে বলল

বউয়ের কথা শুনে কাশি উঠে গেছে।

অভিক বলল

আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।

মমতাজ বেগম এসে বললেন

অহ দাদুভাই তোমরা ফিরেছ? সবাই তো নতুন বউকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। হবু শ্বাশুড়িকে মাতিয়ে আসবে না? সুজানা সালামি পাবে তোমার কাছে। না গেলে ভারী অন্যায় হবে।

আনিকা বলল

অভি সুজানা কিন্তু তোর কাছ থেকে মোটা সালামি পাবে। হুমমম।

সুজানার হয়ে সালামি খোঁজার মানুষের দেখছি অভাব নেই।

কি বললি?

অভিক হেসে উঠে চলে গেল।

গোসল নেয়া শেষ হতে না হতেই দরজায় ঠোকা পড়লো। ওয়াশরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অভিক ঘরের দরজা খুললো। দেখলো লাল টকটকে ফ্রক পড়া একটা ছোট্ট পুতুল। গোলগোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অভিক হাঁটু মুড়ে বসে বললো

কি সুন্দর! কি হয়েছে আম্মি?

অনা হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
অভিক কোলে তুলে গালে আদর দিয়ে বলল

ওরেবাবা আমি তো ভুলেই গিয়েছি আম্মিকে বখশিশ দেয়া হয়নি। আম্মি কত বখশিশ চায়?

অনা ওর গালে গাল লাগিয়ে হেসে বলল

সুজান।

অভিক তার দিকে চাইলো।

সুজান কি হয়েছে?

সুজানির কাছে যাবো।

অভিক তার গালে চেপে চুমু খেয়ে বলল

ওক্কে।

পমিচ বোলো অভি।

অভিক হেসে উঠে বলল

ওকে প্রমিজ আম্মিজান।

ঘরের ভেতর হৈহল্লা করে ঢুকে এল সবাই। বলল

আমরা সবাই রেডি। বউ দেখতে যাব।

অভিক ভুরু কুঁচকে তাকালো অনার দিকে। অনা খিকখিক করে হেসে আবারও জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখলো।

আচ্ছা এটা প্ল্যান ছিল?

সবাই সমস্বরে বলে উঠলো

ইয়েসস।

আবিদ এসে গাল ফুলিয়ে বলল

অভি বুনুকে কুলে নিচে।

অভি অনাকে রেখে তাকে কোলে তুলে দুগালে আদর করলো। তারপর বখশিশ দিল সবাইকে। আনিকা বলল

আমারও।

অভিক তাকেও বখশিশ দিল। বলল

সালাম ছাড়া সালামি?

আনিকা হেসে তার সামনের চুল টেনে দিয়ে বলল

তুই আমাকে সালাম করবি।

করতেই পারি। সম্পর্কে তুমি বড়। কিন্তু বয়সে বড় কে?

আনিকা হেসে উঠলো। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল

সালাম নিয়েন ভাইজান।

অভিক হাসলো।

সালমা বেগম ঘরে প্রবেশ করলেন। হাতে কফির মগ। মগটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললেন

সুজানাকে তোর মামী আর খালাম্মা দেখতে চাচ্ছে।

অভিক সাথে সাথে বলে উঠলো।

নো ওয়ে। এত ঝামেলায় ফেলে লাভ আছে উনাদের? পরে।

সালমা বেগম অবাক চোখে তাকালেন। জিনিয়া বলল

বাবারে বাবা শ্বশুরবাড়ির জন্য এখন থেকে যা দরদ!

আনিকা বলল

আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে। সুজানাকে এখানে নিয়ে আসলে কেমন হয়? সবাই দেখতে পারবে। ভালো হবে না?

অভিক বলল

খুব খারাপ হবে না।

ধুরর সোজা কথা বল। তুই গিয়ে সুজানাকে নিয়ে আয়। খুব মজা হবে। তরী খড়ি যাক তোর সাথে।

হুমম।

সালমা বেগম বললেন

কি হুম ? তোর যাওয়া উচিত। সাথে ওকে নিয়ে আসবি। ব্যস।

অভিক আবিদের গালে টুপ করে আদর বসিয়ে বলল

আপনিও যাবেন জুনিয়র?

হ্যা সুজান বাড়ি যাবো।

অনা বলল

অভি অভি আমি যাব।

অভিক বলল

ওকে।

আনিকা বলল

সুজানাকে একটা ফোন দেব?

অভিক কফির মগে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়ালো।

দেব না? কেন?

সারপ্রাইজ থাকুক।

ওহ আচ্ছা আচ্ছা তুমি এত সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করো তাকে। বুঝিতে পারিয়াছি।

সবাই হাসলো। তরী বলল

তাহলে আমরা রেডি হই? জিনি আপু তুমি যাবে না?

জিনিয়া অভিকের দিকে তাকালো।

যাই?

ইয়াহহ।

থ্যাংকিউউউ।

তারা সবাই রেডি হতে চলে গেল।

****

অভিক রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে সেই তখন থেকে সিজান আর রিছানের সাথে।
আনিকাকে ডেকে বলল

ওদের হয়েছে?

ওরা একটু সাজগোছ করছে। তোর দেখছি তর সইছে না।

আর পাঁচ মিনিট। তারপর আমি চলে যাব।

আনিকা দ্রুত পায়ে হেঁটে তাদের কাছে চলে গেল তা জানাতে। তারা নেমে এল রেডি হওয়ার পর। অভিক তাদের দেখে বলল

ময়দার দাম এজন্যই এত বেশি।

জিনিয়া বলল

কি বললে?

কিছু না। লেটস গো।

ওদের সাথে সাথে অনাকে দেখলো অভিক। সাদা গোলাপি একটা স্কার্ট পড়েছে। অভিককে দেখে ছুটে আসলো। অভিক তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল

আবি কই?

আবি সুসু কততে গেচে।

সবাই হেসে উঠলো তার কথায়। সালমা বেগম বললেন

জরুরী সময়ে তার সুসু পায়।

আবিদ আনিকার কোলে করে এল। রিছান তাকে কোলে নিয়ে বলল

যাওয়া যাক আবিদ সাহেব।

_________

আছরের আজানের পরপরই বন্ধুরা এসেছে সুজানার বাড়িতে। তারা সবাই একসাথে সবার বাড়ি যাবে। তারপর নীলা ম্যামের বাড়িতে যাবে উনি অনেক জোরাজুরি করেছেন যাওয়ার জন্য। সুজানা আহিরের বাড়িতে গিয়ে মাত্রই পৌঁছেছিল তারমধ্যে সাইফ ফোন করে জানালো যে ওই বাড়ি থেকে মানুষ এসেছে। সে যেন দ্রুত চলে আসে।

বন্ধুদের রেখে একপ্রকার ছুটে এল সে। যদিও জায়িনদের বাসায় যাওয়া হয়নি কিন্তু এমতাবস্থায় ওইখানে থাকা আর সম্ভব না। কতগুলো দিন পর একটু সামনাসামনি দেখা হবে।

সাজিয়া বেগমের সাথে তরী খড়ি আর জিনিয়ার অনেক গল্পগুজব হলো। অভিক এল তারও খানিকটা পরে সাইফের সাথে। ড্রয়িংরুমে সবাই বসা ছিল। অনা আবিদ সোফায় বসে সুজানের জন্য অপেক্ষা করছে আর আপেল খাচ্ছে। অভিক ড্রয়িংরুম পার হয়ে সাজিয়া বেগমের সাথে দেখা করার জন্য ভেতর রুমে পা রাখলো। উনার হাতে আঙুরের প্লেট। অভিককে দেখে উনি থেমে গেলেন। হাসলেনও।

অভিক সালাম করে বলল

ঈদ মোবারক।

সাজিয়া বেগম হেসে বললেন।

ঈদ মোবারক।

অভিক বলল কান মলে বলল

কি একটা অবস্থা। এত পালিয়ে থাকলে চলবে?

পালাচ্ছে কে?

মা মেয়ে দুজনেই।

এটা কোনে কথা? ও তো সন্ধ্যায় বেরুলো। মাস্টারমশাই আসবে জানলে কি বেরোতো?

সায়েম কোথায়?

ও বন্ধুদের সাথে। ঘরে থাকে নাকি? সেই রাত করে আসবে।

আচ্ছা। সুজানাকে নিয়ে যাই? বাসায় মামী আর খালামণিরা এসেছে। সবাই দেখতে চাচ্ছে।

কিন্তু….

আমি কোনো কিন্তু শুনতে আসিনি।

এভাবে যাওয়া আসা করলে লোকে মন্দ বলবে না?

আমি মন্দ কথা আমার কানে যায় না ?

ঠিক আছে। যেতে পারে কিন্তু রাতে আবার এনে দিতে হবে।

কেন? থাকুক। ওখানে সবাই আছে। সবার সাথে থাকবে। আমি না শুনতে আসিনি।

না না ওভাবে থাকাটা খারাপ দেখায়। লোকে কি বলবে? বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়িতে ওভাবে যাওয়াও যায় না। অনেক মন্দ কথা শোনাবে লোকে। না না।

অভিক বলল

আচ্ছা সুজানা যদি থাকতে চায়?

ও চাইবে না।

যদি চায়?

সাজিয়া বেগম ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। অভিক হেসে বলল

আমি উনাকে রাজী করিয়ে নেব। আসি।

এমা কোথায়? কিছু তো খাওয়া হলো না। কতকিছু বানিয়ে রেখেছি মাস্টার আসবে বলে।

অভিক প্লেট থেকে আঙুর নিয়ে মুখে দিল। বলল

খাওয়ার সময় অনেককক পড়ে আছে। কত আসা যাওয়া হবে।

সাজিয়া বেগম হাসলেন। বললেন

ওরা তো প্রথম এসেছে বসুক না।

বসুক সমস্যা কোথায়? আমি সুজানাকে নিয়ে আসি।

ও আসছে তো।

আমি একটু আগ বাড়িয়ে নিয়ে আসি। সমস্যা কোথায়?

না সমস্যা নেই।

তাহলে আসি। টা টা।

সাজিয়া বেগম হাসলেন।

সাজিয়া বেগম বাকিদেরকে
হালিম, ফালুদা, শির কুরমা, আমের কুলপি আর ফলমূল সাজিয়ে দিল। অনা আবিদ খেতে খেতে বলল

তুমি সুজান আম্মু?

হ্যা।

সুজান নাই?

সাজিয়া বেগম তাদের আদর করে বললেন

আসছে।

__________

সুজানাকে আহির একটা সিএনজিতে তুলে দিয়েছে। সিএনজি থেকে নামার পর সরিষাবাড়ির পথ ধরতেই অনেকগুলো দোকানের দেখা। দোকান গুলো পার হয়ে যেই একটু নির্জন রাস্তায় উঠেছে দুটো কুকুর দেখতে পেল সাদা কালো। ভয়ে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। সড়ক বাতির আবছা আলোয় দেখতে পেল একটা গাড়ি ধেঁয়ে আসছে তার দিকে। কিছুটা দূরে সেটি থেমেও গেল। সুজানা হাঁটা বন্ধ করলো না। সরু চোখে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেল গাড়ি থেকে অভিক নামছে। সুজানা তারপর থেমে গেল। যদিও এখানে তাহার দেখা পাওয়াটা কোনো কাকতালীয় নয় কিন্তু চোখজোড়া ছানাবড়া হতেও সময় লাগলো না।

অভিক এগিয়ে গেল তার দিকে। চোখের মিলন হতেই দুজনের চোখজোড়া হাসলো ঠোঁটের সাথে। সুজানা হেসে বলল

ঈদ মোবারক।

অভিক হেসে বলল

শাদী মোবারক।

সুজানা হেসে উঠলো খলখলিয়ে। হাসার সময় ওর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে যায়। অভিক ধীরপায়ে কাছে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুঁড়লো।

কোথায় যাওয়া হয়েছে?

সুজানা ও নরম পায়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল

সবার বাড়িতে গিয়েছি। শুধু জায়িন ছাড়া। বেশি সময় কেটেছে ম্যাডামের বাসায়। ম্যাডাম ছাড়তে রাজী নন। খুব ভালো উনি। আমাকে খুব স্নেহ করেন।

কেমন আছে আপনার বন্ধুরা?

তারা ভালো।

আপনার ম্যাডাম?

উনি বিচ্ছেদের আগুনে পোড়া একটা মানুষ। সবসময় ভালো থাকতে দেখা যায়। ভেতরের খবর তো আর আমি জানিনা।

বিচ্ছেদের আগুনে পোড়া মানুষগুলো কেমন হয়?

খাঁটি সোনার মতো।

অভিক তার কাছে এসে থামলো। বলল

আচ্ছা খাঁটি সোনা হতে গেলে বিচ্ছেদে পুড়তে হবে বলছেন?

যদি খাঁটি সোনা হতে চান।

উহু, আমি হতে চাই না। না মানে না। আমি অতশত কিছু বুঝিনা। আমি শুধু বুঝি থাকতে হবে, থেকে যেতে হবে, থাকা উচিত বরং না থাকাটা অনুচিত।

সুজানা নির্মল হাসলো।

অভিক তার নিকটে এসে দাঁড়ালো। মুখোমুখি। বলল

এই বিচ্ছেদের শহরে আপনি আমার থেকে যাওয়ার মানুষ হোন । অকারণে তো ভুলেও না, কারণেও ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে না। পাপ হবে পাপ।

সুজানাকে বিমূঢ় হয়ে তাকাতে দেখে অভিক মাথা দুলিয়ে বলল

হুমম।

সুজানা ছোট্ট করে বলল

আপনাকে ছেড়ে দিলেই আমি ধ্বংস মাস্টারমশাই।

তারপর বাকিটা পথ তার হেঁটেই গেল।
হাত ধরে একসাথে চলা হয়নি হয়ত কিন্তু তাদের খানিকটা পথের এই গল্পগুলো আগের মতো ভালোবাসাহীন নয়। ভালোবাসারা তাদের গল্পেসল্পে ঠাঁই পেতে চায়।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here